বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

শৈলের নতুন ডায়েরী

শৈলের নতুন ডায়েরী
গল্প

সব কাজ সেরে শৈল ছাদে এসে দাঁড়ালো। এই বাড়িটার প্রায় সব ঘর দিয়েই গঙ্গা দেখা যায়। তবু ছাদে উঠলে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

সেই কোন ছোটবেলায় ঠাম্মির সাথে এই বিশ্বাস বাড়িতে এসেছিল ও। বাবা আর মা গ্রামের বাড়িতে তখন ওর নতুন জন্মানো দুই ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত।

শৈলর ঠাম্মিকে কে যেন খবর দিয়েছিল এই কাজের ব্যাপারে। আশ্চর্য বাবা মাও দোনোমোনো করে নি ওকে নিয়ে যখন ঠাম্মি বলেছিল "ওকে নিয়ে যাই সাথে , ভালো মন্দ কিছু কপালে জুটবে , এখানে থাকলে কি যে ওর হবে !"

কাঁদেনি শৈল একটুও না। ও তো ছোট থেকেই ঠাম্মির কাছে মানুষ। মেয়ে হবার অপরাধে বাবা মা দুজনেই কোনদিন ওর সাথে ভালো ব্যবহার করে নি। বাবা এমন ব্যবহার করতে পারে কিন্তু মা ! ছোট্ট শৈল ঠাম্মির বুকের মাঝে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ঠাম্মিকে প্রশ্ন করতো "ও ঠাম্মি একবার মা কে দেখে আসি! ঠাম্মি মাথা নাড়িয়ে ওকে আরো জোরে বুকের মাঝে চেপে ঘুম পাড়িয়ে দিতো।

সেই শৈল শহরে এসে এই বাড়িটার মানুষগুলোকে দেখলো সবাই কত ভালো। নতুন মা , বাবু , নতুন ঠাম্মি আর আরো কত লোক। দুই দাদা একটা দিদি আর ওর মতো একটা ক্যাবলা ছেলে। সারাদিন বায়না করে আর কাঁদে। নতুন মা সারা বাড়িতে মহারানীর মতো সেজে গুজে ঘোরার ফাঁকে ফাঁকেই নিজের ছোট্ট ছেলেকে আদর করে শৈলের কাছে বসিয়ে দিয়ে যায়। "এই তো তোমার খেলার সঙ্গী এসেছে , খেলো এর সাথে। দেখো তো এ কেমন একটুও কাঁদে না !"

দু চক্ষে ওকে দেখতে পারতো না কর্ণ , চুল টানতে টানতে ওকে কোণে নিয়ে যেতো আর খুব মারতো। কাঁদতো না শৈল , কেউ না কেউ এসে ছাড়াতো ওদের আর শৈলের মাথায় হাত বুলিয়ে নতুন মা পরে বলতো "তুই কেন মারিস না ওকে , ও তোকে এত যে মারে !"

কোঁচকানো চুলের আড়ালে ছোট্ট শৈল হাসতো একটু। আর নতুন মায়ের কোলের কাছে ঘেঁষে বলতো "তুমি তো আমায় কত ভালোবাসো নতুন মা , আমার একটুও লাগে না কর্ণ মারলে !"

দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তো নতুন মার আর আরো আদরে ভরিয়ে দিতো ওকে।

সেসব দিনের কথা মনে পড়লে হাসি আসে মুখে ওর আজকাল। নয় নয় করে ষোল বছর কেটে গেলো এই বাড়িতে এসে। এখন শৈল অনেক বড় হয়ে গেছে। এরা ওকে পড়িয়েছে , লিখিয়েছে আর নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছে।

কর্ণ এখন বিদেশে। আর সব দাদা দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। নতুন মা এখন আর অত দৌড়োতে পারে না পুরো বাড়িতে। কি করে যেন জেঠু কাকাদের ছেলেদের তিনজন বউ আসার পরেও এই বিশ্বাস বাড়ির চাবির গোছা এখন শৈলের হাতে।

এ পর্যন্ত তো সব ঠিক ছিল , কিন্তু মুশকিল হলো ওই ছোট বৌমণি মানে ওই কর্ণের বৌয়ের সাথে আলাপ হয়ে। বিনীতা প্রথম দিনই আলাপের পরে বড় অদ্ভুত একটা কথা বললো। হঠাৎ বলে বসলো "আগে কি ইচ্ছে শৈল এভাবেই জীবন কাটানোর না কি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর !"

হতবাক শৈল কিছুই উত্তর দিতে পারলো না। ছাড়লো না বিনীতা , বলে উঠলো " এই যে এত লেখাপড়া করেছো , কত কিছু জেনেছো , ইচ্ছে হয় না তোমার মতো যে শত শত মেয়েরা আছে তাদের জন্য কিছু করার। ইচ্ছে হয় না আরেকটু অন্য ভাবে বাঁচার ! না কি বংশ পরম্পরায় তুলে দিতে চাও এই কাজের লোকের উপাধি নিজের সন্তানের হাতে !"

শিউরে উঠেছিল শৈল আর হঠাৎ ধরে নিয়েছিল বিনীতার হাত দুটো।

"তুমি আমাকে দেখাবে পথ বৌ মণি ! "

বাধা দিয়েছিল বিনীতা...

"না বৌ মনি না , তুমি আমাকে বিনীতাদি বলে ডাকবে আর তাছাড়া বিয়েটা আমাদের এখনও হয় নি তো !"

সে রাতে ঘুমোয়নি শৈল , শুধু সে রাত নয় পরপর অনেক রাতে ঘুম আসে নি।

ঠাম্মি বয়সের ভারে এখন আর তেমন করে কাজ করতে পারে না। তবু বসে বসে রান্নার জোগাড় করে দেয় একমনে।

নিজের নাতনির পরিবর্তন চোখে যে পড়ে নি তা নয় ।

কি জানি কোন দিন বাধা দেন নি কোন কাজে , আজকেও না। তবু বিনীতা একবার দুবার এসেছে যখন এ বাড়িতে তখন বারবার দেখেছে শুধু শৈলর সাথে কথা বলতে।

কি যে বলে ওকে কোনদিন জানতে চান নি। আজও নয়।

কিন্তু কাল রাতে যখন নিজে এসেই বললো কিছু কথা বড্ড কষ্ট হলো যেন বুকের মাঝে। এমন করে ভাবা যায় কই তার তো স্বপ্নে আসে নি কোনদিন এমন কথা।

বাঁচার জন্য শুধু বেঁচে যাওয়া। দু বেলা দু মুঠো খাওয়া , পরনের কাপড় পাওয়া আর রাত্রে নিরাপদ একটা ঘরে ঘুমিয়ে পড়া।

অথচ এ মেয়েটা বলে কি ! ও নাকি ওই নতুন বৌ মনির সাহায্য নিয়ে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে বেশ কয়েকটা। ওকে গড়ে পিটে না হলেও রাত দিন ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে একটা চাকরির পরীক্ষা সসম্মানে পাশ করতে পেরেছে ও।

আর ক'দিন পরেই চলে যাবে সেখানে ও নাকি নিজের ঠাম্মিকে নিয়ে।

ঠাম্মি আজ কাঁদছে না হাসছেও না।

নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না যদিও তবু সেই কদিন ধরেই দেখছে একমনে গুছিয়ে চলেছে ব্যাগ সুটকেস কতকিছু শৈল নিজের মনে। ওর নতুন মা এসে বারবার তদারকি করে যাচ্ছে।

এক একবার মনে হচ্ছে নীরদার শৈলের বাবা মাকে খবর দিতে। কিন্তু সেই চলে আসার পরে তারাও তো একবারের জন্য খবর নেয় নি তাদের।

আজ এত সুখের কথা জানতে পারবে না তারা কোনদিন।

কাছে এসে দাঁড়ালো শৈল। আজ এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পালা।

সবার চোখে জল। শুধু বিনীতা দৃঢ় ভঙ্গিতে কাছে এগিয়ে এলো।হাতে একটা বড় প্যাকেট দিয়ে বললো "তোমার ছোটবেলার খেলার সাথী এ উপহার পাঠিয়েছে বিদেশ থেকে আর একটা কথা বলতে বলেছে তোমাকে , নতুন পরিচয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পরের জীবনে আবার যদি কোন শৈলের দেখা পাও তার ঠাম্মির সাথে তাকে আশ্রয় দিও । দিও নতুন নাম আর একটা নতুন জীবনের দরজার ঠিক কাছে পৌঁছে দিও ! পারবে তুমি সে আমি আর কর্ণ দুজনেই জানি !"

এগোলো শৈল , সবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সারলো শুধু বিনীতাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।

"বিয়েতে আসবো আমি ঠাম্মিকে নিয়ে ! ততদিনে চেষ্টা করবো নতুন কোন শৈলকে জীবনে খুঁজে পাবার ! আসি গো ! ভালো থেকো সবাই , আসলে এটা কোন বাড়ি থেকে যাচ্ছি না আমি। আশ্রমে নিজের জীবনের সব শিক্ষা নিয়ে যাচ্ছি নতুন জীবনে ! আশীর্বাদ কোরো সবাই এমনটাই যেন থাকি !"

গাড়িটা ছেড়ে দিলো। ঠাম্মির হাত নিজের হাতে নিয়ে এক শৈল নতুন জীবনের স্বপ্ন সাজিয়ে এগিয়ে গেলো জীবনের পথে ..

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু