বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

তোমার আমার সংসার

পিয়ালি আর মিতালির সম্পর্কটা ঠিক তিক্ত না মধুর তা আজও কেউ ঠাওর করতে পারলো না।সবসময় 'তু তু-ম্যায় ম্যায়' অবস্থা।দুজনের জন্য মিত্র বাড়িতে কাক পযর্ন্ত বসতে পারে না।আশে-পাশের লোকজনরাও অস্থির হয়ে পড়ে বউমা-শাশুড়ির চেঁচামেচিতে।পিয়ালির স্বামী সুজয়, যে কিনা এই বাড়ির একমাত্র ছেলে,সে তো সকালে অফিসে যেতে পারলে বেঁচে যায়।সকাল ১০টা নয়,ভোর বেলা থেকে রাত ১২টা পযর্ন্ত যদি অফিস আওয়ার হয়,ওর থেকে বেশী খুশি বোধ হয় আর কেউ হবে না।তাই কাজের সময় শেষ হয়ে গেলেও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় মা আর বউয়ের অশান্তির ভয়ে।মিতালির স্বামী তাপস বাবু অবসার প্রাপ্ত মানুষ।বেচারা যান কোথায়?তিনি তো আর সকাল থেকে পাড়া বেড়াতে পারেন না,তাই তাঁকেও অপেক্ষা করতে হয় বিকেলের সময়টুকুর জন্য।বিকেল হলেই তিনি আর কোনো দিকে তাকান না।সোজা পার্কে গিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।আর রইল এই বাড়ির নাতি,ছয় বছরের কুট্টু, সে স্কুলে যতক্ষণ থাকে ভালোই থাকে।অন্যান্য বাড়ির বাচ্চারা শুধু রবিবার কেন,সপ্তাহের অন্যান্য দিন গুলোতেও কখনও কখনও স্কুলে যেতে চায় না।কিন্তু কুট্টু রবিবারের সকালেও ঘুম থেকে উঠে আদো আদো কথায় বলে,মা আমি স্কুলে যাবো।ঘরে তোমার আর ঠামের চেঁচামেচিতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যায়।বুঝুন ঠেলা!এই হচ্ছে মিত্র বাড়ির বাস্তব রূপ।


পিয়ালি প্রথম থেকেই অতীব গোছানো স্বভাবের এবং  শৌখিন মেয়ে।সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ভালোবাসে,ঘরের কোথাও যেন এক টুকরো নোংরা পড়ে না থাকে।সবকিছু একদম পারফেক্ট থাকা চাই।নিজের জামা-কাপড় -শাড়ি সবকিছুর যত্ন সে রাখে।আর একটা জিনিসের প্রতি ওর খুব নেশা,সেটা হল কাঁচের বিভিন্ন ধরণের দামি দামি ডিনার সেটে রান্নাঘরের আলমারি ভর্তি করে রাখা।


পিয়ালি যতোটাই গোছানো মেয়ে,মিতালি দেবী ততোটাই অগোছালো মানুষ।পিয়ালির একদম বিপরীত স্বভাবের।ছেলের বিয়ের আগে তিনি যেমন তেমন করে সংসার চালাতেন,চলে তো যাচ্ছে,এই মনোভাব নিয়ে।কিন্তু দশ বছর আগে পিয়ালি যখন এই বাড়ির বউমা হয়ে আসে তখনই সমস্যাটা বাড়ে।পিয়ালি সব কিছুতেই তাঁর খুঁত ধরে,আর মিতালি ধরে বউমার।


"মা তোমার শাড়ি টা কতোদিন ধরে আলনায় পড়ে আছে।ধুলো পড়ে পড়ে নোংরা হয়ে গেলো।নিজেও কাচো না,আমাকেও কাচতে দাও না"।


"তোকে দেখতে হবে না,তুই তোরটা কর,আমি আমারটা দেখে নেবো।আচ্ছা বাতিকগ্রস্ত মেয়ে মানুষ বটে"।


"মা তুমি আবার তোমার এঁটো বাটিটা টিভির সামনে রেখে দিয়েছো"?


"এঁটো কোথায় রে,মুড়ি খেয়েছি মাত্র।আর ওমনি এঁটো হয়ে গেল?মাছ- মাংস তো আর রাখিনি"?


"দু'দিন পর তাই রাখবে"।


"বেশ করবো রাখবো,আমার বাড়ি,যেখানে ইচ্ছে রাখবো,তোর কী"?


"হ্যাঁ ওই বাড়ি ধুয়েই জল খাও তুমি।কাজের কোনো ছিড়িছাদ নেই"।এইভাবেই দুজন দুজনের পিছনে লেগে পড়ে  সংসার চলছে তার আপন গতিতে।


তবে মিতালির একটা ব্যাপারে খুব যত্নশীল।তাঁর সাধের বাগানটি।এটি নিয়ে তিনি যতোটা না সময় কাটান,ঠাকুর ঘরেও তিনি ততোটা কাটান না।নিত্যদিন বিভিন্ন ধরণের চারাগাছ এনে,মাটি কুপিয়ে,সার এনে তিনি  যত্নসহকারে এবং পরম মমতায় সারাদিন ধরে সেগুলি নিজের হাতে রোপণ করেন। পিয়ালির আবার ঠাকুরে খুব ভক্তি।সকালে উঠে স্নান সেরে আগে ঠাকুরের পুজো করবে,তারপর বাকী সব কাজ।শুধু মাসিকের দিনগুলোতে সে খুব সমস্যায় পড়ে যায়।তখন বাধ্য হয়েই মিতালিকে পুজোটা করতে হয়।কিন্তু সেখানেও তিনি গন্ডোগোল করে ফেলেন,ঠাকুরের কোনো থালায় নকুল দানা পড়ে,কোনোটায় পড়ে না।কোনো গ্লাসে জল দেন তো কোনো গ্লাস ফাঁকা।মাসিক শেষ হওয়ার পর পিয়ালি ঠাকুর ঘরে এলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে।"মা একটা কাজও কী তুমি ঠিক করে করতে পারো না?দেখো কী করেছো?ঠাকুরকে ঠিক করে খেতেই দাও নি"।মিতালিও বাইরে থেকে চিৎকার করেন,"যখন সব কাজেই আমার ভুল দেখো,নিজেই তো করতে পারো মা।কে তোমায় দিব্যি দিয়েছে,শরীর খারাপ হলে পুজো দিতে না?আজকাল এইসব কেউ মানে না।ঠাকুরেরও হয়,বুঝলে?মনে ভক্তি থাকলেই সব কাজ করা যায়"।পিয়ালি ও দমবার পাত্রী নয়।সেও চিৎকার করতে থাকে",কিছু কিছু নিয়ম মানতে হয় মা।আর তোমার মনে কতো ভক্তি আছে,সে আমার ভালো করেই জানা আছে।কোথায় এই বয়সে ঠাকুরের নাম-গান করবে তা না,বাগান নিয়ে পড়ে আছে সারাদিন,যত্তসব"।"বেশ করি,বাগান নিয়ে পড়ে থাকি।তোমার মতো পাশের বাড়ির বউদের সাথে পরনিন্দা - পরচর্চা তো আর করতে যাই না"? "তোমাকে কে বলেছে আমি এসব করি?বরং ওরাই বলে,তোমার শাশুড়ি মায়ের সংসারে মন নেই।তাই কোনো কাজই তিনি ঠিকমতো পারেন না,শুধু তোমার পিছনে লাগা ছাড়া"। "কে বলে শুনি?নামটা বল দেখি,তার পিন্ডিটা চটকে আসবো আমি"। "আমার পিন্ডি চটকাচ্ছো,এটাই যথেষ্ট নয় কি?আবার লোকের পিছনে লাগতে যাচ্ছো"?আর কথা না বাড়িয়ে ঠাকুরের দিকে মন দিলো পিয়ালি।কিন্তু পুজো করতে গিয়ে,বিশাল একটা বিপদে পড়লো সে,আজ বাজার থেকে ঠাকুরের ফুল আনা হয়নি।একদম মনে ছিলো না।কী হবে এবার?ফুল ছাড়া পুজো অসম্ভব তার কাছে।এবার একটাই রাস্তা।সেটা ভেবে নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে পিয়ালির।এখন শাশুড়ি মায়ের পায়ে পড়তে হবে।অর্থাৎ ওনার বাগানের ফুল নিতে হবে।যেটা মিতালির একেবারে অপছন্দ।গাছ থেকে ফুল ছেঁড়া তিনি পছন্দ করেন না।মাটিতে পড়ে থাকা ফুল তিনি দিতে পারেন,কিন্তু গাছ থেকে তুলে নয়।এতে নাকি গাছের ব্যাথা লাগে।যতোসব পাগলামি।একবার ঘর সাজাবার জন্য পিয়ালি শাশুড়ি মাকে না জানিয়ে বাগান থেকে রজনীগন্ধার কয়েকটা স্টিক কেটে নিয়ে, ফুলদানিতে রেখেছিলো।ব্যাস যায় কোথায়,মিতালি কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন।"তোর এত বড়ো সাহস,তুই আমার বাগান থেকে ফুল তুলে নিয়েছিস?তোর যদি ঘর সাজাবার এতোই শখ হয়,বাজার থেকে কিনে আনতে পারলি না?এখন যদি তোর হাতটা কেউ কেটে দেয়,তোর কেমন লাগবে?ব্যাথা হবে তো?গাছেরও ব্যাথা হয় বুঝলি?আর কোনোও দিন যদি দেখি,তুই আমার গাছে হাত দিয়েছিস,তো তোর একদিন কী আমার একদিন।এই বলে দিলুম"।সেই কথাটা মনে পড়তেই মিয়ালির সর্বঅঙ্গ জ্বলে গেল। কিন্তু  উপায়ও নেই।তাই মেকী হাসি নিয়ে মিতালির কাছে উপস্থিত হলো।"মা,বলছিলাম কিনা,ঠাকুর পুজোটা তুমি ভালোই কর,ওই একটু আধটু এদিক-ওদিক হয়ে যায়।সে আর কী এমন বড়ো ব্যাপার বলো?হতেই তো পারে তাই না"? "কি ব্যাপার বলতো পিয়া,সুরটা হঠাৎ বদলে ফেললি?ধান্দা আছে কিছু  নাকি?আমি বাপু আজ রান্না করতে পারবো না।বেলার দিকে বেরিয়ে কয়েকটা চারাগাছ আনবো ভাবছি।আজ তুই রান্নাটা করিস।কাল আবার আমি করবো না হয়"।


"হ্যাঁ হ্যাঁ কোনো ব্যাপার না।সে আমি করে নেবো।কিন্তু এখন একটা জিনিস চাই তোমার কাছে।না মানে আজ ঠাকুরের ফুল আনা হয়নি।তাই তোমার বাগানের কয়েকটা.." 


"ফুল চাই।তাই তো?এই একটু আগেই না আমার বাগান নিয়ে কতো কথা বলছিলি?দেখলি সেই বাগানের ফুলই তোর প্রয়োজন পড়লো।যা যা বেশী নিবি না,দু-চারটে নিবি।আর হ্যাঁ,খুব আস্তে আস্তে তুলবি।যেন ব্যাথা না পায়"।মিতালির কথায় পিয়ালির গা টা রাগে চিড়বিড় করে উঠলো।মনে মনে ভাবলো,"বিপদে পড়েছি,তাই তোমার কাছে আসা,নাতো তোমার কাছে হাত পাততে আমার বয়েই গেলো"।


মিতালি আজ বড্ড খুশি।তাঁর বউমা তাঁকে কতো অনুনয় বিনয় করে কথা বলতে বাধ্য হয়ছে।কিন্তু একটু পরেই মিতালির সব মজা মাথায় উঠলো রান্নাঘর থেকে পিয়ালির চিৎকার শুনে।


"মা এদিকে একটু শোনো?কী করেছো তুমি দেখো"?


"আমি আবার কী করলাম"?


"কী করলাম মানে?ফ্রিজে কবেকার পেঁয়াজ পড়ে আছে দেখো।আমাকেও বলোনি।তাহলে তো আমি নষ্ট হতে দিতাম না।কিছু একটা করে নিতাম।এখন পেঁয়াজের কতো দাম জানো?নষ্ট হলে গায়ে লাগে মা।তুমি এমনই করো রান্না করতে গেলে।একটু একটু করে সব্জিগুলো রেখে দেবে,পরে নিজেও ভুলে যাও আর আমাকেও বলো না।এখন ফ্রিজটা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখলাম।এগুলো ঠিক না মা"।


"ভুলে গেলে কী করবো?তুই রোজ দেখে নিবি রান্না করার সময়"।মিতালি আর দাঁড়ালেন না।পিয়ালিও মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলো।কোনো জিনিস অপচয় করা তারা পছন্দ নয়।


"আজ সন্ধ্যেবেলা পিয়ালিদের একটা অনুষ্ঠান বাড়ি ছিলো।পিয়ালি সকাল থেকে শাশুড়িমাকে বলে চলেছে,"তুমি রাত্রে যে শাড়িটা পরবে সেটা গুছিয়ে  রাখো।ব্লাউজ খুঁজে রাখো।তোমার কোনো জিনিস ঠিক জায়গায় থাকে না।একটা এদিকে তো আরেকটা অন্যদিকে পড়ে থাকে।শাড়িটাও যেমন-তেমন করে রাখা থাকে আলমারিতে।আলমারিটার এমন অবস্থা করে রাখো,যে গরু হারালেও সেটা পাওয়া যাবে না। নিজেও কোনোদিন গোছাও না,আমাকেও গোছাতে দাও না।কুচকে-মুচকে ফেলে রাখো দামি দামি শাড়ি গুলো।বাবার জিনিস গুলো আমিই যত্ন করে রাখি বলে সেটা অন্তত ঠিকঠাক জায়গায় থাকে"।কিন্তু মিতালি দেবীর ওদিকে খেয়াল নেই।তিনি দিব্যি গাছ লাগানো নিয়ে ব্যস্ত।পরে করবো-পরে করবো বলে কাটিয়ে দিলেন সারা সন্ধ্যে।রাত আটটায় যখন পিয়ালি তার স্বামী ও ছেলেকে রেডি করে মিতালির ঘরে গেলো ওনারা রেডি হয়েছেন কিনা জানতে,তখন দেখে মিতালি দেবী পায়ের উপর পা তুলে বই পড়ছেন।পিয়ালি বললো,"মা যাবে না?তৈরী হও নি কেন"? "এই তো হচ্ছি।তুই যা, আমরা তৈরি হয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে আসছি"।পিয়ালি বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। এদিকে আধা ঘন্টা হয়ে গেছে তবুও শাশুড়ি মাতার পাত্তা নেই।তিনি তখনও ব্লাউজ খুঁজে যাচ্ছেন।পিয়ালি ঘরে গিয়ে দেখে খাটের উপর দুমড়ানো-মুচড়ানো একটা শাড়ি পড়ে আছে।পাশে আইরনটা অন করা,এবার সেটি কতদূর গরম হয়েছে জানা নেই,কিন্তু  পিয়ালির মাথাটা যথেষ্টই গরম হয়েছে।"তোমাকে যে সকাল থেকে বললাম সব গুছিয়ে রাখো,রাখো নি কেন?এখন ৯টা বাজে।তুমি শাড়ি আইরন করে তারপর বিয়ে বাড়ি যাবে?অনেক দেরী হয়ে যাবে মা?আমি আমার একটা শাড়ি দিচ্ছি,ওটা পরে নাও"।


"না,আমি তোর ঐ রংচঙা শাড়ি পরবো না।আমারটাই পরবো।তোদের দেরী হলে তোরা চলে যা"।


"বেশ তো কাউকেই যেতে হবে না।সবাই ঘরে থাকবে।এবার খুশী তো মা"?পিয়ালি রাগ করে নিজের ঘরে গিয়ে শাড়ি-সাজ সব খুলে ফেললো।বাড়ির দুই পুরুষ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।এই পরিবারে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম নয়,কর্ত্রীর ইচ্ছেয় কর্ম হয়।শুধু কুট্টুটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়লো।বাড়ির সকলেই না খেয়ে যে যার ঘরে পেটে গামছা বেঁধে শুয়ে রইলো।সকালে আবার নতুন দিন শুরু হলো।কিন্তু মিতালি আর পিয়ালি দুজনেরই মুখ থমথমে।কেউ কার সাথে কথা বলছে না।পিয়ালি সকালে উঠে ওর মতো কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে।আর মিতালি দেবীও তাই,তিনি যথারীতি বাগান নিয়ে আছেন।কুট্টুর আজ স্কুল ছুটি।সারা ঘর দাপিয়ে বেরাচ্ছিলো।এখন ঠাম্মির পিছন পিছন বাগানে দৌড়েছে।পিয়ালি রান্নাঘরে নিজের কাজে ব্যস্ত  ছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই ছেলের কান্নার আওয়াজে বাইরে এলো।এসে দেখে কুট্টুর হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে।আর মিতালি দেবী দৌড়েছেন ফাস্টেডের জিনিস আনতে।কুট্টুর কথায় যতটুকু বোঝা গেলো তা হল, ঠাম বাগানের কাজে ব্যস্ত ছিলেন,আর কুট্টু গোলাপ গাছ থেকে একটি গোলাপ তুলতে গিয়ে হাতে অনেকগুলো কাঁটা ফুটিয়েছে।আর সেখান থেকেই রক্ত পড়ছে।পিয়ালির কাল রাত থেকেই মাথাটা গরম ছিলো।আজ আবার সকাল সকাল এই কান্ড।তাই সে কোনো কথা না বলে সোজা বাগানে গিয়ে সব গোলাপ গাছগুলি মাটি থেকে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। মিতালি দেবী পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে সব দেখলেন নিজের চোখে।এত শখ করে লাগানো গাছগুলোর এই করুন অবস্থা দেখে তিনি নিজেই শকড্ হয়ে গেলেন।পিয়ালি ততক্ষণে ছেলেকে ভুলিয়ে -ভালিয়ে ওষুধ লাগাতে ব্যস্ত।হঠাৎ করেই রান্নাঘর থেকে বিকট কতগুলো আওয়াজ শুনে পিয়ালি সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে যায়।তার শাশুড়িমা রান্নাঘরের আলমারি থেকে পিয়ালির সাধের জমানো কাঁচের ডিনার সেটগুলি একটা একটা করে বের করছেন আর মাটিতে আছড়ে ফেলছেন।পাঁচমিনিট পর সবকটি জিনিস সযত্নে ভাঙার পর তিনি ক্ষান্ত হন।পিয়ালি একটি কথাও বললো না।চুপচাপ ঘরে গিয়ে নিজের আর কুট্টুর জামা-কাপড়গুলো ব্যাগে গুছিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা হলো।মিতালি চুপ করে বসে পিয়ালির চলে যাওয়া দেখলেন,বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করলেন না।সন্ধ্যেবেলা ছেলে বাড়ি এসে মিতালিকে আর বাবাকে ডেকে বললো,পিয়ালি বাপের বাড়ি পৌঁছোনোর পর স্বামীকে ফোন করে সবটাই জানিয়েছে।আর এও জানিয়েছে পিয়ালি আর একসাথে থাকতে চায় না।তাই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং যতদিন না নতুন বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন পিয়ালি বাপের বাড়িতেই থাকবে।পরে এসে ওদের বাকী জিনিসগুলো নিয়ে যাবে।মিতালির ছেলেরও এ ব্যাপারে কিছু করার নেই।সেও চায় এভাবে একসাথে থেকে রোজ রোজ অশান্তির চেয়ে,আলাদা হয়ে শান্তিতে থাকাই ভালো।মিতালির স্বামীরও একমত।তিনিও বাড়িতে শান্তি চান।তাতে কোনো আপত্তি নেই ওনার।শুধু মিতালিই থম মেরে সোফার উপর বসে রইলেন।কোনো কথা আজ তাঁর মুখ দিয়ে বেরোলো না।শুধু আজকের পর থেকে তিনি আর তাঁর সাধের বাগানে পা রাখলেন না।বাগানের গাছগুলো মরলো কী বাঁচলো,সেটা দেখারও আর ইচ্ছে হয় না তাঁর।নিঃশব্দে সংসারের কাজ করেন,তাও আবার গুছিয়ে।আর তিনি এঁটো বাসন এদিক - ওদিক ফেলে রাখেন না।প্রতিটি দুপূরে একটু একটু করে জামা-কাপড়ের আলমারিটা গুছিয়ে রাখেন।কুচকে যাওয়া শাড়িগুলি,রোজ একটি একটি করে আইরন দ্বারা টান টান করে, অত্যন্ত যত্ন সহকারে আলমারিতে তুলে রাখেন।বারান্দার আলনাটাতে রাখা শাড়িগুলোতে আর ধুলো পড়তে দেন না মিতালি।তার আগেই ধোওয়া হয়ে যায়।ঠাকুরও এখন নিয়মিত পুজো পান,নকুলদানা পান।প্রতিটি গেলাসে জল থাকে।সবই বদলে ফেললেন তিনি এই কয়েকটা দিনে। এদিকে পিয়ালিরও এখন প্রতিটি জিনিস নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজন হয় না।কোনোরকম কাজ চলে গেলেই হলো।এখন নিজের জামা-কাপড়গুলোও দিনের পর দিন বাইরে পড়ে থাকে,আলমারিতে আর যত্নের সাথে স্থান পায়না ওরা।রান্নাঘরের আলমারিটাও ফাঁকা।কোনো কাঁচের জিনিস নেই সেখানে।ঠাকুরঘরেও  আর মন বসে না পিয়ালির।মন যে তার শ্বশুর  ঘরে একজনের কাছে বাঁধা হয়ে পড়ে আছে।দশ বছরে গড়ে ওঠা শত্রু নামক  ভালোবাসার টানকে কী এত সহজে ভুলে  থাকা যায়?


"শুনছো,আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারবে"?মিতালির কথায় ওনার স্বামী একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন,"এত টাকা নিয়ে তুমি কী করবে?মানে তুমিতো কোনোদিনও এতটাকা চাওনা,তাই জিজ্ঞেস করলাম।ও বুঝেছি,আবার বাগানটাকে নতুন করে সাজাবে তাই তো?খুব ভালো কথা।চলো আমিও তোমার সাথে যাই"। 


"না না,তোমাকে যেতে হবে না।আমি নিজেই যেতে পারবো।তবে আমার আসতে একটু বেলা হয়ে যাবে।তুমি খেয়ে নিও"।এই বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।বিকেল পাঁচটার সময় একটা ট্যাক্সিভর্তি জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।গাড়ি থেকে প্রতিটি জিনিস বার করে, গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে ঘরে ঢুকতেই তাঁর নাতি কুট্টু তাঁকে জড়িয়ে ধরলো।মিতালি নাতিকে এতদিন পর দেখে খুশীতে কেঁদেই ফেললেন।


"ঠাম ঠাম একটা জিনিস দেখবে এসো,তাড়াতাড়ি এসো"।কুট্টু মিতালিকে নিয়ে বাগানে যায়।বাগানটা দেখে মিতালি অবাক হয়ে যায়।ছোট্টো বাগানটা ছোটো ছোটো গোলাপ চারায় ভর্তি।বোঝাই যাচ্ছে,কেউ অত্যন্ত যত্ন সহকারে একটু আগেই চারাগাছগুলি লাগিয়েছে।মিতালি চোখের জল মুছে কুট্টুকে জিজ্ঞেস করে,তোমার মা কোথায় দাদুভাই"?ততক্ষণে পিয়ালি শাশুড়ি মায়ের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।


"আমায় ক্ষমা করে দাও মা,সেইদিন ওভাবে তোমার নিজের হাতে সাজানো বাগান নষ্ট করা উচিৎ হয়নি আমার"।মিতালি বউমার চোখের জল মুছে দিয়ে পিয়ালির হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে যায়।যেখানে একটু আগে আনা জিনিসগুলো রাখা আছে।


"নে,এবার তোর জিনিসগুলো গুছিয়ে তুলে রাখ তোর আলমারিতে"।পিয়ালি প্যাকেটগুলো খুলে দেখে কয়েকটা সুন্দর সুন্দর কাঁচের ডিনার সেট।"এটা কী করেছো মা?এতগুলো ডিনার সেট"?পিয়ালি আনন্দে মা কে জড়িয়ে ধরে।মিতালিও পিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন,"তুই বউমা থেকে মেয়ে হলি আমার,আর আমি শাশুড়ি থেকে মা হতে পারবো না তোর"? মা-মেয়ের এত মিল দেখে দুজনের স্বামীই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।"যাক বাবা,কাল থেকে ঘরে শান্তিই শান্তি।কোনো চিৎকার চেঁচামেচি না"।কিন্তু আরেকজন মানে আমাদের সৃষ্টিকর্তা, যিনি সবকিছুর মূলে রয়েছেন,উপর থেকে হেসে হেসে বললেন,"সে গুড়ে বালি"।


পরের দিন সকালে..


"মা..তুমি বাগানের গাছগুলোতে জল দাও নি কেন?গাছগুলো মরে যাবে তো?এত কষ্ট করে লাগালাম?তুমি কি কোনোদিন শুধরোবে না ঠিক করেছো"?


"পিয়া..কাল থেকে এখানেই জামা-কাপড়ের ব্যাগটা ফেলে রেখেছিস?ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়নি নাকি?আর সকালে জল খেয়েছিস,এঁটো গ্লাসটা দাদুভাইয়ের টেবিলে রেখে দিয়েছিস?এরপর এঁটো থালা-বাটি সব রাখবি"?


পাশের বাড়ির লোকজন-"বউটা কয়েকদিন বাড়িতে ছিলো না,একটু শান্তিতে ছিলাম।যেই বউটা বাড়ি ফিরে এলো,ওমনি মহাভারত শুরু হয়ে গেল।এবার তো দেখছি আমাদেরই বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে"।


আর মিত্র বাড়ির  দুই সহনশীল পুরুষ? তাদের কষ্টের কথা আর নাই বা বললাম?


সমাপ্ত।



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু