বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মুখোশ

অমলের ঝুলন্ত মৃতদেহটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে রয়েছে বিশাখা।পাশে স্থবিরের মতো বসে বিশাখার দুই মেয়ে,নেহা আর মেঘা।নেহার বয়স এখন তেরো।বাবার খুব আদুরে মেয়ে।রাজ্যের গল্প শুধু বাবার সাথেই শেয়ার করতো নেহা।স্কুলের কোন ছেলেটা তাকে প্রপোজ করলো,কোচিং ক্লাসের কোন্ ছেলেটাকে নেহার ভালো লাগে সব যদি সে বাবাকে না বলতে পারতো,তবে যেন ওর পেটের ভাতই হজম হতো না।শুধু কি তাই?কোন্ ড্রেসটা ওকে মানাবে,কোন খাবারটা খেলে ওর ওয়েট পুট অন করবে না,সবকিছু বাপের সাথেই আলোচনা হতো।


আর অমলও তেমন,মেয়ের এই ছোটোখাটো আবেদনগুলো খুব নিপুণ হস্তে পূরণ করতো,উপভোগ করতো পিতৃত্বের পবিত্র সম্পর্কটিকে।


কিন্তু মেঘা ছিলো মায়ের ভক্ত।যতক্ষণ ঘরে থাকবে,বিশাখার পিছন পিছন ঘুরবে।এক সেকেন্ড বিশাখাকে ছেড়ে থাকতে চায় না মেয়েটা।তাই ও বিশ্বাস করতো, মা যদি ওর কাছে থাকে,তবে দুনিয়ার কাউকে ওর প্রয়োজন পড়বে না।মেঘা,নেহার থেকে প্রায় দেড় বছরের বড়ো।বয়সের ব্যবধান কম হলেও দুজনের স্বভাবের পার্থক্য ছিলো বিস্তর।নেহা যতোটাই প্রাণচঞ্চল মেয়ে,মেঘা ততোটাই শান্ত এবং স্বল্পভাষী।তা সত্বেও দুই বোনের মধ্যে ভালোবাসার টানের কোনো খামতি ছিলো না।বিশেষ করে নেহা তো খুবই ভালোবাসে তার দিদিকে।


তবে কী এমন হলো এই চারজনের সংসারে,যে এত বড়ো একটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো?


পুলিশ এখনও আসেনি অমলের লাশটি নিতে।তবে বার বার বলে দিয়েছেন,যতক্ষণ না ওনারা আসছেন,ততক্ষণ যেন কেউ যেন কোনো কিছুতে হাত না দেয়।ঘরটিতে লোকজন ভর্তি হওয়ায় বিশাখার প্রচণ্ড দমবন্ধ লাগছে।তার উপর পাড়ার লোকদের গুঞ্জন তো রয়েইছে।


"কী হলো তো বলো দিদি?এই তো কয়েকমাস হয়েছে ভদ্রলোক, দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের পাড়ায় এলেন।বেশ ভালো লোক ছিলেন কিন্তু।আমার কর্তার সাথে দেখা হলেই নিজে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন।আমার মেয়েটার সাথেও কতো গল্প করতো।'কখন স্কুল থেকে ফিরলি?এখন কী করবি?আমার ঘরে আমার মেয়ে আছে,সময় করে এসে দেখা করে যাস'।সবসময় হাসি লেগেই থাকতো ভদ্রলোকের মুখে"।


"হ্যাঁ গো,একদম ঠিক কথা।আমার সাথেও তো কতোবার দেখা হয়েছে ওই রামের দোকানে জিনিস কিনতে গিয়ে।উনিই সবসময় আগে কথা বলতেন।আমাকে বৌদি বলেই ডাকতেন।কতোবার বলেছেন ওনাদের বাড়ি একবার যেন আসি।ওনার স্ত্রীয়ের সাথে আলাপ করি।যাবোও ভেবেছিলাম।কিন্তু দেখো,কোথা থেকে কী হয়ে গেল।আমার মনে হয়,বউটার সাথেই কিছু হয়েছে।বউটা তো কারোর সাথে মিশতো না।নিজের ঘরেই থাকতো।রাস্তায় এক দু বার দেখা হলেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়।কি জানি,কারোর সাথে লটরপটর আছে কিনা।ওইজন্যই হয়তো স্বামীটা..


একটু পরে পুলিশ এসে অমলের মৃতদেহটা নামিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো।অমলের মুখটা কেমন বীভৎস লাগছে দেখতে।চোখগুলো নিজের জায়গা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে।জিভটা বাঁকা ভাবে মুখের একদিকে কাত হয়ে রয়েছে।কিন্তু এইসব দেখে একটুও কষ্ট হচ্ছে না বিশাখার।বরং আত্মতৃপ্তি হচ্ছে ওর,মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ারটার দিকে তাকিয়ে।যেই চোখ দুটি দিয়ে জানোয়ারটা মেঘার শরীরটা মাপতো,সেই লোলুপ দৃষ্টিকে উপড়ে ফেলেছে সে।মেঘাকে দেখলেই যেই জিভটা দিয়ে নোংরা লালা ঝরতো,সেই জিভটাকে সে ছিঁড়ে নিয়েছে।খুব আনন্দ হচ্ছে বিশাখার,খুব।


মেঘা বিশাখার দাদার মেয়ে।একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে যখন মেঘার বাবা- মা মারা যায়,তখন মেঘার ৫ বছর বয়স।বিশাখা এই মেয়েটিকে অনাথ হতে দেয়নি।নিজের মেয়ের সাথে দাদার মেয়েটাকেও সে আপন মনের মতো করে মানুষ করবে।অমলও তো কোনো আপত্তি করে নি।বাড়িয়ে দিয়েছিলো নিজের সাহায্যের হাতটা সেদিন।তখন যে বিশাখা জানতো না, এই নোংরা হাত দুটো সাহায্যের জন্য নয়,মেঘাকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্যই বাড়িয়েছিলো ওর দিকে।প্রথম প্রথম অমল মেঘার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।কারণ সদ্যমাতৃ-পিতৃহারা মেঘাকে,বিশাখা সবসময় নিজের কাছেই রাখতো।স্কুলের চাকরিটা পযর্ন্ত ছেড়ে দিয়েছিলো এই দুই মেয়ের জন্য।তাই অমলের মেঘার উপর থাবা বসানোর সুযোগটা বার বার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো।কিন্তু শিকারি তো সবসময় সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকে।একটু এদিক ওদিক দেখলেই নিজের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় শিকারকে।মেঘার যখন বারো বছর বয়স,তখন সে প্রথম বুঝেছিলো অমলের নোংরা মানসিকতার কথা,অমল সেদিন ঘর ফাঁকা পেয়ে মেঘার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো।কিন্তু নেহা হঠাৎ করেই বাড়িতে ফেরায় মেঘা সে যাত্রায় বেঁচে যায়।কিন্তু অমল মেঘাকে শাসিয়ে রাখলো,যদি ও কাউকে এই ব্যাপারে কিছু জানায়,তাহলে সে মেঘাকে এখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে।আর মেঘা সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না।একবার মাতৃহারা হয়েছে,দ্বিতীয় বার হতে চায় না।তাই মেঘাও বাধ্য হয়ে চুপ করে গিয়েছিলো সেদিন।কিন্তু বুদ্ধিমতি মেঘা নিজের আত্মরক্ষা করার একটা উপায় বের করে নিলো।এরপর থেকে মেঘা কখনই আর একা একা থাকতো না।হয় নেহা না তো বিশাখা,এদের কাছাকাছিই থাকার চেষ্টা করতো সে।কোনো কারণে মেঘাকে একা থাকতে বললেই,ও কান্নাকাটি করে হোক কিংবা জেদ করে হোক ওদের সাথে যেতো।বিশাখা জানতেই পারে নি তার এই সাধের সংসার,যার অপর নাম ভালোবাসা আর নির্ভরতা,তার নিজের স্বামীর কাছেই এর কোনো মূল্য নেই।সে স্বপ্নেও ভাবেনি,যার নেহার মতো নিজের একটা মেয়ে আছে,সে মেঘার সাথে এমন জঘন্যতম কাজ করতে পারে।অমল মেঘার প্রতি নিজের নোংরা কাম-লালসা চরিতার্থ করতে না পেরে পাশের বাড়ির একটি বাচ্চা মেয়েকে একদিন ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসেছিলো।সেদিন বাড়িতেও কেউ ছিলো না।ভাগ্যক্রমে মেঘা সেদিন স্কুল থেকে আগে এসে বাড়িতে পৌঁছেছিলো।মেঘা জানতো এতক্ষণে বিশাখা আর নেহা নিশ্চয়ই বাড়িতে থাকবে।কিন্তু বিশাখা মেঘাকে না জানিয়েই নেহাকে নিয়ে একটি কাজে বেরিয়েছিলো।আর অমল সেই সুযোগটাই নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো।অফিস থেকে ফেরার সময় পাশের বাড়ির পাঁচ বছরের মেয়েটিকে বাড়ির সামনে খেলতে দেখে,লোভনীয় খাদ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলো সবার অলক্ষ্যে।কিন্তু মেঘা এসে যাওয়ায় অমল ব্যর্থ হয় নিজের নোংরা অভিসন্ধিতে।ফলস্বরূপ অমলের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়েছিলো মেঘার উপর।মেঘাকে হিসহিসিয়ে বলেছিলো,"কাল রাতে তৈরী থাকিস,যেই কাজে তুই বাধা দিলি,তুই নিজেই সেটা পূর্ণ করবি।" ভয়ার্ত মেঘাকে আবার আগের হুমকি মনে করিয়ে দিতেও ভুললো না জানোয়ারটা।কাল সন্ধ্যায় বিশাখা আর নেহা বাড়ি থাকবে না।একটা নিমন্ত্রণ আছে।নেহার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও মেঘার শেষ হয়নি।পরের দিন আরও একটা পরীক্ষা আছে তার।তাই বাধ্য হয়েই থাকতে হবে বাড়িতে।বিশাখা কোনো অনুরোধ শোনে নি। অমলও তার অজুহাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলো। তার শরীর ভালো নয়,তাই সেও যাবে না।বিশাখা তাই বিশ্বাস করলো। বেশ খোশ মেজাজেই বাড়ি ঢুকলো অমল।অফিসের ব্যাগটা কোনোরকমে সোফার উপরে রেখেই মেঘার ঘরে ঢুকলো।ঘরটা অন্ধকার হলেও বাইরের ঘরের আলো ঢুকছে।অমল বুঝতে পারলো মেঘা শুয়ে আছে গায়ে চাদর দিয়ে।শরীরটা ক'দিন ধরেই ভালো যাচ্ছিলো না ওর।বিশাখা প্রায়ই কানের কাছে বকর বকর করতো ডাক্তার দেখানোর জন্য।আজ যাবো কাল যাবো করে আর যাওয়া হয়নি। "যতোই তুমি বাহানা করে শুয়ে থাকো,আজ তোমার ছাড় নেই।আমার মুখ থেকে শিকার কেড়ে নেওয়া?বুঝবে এবার মজা"।কথাগুলো শেষ করেই ঝাঁপিয়ে পড়লো মেঘার উপর জানোয়ারটা।


"বাবা!তুমি কী করছো আমার সাথে এটা"?


বিদ্যুৎ-এর ধাক্কা খাওয়ার মতো ছিটকে গিয়েছিলো অমল।


"নে..হা তু..ই"?


"হ্যাঁ বাবা আমি।মায়ের কথা না মেনে আমি যদি মেঘা দিদির জায়গায় না থাকতাম,তাহলে তোমার এই নোংরা রূপটা দেখতে পেতাম না।ছিঃ বাবা ছিঃ।ঘেন্না হচ্ছে তোমায় দেখে"।বিশাখা ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে মেঘাকে নিয়ে পিছনে এসে দাঁড়ায়।


"কী হলো অমল?থেমে গেলে কেন?যাও?মেঘা আর টুসির সাথে যেটা করতে পারো নি,নিজের মেয়ের সাথে করো?দাঁড়িয়ে রইলে কেন"?


"চুপ করো বিশাখা,চুপ করো।আর শুনতে পাচ্ছি না আমি,চুপ করো তুমি।নেহা আমার মেয়ে?ওর সাথে আমি..এর থেকে আমার মরণ ভালো"।


"নেহা তোমার মেয়ে,মেঘা আর টুসি নয়,রক্তের কেউ নয় তাই তো?তুমি না ঠিকই বলেছো।তোমার বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই।আমি তো ছেড়ে দাও,নেহা কোনোদিন আর তোমার মুখ দেখবে না।পুলিশে দিতে পারি,কিন্তু আমার দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে তাতে।যতোই হোক লোক তো জানে তুমি নেহা আর মেঘার বাবা।তার থেকে তুমি যদি নিজেই নিজেকে শাস্তি দাও,তাহলে সবদিক রক্ষা পাবে।তোমার হাত থেকে আরও কয়েকটা নিষ্পাপ শিশু বেঁচে যাবে।খাটের পাশেই মেঘার ওড়নাটা রাখা রইলো,আশা করি তুমি নিজে অসৎ হলেও আজ অন্তত সৎ কাজটা করবে"।বিশাখা চোয়াল শক্ত করে দুই মেয়েকে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।যাওয়ার আগে বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিতে তার কোনো ভুল হলো না।


মেঘা সেদিন আর লুকোতে পারেনি নিজের ধ্বংসের শেষ সংকেতের কথা।সব বলেছিলো মা কে।আর বিশাখাও স্বামীর অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে উপযুক্ত শাস্তি বেছে নিয়েছিলো অমলের জন্য।অমলকে নিজের অনুতাপে পুড়িয়ে মারার জন্যই,অনিচ্ছা সত্বেও নেহাকে এগিয়ে দিয়েছিলো এই কাজে।


পুলিশ অমলের মৃতদেহটার পাশে একটি সাদা কাগজের টুকরো পায়।যেটাতে লেখা ছিলো,"আমার ধ্বংসের জন্য আমি নিজেই দায়ী,অন্য কেউ নয়"..

​সমাপ্ত।



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু