বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

হুজুগে বাঙালীর ডায়েরীর পাতা থেকে

সেদিন দোকান থেকে ম্যাগি, চানাচুর, তেল, আলু আর খানকতক হ্যান্ডওয়াশ কিনে নিয়ে ফিরছি – একটা ডায়েরির পাতা রাস্তায় একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখলাম। হাতে লেখা পাতা দেখে বাজারের ব্যাগ নামিয়ে এগিয়ে গেলাম। পাতাটা তুলে দেখি দুই পিঠে বেশ জড়ানো হাতের লেখায় একটা তারিখ দিয়ে লেখা। লেখকের নাম তো নেই। একটা ছোট্ট ইনিসিয়াল। দেখে মনে হল, "গো.বা”। এ আবার কি নাম? আমি মনে মনে 'গো. বা' - র নাম দিলাম গোজাবাবা। তার ডায়েরীর লেখাগুলি হুবহু তুলে দিলাম।


তাং - ২৫.০৬.২০২০।।

“রোজ অফিস বেরোনোর আগে বউ একথালা ভাত কোন একটা স্বাস্থ্যকর তরকারী দিয়ে খেতে দেয়। আমার রোজ স্বাস্থ্যকর জিনিস খেতে ইচ্ছে করেনা। তাও দেয়। আবার আমার জুতো পরা হয়ে গেলে একটা মগে করে জল আর সাবান এগিয়ে দেয়। আমি হাত ধুয়ে জগৎ উদ্ধার করি। তারপর মুখে নাকে মাস্ক আটকে রাস্তায় নামি। গাড়ি আসে আমাকে নিতে। ট্রেনে বাসে লোকজন বেশি। তাই আমরা কয়েকজন মিলে শেয়ার গাড়ি নিয়ে অফিস যাই।


মাস্ক পরে বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ফিলিং হয়। যেন সারা দেশে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে, আমরা যারা অফিসের গুঁতো খেয়ে বেরোচ্ছি, তারা মনে করছি বা বাড়িতে মনে করাচ্ছি যে দেশের সেবায় প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়েছি। সবাই করোনাযোদ্ধা।


যারা চিরকাল ক্যান্টিনে আর ফুটপাথের ঘুগনি, রুটি, ডিমটোস্ট খেয়ে কাটিয়ে দিলাম, তাদের বাড়ি থেকে টিফিনকৌটো গুছিয়ে দিচ্ছে, ভালমানুষের মতো সবাই রুটি-তরকারী, চাউমিন ইত্যাদি চিবোচ্ছে। যারা অন্যের ভাল টিফিন দেখলেই খপ করে তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিতাম, তারা খুব অসুবিধায় পড়েছি। যে ছেলেটি লুকিয়ে সন্দেশ খেত আমার লোলুপ হাতের ভয়ে, সে এখন চকাম চকাম শব্দ করে সন্দেশ খায়। আমি লকডাউন ওঠার অপেক্ষায় আছি। লকডাউন উঠলেই ওর সন্দেশ খাওয়া বার করছি।


কাজ জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে। একটু একটু করে কাজ করলেই ঘুম পাচ্ছে। তখন মাথায় ঘুরছে লাদাখ, গালওয়ান, প্যাংগং ইত্যাদি। কি কান্ড!


মে মাস থেকে নাকি বর্ডারে গন্ডগোল চলছে, সেই খবর আমরা সেইভাবে পেলামই না! এখন কয়েকদিন ধরে একটা যুদ্ধের আবহ, শুনছি নাকি সেনা, বিমান, হেলিকপ্টার সব মোতায়েন হচ্ছে সীমান্তে। সেই জন্ম থেকে শুনছি চীন আর পাকিস্তান নাকি আমাদের দেশের শত্রু, তা শত্রুনিধন দেখব, ভারত জিতবে, এইরকম সবার মতো আমিও দেখতে চাই। কিন্তু সে সুযোগ তো হবার নয়। কারণ আজকাল সব অর্থনীতির কূটনীতির চাপানউতোর চলে। এতো আর আলেকজান্ডারের যুগ নয় যে সরাসরি যুদ্ধ আর জয়পরাজয় হবে। খুব জটিল ব্যাপার।


লোকজনকে সরাসরি বলতে পারছিনা যে যুদ্ধ যুদ্ধ আবহে মনটা ফুরফুরে লাগছে, খবর শোনার একটা কারণ খুঁজে পাচ্ছি, কারণ সেটা বললে আমার গালাগাল, এমনকী মারধোর খাওয়া কেউ রুখতে পারবেনা। কিন্তু এই নিয়ে তো কোন তর্ক থাকতেই পারেনা যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা যারা খেলে, তারা রক্তের পিছল পথেই গদিতে চাপে আর কম্পিউটার স্ক্রিনে লাইভ রক্তারক্তি দেখে তারা ভিডিও গেম খেলার মজাই পায়। যাকগে যাক, আমি আদার ব্যাপারী।


মাঝে মাঝে গুগলে গালওয়ান নিউজ, লাদাখ লেটেস্ট নিউজ ইত্যাদি লিখে দেখছি কি দেখায়। খালি বলে চলেছে এর সঙ্গে তার মিটিং, নিম্ন মধ্য উচ্চ নানাপর্যায়ের বৈঠক। তার ফল যে কি দাঁড়াল, সেটা পরিষ্কার বোঝার ক্ষমতা আমার মতো লোকের নেই। আমি আপাতত ইউটিউবে মহাভারতের যুদ্ধ এপিসোডগুলো দেখছি।


কিন্তু সেটাও আর কয়দিন চলে? একঘেঁয়ে ব্যাপার। ঠং ঠং তীর, ধনুক, তলোয়ার ওসব কি আর চলে?


এদিকে যেটা নিয়ে বেশ মশলামুড়ির ফিলিং হয়, সেই আইপিএল এবারে নেই। দূর ব্যাঙ, দেখব কি?

খুব ইচ্ছে ছিল বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভের আমলে ধোনির অপসারণ দেখব। ওমা, সেগুড়েও বালি।



যা দেখছি, কিছুই হবেনা। প্রথম প্রথম যখন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি বাড়তে লাগল এই দেশে, বেশ স্ট্যাটিস্টিক্স খুলে খুলে দেখার ইচ্ছে হতো – কয়জন নতুন আক্রান্ত হলো; ইতালি, আমেরিকা, স্পেন কেমন চাপে আছে – এইসব দেখে বেশ একটা অদ্ভুত

ফিল হতো, তারপর সবই কেমন গা সওয়া হয়ে গেল। দেশের করোনা পরিস্থিতি যাই হোক, কিছুই আর দাগ কাটছেনা মনে। হাজার হাজার আক্রান্ত – আমারই দেশবাসী, কিন্তু বিন্দুমাত্র চিন্তা হয়না আজকাল। মনে মনে খালি ভাবি, কবে যে ট্রেন চালু হবে পুরোদমে, গাড়ির খরচ আর পোষাচ্ছেনা।


সর্বক্ষণ যেন কিছু না কিছু একটা চাই যেটা নিয়ে মেতে থাকতে পারি। সেবারে এমন হয়েছিল ফনি নিয়ে। গতবছর এই ঝড় আসার খবরে চারদিক সতর্ক। সারা কলকাতা দুপুরের মধ্যে শুনশান। বিকালের মধ্যে সকলে বাড়ি ফিরতে মরিয়া। কি হয় কি হয় ভাব একটা! বারান্দায় চা নিয়ে বসেছিলাম ঝড় দেখব বলে। একটা পাতাও উড়তে দেখিনি। সমস্ত থ্রিলের বাষ্পীভবন হয়ে গিয়েছিল।


সেই সাধ মেটাতে এবারে এসেছিল আমফান। ওয়েবসাইটে আগে থেকে ক্রমাগত ঝড়ের গতি পর্যবেক্ষণ তো চলছিলই। সত্যিকারের ঝড়ের সময় ঝড়, বৃষ্টি, প্রবল শব্দ আর ঘরময় জল, জানলার কাচের ঝনঝনানি, বিদ্যুৎহীনতা, আরো নানান অসুবিধা দেখে আর বাংলায় সত্যিই ঝড় হলে কি অবস্থা হয়, খানিকটা বুঝে, খানিকটা টিভিতে দেখে খানিক থ্রিল নেওয়ার শখ স্তিমিত হয়েছিল।


তবে মনটা বারবার নতুন কিছু খবর চাইছে। ভাল খবর তো আসার সম্ভাবনা নেই। কোন কঠিন, অদ্ভুত, মশলাদার, চাবুক, একদম বোম্বার্সটিং টাইপের খবরে বুঁদ হয়ে থাকার দিন এখন।


একপেট ভাত খেয়ে, মাস্ক পরে, দিনে আঠাশবার হাত ধুয়ে  বড় রাস্তায় শত শত প্রাইভেট শেয়ার গাড়ির ভীড়ে ঠেসে প্রাণান্তকর জ্যামের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা আর মুখের মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে সরকার, নেতা, মন্ত্রী, কর্পোরেট সংস্থা প্রমুখের নিন্দামন্দ আর চীন, জাপান, রাশিয়া নিয়ে তুলকালাম, মাঝেমাঝেই করোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা করতে করতে এইভাবেই পরের নিউজ ফ্ল্যাশের অপেক্ষা চলতে থাকছে। পরিশ্রম, বড়ই পরিশ্রম।”


(তলায় নাম সই – গোজাবাবা)।।


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু