বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মন কি বাত

#মন_কি_বাত

  অন্তরা রায়


-- বৌমা আজও আড্ডা দিতে বেরোলো? তুই কেন কিছু বলিসনা পপি?

গত এক সপ্তাহে এই নিয়ে তিনদিন বড়ো মাসিশাশুড়ি কেয়ার চোখ এবিষয়টা এড়ায় নি। বহুবার শ্রীজয়ীকে যে আড় চোখে মেপে নিচ্ছিলো, তা মৃদুলার ছোটবোন খেয়া অনেকবারই খেয়াল করেছে।

বেশ দুয়েকবার এনিয়ে কিছু কথা কানে এলেও ছোটবোন খেয়া ওরফে পপি এনিয়ে কোনো উত্তর দেয়না।


রাত দশটা,

ঘন্টা দেড়েক পর টেবিলে সকলে খেতে বসেছে। নীলিমাদি এক এক করে খাবারগুলো সব টেবিলে পৌঁছে দেয়। দুই শাশুড়িকে খেতে দেয় শ্রীজয়ী।

-- তুমিও বসে যাও শ্রী।

মৃদুলা মনে মনে ঠিক করেছে আজই খেতে বসে শ্রীজয়ীকে এনিয়ে ঠারেঠোরে কথাগুলো বলবে। উচিত কথা বলা মানুষ এসংসারে কম বলেই এবাড়ির এই অবস্থা। একি বিশৃঙ্খলা সংসারে!

ছোটবোন বাতের রুগী, নড়তে চড়তে তেমন পারেনা বলে মুখেও সেকারণে কিছু বলেনা এ খুব স্পষ্ট বুঝতে পারে মৃদুলা। আর তারই সুযোগ নেয় শ্রী।


-- না মাসিমনি আপনারা আগে খেয়ে নিন, রাত হয়ে যাচ্ছে তো, আমি আর নীলিমাদি একসাথে বসবো।


কথাটা বোধহয় একপ্রকার শ্রী কায়দা করেই এড়িয়েই যায়, এসব খুব ভালো বোঝে মৃদুলা। পাকা চুলের অভিজ্ঞতা কি কম?


ময়েসচারাইজার দু'হাতে ঘষতে ঘষতে ছোটবোনের সাথে পুরোনো দিনের নানান গল্পে ডুবে যায় মৃদুলা। কিন্তু শ্রী'এর অত্যাধিক স্বাধীনতার লাগামটা যে টানা দরকার সে কথাও মনে করাতে ওঁর ভুল হয়না।

সকালে মৃদুলার ঘুম ভাঙলে ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখে খাওয়ার টেবিলে অমিয় আর শ্রীজয়ীকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে ওদের মা।


-- নীলিমাদি, মাসির চা'টা একটু দিয়ে যাওনা প্লিজ।

-- তোমাদের আবার বাড়াবাড়ি, প্লিজের কি হলো, ওর কাজই তো এগুলো।

খেয়া দিদির কথায় চুপ করেই থাকে। শ্রী খানিক হেসে বলে,

-- সে তো বটেই মাসিমনি, তবু যে সারাদিন আমাদের ফরমায়েশ খেটে চলতে ক্লান্ত হয়েও মুখে রা'টি কাটেনা, এটুকু বিনয় তার প্রাপ্য।

মিচকে হাসে মৃদুলা। কাজের লোককে তেল না দিলে বউয়ের বাবুয়ানা যে করা সম্ভব নয়, মহত্ব দেখলেই যেন মহৎ হওয়া যায়!


আজ অমিয়র শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ করে।

প্রচন্ড বুকে ব্যাথা নিয়ে অফিস থেকে বিকেলেই বাড়িতে ফিরে আসে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে শ্রী ও অফিসের কাজগুলো কোনোভাবে সেরে বাড়ি ঢোকে। গাড়িতে উঠেই অমিয় ফোনে শ্রীকে জানিয়েছিল, ঘাম হচ্ছে আর সঙ্গে প্রচন্ড বুকে ব্যথা।

বাড়িতে ফিরেই সময় না নিয়ে আমিয়কে সোজা  নার্সিংহোমে এডমিট করতে নিয়ে যায়। রাতেই ছেড়ে দেয় নার্সিংহোম থেকে। শ্রী স্নান সেরে টেবিলে খেতে দিতে আসে। ততক্ষনে খেয়া সকলের খাবার দিয়ে দিয়েছে।

-- মা রাত হয়েছে, তোমরা খাওনি?

-- মাসিমনিকে জোর করেই দিয়ে দিয়েছি। ওর খাওয়া হয়ে গেছে। আমার ছেলেটা যে অসুস্থ, ছেলেমেয়ে দুটোই যে না খেয়ে, আমি কি করে খাই বলতো?


ওদিক থেকে মৃদুলা এঘরে উঠে আসে।

-- ইসস, কি ধকল গেলো তোমাদের, এবার খেয়ে নাও। তোমাদের মা'ও তো না খেয়ে।


-- হ্যা, জানি মা অপেক্ষায় থাকবে। ওই জন্যই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরলাম।

মৃদুলার ঘুম আসেনা।

মনে মনে ভাবে এ বউ খুব চালাক। সারা সংসার কায়দা করে নিজের হাতে করে নিয়েছে। ছোটবোনটা রাজ্যের ক্যাবলা। একে সাবধান না করলে ছেলের বৌটি একদিন মাথায় চড়ে নাচবেই নাচবে।


-- হ্যা রে পপি, তোর ছেলের বউ যে বাড়ির সব নিয়ম কানুন পাল্টে দিচ্ছে রে। এরপর তোর হাতে কিছুই তো থাকবে না। আর তুই এরকম কলের পুতুলের মতো হয়ে গেলি? সেই তোর প্রতাপ আজ তো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রে! সংসারের হাল অন্যের হাতে কেউ ছাড়ে?


-- দিদি, এক এক সংসারের এক এক রীতি-নিয়ম। শ্রী যথেষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে। সমস্ত দিক সুন্দর পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে। আমার তো বয়েস হয়েছে দিদি, নড়তে চড়তে পারিনা। শুধু মুখে প্রতাপ দেখালে তো হয়না, কাজেও করতে হয়। আর ও আড্ডা দিক পার্টি করুক কোনো কিছুই ও সীমার বাইরে গিয়ে করেনা। দায়িত্ব কর্তব্য সবটাই তো এতগুলো দিন ধরে করে যাচ্ছে। আমার অমিয়র কোনো অসুবিধে হয়নি এতগুলোদিনে।

এই পাড়াতেই আশেপাশে ওর স্কুলের দুই বন্ধুর বাড়ি। মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যায়, ওরাও আসে, আসুক। আমার ছেলে যদি রাতবিরেতে আড্ডা পার্টি ট্যুর করতে পারে তবে ছেলের বউ করলে তার জাত যাবে কেন? ও রুচিশীলা, ভদ্র, ওকে নিয়ে এসব আমি ভাবিনা। তাছাড়া ভাবার বিষয় তো কম নয়। সেগুলোই সেরে উঠতে পারিনি এখনো অবধি।

কদিন বাঁচবো দিদি। ভালোবাসা, কেয়ার যথেষ্ট পাই। এটুকু নাই বা হারালাম। তোমার তিন ছেলে মেয়েরা দেখো তোমার খোঁজটুকুও নেয়না। কি হবে বলতো এদের ওপর শাসন নিয়মের বোঝা দিয়ে। এরা এদের মতো সামলাতে জানে, তাতে বাকিদের কোনো অসুবিধে হয়না। যদি তেমন হতো জানিনা কি হতো। তবে শ্রী খুব বোঝদার, সংসার ধরে রাখতে জানে। ও প্রথম দিনই তোমার কথার ইশারা বুঝেছে, কিন্তু কিছু বলেনি। ও কষ্ট পাবে দেখে আমিই ওকে বলেছিলাম, ও যেন কিছু মনে না করে। উত্তরে ও বলেছে, আমরা বুড়োবুড়িরা এখন নাকি শিশুর মতো। শিশুরা যেমন মা বাবার কাছে প্রাধান্য পেতে চায়, ঠিক তেমন। তবে সেদিন আমার গলা জড়িয়ে বলেছিল, " তুমি আলাদা মা, সব্বার থেকে আলাদা, তাই তো তুমি আমার মা।"


বছর আটষট্টির মৃদুলা কোথায় যেন হেরে যাচ্ছে। পরিণত বুদ্ধি নিয়েও কতটা আজ নিরাপদ জীবনে?

অথচ বছর দশেকের ছোট কোলের বোনটা এক ছেলে এক ছেলের বউ নিয়ে কি সুন্দর সুখে আছে।


এর পরেও কি মনে হয়না, বুদ্ধিমতী আসলে কে?

জীবনের কোনকোন ক্ষেত্রে বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন পড়েনা। এমনি এমনি তা সুষ্ঠ ভাবেই বয়ে চলে। বরং সেখানে মন কি বাত একমাত্র ওষুধ হয়।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু