বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

প্রত্যাখ্যান




শেষবারের মত ব্লক করার আগে সৌম্যদীপ ঠাকুরের প্রোফাইলটা একবার ভালো করে দেখে নেয় ইন্দ্রানী। সৌম্যদীপ একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। প্রোফাইল জুড়ে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে স্ত্রী আর তিন বছরের মেয়ে সামিয়ানার সাথে মিষ্টি মিষ্টি হাসিখুশী ছবি৷ যদিও সৌম্যদীপ এই গত দুইমাসের ইনবক্স চ্যাটে  হাবে ভাবে কথায় বার্তায় ইন্দ্রানীকে বারবারই বুঝিয়েছে যে সে খুব সুখী নয় তার ব্যক্তিগত জীবনে।

সৌম্যদীপের স্ত্রীর নাম অনুষ্কা। ধনী তৈল ব্যবসায়ী পিতার একমাত্র আদরের কন্যা অনুষ্কার রূপ যেমন চড়া মেজাজও তথৈবচ। তার মধ্যে  স্বামীকে সবসময়ই একটা অবজ্ঞা করা আর তুচ্ছ করার প্রবণতা কাজ করে। মেয়ের সব বিষয় সেই ঠিক করে। সৌম্যদীপের সেখানে মতামত দেবার অধিকারটুকুও নেই। অসম্ভব মুখরা অনুষ্কার রুচিও নিম্নমানের। মুখের ভাষাও তেমন। সৌম্যদীপের জীবনে সে যেন প্রখর সূর্যের তেজ। সে যে সৌম্যদীপকে ভালোবাসে না তা নয়। সৌম্যদীপকে সে যত্নেও রাখে তবে একেবারেই নিজের হুকুমদারিতে। সেখানে এতটুকু স্পেস নেই সৌম্যদীপের। তাই তাকে ছাড়া সৌম্যদীপের জীবন  অন্ধকার এটা যেমন সত্যি, তেমনই মাঝে মাঝে নিজেকে তার দগ্ধ মনে হয়। আর তখন সে বড় অভাব বোধ করে চাঁদের স্নিগ্ধতার। এক এক সময় সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। শুধু পারে না কচি মেয়ের মুখ চেয়ে।

ইন্দ্রানীকে দেখে তার তেমনই স্নিগ্ধ মনে হয়েছে একথাও সে বারে বারে হাবে ভাবে বুঝিয়েছে। কতবারই তো বলেছে-" আপনার স্বামী সত্যিই খুব লাকি।" অথবা বলেছে-" কেন আগে দেখা হল না বলুন তো।" আবার কোন সময় বলেছে-" যদি আগে দেখা হত বিশ্বাস করুন চুরি করে পালাতাম আপনাকে নিয়ে।" কিম্বা " যাই বলুন, কিছু মনে করবেন না। মিঃ রায়কে আপনার সাথে  এক্কেবারে মানায় না।" 

ইন্দ্রানী চার বছর বিবাহিত৷ একটা মেয়ে হিসেবে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে খুব সহজভাবেই বুঝিয়ে দেয় সৌম্যদীপ ঠিক কি চায়। ইন্দ্রানী সেটা বোঝার পর পরই ব্লক করতে পারত সৌম্যদীপকে। এমন সে আগে করে নি তাও নয়। এমন লোকের অভাব তো নেই ফেসবুকে। এর আগেও কতই তো এমন কথা সে শুনেছে কতজনের থেকে। সেই এক বাঁধাগতের বুলি। এতটুকু তফাৎ নেই। ইন্দ্রানীর বুঝতে অসুবিধা হয় না ইনিও তাদেরই একজন। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে ক্লান্তি এলে মুখ বদলানোর জন্য ফেসবুকের সাগরে জাল ফেলা এই মানুষদের সবারই প্রায় একই গল্প। দুঃখী বিবাহিত জীবন, নিসঙ্গতা, একাকীত্ব। তারপর নতুন সম্পর্ক তৈরী বিবাহিত কোন নারীর সাথে। নিরাপদ গুপ্ত পরকীয়া। স্ব স্ব সংসারের সুখী পুরুষ ও সুখী রমনীর একটু নিষিদ্ধতার সুখভোগ। একই সঙ্গে দুই নৌকায় পা রেখে নির্দিষ্ট ছন্দে ব্যালেন্স করে চলাও একটা নব্য ফেসবুকীয় কালচার। প্রতরনাও একটা অদ্ভুত নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যুগে।

কিন্তু তবু কেন যে সৌম্যদীপ ঠাকুরকে শুরুতেই ব্লক করতে পারে নি ইন্দ্রানী..প্রোফাইলটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে চলকে উঠেছিল বুকের রক্ত। ডি.পিতে থাকা ছবিটার অন্তর্ভেদী সেই দৃষ্টি..ইন্দ্রানীকে বাধ্য করেছিল উত্তর দিতে। ইন্দ্রানীর প্রোফাইল নেম ইন্দু। আজোও মনে পরে সৌম্যদীপের সেই প্রথম কথা-" আপনার নাম আপনার চেহারার সাথে ভীষণ মানানসই। ঠিক যেন গলে পরা জোৎস্না।" দুটো দিন কোন উত্তর দেয় নি ইন্দ্রানী৷ কিন্তু বহুবার খুলে খুলে পড়েছিল ওই এক ম্যসেজটাই। তারপর তৃতীয়দিন আর নিজেকে আটকাতে পারে নি। ছোট্ট করে লিখেছিল-" থ্যাংক ইউ।" তারপরই শুরু কথোপকথন। যত দিন এগিয়েছে ইন্দ্রানী অনুভব করেছে সৌম্যদীপ একটু একটু করে দুর্বল হয়েছে তার প্রতি। আর ইন্দ্রানী...কি এক অদ্ভুত আকর্ষণে, কিসের এক লোভে সে মৃদু প্রশ্রয় দিয়ে গেছে সৌম্যদীপকে। অথচ সুযোগ অনেক ছিল সৌম্যদীপকে সমঝে দেবার। ইন্দ্রানী তো বলতেই পারত -" আপনাকে দাদাভাই বলতে পারি?" এই একটি বাক্যেই,এই একটি ইন্ডিকেশনেই সৌম্যদীপ বুঝে যেত যে ইন্দ্রানী ফ্লার্ট করতে আগ্রহী নয়। ভদ্রলোক হলে এরপর আর এগোয় না। আর তারপরেও  অভদ্রতামি করলে তো তাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য ব্লকের অপশানটা ছিলই।

কিন্তু ইন্দ্রানী তো এরকম কিছু করে নি। নিদেন পক্ষে একটা ধমকও দেয় নি। এমন কি নিরুৎসাহ ভাবও দেখায় নি। উল্টে তাকে তার কথার উত্তরে মৃদু প্রশ্রয়ই দিয়েছে। হাসির স্মাইলি পাঠিয়েছে। থ্যাংক ইউ লিখেছে প্রশংসার উত্তরে। খুব বেশী হলে লিখেছে-" কি যে বলেন।" অতএব সৌম্যদীপ উত্তোরত্তর সাহসী হয়েছে। প্রথমে ইন্দ্রানীর ফেসবুক পোস্টের প্রশংসা, তারপর ধীরে ধীরে তা থেকে রুচি, রূপ ও চেহারার প্রশংসায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। আর ইন্দ্রানী এই প্রতিটি প্রশংসায় প্রতিবার কেঁপে উঠেছে।

না নিজে থেকে ইন্দ্রানী এমন কিছু বলে নি যাতে তার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। শুধু প্রতিবাদ করে নি বা  নিরস্তও করে নি, এইটুকুই। তাই জন্যই হয়ত ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল সৌম্যদীপও। হয়ত ভেবেছিল কি চায় ইন্দু নামের এই মেয়েটা। শুধুই স্তাবকতা? কিন্তু সৌম্যদীপ যে শুধু স্তাবক হয়ে থাকতে চায় না। তার যে একটু বিশেষ হয়ে ওঠার ইচ্ছা। এই দীঘল আঁখি পল্লব, এই কোঁকড়া কৃষ্ণকেশী অপাঙ্গে চাওয়া মেয়েটির ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে যেন অনেক কথা। সৌম্যদীপের মত ছেলে কি তার বিশেষ বন্ধুত্বের যোগ্য নয়? সৌম্যদীপই বা কম কিসে। বালিগঞ্জে নিজেদের বাড়ি।পৈতৃক সম্পত্তি, নিজের কর্ম ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত সে। একটা সময় যথেষ্ট রূপবানই ছিল। এখন ভুঁড়ি আর চুলের ব্যস্তানুপাতিক ভাবে যথাক্রমে ক্রম বৃদ্ধি আর ক্রমহ্রাসতায় তা কিঞ্চিৎ ক্ষুন্ন হলেও পাতে দেওয়ার অনুপযুক্ত নয় সে। অনুষ্কাকে বিয়ে করার আগে তাকে জামাই করতে কম মেয়ের বাপ হন্যে হয়েছিল নাকি? আর ইন্দু নামের এই মেয়েটি সুন্দরী ঠিকই কিন্তু এতটাও নয় যে এত অহংকারী হবে। বিশেষ করে আজকালকার মেয়েদের ছবির অর্ধেক সৌন্দর্য পার্লারের কৃপা আর অর্ধেক বিউটি অ্যপের মহিমা এ কে না জানে। তাই অসহিষ্ণু সৌম্যদীপ অবশেষে গতকালই প্রপোজ করে বসে ইন্দুকে।বলেছিল-" তোমাকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে ইন্দু। আমাকে একটু জোৎস্না মাখতে দেবে?"

ইন্দ্রানী উত্তর করে নি। লগ আউট করে গিয়েছিল। কেন? পরকীয়াকে কি সে ঘৃণা করে? না ততটা পুরানো পন্থী সংস্কারাবদ্ধ মন তো তার নয়। দুটো এডাল্ট মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসতেই পারে এতে তো ন্যায় অন্যায়ের কিছু থাকতে পারে না। হ্যাঁ প্রতারণাকে সে ঘৃণা করে একথা ঠিক। কিন্তু শুধু তাই জন্যই কি সে লগ আউট করে গেল? গত চব্বিশ ঘন্টা তার যে বুকের ভিতর চলেছে উথাল-পাতাল ঝড়। সেই ঝড় তাকে বার বার নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলেছে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে৷ তখন সে ইন্দু রায় নয়, ছিল ইন্দ্রানী সেন।

কোমর ছাড়ানো লম্বা চুল, মুখে অল্প ব্রণের দাগ, গায়ের রঙ মাজা মাজা। সাইকোলজি নিয়ে অনার্স গ্রাজুয়েট। বাবা বিয়ের সম্বন্ধ দেখছিলেন। অনেক ছবিই হাতে আসছিল। বাতিলও হচ্ছিল। পাত্রপক্ষের সামনে মাঝে মধ্যেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসতে হচ্ছিল ইন্দ্রানীকে অধোবদন হয়ে। সেই রকম সময়ই এসেছিল ছবিটা। সৌম্যদীপ ঠাকুরের ছবি। ডি.পির মতই সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। কেন জানি না এক দেখাতেই বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর সৌম্যদীপের ছবিটা। যদিও মুখে সে কথা কাউকে সে বলে নি। তবে যেদিন পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল সেদিন বিরক্তি নয় একটু বরং যত্ন করেই সেজেছিল সে। সৌম্যদীপের অবশ্য সেদিন আসা হয় নি। ওঁর বাবা মা আর মামা এসেছিলেন। বাবা প্রতিবারের মতই মিষ্টির থালা সাজিয়ে দিয়েছিলেন। ওনারা টুকটাক কিছু প্রশ্ন করে পরে জানাবেন বলে চলে গিয়েছিলেন। " পরে জানাচ্ছি" শব্দটা সম্বন্ধের ক্ষেত্রে বেশ নেতিবাচক। তাই বাবা আবারও মুসড়ে পরেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ওরা বেশ কিছুদিন পর সত্যিই জানিয়েছিলেন। প্রায় মাস খানেক পর। বাবা তো অবাক। ওনারা বলেছিলেন মাঝে মল মাস পরেছিল বলে ওনারা কথা বলেন নি। ওদের মেয়ে অপছন্দ নয়। যদিও গায়ের রঙ একটু চাপা। তবুও মেয়ের চুলের যা ঢল তা পাত্রের মা'কে মুগ্ধ করেছে। তাছাড়া পরিবারের মানুষদের ব্যবহারও তাদের ভালো লেগেছে। ইন্দ্রানীর বাবা চাইলে তারা কথা এগোতে পারেন। ইন্দ্রানীর বাবার চাওয়াটাই তখন মেয়েকে সুপাত্রস্থ করা। তার আপত্তির কি বা থাকতে পারে। তাই অবশেষে সৌম্যদীপ ওর এক দাদাশ্রেনীর বন্ধুকে নিয়ে একদিন অফিস ফেরত এসেছিল দেখতে। সেদিনও ইন্দ্রানী আবার নিজেকে সাজিয়ে বসেছিল সৌম্যদীপের সামনে। সেদিনও ইন্দ্রানীর বাবা প্লেট সাজিয়ে দিয়েছিলেন ওদের সামনে। সৌম্যদীপ টুকটাক দুএকটা মামুলি প্রশ্ন করেছিল। অধোবদন ইন্দ্রানী জড়তাহীন সাবলীল কিন্তু নরম গলায় উত্তর দিয়েছিল। সৌম্যদীপকে নানান প্রশ্ন করেছিলেন ইন্দ্রানীর জামাইবাবু। কান পেতে সে উত্তর শুনেছিল ইন্দ্রানী। বুঝতে পেরেছিল প্রকৃত আধুনিক উদার মানসিকতার একজন মানুষ সৌম্যদীপ। মেয়েদের সম্পর্কে তার ধ্যান ধারণাই অন্যরকম। নারী পুরুষকে সে সমান স্থান দেয় তার জীবনে। বিয়ে তার কাছে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া আর বিশ্বাস ভালোবাসার উপর গড়ে ওঠা এক পবিত্র প্রতিষ্ঠান।

সৌম্যদীপ বাড়ি গিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল বিয়েতে। আর ইন্দ্রানী? সৌম্যদীপের অফিস ফেরত সেই ক্লান্ত অথচ দীপ্ত মুখটা ভুলতেই পারছিল না। লুকিয়ে সে যে কতবার ওই মুখের ছবি দেখত তার ইয়ত্তা নেই। উচ্চারণ করত নিজের নামটা " ইন্দ্রানী ঠাকুর।" নিজেই লজ্জা পেত। মনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করত-" এই আমি কি ওর প্রেমে পরলাম?"

ইন্দ্রানীর দিদি জামাইবাবু বলেছিল আজকাল বিয়ে ঠিক হলে তো ছেলে মেয়ে একদিন অন্তত বাড়ির বাইরে কোন রেস্তোরাঁয় দেখা করে নিজেদের মধ্যে কথাটথা বলে নেয়। দুজনের সঙ্গেই না হয় বড় দাদা দিদি কেউ থাকবে। কিন্তু ইন্দ্রানীর বাবা পুরানো পন্থী ভীষণ কনজার্ভেটিভ। তিনি রাজী হন নি। ও তরফেও তেমন কোন তাগিদ ছিল না৷ তবু দিদির উদ্যাগেই পরস্পরের নম্বর এক্সচেঞ্জ হয়েছিল। ইন্দ্রানীর ভীষণ ইচ্ছে ছিল কথা বলার। কিন্তু সৌম্যদীপ ফোন করে নি। তাই সে মেয়ে হয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন করতে পারে নি৷ সৌম্যদীপের এই ফোন না করাটাও খুব ভালো লেগেছিল তার। ছেলেটা নিশ্চয় খুব ভদ্র আর লাজুক। এমনটাই তার মনে হয়েছিল। এর মধ্যে ইন্দ্রানীর বাবা গিয়ে দেখা করে এসেছিলেন একদিন। ওদের বাড়ি থেকে দাবীদাওয়া কিছু করে নি তেমন। তবে ছেলের একটা চারচাকার শখ একথাটা নাকি কথায় কথায় বলেছেন সৌম্য'র মা। আর কিছু চাইছেন না বলে বাবা তাতেই রাজী হয়েছেন।

ভীষণ খারাপ লেগেছিল ইন্দ্রানীর এটা। মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল -"সৌম্যদীপবাবুও ছিলেন। উনিও বললেন? " বাবা ব্যঙ্কের লোন এপ্লিকেশনের ফর্মটা ভরতে ভরতে বললেন -" না সৌম্যদীপ ডিব্রুগড় গেছে৷ কি একটা কাজে। " ইন্দ্রানীর মনে হয়েছিল সৌম্যদীপ থাকলে নিশ্চয় প্রতিবাদ করত। সৌম্যদীপের ইন্দ্রানীকে দেখতে আসার দিনের কথাগুলো শুনে এটুকু অন্তত সে বুঝতে পেরেছিল। সে আর যাই হোক বিয়ে নিয়ে ব্যবসা করার মানুষ নয়।

ইন্দ্রানী জানে তার বাবার সামর্থ্য কতটা। বিয়ের খরচ করে চারচাকার এই দাবী বাবা হয়ত মেটাতে পারবেন ঠিকই। কিন্তু তারপর তার নিজের বৃদ্ধবয়েসের সঞ্চয়ের ভাঁড়ার ঠেকবে তলানিতে। না ইন্দ্রানী এভাবে কখনই বিয়ে করতে পারবে না। সে তো বরং স্বপ্ন দেখে চাকরী করে তার পরিবার তার বাবার পাশে অবলম্বন হয়ে দাঁড়ানোর। তাই একদিন সে সেই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে। বাড়ি থেকে দোকানে যাবার নাম করে ফোন করে সৌম্যজিতের মোবাইলে। সৌম্যজিত সম্ভবত দূর স্বপ্নেও ভাবে নি যে ইন্দ্রানীর মত লাজুক কনজার্ভেটিভ ফ্যামিলির মেয়ে এভাবে লুকিয়ে তাকে নিজে থেকে ফোন করতে পারে। ইন্দ্রানী নিজেই কি ভেবেছিল। লজ্জা সংকোচ জড়তা কাটিয়ে অবশেষে ইন্দ্রানী বলে-" আমি যে আপনাকে ফোন করছি এ কথা আমার বাড়িতে জানে না। কিন্তু সেদিন আপনার কথা শুনে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে আপনি তেমন মানুষ নন। তাই জন্যই সাহসে ভর করে এই ফোন করতে পেরেছি। একটা মস্ত ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে জানেন। আপনার মা খুব সাধারণ ভাবে কথায় কথায় আপনার গাড়ির শখের কথা গল্প করেছিলেন। আমার বাবা সেটাকে আপনাদের দাবী ভেবে ভুল করে লোনের বন্দোবস্ত করছেন। আমি জানি বিয়ে আপনার কাছে লেনদেনের বিষয় নয়। তাই এটা নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝি। আপনি যদি এই ভুলটা ভাঙিয়ে দেন তবে বড় ভালো হয়।"

সৌম্যদীপ চুপ করে ছিল অপর প্রান্তে। তারপর বলেছিল -" আচ্ছা আমি দেখছি।"

ইন্দ্রানী এরপর দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করেছিল ও তরফের ফোনের৷ পাঁচ দিনের মাথায় ফোন এসেছিল। না ভুল ভাঙানোর ফোন নয়। প্রত্যাখানের ফোন। ওরা সম্বন্ধ নাকচ করেছিল। বাবার মাথায় হাত। এতদূর কথা এগিয়ে কেন এই প্রত্যাখ্যান? বিস্মিত ইন্দ্রানী শুনেছিল সৌম্যদীপ নাকি জানিয়েছে পরিবারের চাপে সম্বন্ধে সে রাজী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ইন্দ্রানীর মত মেয়ে তার ঠিক পছন্দ নয়। সে একটু স্মার্ট, সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের মেয়ে পছন্দ করে। ইন্দ্রানীকে তার নিস্প্রভ মনে হয়েছে। তাছাড়া ইন্দ্রানীর সাথে তার মানসিকতারও মিল হবে না। সম্পর্ক সমানে সমানে হয়। তাই এই বিয়ে সে করতে চায় না।

স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানী। বুঝতে অসুবিধা হয় নি সৌম্যদীপ কেন হঠাৎ করে এই সম্পর্ক নাকচ করেছে।

একদিকে শান্তিই পেয়েছিল ইন্দ্রানী এক মুখোশধারী লোভীর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে। কিন্তু কোথায় তার আত্মসম্মানে আঘাতও লেগেছিল। এ আঘাত সম্পর্ক ভাঙার জন্য নয়। এ আঘাত সৌম্যদীপের দেখানো সম্বন্ধ ভাঙার কারণের জন্য। একটা হীনমন্যতা নিয়ে আয়নার সামনে সেদিন দাঁড়িয়েছিল ইন্দ্রানী। ঠিক যেমন আজ দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে সে। খুব কি কিছু বদলেছে সত্যিই? হ্যাঁ কোমর ছাড়ানো চুল এখন ঘাড় অবধি কার্ল করা। সিঁথিতে একটা হালকা লাল রেখা। আর প্রসাধনের গুণে মুখের ব্রণের দাগগুলো তত বোঝা যায় না।  তাই জন্যই হয়ত সৌম্যদীপ চিনে উঠতে পারে নি। তাছাড়া বিয়ের বাজারে নিলামে ওঠা সৌম্যদীপের জীবনে এমন কত প্রত্যাখ্যান জমা হয়ে আছে কে জানে। সেই ভীড়ে ইন্দ্রানীকে  একখানা ছবি আর একবারের চাক্ষুস দেখায় মনে না রাখাই স্বাভাবিক। আর ইন্দ্রানী সেন যে এখন ইন্দু রায়। তাই নাম দেখেও ধোকা খেয়েছে বেচারা। তাই একদা নিস্প্রভ মেয়েটাকে আজ তার মনে হয়েছে জ্যোৎস্না। ইন্দ্রানীও হয়ত চিনতে পারত না। যদি না ওই চেনা নামের সাথে বিশেষ পদবীটা মিলে যেত।

স্মার্ট ফোনটা আবার হাতে তুলে নেয় ইন্দু রায়। ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে লেখে -" আপনার বোধহয় একটু ভুল হচ্ছে। বন্ধুত্বকে আপনি একটু বেশীই কিছু ভেবে ফেলেছেন। আপনার মানসিকতা ঠিক আমার সাথে খাপ খায় না। এই নিস্প্রভ গতানুগতিক চিন্তাধারা যেখানে একজন নারী আর একজন পুরুষের সম্পর্ক শুধু বাঁধাগতেই এগোয় তা আমি স্বীকার করি না। আমি মনে করি বন্ধুত্বই বলুন বা সম্পর্ক, তা সমানে সমানে হয়। না হলে এক পক্ষ অন্যকে শুধুই করুণা করে যায়। তাই বিদায় নিলাম। ভালো থাকবেন।"

ব্লক করে ইন্দ্রানী সৌম্যদীপকে। এতদিনের এত অপেক্ষার আজ অবসান হয়েছে ইন্দ্রানীর। প্রত্যাখ্যানে পেরেছে সে ফিরিয়ে দিতে তার সেদিনের সেই অপমানের উত্তর।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু