বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সহেলী

সহেলী


সংযুক্তা ব্যানার্জী চক্রবর্তী


বাস থেকে নেমে পড়িমড়ি করে ছুটলাম হাওড়া স্টেশনের গর্ভের দিকে। ছুটতে ছুটতে এসে যখন ট্রেনটাতে উঠলাম ট্রেনটা ছেড়ে দিল। তখনই পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে বুঝলাম আরেকজনও আমার মতই দৌড়ে এসে উঠল।যাক বাবা  ১১.৪৫এর লাস্ট ব্যান্ডেলটাতো পাওয়া গেল নইলে আজ রাতটা হাওড়া স্টেশনেই কাটাতে হত। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহটায় বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে বলেই হোক আর শেষ ট্রেন বলেই হোক এই কামরার  যাত্রী  সংখ্যা আমাকে নিয়ে মাত্র তিন। বসে বসেই খেয়াল করলাম আমাকে ধাক্কা দিয়ে যে ব্যক্তি উঠলেন তিনি একজন মহিলা। একে শীতের মুড়ি তারওপর জিন্সের প্যান্ট  পড়া থাকায় প্রথমে বুঝতে পারি নি। তৃতীয় ব্যক্তি এক মাতাল। এসব দেখে মেয়েটিকে বললাম, ম্যাডাম, পরের স্টেশনে নিজেদের কামরায় চলে যাবেন, দেখছেনই তো এখানে এক মাতাল আছে। মেয়েটি একটু চুপ করে থেকে বললো, কেন আপনিও তো আছেন, আপনার ভরসায় থাকা যাবে না? দেখুন এত রাতে লেডিসে আর কেউ নাও থাকতে পারে, তখন আমি কি করবো? একদম ঠিক কথা।বললাম, ঠিক আছে থাকুন। খুব আশায় থাকলে হয়ত লিলুয়াতে মানে প্রথম স্টেশনে কেউ উঠতেও পারে। এমন সময় মেয়েটির মোবাইলটি বেজে উঠল।মেয়েটি ফোন ধরে কথা বলছে আর স্বাভাবিকভাবেই সব কথা আমার কানে ঢুকছে।কথা শুনে বুঝলাম মেয়েটিও আমার মতন কোনো হাসপাতাল থেকে ফিরছে।হ্যাঁ,আজ অফিসের বোসদা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে ওনাকে অফিস থেকে আমরা কয়েকজন মিলে পি.জি.তে নিয়ে যাই। ওনার বাড়ীতেও খবরটা দিয়ে দিতে বৌদি ও ছেলে  চলে এসেছিল।ছেলেটা সবে এইটে পড়ে। তাই বৌদির অনুরোধে হাসপাতালে থেকে গিয়েছিলাম আমরা দুই বন্ধু।শেখর, মানে আমার ঐ বন্ধু গড়িয়াতে থাকে, বোসদার বাড়ীর কাছেই। তাই বোসদার অবস্থা একটু ভালো হতে শেখর বৌদিদের নিয়ে একটা ওলা নিয়ে চলে গেল।কিছুক্ষণ পর আমার বাসটা এসে গেলে আমিও চলে এলাম।কিন্তু বাসটা সিগনাল না মেনে হু হু করে টেনে যাচ্ছিল ফাঁকা রাস্তায় আর তার ফল স্বরূপ পুলিশের হাতে পড়ল।এই ঝামেলায় পরে আমার এতটা দেরী হয়ে গেল। ফোন রেখে

মেয়েটা আমায় জিজ্ঞেস করলো, আপনার কে হাসপাতালে আছে? আমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বললাম, মানে? মেয়েটি ও থতমত খেয়ে বলল, না, মানে আপনাকেও পিজিতে দেখলাম কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি। আপনার ইচ্ছে না হলে বলবেন না,কোনো ব্যাপার নয়। আরে না না, আমি বলে উঠলাম,মানে আমি কিন্তু আপনাকে ট্রেনেই প্রথম দেখলাম, হাসপাতালে দেখি নি, তাই আপনার প্রশ্ন শুনে চমকে গিয়েছিলাম। আমার অফিসের একজন আজ অফিসেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সেই দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়েই এত দেরী হয়ে গেল। আপনার কে  ভর্তি আছে? মেয়েটি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, আমার বাবা। হয়ত বাঁচবেন না। আমি কি আর বলবো, তবু জিজ্ঞেস করলাম এমন ভাবছেন কেন, ভালোও তো হয়ে যেতে পারে! বাড়ী থেকে বুঝি মা ফোন করেছিলেন? মেয়েটি একটু হেসে বললো, না মা নেই। পাশের বাড়ীর কাকীমা। আর বাবার কথা বলছিলেন না,বাবা কোমায় আছে আজ পাঁচদিন ধরে।আমি অফিস করে তারপর রোজ বাবার খবর নিয়ে ফিরি।আজ নার্স বলছিলেন কাউকে থাকতে।আমি বললাম আমার তো আর কেউ নেই তাই থাকারও কেউ নেই। বাবার যদি কিছু হয়ে যায় সব নল,সূচ সব খুলে দেবেন আর আমাকে দয়া করে একটা ফোন করবেন। মেয়েটির এমন কথার পর আর কিছু বলার ছিল না আমার।হঠাৎ দেখি গাড়ী হিন্দমোটরে দাঁড়িয়েছে।এরপর আমি নেমে যাব, তাহলে মেয়েটার কি হবে? ও একা এই মাতালটার সাথে কি করে যাবে। খেয়াল করলাম মাতালটা ঘুমিয়ে আছে একটা সীটে। আমি মেয়েটাকে বললাম সে কথা। মেয়েটি আমাকে অবাক করে দিয়ে জানালো ও কোন্নগরেই নামবে। আমি তখন বললাম, কোনদিকে থাকেন আপনি? জোড়াপুকুর--মেয়েটি  জানাল। আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি থাকি অনেকটা আগে। তারপর ভাবলাম মেয়েটাকে সেটা বলার দরকার নেই, ওকে একটু এগিয়ে দি বরং। ট্রেন থামলে দুজনেই নেমে পড়লাম। এবার হন্টনং ছাড়া উপায় নেই, তাই দুজনে মিলে হাঁটা লাগালাম।মেয়েটা বেশ দ্রুত হাটছে। হঠাৎ মেয়েটার ফোনটা বেজে উঠল। মেয়েটা তাড়াতাড়ি ফোনটা বের করে বলে উঠলো, হাসপাতাল। আমি সাথে সাথে ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে ধরলাম। হাসপাতাল থেকে জানালো যে মেয়েটির বাবা একটু আগে মারা গেছেন। আমি জানালাম যে, আমরা অনেক দূরে থাকি এখন যাবার কোনো উপায় করতে পারলে যাব নইলে যেতে ভোর হয়ে যাবে। ফোন বন্ধ করে দেখি মেয়েটা মাটিতে বসে আছে।আমি আর কি করবো, আস্তে আস্তে মেয়েটিকে তুলে দাড় করালাম।  এতক্ষণে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।আমি ঠিক করে নিয়েছি যে মেয়েটাকে আমি আমাদের বাড়ী নিয়ে যাব।সেখানে আমার মা আর বোন আছে,ওকে দেখে রাখতে পারবে। এই অবস্থায় মেয়েটি নিজের বাড়ীতে একাএকা সারারাত কাটাবে কি করে! মেয়েটির বোধহয় আর কিছু চিন্তা করার অবস্থা নেই। আমি মেয়েটিকে ধরে ধরে আমাদের বাড়ী নিয়ে এসে ঘন্টাটা বাজাতেই মার গলা শুনতে পেলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন -কেরে সমু এলি? আমি বললাম -- হ্যাঁ মা।এবার মেয়েটা বুঝতে পেরেছে যে ও অন্যখানে এসেছে।তাই আমাকে বললো -- আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন?এদিকে মা দরজা খুলে দেখে আমি একটা মেয়েকে ধরে দাড়িয়ে আছি।মাও অবাক। আমি তখন মেয়েটিকে বললাম, ঘরে চলুন। ঘরে এসে বোনকে বললাম, এনাকে একটু জল খাওয়া তো। আর মাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললাম। মা বললেন, তুই খুব ভাল কাজ করেছিস বাবা। কাল ওর সাথে হাসপাতালে গিয়ে যা যা দরকার করে ওকে এখানেই নিয়ে আসিস। তারপর মা একটু দুধ গরম  করে ওকে খাইয়ে দিল। বোন ওর একটা পোষাক এনে ওকে দিল পড়তে।রাতে বোন আর মেয়েটি শুলো আর আমি মার কাছে শুলাম। মা রাত থাকতেই আমাদের তুলে দিলো।দেখি মা সেদ্ধভাত করে ফেলেছে।এবার মা মেয়েটির নাম জানতে চাইলে আমার খুব হাসি পেয়ে গেল। সত্যিই তো আমরা কেউ ওর নামটাও জানি না। মেয়েটি বললো ওর নাম সহেলী রায়। ও একটা বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে। বাবা প্রায় দুবছর ধরে বিছানায়।মেয়েটি ভাত খেতে রাজী হচ্ছিল না। কিন্তু মা ওকে বুঝিয়ে বলতে ও খেয়ে নিল।আমিও খেলাম। তারপর দুজনে মিলে ট্রেন ধরতে বেড়িয়ে পড়লাম।


(২)


সব কিছু সেরে সহেলীকে নিয়ে আবার বাড়ী ফিরে এলাম। স্নান সেরে সহেলী মার কাছে গিয়ে বসলে মা ওকে কাছে টেনে নিলেন।একটু পরে দেখি সহেলী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আর মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাতে খেতে বসে মা সহেলীকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে ও বললো যে ও কলেজে পড়ার সময়ই ওর মা ক্যান্সারে মারা যান। আমার মা জানালেন যে, মা একজন পুরোহিতকে কাল আসতে বলেছে।শ্রাদ্ধশান্তি করার জন্য। সহেলী যদি চায় তবে গঙ্গার ঘাটেই কাজ করতে পারবে। সহেলী তখন বললো যে, কাল ও বাড়ী যেতে চায়।মা বললো, নিশ্চয়ই যাবে, তবে আমার সাথে যাবে আবার আমার সাথেই ফিরে আসবে। এই বয়সী একটা মেয়েকে এই সময় আমি কি করে একা ছাড়বো বলো তো। সহেলী আর কিছু বললো না। পরের দিন আমি বসে আছি, একটু পরেই অফিসে যাব, সহেলী এসে সামনে বসলো। আমি তাকাতেই আমাকে বললো, আমি আপনাদের খুব অসুবিধের মধ্যে ফেলে দিয়েছি। কি যে করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।আমার এক পিসি আছেন, সোনারপুরে থাকেন, কাল আমি বাবার খবর জানাতেই বললেন, দেখ আমার দুকামরার ফ্ল্যাট, এখানে তো আর তোকে এনে রাখতে পারব না, তুই একটা লেডিস হোস্টেলে চলে যাস কাজ হয়ে গেলে।আর দেখ আমার শরীর ভাল না তাই এখন যেতেও পারব না, কাজ হয়ে গেলে জানাস।

তাই ভাবছি বিপদের দিনে আপন পর হয়ে গেল আর পর হয়ে গেল আপন। আমি তখন হেসে বললাম, আমরা যখন আপন হয়েই গেলাম তখন আর এসব নিয়ে ভাবছেন কেন? আমার মায়ের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন, দেখবেন সব ঠিকঠাকভাবে হয়ে গেছে।না, আর দেরী করা যাবে না, এবার আমাকে দৌড়াতে হবে।রাতে দেখা হবে--এই বলে আমি উঠে পরলাম।


সহেলীর বাবার কাজ মিটে গেলে ও অফিসে আবার যোগ দিল। মার সহেলীকে খুব পছন্দ হয়েছে। একদিন আমাকে ডেকে সেকথা জানালো। আমি কিন্তু আমার দূর্বলতা প্রকাশ করলাম না। এবার মা সহেলীর কাছে জানতে চাইল যে তার কেউ মনের মানুষ আছে কিনা।সহেলী হেসে ফেলে বললো, কোথায় খুঁজবো আমি?আমার দ্বারা ওসব হবে না। মা বেশ জোর পেয়ে বললো, মা বলে ডাকবি আমায়?সারাজীবন আমার কাছে থাকবি? সহেলী কেঁদে ফেলে বলে, তুমি তো আমার মা ই গো।মা ছাড়া কেউ অন্যের জন্য এত করে?কিন্তু তোমার কাছে সারাজীবন তো থাকতে পারবো না মা, তোমার ছেলের বৌ এসে আমাকে ঘাড় ধরে বের করে দেবে যে। মা তখন দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে আর বলছে, কেন তুই আমার ছেলের বৌ হতে রাজী নোস্? সহেলী চমকে ওঠে তারপর ছুটে পাশের ঘরে চলে যায়।


মাঘ মাসের এক সন্ধ্যায় মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে দিয়ে দিলেন।আজ আমাদের ফুলশয্যা। বোন একগোছা রজনীগন্ধা দিয়ে ঘর সাজিয়েছে।আমি আর সহেলী বসে আছি। সহেলীকে দুহাতের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম--------

    এক শীতের রাতে তোমার সাথে

         হল পরিচয়,

   শীতের মাঝেই তোমার প্রেমে

         মগ্ন হল মন।

   শীত কাঁতুরে বড়ই আমি

তোমায় পেলাম আজ,

তোমার তাপে শীত কমাবো

  এটাই মনের সাধ।


ব্যাস,এরপর আর কোনো কথা তো থাকতেই পারে না।  সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু