ফাঁড়া
“চোখে চশমা, লাল চোখ, তোমার অফিসে কাজ করে – এরকম মানুষকে একটু অ্যাভয়েড করে চলো – সে তোমার ফাঁড়ার কারণ হবে।” দু’মিনিট দেবযানীর হাতটা দেখে নিয়ে বললো সুরেশ কাকু। সুরেশ কাকু বাবার ছোটবেলার বন্ধু – বিখ্যাত পামিস্ট। এসবে দেবযানীর কোনদিনই বিশ্বাস ছিল না। তবে, দু’বছর আগে মাকে হারিয়ে, তার মন অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই দু’বছরে অফিসে কার চোখ লাল আর কার চোখে চশমা, সেটাও ভালো ভাবে দেখার সুযোগ পায়নি সে। পরদিন অফিসে ঢুকে প্রথমেই দেখা বিশ্বদীপের সঙ্গে। এমনিতে নিরীহ ধরণের ছেলে – কারো সাতে-পাঁচে থাকেনা। তবে, বিশ্বদীপ একবার তার সাথে বাইরে কফি খেতে যেতে চেয়েছিলো। দেবযানীর থেকে বিশেষ পাত্তা না পেয়ে এখন সে একা একাই অফিসের ভেন্ডিং মেশিনের কফি খায়। আজ হঠাৎই বিশ্বদীপের অ্যান্টি রিফ্লেক্টিভ চশমা দিয়ে ঢাকা চোখ দুটোতে নজর পড়ে গেলো – একি? বিশ্বদীপের চোখের রঙ টকটকে লাল। তবে কি বিশ্বদীপ? বিশ্বদীপ’ই তার ফাঁড়ার কারণ?
পরের দুটো দিন দেবযানী কোন কাজেই মন দিতে পারলো না। খালি মনে হতে লাগলো – অ্যাতো পরিশ্রমের পরেও অফিসে প্রমোশন না পাওয়া, পরপর দু’বছর মাইনে না বাড়া, কিছুতেই বিদেশে যেতে না পারার সুযোগ না পাওয়া, এ সবের জন্যই দায়ী বিশ্বদীপ। সুরেশ কাকু ঠিকই বলেছে – হয়তো, এরপর বিশ্বদীপের জন্য আরও খারাপ কিছু হবে – কোন ফাঁড়া নিশ্চয় সত্যিই অপেক্ষা করে আছে তার জন্য।
শুক্রবার দিন সকালে, অফিসে ঢুকে দেবযানীর মাথায় ফন্দিটা এলো। লাঞ্চ টাইমে, বিশ্বদীপকে দেখে এক গাল হাসলো দেবযানী। বিশ্বদীপও প্রত্যুত্তরে তার দিকে একটা সরল হাসি ছুঁড়ে দিলো। শুক্রবার, অনেকেই একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে বিশ্বদীপের ডেস্কে গেলো দেবযানী – “চল বিশ্ব। অফিস থেকে বেরনোর আগে, টেরাসে এক কাপ কফি খেয়ে আসি”। একবার হাত ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে দেখে, বিশ্বদীপ বললো, “চলো, দেবযানী দি”। ভেন্ডিং মেশিন থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে অফিসের প্রজেক্টের কথা বলতে বলতে, বিশ্বদীপকে ওপেন টেরাসের লো-ফেন্সিং দিকটায় নিয়ে গেলো দেবযানী।বিশ্বদীপ একটু অন্যমনস্ক হয়ে, নিজের ক্লায়েন্টের ব্যাপারে কথা বলছে।দেবযানী বুঝলো এই সুযোগ। দু’পা পিছিয়ে এসে, বিশ্বদীপের পিঠে দিলো এক সজোর ধাক্কা। কিছু বোঝার আগেই, ছ’তলার ছাদ থেকে, বিশ্বদীপের শরীরটা এক মুহূর্তে আছড়ে পড়লো একতলার কংক্রিটের জমিতে। ব্যাস, আর কোন চিন্তা নেই। দেবযানীর ফাঁড়ার কারণ আপাতত প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে তলায়। সুরেশ কাকুর কথাটা মনে পড়তেই একটা মারাত্মক স্বস্তি অনুভব করলো দেবযানী। কিন্তু ঘাড়টা ঘোরাতেই চমকে উঠলো সে। ওপেন টেরাসের ঠিক মাথার উপরে রয়েছে, একটা সিসিটিভি ক্যামেরা। তাহলে কি শেষ পাঁচ মিনিটে ঘটে যাওয়া সব কিছু রেকর্ড হল ওতে? এ কথাটা তার আগে মাথায় আসেনি কেনো? সিসিটিভি-রেকর্ড-পুলিশ-জেল – কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঝিমঝিম করে এলো দেবযানীর। দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার দিকে তাকাতেই সে যা দেখলো তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেলো। গত দু’দিনের ভাইরাল ফিভারে তার চশমার আড়ালে থাকা চোখদু’টো টকটকে লাল হয়ে গেছে। তাহলে কি..? তাহলে কি সুরেশ কাকুর বলা তারই অফিসে কাজ করা সেই ‘চোখে চশমা, লাল চোখ’ ফাঁড়ার কারণটা সে নিজেই? আর আজ নিজের হতাশার ভার এক নিরীহ মানুষের উপর চাপিয়ে, তাকে খুন করে, নিজের ফাঁড়া সে নিজেই ডেকে আনলো?