বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সুখে থাকার তৃষ্ণা



রাত দুটোর সময় টলমল পায়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো শুভ্র সেন আর তার ডাকসাইটে সুন্দরী বৌ পলা সেন। এসব অবশ্য নতুন কিছু নয়। সামনের সপ্তাহে প্রমোশন অর্ডার বেরবে। শুভ্রর বস্‌কে খুশি করার সুযোগ আজ হাতছাড়া করেনি পলা। হিলহিলে সেক্সি সিডিউসিং পলার প্রতি লুব্ধ হয়ে আত্মসমর্পন করেনি এমন বস্‌ আজ পর্যন্ত পায়নি শুভ্র। ফলে তার ক্যারিয়ার গ্রাফ বরাবরই সটান ঊর্দ্ধমুখী। পলা দামী শাড়ি গয়না গাড়ি আর বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে বিন্দাস আছে। খুবই হ্যাপি কাপল্ তাই তারা। আজও হাসতে হাসতে জড়িত স্বরে শুভ্র বৌকে বলে - শুয়ে পড়ো ডার্লিং। ধকল গেছে তো বেশ আজ। কাল আবার যেতে হবে ওবাড়ি, অনেকটা পথ। কাল কিন্তু পুরো সুদ্ধ-সাত্ত্বিক রূপ, মনে আছে তো? তবে এবারই শেষ ডার্লিং, সব মিটে গেলে কে আর ওমুখো হবে !

সে নিয়ে ভেবো না শুভু, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো- স্খলিত স্বরে বলে পলা। তবে এবার কিন্তু আমার মার্সিডিজ চাই-ই চাই।  

কাল লক্ষ্মী পুজো শুভ্রদের দেশের বাড়িতে। একমাত্র ছেলের বৌ নিষ্ঠা সহকারে প্রতিবার পূজো করে বলেই না শুভ্রর মা রাজী হয়েছেন বিশাল বাগানওয়ালা প্রাসাদোপম বাড়ি, জমি বিক্রি করে মন্দিরের লাগোয়া দেবোত্তর জমিতে থেকে যেতে। শুভ্র কথা দিয়েছে বিক্রিবাটা হয়ে গেলে মনের মত করে মন্দির আর মায়ের থাকার জায়গা করে দেবে। তাঁর ভরণপোষণ আর দেবসেবার ভার যখন উপযুক্ত ছেলে বৌমাই নিয়েছে তাঁর আর চিন্তা কি। শহুরে বড়মানুষ হলে কি হবে, ভারি মাতৃভক্ত ছেলে। তাছাড়া গতবছর শুভ্রর বাবা মারা যাওয়ার পর তার আর চাইবার আছেটা কি!


আলো ঝলমলে পূজো দালানের অন্ধকার এক কোনে এসে দাঁড়িয়েছে বিন্তি। একবার শুধু প্রণাম করবে মা লক্ষ্মীকে। নিজের ঘরে তো আসন পাতার সাহস পায়নি। মা বাবা আচমকা মারা যাওয়ার পর চারটে ভাইবোন আর বুড়ি ঠাকুমাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপাত করত বিন্তি। দিনরাত খেটে মরত, তবুও আধপেটা খাবার জুটত না সবার। তারমধ্যেই নিস্তার মিলল না তার ভরন্ত শরীর লোভী শকুনগুলোর হাত থেকে। কে নেই তার মধ্যে- ছিঁড়ে খেতে লাগল সব অসহায় মেয়েটাকে দিনের পর দিন। বিন্তি দেখল, এভাবে নিজেকে শুধুশুধু বিলিয়ে দেবে কেন ! তারপর থেকে সপ্তাহে কয়েকটা রাত শহরে থেকে আসে সে। ঠাকুমা ভালো পথ্যি পাচ্ছেন, ভাই বোন গুলো সব ভালো স্কুলে পড়ে, পেট ভরে খায় দু'বেলা। গাঁয়ের লোকে যাই বলুক, দিদি তাঁদের প্রাণ। ছোট ভাইটি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে, লেখাপড়া শিখে সে বড় হবেই। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলে প্রথমেই সে তার দিদির সমস্ত যন্ত্রণার অবসান করবে, মাথায় করে রাখবে তাকে।   


লাল টুকটুকে শাড়ি, সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদূর আর এক গা গয়না পরা লক্ষ্মীমন্ত বৌমাকে নষ্টা মেয়েটার হাতে পূজোর প্রসাদ তুলে দিতে দেখে শুভ্রর মা রাগে ফেটে পড়লেন - কুলটা, অসভ্য, বেশরম, বেশ্যা কোথাকার! তোর এত্ত সাহস ......

চমকে তাকায় বিন্তি আর পলা।

========

 বছর খানেক পরের কথা।

বিন্তি বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বারাব্দায় পা রাখতে না রাখতেই চেঁচিয়ে ওঠেন রমা- আবার এসেছিস? কি চাস্‌ তুই বলতো? আমায় শান্তিতে মরতেও দিবি না? তোর হাতে জল খেয়ে আমি মরার পর নরকবাসী হই, এই চাস্‌ ?

- মরার পর কেন, অতদিন অপেক্ষা করতে হবে না, এখনই তোমায় নরকবাসী করবো বলে আসি। আমি নিজেই তো নরকের কীট, জানো না?

ব্যাগ নামিয়ে রেখে ঘর থেকে ঝাঁটা বার করে ঝাড় দিতে দিতে বক্‌বক্‌ করে বিন্তি। এক কামরার ঘর, সামনের লাগোয়া বারান্দা আর সেই বারান্দার কোনে একফালি রান্নার জায়গা। এই তো এখন সম্বল রমার। সেনদের বিশাল বাগান পুকুর জমি সহ প্রাসাদপম বাড়ি এখনও আছে। তবে রমার গুনধর ছেলে বৌমা এক ফিল্মের প্রোডাকশন হাউসকে বেচে দিয়েছে সেসব ক'বেই । এই এক চিলতে থাকার জায়গা গাঁয়ের লোকজন জোর করে আদায় করে দিয়েছিল বলে তবু রক্ষে। একমাত্র ছেলে শুভ্র মাকে মন্দির আর থাকার মত বাড়ি বানিয়ে দেবে কথা দিয়ে সব লিখিয়ে নিয়েছিল। লেখাপড়া হতেই আর এমুখো হয়নি সে। অবশ্য সেই মুখও আর নেই তার। সুন্দরী বৌকে যেনতেন প্রকারে কাজে লাগিয়ে সে জীবনের বাজী জিততে চেয়েছিল। টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ির লোভে যতদূর নামা যায়, নেমে গেছিল। সেই বৌও শোধ তুলেছে সময়মত। সেন বাড়ি বিক্রির সব টাকা নিজের নামে করে নিয়ে এক রাতে এক কোটিপতি রত্ন ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে পাড়ি দিয়েছে বিদেশে। শুভ্র দিন কতক মুখ লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল। তারপর নিজের ফ্ল্যাট আর চাকরীটা কোনক্রমে বাঁচিয়ে রেখে রাতভর মদ গিলে গিলে কাটিয়ে দেয়। রমা শুনেছেন, খারাপ পাড়ায় যাতায়াতও শুরু করেছে। ওদের নামও উচ্চারন করেন না তিনি এখন। এই এক চিলতে বাড়িতে একার সংসারে মুখ গুঁজে দিন কাটিয়ে দেন। সেনবাড়ির দয়ায় এক সময় বেঁচে থাকা লোকের সংখ্যা গ্রামে কম নয়। আর নিজের ছেলের মত সবাই মনুষত্ব হারায়নি, তাদের দয়ায় দিন কেটে যাচ্ছে তাঁর একরকম করে। আর এই বিন্তিটা - একে নিয়েই তাঁর যত মুশকিল। দিন নেই রাত নেই যখন তখন এসে হাজির। দোকান পাট বাজার ঘাট, ঘর দুয়ার পরিস্কার করা, জামা কাপড় কাচাকুচি কি না করে। রমার জন্য প্রানপাত করে দিচ্ছে। আগে রান্নাঘরে ঢুকতো না। সেবার জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে থাকার সময় বিন্তির সেবাতেই উঠে দাঁড়িয়েছেন। এখন রান্নাবান্নাটাও সামলে দেয়। তবে অতীত তো মেয়েটার পিছু ছাড়ে না। আক্ষরিক অর্থেই একসময় গতর খাটিয়ে নিজের সংসারটাকে দাঁড় করিয়েছে মেয়েটা। গাঁয়ের অন্য লোকের কথা কি বলবেন, রমা নিজেও তাকে কি গালাগালটাই না করেছেন একসময়। কুলটা, বেশ্যা - কি না বলেছেন! মা লক্ষ্মীর প্রসাদ পর্যন্ত হাতে তুলে দেননি, পূজোর মন্ডপ থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তার নিজের বৌমা? বাইরের লক্ষ্মীমন্ত রূপ দেখিয়ে তাকে ভুলিয়ে রেখেছিল। ভিতরে ভিতরে তারা যে এমন নিষ্ঠুর, এমন মনুষত্বহীন তা তিনি বুঝতেও পারেননি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসে চোখের জলে ভেসে যান, এতটা ঠকাতে পারলো তাকে ওরা! নিজের পেটের সন্তান! জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেছে তার। এই বিন্তিটাকে দেখলেই তার ভিতরে আবার সন্তান সংসার তৃষ্ণা জেগে ওঠে! সেই তৃষ্ণা ভুলতেই গালাগাল দিতে থাকেন মেয়েটাকে সমানে, ও কি বোঝে ?

বিন্তি দেখে রান্নাঘরে এক বাটি পান্তা যত্নে ঢাকা। পাশেই দুটো কাঁচা ডিম আর কিছু পেয়াঁজ আলু লংকা। মনে মনে হাসে বিন্তি। গালি দেবে মুখে আবার বিন্তির জন্যই খাবার দাবার চেয়ে চিন্তে নিয়ে যত্ন করে তুলে রাখবে। নিজে তো এসব মুখেও দেন না। নিরামিষ সেদ্ধ কিম্বা ডাল ভাজাতেই তার খাওয়া শেষ। কিন্তু বিন্তির জন্য ডিম মাছ রাখতে ভোলেন না। নিজের যে'কটা পুরোনো রঙ্গিন শাড়ি, চাদর, বাসনকোসন বেচেবর্তে আছে, সেসব থেকে টুকটাক দেওয়ারও বিরাম নেই। নগদ পয়সা তো হাতে নেই, পূজোপার্বন এলেই ওই দামি দামি ঘরের জিনিসপত্র গুলো একটা না একটা জোর করে ওর হাতে তুলে দেবে। না নিলেই বলবেন - ও, নতুন দিতে পারি বলে নিবি না? তবে বিন্তি গালমন্দ খেয়েও বারবার আসে এবাড়ি তা কিন্তু এইসব জিনিসের লোভে নয়। মায়ের মুখ মনেও পড়ে না তার। সংসারে ছোট ভাই বোন গুলোর জন্য নিজে সব করে গেছে মুখ বুজে। তারা ভালোওবাসে তাকে এখনও। কিন্তু হাতে করে তাকে কেউ কিছু তুলে দেয়নি কখনও। কেউ বসিয়ে দু'মুঠো ভাত বেড়ে খাওয়ায় নি। তারও যে প্রাপ্তিসুখ বোধ আছে কেউ বোধহয় ভাবেই না। মায়ের স্নেহের যে কি ভীষণ তৃষ্ণা তার বুকে জমে আছে, সে কিভাবে বোঝায়! কাকেই বা বোঝায়! এবাড়ির দাওয়ায় বসে থালায় করে ভাত আর ডিমের ঝোল নিয়ে যখন খাবে, রমা পিসি দূরে বসে দেখবে। আর বলবে - "আর দু'টো ভাত নে রে মুখপুড়ি। এত খাটিস, তারপর না খেয়ে পড়ে থাকলে লোকে আমায় দুষবে এই চাস্‌ ? ডিম রাখবি না, ভাইবোনদের জন্যও নিবি না, তুই খা। আমার সামনে বসে খা তো।" আপাত কঠিন গলার স্বর তুলে পিসিও যে একটা কোমল স্নেহ চাপা দিতে চায় সে কি বোঝে না! একটা আনন্দের কান্নায় গলা বুজে আসে তখন বিন্তির, ভাত খাবে কি!

অসম বয়সী অসম অবস্থানের দুটি মানুষ, নিজের নিজের সংসারে যা পায়নি, মুখোমুখি বসে এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে সেসব চাওয়া পাওয়ার হিসেব যেন এই জন্মেই মিটিয়ে নেবে। কেউ কাউকে মুখ ফুটে নির্ভরতা জানায় না। অথচ দিন গেলে অপেক্ষায় থাকে একে অপরের। সেই অপেক্ষার অবসানেই তাদের সুখ।

*********


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু