বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বিসর্জনের দেবী

কিছুদিন আগেও শিউলির সুবাস মিশে থাকা শারদবাতাসে, মাথাদোলানো কাশবন আর  নীলাকাশের বুকে  লঘুভার মেঘেদের দেখে মনটা ভরে যেত‌। নীলকন্ঠ পাখির ডাক জানান দিত,"মা আসছেন।" 
কিন্তু সেই আনন্দকলতানও করুণ হয়ে এসেছে, ঘরের মেয়ে অপেক্ষায় ঝড়ে যাওয়া মুঠোশিউলির ভালোবাসা রেখে ফিরে যাচ্ছে বলে । তবে প্রথমদিনের মতোই আকাশটা আজো নীল কিন্তু  খুশিতে নয়,বিষাদযাতনায়।আর এই বিদায়লগ্নে সিঁদুরখেলায় সূর্যালোকও আজ সঙ্গ দিয়ে,নীলচে আকাশের বুকে লালচে আবির ছড়িয়ে দিয়েছে যেন।
তবে আসছে বছর শরতে গৌরী আবার ফিরবে  , আর সেই আগমনী প্রতীক্ষার চিঠিরূপী নীলকন্ঠীপাখি তার নিজের একটা পালক ফেলে দিয়ে গিয়েছে নয়নের ঘরের কাছে। কিন্তু সেদিকে আজ তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।  
জানালার বাইরে উদাসীচোখে চেয়ে থাকা নয়নের মনটা  বড় ভার।তার খুব মনে পড়ছে বছর দশেক আগের কথা-
মায়ের হাত ধরে সে দুগ্গামায়ের ভাসান দেখতে গিয়েছিল। সেদিন  সবাই  লাল আবিরে সেজেছিল। কিন্তু নয়ন বুঝতে পারেনি কেন তার মা  অমন সাদাশাড়িতে একহাত ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়েছিল সবার থেকে দূরে।
' ঐ যে বল্টুদাদার মাও তো সবাইকে রঙ 
লাগাচ্ছে ,আমার মাকে কেন লাগাচ্ছেনা ?আড়ি হয়ে গেছে কি ? আমার মায়ের চোখে জল,না,না,আমি আমার মাকে কাঁদতে দিবনা।যখন আমাকেও কেউ রঙ দেয়না হোলিতে তখন মা দেয়, আজকেও দূর্গাপূজার হোলি , কিন্তু মাকে কেউ খেলায় নিচ্ছেনা যখন আমিই মাকে রঙ দিব।,'ভাবনার মাঝেই নয়ন  একজনের থালা থেকে সিঁদুর নিয়ে তার মায়ের গালে  লাগাতেই ,নয়নের মা চিৎকার করে ,"এ কি অনর্থ করলি ? জানিসনা আমাকে সিঁদুর ছুঁতে নেই ?তোর বাবা ছয়মাস আগেই আমার সব রঙ নিয়ে চলে গেছে  রে"বলতে বলতে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগলো।

উমার ক্রন্দনরত স্বর আর তার বলা কথাগুলো উপস্থিত সকলের কর্ণগোচর হতেই  থেমে গেল ঢাকের বাদ্যি আর সিঁদুরখেলার সাথেই চলতে থাকা হাস্যকলরব । ভেসে আসতে লাগল ফিসফিসানি আর কটুক্তি, কেননা বিধবামানুষের সিঁদুরখেলা মানতে যে পারেনা আজো শিক্ষিত জনসমাজ। ইতিমধ্যেই গ্রামের  শ্রীরত্নপন্ডিত বিধান দিয়েছেন-"মৃত চন্ডালের বিধবা স্ত্রী , উপরন্তু পিতৃহীন সন্তানের গর্ভবতী  উমা সিঁদুর ছুঁয়ে যে অমঙ্গল করেছে গ্রামের, তার একটাই প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে; দূর্গাপ্রতিমার সাথেই বেঁধে তাকেও বিসর্জন দেওয়া হবে এই নদীতেই আর যে ছেলে তাকে সিঁদুর লাগিয়েছে তাকে প্রাণভিক্ষা দিয়ে,ডানচোখটা অন্ধ করে দিয়ে, গ্রামের বাইরের এই নদীতীরের ঝুপড়িতেই একঘরে করে রাখা হবে নজিররূপে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই দুঃসাহসিক কান্ড ঘটানোর ভাবনাও মনে না আনে।"
বিধান শুনে , কাঁদতে কাঁদতে উমা,"সব দোষ
আমার ,আমি মানছি কিন্তু আমার সন্তানদের এভাবে কষ্ট দেবেননা।নয়ন ছেলেমানুষ,ওকে ক্ষমা করে দিন আর যে আমার মধ্যে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছে সেই বা কি অন্যায় করেছে ? দয়া করে এভাবে তার প্রাণ কেড়ে নেবেন না " বলে শ্রীরত্ন পন্ডিতের পা ধরে ক্ষমা চাইলেও মত পাল্টায়না পন্ডিতমশাইয়ের। 
এসবের মাঝে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থানুর মতো নয়ন;নয়ন যে বুঝতে পারছেনা কি ঘটেছে,সে কি ভুল করেছে। তাই উমার দিকে চেয়ে বলে উঠল, " মা, তুমি কাঁদছ কেন ? আর ওরা তোমাকে বিধবা বলছে কেন ? তুমি তো বলো সবাই দুগ্গামায়ের ছেলেমেয়ে ,তুমিও তার মেয়ে এই বিধবাটা কি তাহলে ? আচ্ছা তুমি যে বললে মা স্বর্গে যাওয়ার আগে ছেলেমেয়েদের জীবন ভালোবেসে রঙিন করে যায় জন্য সবাই লাল আবিরে আজ হোলি খেলছে তাহলে তুমি কেন সাদা জামায় একা দাঁড়িয়েছিলে ? তোমার সাথে আমি হোলি খেলেছি জন্য কেন সবাই এতো রেগে গেল ?  ওরা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে বলছে ? তুমি আমায় ছেড়ে যাবেনা তো ? মা আমার যে আর কেউ নেই তুমি ছাড়া...।  " নয়নের কথা শুনে তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল উমা,তার অবুঝ ছেলে যে জানেনা জটিল সমাজের কালো মানসিকতার কথা। 

"
হে মা দূর্গা, তুমি কি পারোনা আমার ছেলেটাকে রক্ষা করতে ? তুমি তো জগজ্জননী ,তাহলে কি এই অসুররূপী মানুষদের হাতে আমাদের নিধন হতে 
দেবে ?কলির দূর্গা কি পাথর হয়েই থাকবে  ?
"নাঃ! সেদিন উমার সেই বুকফাটা আর্তচিৎকারও ব্যর্থ ছিল জগজ্জননীর ঘুম ভাঙাতে।

গ্রামবাসীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে নয়নের থেকে দূরে
সরিয়ে নিয়ে বেঁধে দিয়েছিল মায়ের মূর্তির কাঠামোর সাথেই ।কেউ শোনেনি উমার ডাক; সকলে ভুলেছিল মানবতার বাণী। কুসংস্কারের বলি হয়েছিল এক অনাগত প্রাণ, একজন মা আর এক শিশুর শৈশব। সেই সাত বছরের অনাথ ছেলেটাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়নি, তার ডানচোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার কান্নাও গলাতে পারেনি গ্রামের শিরোমণিদের পাষাণহৃদয়।সেই একচোখের জ্যোতি নিয়ে অনাথ হতে বসা ছেলেটা দেখছিল কেমনভাবে গ্রামলক্ষ্মী স্রোতস্বিনীর বুকে ডুবে চলেছে তার জন্মদাত্রী মা আর জগজ্জননী মা। তার শোকদিবসে কেমনভাবে উৎসবে মেতে উঠেছে অসুরের দল।তবে নয়ন  চোখ হারানোর যন্ত্রণায় ,মা হারানোর ভয়ে তটস্থ হয়ে সেই মৃত্যুলীলার মাঝেও দেখছিল তার মায়ের বিজয়িনী হাসি আর ঢাকের বাদ্যির মাঝেই শুনছিল ডুবে যাওয়ার আগে উমার বলা কথাগুলো,"
ধর্মের নামে কত অধর্ম করবি তোরা ? কত দূর্গাকে বিসর্জন দিবি? কত উমার জীবন থেকে রঙের অধিকার কেড়ে নিবি ? ওরে অর্বাচীনের দল,এটাও ভুলে গেলি রে সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর কেহ নাই ? অধর্ম যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে,তখন তার সংহারবীজ বপন হয়। আজ আমার মৃত্যু নয় তোদের অন্যায়ের কর্মফলের চিতা তোরা প্রস্তুত করেছিস..যে নারী থেকে সৃষ্টি হয়,সে রুষ্ট হলে ধ্বংসপ্রলয়ও ঘটতে পারে।শতশত নারী এক হলে ,তাদের অন্তরের দূর্গা জেগে উঠলে কোথায় পালাবি তোরা তখন ? আর প্রতিবছর এই যে ভাসান দিতে আসিস এতো এতো দূর্গা এরাও নিরঞ্জিত হবেনা আর।কারণ বিসর্জন হয় অসুরের, মায়ের নয়। মা তো শুধু যাচ্ছেন চন্ডীরূপে ফিরবে বলে,প্রতি বছর তোদের মতো নরপিশাচদের একেকজনের বলি চড়বে সেই রণচন্ডীর হাতে। আমিও ফিরব... আবার ফিরব...  "

ঢাকের করুনবাদ্যির সুর কর্ণগোচর হতেই,স্মৃতির পাতা থেকে ফিরে আসে নয়ন।
আজ যে আবারো এক দশমীর বিকেল,সেখান থেকেই ভেসে আসছে সে সুর।সিঁদুরখেলা চলছে,ভাসান হবে আবারো । ঘোলাটে বাঁচোখে নয়ন তখন উদগ্রীব হয়ে দেখছে দুগ্গামায়ের প্রতিমা জলের কাছে নিয়ে আসতেই তা ওজনে বেড়ে গিয়ে বসে পড়ল নদীর পাড়ে। হ্যা, দূর্গামণিপুর গ্রামে উমা আর দেবীদূর্গার একসাথে বিসর্জনের পরের বছর থেকে আর একটা দূর্গাও বিসর্জন দিতে পারেনি কেউ।
জলে ডুবে যাওয়ার আগে উমার শেষ কথাগুলো বৃথা যায়নি।  দশরূপে দশদিকে এমনভাবেই বিসর্জনরত দূর্গা চিরকালের মতো স্থাপিত হয়ে গেছে গ্রামলক্ষ্মী স্রোতস্বিনীর পাড়ে। আর ঐ এক চোখেই দশরূপে দুগ্গামা আর উমার মিশে যাওয়া রূপ দেখতে পায় নয়ন। 

এমনসময় "দাদা দেখো দরজার সামনে এটা পেলাম।কি সুন্দর তাই না ?"পেছন থেকে কেউ বলে উঠতেই, নয়ন সেদিকে ফিরে দেখল, হাসিমুখে নীলকন্ঠ পাখির  পালকটা হাতে  দাঁড়িয়ে আছে শ্যামা।
নয়ন হাসিমুখে ,"হ্যাঁ,অনেক সুন্দর তবে আমার বোনের চাইতে কম "প্রত্যুত্তর করলে শ্যামা তাকে জড়িয়ে ধরল; সেও আগলে নিল বোনকে।
হ্যা অনাথ, চন্ডাল ছেলেটা আজ অনাথ নেই। শ্মশানকালী মন্দিরে অমাবস্যার রাতে যেদিন 
শ্রীরত্নপন্ডিতের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেছিল,ঐ একই দিনে দেবীমূর্তির সামনে শ্যামাকে পায় নয়ন। তারপর থেকে ঐ ওর মা,বোন সবকিছু।সে বুঝেছে, উমা ফিরেছে আবার,তবে  শারদলক্ষ্মীরূপে নয়,চন্ডিকারূপে।সমাজে কালীর দরকার বড়, মানবমনের কালিমা দূরীকরণে‌‌।
নয়নের ভাবনার মাঝেই শ্যামা বলে উঠল,"জানো দাদা  নগেনজ্যেঠু যে আমায় খুব ব্যথা দিয়ে আদর করছিল সেদিন,আজ দুগ্গামূর্তি বিসর্জনের সময় দুগ্গামা রয়ে গেছে কিন্তু জ্যেঠু জলে ডুবে গেছে ,আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে।"
নয়নের হাতের মুঠোয় এখনো  পালকটা ধরা,সেটার দিকে চেয়েই নয়ন মৃদুহাস্যে বলে উঠল,"আসছে বছর আবার হবে...দেবীর নয় অসুরের ভাসান হবে..."


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু