বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

দেখা না দেখায় মেশা

-ভ্যাকসিনটা নাও!

-তুমি কবে নেবে?


ও প্রান্ত নিশ্চুপ। খানিক্ষন পরে টুং করে মেসেজ আসে- তোমাকে এখনও অনেক বছর ভালো থাকতে হবে। অনেক লিখতে হবে। সুতরাং নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে।

-তোমার সুস্থ থাকার দরকার নেই বুঝি?

-না থাকলেও ক্ষতি নেই। আমি একেবারে না থাকলেও পৃথিবীর কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।

-যাদের জন্য তোমার সকাল বিকেল, যাদের ভালো রাখার জন্য তোমার রোজকারের আয়োজন, তারা বাদেও কেউ একজন তো আছে, তুমি ভালো থাকলে যে ভালো থাকে! দূরে হলেও তো আছে, মানো কি একথা?

আবার নিশ্চুপ ওপ্রান্ত।


অমল জানে, এখন আর উত্তর আসবে না। অজন্তা এখন গোপনে কাঁদবে। কেউ দেখবে না হয়ত, তবু কাঁদবে সে তার মনের জন্য। অমল ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়েছে মনসিজ বলে। অজন্তা তাকে ডাকে মন বলে। একমাত্র অজন্তাই ডাকে মন বলে।


তিন ভাই এক বোন। অমল সব থেকে ছোট।  বড় ভাই বোনেরা সকলে উচ্চ শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, সুউপায়ী, সংসারী। তাদের উজ্জ্বল যৌথ পরিবারের এক কোনে টিমটিম করে মাটির প্রদীপের মত জ্বলে অমল। বাবা বেঁচে থাকতে তার তবু নিজস্ব একটা ঘর ছিল। এখন মা আর সে, দুজনে সেই ঘরের যুগ্ম দখলদার, কারণ সংসারে লোক সংখ্যা বেড়েছে। দাদাদের ছেলেরা এক একটি স্বাধীন ঘরের দাবিদার হয়ে উঠেছে। দাদা বৌদি ভাইপোরা কেউ অসম্মান করে না, অবহেলা করে না অমলকে। কলেজ স্ট্রিটের বইএর দোকানে কাজ করা সাধারন বিএ পাস অমলের এই সংসারে না আছে কোন কন্ট্রিবিউশন, না আছে কোন প্রানের টান। কন্ট্রিবিউশন একেবারে নেই বলা কিন্তু ভুল। দু'বেলার বাজার দোকান, মায়ের ডাক্তার দেখানো, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি কলের মিস্ত্রি ডাকা, হটাৎ দরকার হলে গ্যাস সিলিন্ডার যোগাড় করা- এসব অলিখিত ভাবে তার দায়িত্বে। কিন্তু ছুটির দিনে একসাথে জলখাবার খেতে তার ডাক পড়েনা। পূজোর সময় বেড়াতে গেলে তার টিকিট কাটা হয় না কোন দাদার সাথেই। সে মেনে নিয়েছে। মুখচোরা অমলের জন্য কারুর অপেক্ষা নেই, আহ্লাদ নেই। 


তবু এক সময়ে একটা স্মার্ট ফোন হয় তার। তারপর গড্ডালিকা স্রোতে ভাসতেই নাকি একাকী রাতের নিঃসঙ্গতা কাটাতে কে জানে, সে ঢুকে পড়েছে ফেসবুকে। সেই ফেসবুকে সে হতে চেয়েছে স্বয়ম্ভু, নিজের মন থেকে যেন নিজেই জন্মেছে। তাই নাম নিয়েছে মনসিজ। মনসিজ শব্দের অন্য অর্থ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সেখানে তার পারিবারিক ইতিহাস নেই, নেই কাগুজে পরিচয়, নেই ব্যর্থতা অপ্রাপ্তির বিষন্ন ছোঁয়া, নেই কোন আশা আকাঙ্খাও। আছে শুধু রোদ্দুর হওয়ার বাসনা। হাঁসের পালকের মত পাঁক না লাগিয়ে সে কেবল ভেসে যেত। কত লেখা, কত ছবি, কত তর্ক বিতর্ক কেবল দেখে যেত, পড়ে যেত নিশ্চুপে। একদিন কমেন্ট বক্সে এক অজন্তা সান্যালের কমেন্টে রিপ্লাই দিয়ে ফেলল- ব্যাক্তিগত জীবন যেমনই হোক, হুমায়ুন আহমেদের লেখা বিচার করার ক্ষেত্রে তা মনে রাখা নিষ্প্রয়োজন। তারপর প্রতি মন্তব্য, আবার অমলের উত্তর। বার কয়েক এসব হওয়ার পর একসময় সাহস করে ইনবক্সে সে লিখে ফেলে- আমি বোধহয় বোঝাতে পারছি না, হুমায়ূন আহমেদের বিবাহ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করিনি। কিন্তু ওনার লেখা আমাকে স্বপ্ন দেখায়, ভাবায়।


তিনদিন পর উত্তর এসেছিল- ঠিকই বলেছেন হয়ত। আসলে ব্যক্তিপূজা স্বভাব আমাদের। 


এরপর টুক টাক মেসেজ। কখনও কোন লেখার কমেন্ট বক্সে আবার মোলাকাত। কবে যেন নিয়ম হয়ে গেল, রাত দশটার পর অমল আর অজন্তা মুখোমুখি হবে। না, ওরা কেউ কারুর ছবি চায়নি, জানতে চায়নি ব্যাক্তিগত জীবনের রোজনামচা, জানে না প্রতিদিনের বেঁচে থাকার স্থুল কার্যকারন।


কিন্তু অজন্তা জানে, কি গভীর ভাবনার বিস্তার অমলের। কি বিশাল ব্যপ্তি তার পড়াশোনার, কি অসম্ভব ভালোবাসা বাংলা সাহিত্যের প্রতি। অমল জানে সহজ সরল মেয়েটা কি অকপট, কি চমৎকার বোধশক্তি। তার মত করে অমলকে কেউ তো বোঝেনি! কেউ তো বলেনি কখনও- আপনি লিখুন, নিজের মনের সব ভাবনা উজাড় করে দিন। কেউ না পড়ুক, আমি পড়বো। সেই জন্যই লিখুন অন্তত।


হ্যাঁ, ওরা আপনিই বলত। তারপর সেই দিনটা এলো। অমলের পরিস্কার মনে আছে, ভ্যালেনটাইন পূজোর নামে ফেসবুকে দেখনদারি প্রেমের তুমুল উচ্চকিত প্রচার। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত অজন্তার সাথে মনসিজের রাত্রি আলাপ চলেছিল। এক সময়ে তারা আপনি থেকে তুমির সহজতায় পৌছে যায় কোন শর্ত না রেখেই। না না, অজন্তা শর্ত রেখেছিল- কথা দাও মন, এই বন্ধুত্বকে আমরা অন্য পরিচয়ে বাঁধতে যাবো না। কথা দাও, কোনদিন কোন রকম দ্বিচারিতা করবো না আমরা একে অপরের সাথে!


অমল বলেছিল- প্রেমের সঠিক সংজ্ঞায় যদি যাও, তবে এও আমাদের প্রেম। কিন্তু এই প্রেমে কোন অধিকার কিম্বা বাহুল্যতা থাকবে না আমি কথা দিলাম। কিন্তু অজন্তা, আমরা দূরে থেকেও পাশে থাকবো চিরকাল। আমাদের বন্ধন যেন ছিন্ন না হয় কখনও।


অজন্তা জানতে পারে, তার মনের মনখারাপ কিনা, অজন্তা জানতে পারে তার মনের দুনিয়াতে আলোড়ন তুললো নতুন কোন বই। অজন্তা অকপটে জানায়, সম্প্রতি দেখা কোন সিনেমার বিশেষ দৃশ্যে সে তার মনসিজকে কল্পনা করেছিল! তার প্রতিটি ভালোলাগা চারিয়ে দেয় সে মনসিজের ভিতরে। তবু দৃশ্যমান প্রেমে ভেসে যেতে চায়না সে কখনোই। জন্ম থেকেই একটা পা ছোট নিয়ে জন্মেছে সে। দীঘল চোখের নরম মনের মেয়েটি অতি অসংখ্যবার অবহেলা পেয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছে চেনা অচেনা ভালো লাগার কাছে। জীবন তাকে শিখিয়েছে কেবল ব্যর্থতা আর বঞ্চনার সাথে সহবাস। ফেসবুকের খোলা জানলায় তাই সে তার স্বরূপ পুরোপুরি উন্মোচন করেনি, করেনি তার মনসিজের কাছেও। শুধু নিজের মনকে পুরোপুরি মেলে ধরেছে। পার্থিব অস্তিত্ব অস্বীকার করে একে অপরের কাছে হৃদয় সমর্পণ করেছে। এই গোপন প্রেম কেবল অনলাইনের সবুজ আলো নির্ভর, কিন্তু তাকে কিছুতেই হারাতে চায়না দুজনের কেউ।


কোন এক বর্ষার সন্ধ্যায় হয়ত এক পা খাটো একটি মেয়ে এসে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শান্ত চোখ তুলে অমলের কাছে চাইবে 'শঙ্খনীল কারাগার'। অমল একটু আনমনা হয়ে বইটি প্যাক করতে করতে ভাববে, অজন্তা কালকেই বলছিল এই বইটির কথা! তারপর জনারণ্যে মিশে যাবে দু'জনে দুই পথে দুই দিকে, অপেক্ষা করবে রাত্রির অবসরে অনলাইন হওয়ার সময়টুকুর জন্য।

*******

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু