উপাধি
বিকেল তখন সাড়ে চারটা। বড় শোল্ডার ব্যাগ থেকে চাবির ছড়া বের করে ঘরে ঢোকে ঊর্মি। ভ্যাপসা গরমে তার নাজেহাল অবস্থা। ঘরে ঢুকেই ফ্যানটা চালায়। ঊর্মির দুই সন্তান বিন্তি আর গুড্ডু আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে স্কুল থেকে। বাচ্চাদের কথা মনে পড়তেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ঊর্মি। গুড্ডু অর বিন্তি সেই সকালে অল্প স্বল্প কিছু মুখে দিয়ে স্কুলে গেছিলো। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে ফ্রিজে রাখা ডিম সব্জির প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ায় ঊর্মি। ঊর্মির কর্তা অনুপম এই কয়েক মাস হলো নতুন চাকরিতে যুক্ত হয়েছে। ঊর্মি নিজেও একটি প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষিকা। বাড়ির সব দায়িত্ব তার কাঁধে ন্যাস্ত। বলা যায় এই সংসারের চণ্ডীপাঠ থেকে জুতোসেলাই সবেতেই হাত লাগাতে হয় ঊর্মির।
না, ঊর্মি আর অনুপমের সংসার যে খুব অবস্থাপন্ন তা নয়। কিন্তু প্রাচুর্য্যও নেই। একটু বুঝে শুনেই খরচাপাতি করতে হয় তাদের। বাচ্চাদের পড়ালেখা, জামাকাপড়, স্কুল ফিস সব মিলিয়ে মাসান্তে দেখা যায় হাত প্রায় শূন্য। কিন্তু তবুও দমে যায় না ঊর্মি। ছেলেমেয়েদের যে মানুষ করতে হবে। সারাদিনের ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে আসে তার শরীর মন। কিন্তু তবুও সে থেমে থাকে না। গত মাসেই ঊর্মির বড় জা আর ভাসুরঠাকুর দেশের বাড়ি থেকে এসেছিলেন অনুপমের এই ভাড়া বাড়িতে। ভাসুর ঠাকুরের সুচিকিৎসার জন্য অনুপম আর ঊর্মি সর্বশক্তি দিয়ে সেবা করেছিল তাদের। ফল স্বরূপ অল্পদিনেই ওনার স্বাস্থের উন্নতি হয়। হ্যাঁ এই ছোট্ট দু'কামরার ঘরে এতজনের থাকা খাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু না, ঊর্মি তাদের অবহেলা করেনি।
যাওয়ার সময় প্রানভরে আশীর্বাদ করে যান তারা ঊর্মিকে।
ঊর্মির বিয়ের পর পরই অনুপম তাকে নিয়ে চলে এসেছিল শহরে। শহরের এক বেসরকারি সংস্থার কাজ করতো তখন অনুপম। উর্মিও এখানে আসার পর একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেয়। ক্রমে ক্রমে বিন্তি আর গুড্ডুর জন্ম। ঊর্মি তখনও চাকরি করে যেতো। চাকরিটা সে ছাড়ে নি। দুটো বাচ্চা নিয়ে অসুবিধা সত্ত্বেও হাল ছেড়ে দেয় নি ঊর্মি। লড়াইটা চালিয়ে গেছে। এবং ঊর্মির এই চাকরিটা ছিল বলেই হয়ত অনুপমের চাকরি ছেড়ে দিলেও দুবেলা দুটো ডাল ভাত খেতে অসুবিধে হয় নি তাদের।
বাচ্চাদের জন্য টিফিন করার ভাবতে ভাবতে ঊর্মি যখন রান্নাঘরে ব্যস্ত তখুনি কলিংবেল বেজে উঠে। দরজা খুলতেই হইহই করে ঘরে ঢুকে বিন্তি আর গুড্ডু। গুড্ডু কাঁধের ব্যাগটা সোফায় ফেলেই ঊর্মিকে জড়িয়ে ধরে বলে, "মা, দিভাই আজকে প্রাইজ পেয়েছে।"
"তাই নাকি?"
"হ্যাঁ মা.."
ঊর্মি হেসে বলে,
"তা আজ ক্লাসে কি প্রতিযোগিতা ছিলো শুনি?"
বিন্তি ঊর্মির কাছে এসে বলে,"মা আজকে ক্লাসে ম্যাম "মা দুর্গা" নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে বলেছিলেন। আমি লিখেছি, "আমার মা উর্মিমালা ভট্টাচার্য আমার চোখে আমার দুর্গা মা। আমার মা'ও যে মা দুর্গার মতন আমাদের সবাইকে আগলে রাখে। আমার মা নিজেই আমার চোখে জ্যান্ত মা দুর্গা আর অসামান্যা একজন নারী।"
এই বলে একটু থামে বিন্তি। পরক্ষনেই আবার বলতে শুরু করে,
"আমার লেখা প্রবন্ধটি ম্যামের খুব পছন্দ হয়েছে তাই আমায় একটি কলম উপহার দিয়েছেন ম্যাম..." বিন্তির কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে ঊর্মি। তার সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা যে আজ তাকে জীবনের সেরা উপাধিটা দিয়েছে...
______*______
