বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ফিরে দেখা

শেষ পর্যন্ত আমার আশঙ্কাটাই সত্যি প্রমাণিত হলো !!

হল ঘরে খুব কম পাওয়ারের লাইট জ্বলছিল।আমি আর অভি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম চুপ করে।

বাবা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এক পা দু পা করে সোজা দরজা খুলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। ফ্রিজে রাখা খাবার বের করে ওভেনে যেই গরম করতে যাবে আমি আর অভি ঢুকে পড়লাম ঘরে।

"নন্দিনী ঠিকই বলেছিল বাবা তাহলে। রাগ করে তুমি যেদিন যেদিন খাও না ও ঠিক গুছিয়ে খাবার রেখে ফ্রিজে তবে শুতে যায়। আজ আবার তুমি মিষ্টি দেওয়া হয়নি বলে রাগ করে খাবার খেলে না। আর নন্দিনী আমাকে বললো, তুমি শুতে যাও আমি বাবার খাবার গুছিয়ে রেখে আসছি

কেন যে এমন জেদ করো তাই তো বুঝি না"

বাবা কেমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।

বড্ড কষ্ট হলো আমার , মনটা কেমন করে উঠলো।

শাশুড়ি মা চলে যাওয়ার পরে আমাদের কাছে এসেছেন বাবা এই ক'মাস হলো। মা বাবা দুজনেই অভির দাদার কাছে ব্যাঙ্গালোরে থাকতো ।

আমাদের বিয়ের পরে আমি অনেক বার বলে ছিলাম অভিকে "মা বাবাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসো , অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য হলেও।

আমি বারবার বলাতে অভি দাদাকে বলেও ছিল। কিন্তু দাদা আর দিদিভাই দুজনেই বলেছিল ওরা চলে গেলে ওদের বাচ্চাদের কে দেখবে। বাড়িতে লোক থাকলেই বা। অভি আর কিছু বলেনি তারপর।

দাদা আর দিদিভাই দুজনেই চাকরি করতো। মা আর বাবা বাচ্চাদের সামলানো ছাড়াও বাজার দোকান আর রান্নারও বেশ কিছুটা দুজনকেই করতে হতো।সে সব যদিও বাবা এখানে আসার পরে কথায় কথায় বলে ফেলেছিল একদিন।

মার শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছিলো না মোটেই। অভি গিয়ে একাই দেখে এসেছে দু'তিনবার।

প্রতিবার ফিরেই গুম হয়ে বসে থাকতো অভি। আর অনেক জিজ্ঞাসার পর বলতো "ওদের এত পয়সা এত বড় বাড়ি দু দুটো গাড়ি আর জানো বাবা মাকে একটা ছোট্ট ঘরে থাকতে দিয়েছে। আমার মাইনেটা কম বলে দাদা বৌদি কোনদিন আমায় মানুষ বলে মনে করে নি। কিন্তু জানো ঝুম্পা মাকে আমি কথা দিয়ে এসেছি একটু বড় বাড়ি খুঁজে নিয়ে আসবো আমার কাছেই। তোমার খুব কষ্ট হবে জানি কিন্তু বাবার চোখে জল এই প্রথম দেখলাম আমি "

সে রাতে অল্প কিছু খেলো অভি। আমি পাশে গিয়ে বললাম "শোনো না ওই বাইরের ঘরে তুমি আর আমি থেকে যাবো। আর আমাদের বড় ঘরে ওরা থাকবে বুঝলে। একটাই বাথরুম হয়তো বাবা মার কষ্ট হবে কিন্তু তুমি তো জানো আমি কোনদিন আমার বাবা মাকে চোখে দেখিনি। দিদিমা দাদুর কাছেই আমি মানুষ। তোমায় তো কবে থেকেই বলছি যাও ওদের নিয়ে এসো"

রাজি হয়ে গেলো অভি এক কথায়। আর যাবার একদিন আগেই খবর এলো মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

গেলো অভি একাই আর বারো দিন পরে বাবাকে নিয়ে ফিরলো।

হাত ধরে ঢুকলো ঘরে যখন বাবা ঠিক যেন একটা ছোট ছেলে।

আমি প্রণাম করতেই আশীর্বাদের হাত মাথায় রেখে কেঁপে উঠলেন কেমন যেন

সামনেই চেয়ার এগিয়ে দিলো অভি।

আমি দৌড়ে গিয়ে চা আর জলখাবারের প্লেট এনে রাখলাম বাবার সামনে।

"তুমি মুখ হাত ধুয়ে এসো বাবা আমি তখন চা ঢালবো তোমার জন্য "

কেমন যেন অবিশ্বাস ভরে দেখলেন আমাকে। বুঝলাম না কেন !

ধীরে ধীরে থাকতে থাকতেও খুব একটা সহজ হলেন না বাবা।

সব সময় কেমন যেন ভয়ে থাকতেন।

মাঝে মাঝে জেদ করতেন

"না আজ আমি খাবো না মিষ্টি না দিলে বা আজ আমার শরীর ভালো নেই!'

শুরু থেকেই এমন দিনে আমি খাবার থালায় রেখে ফ্রিজে রেখে দিতাম।

আহা মানুষটার যদি রাতে খিদে পায় , ওমন তো দাদু রাগ করে না খেলে দিদিমাও খাবার টেবিলে খাবার চাপা দিয়ে রাখতো।

দিনে দিনে ভয়টা একটু কমলেও কিছুতেই মন খুলে কথা বলতেন না বাবা।

সব সময় আড়ষ্ট হয়ে থাকতেন।

পরে যদিও জেনেছিলাম সব।

ওখানে কাজ আর বাচ্চাদের দেখা ছাড়া তাদের আর কোন কিছুতে কেউ ডাকতো না কখনও। বড় বড় পার্টি হতো। অভির মাকে দিয়ে নানান রকমের রান্না করিয়ে নেবার পর কড়া নির্দেশ থাকতো দুজনেই যেন ঘরের বাইরে পা না রাখে।

বাবা জেদ যদিও করতো না ওখানে কিন্তু রোজ একঘেয়ে খাবার বরাদ্দ বলে কোনদিন হয়তো খেতো না ওরা দুজনেই।

তাতে ওই ছেলে বউয়ের কিছুই এসে যেতো না। রাতে সব খাবার ফেলে রান্না ঘরে তালা লাগিয়ে শুতে যেতো বৌ। বড় ছেলে যখন তখন যাচ্ছেতাই করে কথা বলতো বাবা মার সাথে।

সব শুনলো এরা দুজনেই। স্তব্ধ হয়ে ভাবছিল নন্দিনী মানুষ নিজের বাবা মাকে এত কষ্ট কি করে দিতে পারে।

একবারে মনে পড়ে গেলো তাই প্রথম দিন এত ভয়ে ভয়ে দেখছিল ওকে বাবা।

বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছিলো হয়তো নিজের এই ছেলে বৌকেও

রাতে খাবার টেবিলে আজ লুচি আর মাংস । পাশে পায়েসের বাটি। গন্ধে ম ম করছে চারদিক

অভি হাত ধরে বাবাকে এনে বসালো চেয়ারে।

নন্দিনী তাড়াতাড়ি একটা থালায় সব সাজিয়ে তুলে রাখলো।

"এ কি করছো ! আজ আবার খাবার তুলছো কেন ! বাবার তো আজ আর কোন রাগ নেই !"

 

হাসলো নন্দিনী..

"না গো পায়েস আর মাংস একটু তুলে রাখছি শুধু। বয়েস হলে দাদু বলতো বড্ড খিদে পায়। রাতে কিছু না পেলে বাবা আবার রেগে যাবে যে!"

এত দিনে খোলা গলায় হাসলো অভির বাবা

"তুই অভি একটা বিচ্ছু মেয়েকে বিয়ে করেছিস বুঝলি "

হাসির স্রোতে ভাসতে ভাসতে চোখ বুজে এলো বাবার , মনে পড়লো অভির মায়ের কথা।

জীবনে একটু খুশীই তো শুধু চেয়েছিলেন ওরা দুজনে।

অথচ সে টুকু তিনি তো পেলেন কিন্তু সরমা পেলো না.. আজ বড্ড মনে পড়ছে যে তাকে

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু