বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ধূসর স্মৃতি

ধূসর স্মৃতি

                   পারমিতা কর

 

ঘুম থেকে আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল সুতপা। কালীপূজোর পরে হঠাৎ করে দুদিন টানা বৃষ্টি হওয়াতে আচমকা একটু ঠান্ডা পরে গেছে। গরম জামা কাপড়গুলো বের করে রোদে দিতে হবে। সকালটা বেশ রোদ ঝলমলে আজ। বাইরে একঝলক দেখে রিয়াকে ডেকে তুলে দিয়ে সকালের খাবার বানাতে গেল। রিয়া গানের রেওয়াজ করতে বসবে। এখন সকাল সকাল অভ্যাস করতে পারছে, স্কুলে পূজোর ছুটি চলছে তাই। সুতপার অবশ্য নিজের কলেজ আছে, এমনিতে পড়ুয়াদের ছুটি, কিন্তু অধ্যাপকদের কিছু অফিসের কাজকর্ম থেকেই যায়। সকালের এই সময়টা খুব ভালো লাগে, চারপাশটা বেশ শান্ত থাকে। একটু বাদেই শুরু হয়ে যাবে ব্যস্ততা। বান্টি উঠলে বাড়ির কোনো প্রান্তই সুস্থ স্বাভাবিক থাকে না, রান্নাঘরে চায়ের জল চাপিয়ে রিয়াকে তাড়া দিল একবার। 

কুড়ি বছরের সাজানো গোছানো সংসার। ছেলে, মেয়ে, বর আর শ্বশুর-শাশুড়ী সবাইকে নিয়ে। পুরো সংসারটাকে বেঁধে রেখেছে সুতপা। সৌম্য একটা বেসরকারী সংস্থায় বেশ ভালো পদে কর্মরত আর ততটাই ব্যস্ত।

        শনিবার সৌম্যর অফিসের বসের বাড়িতে একটা পার্টি ছিল। এইসব হাই প্রোফাইল পার্টি সুতপা একদম পছন্দ করে না। মাদক আর সিগারেটের গন্ধে পরিবেশটা কেমন ঝিম ধরে যায়। কিন্তু কিছু কিছু জায়গাতে যেতেই হয়। এই পার্টি তেমনই একটা, সৌম্যর বসের মেয়ের বাগদান পর্ব। সেন দম্পতি বাড়ি এসে বারবার বলে গিয়েছিলেন। সুতপা আর না করতে পারেনি, দুপুরেই যেতে হয়েছিল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। 

         ঘরে ঢুকতেই রামুকাকার কাছে শুনলো, একটা বড়সড় পার্সেল এসেছে।

সৌম্য, সারাদিনের ক্লান্তিতে বাড়ি ফিরেই সোজা বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।  

রামুকাকা এতক্ষণে সুতপাকে পেয়ে সারাদিনের ঘটনাবলী বলতে শুরু করে দিল। সেইসব শুনতে শুনতে, পার্সেলটা একনজর দেখেই বুঝলো, সেটা দাদার থেকে এসেছে। গতমাসে বাবার শেষ কাজে যখন বাড়ি গিয়েছিল, দাদাকে বলে এসেছিল, পুরনো সব বইখাতা যা ছিল সুতপার সেগুলো পাঠিয়ে দিতে। কাল ফুরসৎ মতন দেখা যাবে, মনে মনে এই ভেবে, ঘুমোতে গেল।   

পরের দিন রবিবার, দুপুরের খাবার পালা সাঙ্গ হলে সুতপা পার্সেলটা নিয়ে বসলো। বাক্স খুলতেই একসময়ের অতি প্রিয় জিনিসগুলো দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। বের হল ওর কবিতার খাতা, হাতের কাজের খাতা আর কিছু হাতে আঁকা ছবি, যা একসময় ছিল ওর সবসময়ের সঙ্গী। একটা একটা করে সব দেখতে শুরু করলো। সবার শেষে হাতে তুলে নিল কবিতার খাতাটা। কত কবিতা লিখত তখন, নিজেই অবাক হচ্ছিল ভেবে। হঠাৎ পেয়ে গেল, খাতার মাঝে সযত্নে গুঁজে রাখা একটা চিঠি।  

এতগুলো বছরে সেটা লালচে হয়ে এসেছে। কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে চিঠিটা বের করলো। হাল খুব খারাপ, একভাবে ভাঁজে পরে থেকে সেটা ঠিক করে খোলা যাচ্ছে না, খুলতে গিয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। খুব ধীরে সুস্থে খুলল চিঠিটা। এ তো ওকেই লেখা চিঠি, কে লিখেছিল, দেখতে গিয়ে দেখে, অয়ন। বিবর্ণ হয়ে এসেছে লেখাগুলো। একলহমায় জীবনের ধূসর হয়ে যাওয়া দিনগুলো.. হুড়মুড় করে সব সামনে চলে এল।

সেই কলেজের হোস্টেল জীবন, ক্যান্টিন, কিছু পাগলামি আর অয়ন। রসায়নের ক্লাশে প্রথম আলাপ হয়েছিল। তারপর বন্ধুত্ব, অয়ন ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট আর মিশুকে ছিল, পড়াশোনায় বন্ধুদের অনেক সাহায্যও করত। সুতপার হোস্টেলের বাইরে বসে কত রকমের গল্প হত ওদের। বাকি বন্ধুরাও থাকত তখন। তবুও অয়ন ওকে একলা পেতে চাইত। ছুটির দিনে কতবার অয়নের বাইকে করে দুজনে মিলে একসঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল ক্যম্পাসের বাইরে। অয়নের জন্ম বড় হওয়া, সবকিছু ওই শহরেই। কাজেই আশপাশটা হাতের তালুর মতন চিনত। ভালোবাসার নেশাতে মত্ত তখন, ক্লাশে একসঙ্গে বসা, হাতে হাত রেখে একসঙ্গে জীবনের স্বপ্ন দেখা, ঝগড়া, খুনসুটি কত কিছু….। 

কলেজে এক বছর পড়ার মধ্যেই অয়ন ইঞ্ছিনিয়ারিং-এ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। চলে যাওয়ার পরেও চিঠি লিখত ওকে। অনেক দিন পর্যন্ত চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। বেশ সুন্দর চিঠি লিখত পারত অয়ন। তখন তো আর এখনকার মত মোবাইল ফোনের এমন রমরমা ছিল না। ল্যান্ডফোনেও কথা বলা বেশ খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। চিঠিটাই সবার মধ্যে যোগসূত্র বজায় রাখত। অয়ন নিজের কলেজ থেকে যখন বাড়ি ফিরত তখন কয়েকবার ওদের দেখাও হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে সব ফিকে হতে শুরু করে, ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি, সবাই নিজের নিজের ভবিষ্যৎ তৈরির তাগিদে ব্যস্ত হয়ে যায়। এরপর বিশ্ব বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে সুতপা একটা কলেজে পার্টটাইম লেকচারার হয়ে ঢোকে। শেষ চিঠিতে অয়ন লিখেছিল ও একটা চাকরি পেয়ে নিউজার্সিতে চলে যাচ্ছে। হয়ত ওখানেই থেকে যাবে বাকি জীবনটা যদি সব ঠিক থাকে। সুতপার মনে হয়েছিল, অয়ন ওর কোন অভিমত নিতে চায় নি। তখন অয়নের চিঠিগুলোতে মন্দিরা নামে একটা মেয়ের কথা খুব থাকতো। সুতোটা যে আলগা হচ্ছিল সেটা সুতপা বুঝতে পারছিল। নিজে থেকে আর কোনও তাগিদ অনুভব করেনি তাই, কোন যোগাযোগ হয়নি তারপর।  ছোট বয়সের একটা ভুল ভেবে এগিয়ে গিয়েছিল নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। কলেজের চাকরিটা পাকা হয়ে যাওয়ার পর নিজেও ভীষণ ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলে, সৌম্যের সঙ্গে বিয়েটাও হয়ে গেল অবশেষে।  

আচ্ছা, অয়ন এখন কোথায় থাকে? ওর মতোই কি সব ভুলে সংসার করছে? কি করে? অনেক কথা ঘিরে ধরেছে আজ এত বছর বাদে। সুতপা হারিয়ে যাচ্ছে সেই দিনগুলোতে। সৌম্যর সংসারের কাণ্ডারি আজ অন্য ছন্দে! 

সম্বিত ফিরল হঠাৎ রিয়ার ডাকে, মাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, দেখ ভাই কি করেছে, আঁকার খাতার সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতে পায়ে রঙ মেখে বসে আছে।

চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছিল। চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করতে করতে সুতপা বলল, তোদের নিয়ে আর পারি না। একদণ্ড শান্তি নেই যেন!

তাড়াতাড়ি ছেলের কাছে গিয়ে দেখে, বান্টি শুধু নিজেকেই রঙ মাখায় নি, অনেক কিছুই এঁকেছে, তার মধ্যে সুতপাও আছে, মাকে সে মাঝে রেখে চারপাশে বাড়ির সবাইকে এঁকেছে। সুতপার মনে হল, বান্টি ওকে পরিবারের মধ্যমণি করেছে। নিজের অজান্তেই সুতপার মুখে হাসি ফুটল, অতটুকু ছেলের কাণ্ড দেখে।  বান্টিকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো পরিষ্কার করাতে, সৌম্য টিভি দেখতে দেখতে বলল, কি গো আজ যাবে নাকি বাজার করতে? কালীপূজোও তো হয়ে গেল। বলেছিলে সিমলা বেড়াতে যাওয়ার আগে কিছু কেনাকাটা করবে। এরপর আবার আমি ব্যস্ত হয়ে যাব অফিসের কাজে। 

রিয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠলো, আমিও যাবো! আমিও যাবো!

ফুটবলের আবদার করল বান্টি।  

  অনাবিল আনন্দ খেলে গেল সুতপার মুখে, খেয়াল হল, তাড়াহুড়োতে চিঠিটা হাতেই থেকে গেছে। সেটাকে আর বাক্স বন্দি না করে জঞ্জালের বাক্সে ফেলে দিল। বাচ্চাদের পোশাক পরতে দিয়ে নিজে তৈরি হতে বসলো সুতপা।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু