প্রদাহ
রোহিত, অভিষেক, রুচিকা, প্রীতি, সৈলেন, দেব আর মেঘনা কলেজ ক্যান্টিনে বসে কথাবার্তা বলছিল। আর ক’দিন পর ওদের কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। ওরা সাতজন কলেজের প্রথম বছরের বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে অনুষ্ঠানে ভাগ নিচ্ছে। ওরা শেক্সপিয়ারের একটা নাটকের উপস্থাপনা করবে। এখন ওদের শেষ পর্যায়ের রিহার্সাল চলছে। সেই সুবাদেই ওরা আজ এত দেরি পর্যন্ত ক্যান্টিনে বসে আছে। রোহিত নাটকের নায়ক আর রুচিকা নায়িকা। দুজনের মধ্যে এমনিই বেশ ভাবসাব আছে। সেই কারণেই সবাই মিলে ওদের দুজনকে নায়ক নায়িকা হিসাবে চয়ন করে। তাতে ওদের দুজনের অভিনয় বেশ জমে উঠছে। সবার ধারণা, ওরা দুজন এবার বাৎসরিক অনুষ্ঠানে অভিনয়ের জন্য প্রথম পুরষ্কার পেতে পারে। ওরা দুজনেই মাঝারী উচ্চতার। আকর্ষণীয় মুখের আদল, ফর্শা গায়ের রঙ আর স্মার্ট চালচলনের জন্যই ওদেরকে এই চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে । নাটকের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ দৃশ্যে আছে ওদের দুজনের। আজকে সেই দৃশ্যটা অভিনয় করতে গিয়ে রোহিতের বারবার ভুল হচ্ছিল। রুচিকার এই দৃশ্যে অভিনয় করতে কোনো দ্বিধা ছিল না, কিন্তু, রোহিত খুব কড়া শাসনে থাকে ঘরে। ওর এই দৃশ্যতে অভিনয় করতে যথেষ্ট অসুবিধে হচ্ছে। সেই কারণেই আজকে ওদের রিহার্সাল শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল।
অভিষেক বলল, “অ্যাই রোহিত! তুই এটা না করতে পারলে কিন্তু নাটকটা একদমই জমবে না। ওটাই নাটকের মূল আকর্ষণ, আর তুই ওটাতেই ফেল মারছিস, বারবার। একটু ঠিক ভাবে কর!” রোহিত কোনো জবাব দিল না। ও শুধু রুচিকার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। আজ রুচিকা একটা স্কিন টাইট ফেডেড জিনসের স্কার্ট আর একটা বুক নামানো কালো রঙের টপ পরে এসেছে। ওর বুকের ভাঁজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল, যখন ও কাছে আসছিল। এটা রোহিতকে এত অস্বস্তিতে ফেলছিল, যে ওর পক্ষে সঠিক অভিনয় করা মুশকিল হচ্ছিল। রুচিকা দেখতে বেশ ভালো। তার উপর ভ্রূ জোড়া একদম নিখুঁত ভাবে টানা। ওর গায়ের রঙ হালকা গোলাপি, ঠিক যেন মোম দিয়ে তৈরি। ও যতবার কাছে আসছিল, রোহিতের সমগ্র শরীরে আগুন জ্বলে উঠছিল। রুচিকাও ওর অভিনয় নিয়ে কটাক্ষ করছিল। ওরা কথাবার্তা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায়, ওদের সবার অভিভাবকেরা এসে পৌঁছে গেল।
অনুষ্ঠানের দিন রোহিত খুব সুন্দর অভিনয় করল। রুচিকাকে সেদিন ঠিক সিনেমার নায়িকার মতন দেখতে লাগছিল। সেদিন সাজ সজ্জা আর মেক আপ করে ওকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। রোহিতের মনে হল, ও এবার সত্যিই রুচিকার প্রেমে পড়ে গেছে। রুচিকাও হয়ত ওর প্রেমে পড়ে গিয়ে থাকবে! মঞ্চের সামনে উপস্থিত কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ওদের দুজনের অভিনয় দেখে খুব হাত তালি দিল। পুরো প্রেক্ষাগৃহ ওদের অভিনয়ের প্রশংসায় করতালি ধ্বনিতে যেন ফেটে পড়ল। শেষ সিনে রুচিকার রোল চলছে। রোহিতের অভিনয় শেষ হয়ে গেছে আগের সিনেই। উইংসে আর কেউ নেই। সবাই মঞ্চের সামনের দিকে চলে গেছে। রোহিত উইংসের ভেতরে একলা অপেক্ষা করছে রুচিকার জন্য। ও এত আবেগ প্রবণ হয়ে গেছে, যে আজ রুচিকাকে একবার অন্তত,…
ঠিক সময় নাটক শেষ হল, আর মঞ্চের আলো নিভে গেল। রুচিকা উইংসের দিকে এগিয়ে আসছে। রোহিতের বুকটা ভীষণ জোরে ধুকপুক করছে। যেই রুচিকা ওর সামনা সামনি এসেছে, রোহিত ওকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুম্বনের পর চুম্বন দিয়ে চলল। রুচিকা প্রথমে ওকে দেখতে পায়নি। ওর বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকল। ঠিক তখনই রোহিত বলে উঠল, “রুচিকা! আই লাভ ইউ সো মাচ!” রোহিতের গলার আওয়াজ শুনে রুচিকা একদম রাগে ঝলসে উঠল। নিজেকে রোহিতের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, সপাটে একটা জোরালো চড় কষিয়ে দিল ওর গালে। চিৎকার করে উঠল, “নোংরা! অসভ্য কোথাকার!” ওর চিৎকার শুনে অনেকে ওদের দুজনের কাছে চলে এল। রোহিতের তখন এমন অবস্থা, যেন বলছে, “ধরিত্রী! তুমি দ্বিধা হও। আমি এই অপমান আর সহ্য করতে পারব না”। ও আর এক মুহূর্ত ওখানে না দাঁড়িয়ে, সোজা ঘরের ফেরার জন্য পা বাড়ালো। রুচিকা তখন অভিষেককে ডেকে বলছে, “আমি ওর নামে প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেন করব”। অভিষেক সেদিন ওকে অনেক করে বুঝিয়ে ক্ষান্ত করতে সক্ষম হয়।
বাৎসরিক অনুষ্ঠানের পরবর্তী দিন কলেজ বন্ধ ছিল। তাই আর এ বিষয় কারুর সঙ্গে কোনো কথা হল না। যেদিন কলেজ খুলল, সেদিন সকালে রোহিত যায়নি। বিকেল বেলায় কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিকাল ছিল। তাই ও গেল। না গেলে ওর উপস্থিতি কমে যাবে। তাছাড়া এতে নম্বরও দেওয়া হয়। সল্ট টেস্টিঙের প্র্যাক্টিকাল চলছে। রোহিত পেছনের একটা টেবিলে চারজন বন্ধুর সঙ্গে কাজে ব্যস্ত ছিল। রুচিকা একদম সামনের দিকের একটা টেবিলে তখন কাজ করছে। দু দুবার ওদের দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। যত চেষ্টা করলেও রোহিত ওর দিকে নজর না করে পারছিল না। না জানি, ওর সম্বন্ধে মেয়েটা কি বলছে বন্ধুদেরকে! রুচিকার সঙ্গে যারা ছিল, তারাও বেশ কয়েকবার রোহিতের দিকে তাকাল। রোহিতের মাথাটা গরম হয়ে গেল। যে সালফিউরিক অ্যাসিডের শিশিটা ওর টেবিলে রাখা ছিল, সেটাকে নিয়ে ও ছুটে গেল রুচিকার দিকে। কাঁচের ছিপীটা খুলে ফেলেছে ও। রুচিকা ওর কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে পড়েছে। অভিষেক কাছেই ছিল। ও চট করে শিশি ধরা রোহিতের হাতটাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। ওকে ধমক দিয়ে বলল, “কি করছিস এটা, অ্যাঁ? পাগল হয়ে গেলি?” রোহিত তখন কাণ্ডজ্ঞান শূন্য একটা পশুর মতন ফুঁসছে। চিৎকার করছে, “ছাড় আমাকে! ছাড় বলছি!” ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে রোহিতের হাত থেকে অ্যাসিডের শিশিটা কেড়ে নিল।
রুচিকা তখন অভিষেককে বলতে আরম্ভ করল, “আমি সেদিনই বলেছিলাম, এটা একটা অসভ্য, নোংরা ছেলে। আমি যাচ্ছি এবার প্রিন্সিপ্যালকে গিয়ে বলব সব কথা”। অভিষেক আর আজকে রুচিকাকে আটকানোর চেষ্টাও করতে পারল না। শুধু ও কেন? ল্যাবের অন্য কেউও কোনো কথা বলল না। ল্যাবে তখন সূচিকা পতনেরও শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে, এমন পরিস্থিতি।
কিছুক্ষণ পরেই প্রিন্সিপ্যালের অফিস থেকে রোহিতকে ডাকা হল। ও তখন পর্যন্ত থর থর করে কাঁপছে; ভয়ে নয়, রাগে। রোহিত প্রিন্সিপ্যালের অফিসে ঢুকতেই, ভদ্রলোক ওকে একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিলেন। বললেন, “আজকে তুমি রুচিকার উপর যা করতে যাচ্ছিলে, সেটা এতে লেখো”। রোহিত কাগজটা নিয়ে, যা হয়েছিল তা লিখল। প্রিন্সিপ্যাল এবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই রকম উদ্ধত আচরণের জন্য তোমাকে এক বছরের জন্য কলেজ থেকে সাসপেন্ড করা হল। তুমি এবার আসতে পার। তোমার মতন ক্রিমিনাল এই কলেজে পড়তে সুযোগ পাওয়া উচিত নয়। শুধু তোমার বাবা, মায়ের কথা চিন্তা করে, তোমাকে কেবল মাত্র এক বছরের শাস্তি দেওয়ার নিষ্পত্তি নিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। নাহলে, আমি কলেজের অন্য ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে, তোমাকে কখনওই আর এই কলেজে স্থান দিতাম না”। মাথা নিচু করে রোহিত প্রিন্সিপ্যালের অফিস থেকে সেদিন বেরিয়ে গেল। আর এল না। কারুর সঙ্গে কোনো কথাও আর বলল না।
অভিষেক বেশ কয়েকবার রোহিতের সঙ্গে দেখা করতে ওর ঘরে গেছিল, কিন্তু, ও কারুর সঙ্গে কথা বলতে চায়নি। ওর বাবাকে দেখে সবার খারাপ লাগত। নিজের এক মাত্র সন্তানের এই পরিণতিতে উনি এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন, যে, উনি কাউকেই কোনো কথা বললেন না, রোহিতকেও না। উনি রোহিতকে ভীষণ ভালবাসতেন। কলেজেও রোহিতকে সবাই ভালবাসত । পড়াশোনায় ভালো ছিল, মাধ্যমিকে রাজ্য মেধা তালিকায় ওর নাম ছিল। স্কলারশিপ পেয়েছিল ও। বেশ মেলাপী ছেলে। যে কোনো মেয়ে ওর প্রেমে পড়ে যাবে, এমন দেখতে ছিল ও। সেই ছেলেটার এমন অবস্থা হবে, কে জানত! বলে না, নিয়তির টান! হয়ত তাই। এক বছরের মধ্যে সবাই দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হয়ে গেল। এবার দেড় মাস গ্রীষ্মের ছুটি। তার পর আবার কলেজ শুরু হবে। রোহিতের বাবা আর মা, দুজনেই এসে প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। প্রিন্সিপ্যাল ওঁদের দুজনকে দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “রোহিত তো বেশ ভাল ছেলে! হটাত কি হল, কে জানে! এরকম একটা কাণ্ড করে ফেলল। ওকে এই ভাবে এক বছরের জন্য পিছিয়ে দিতে আমারও সেদিন ভাল লাগেনি, কিন্তু, আর কোনো উপায় ছিল না। আপনারা মোটে ব্যস্ত হবেন না। এবার ও নিশ্চয় ভাল ভাবে উত্তীর্ণ হবে। আমি ওকে কলেজে আসার অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি। ছুটির পরই ওকে পাঠিয়ে দেবেন”। ওঁরা চলে গেলেন।
দেড় মাস ছুটির মধ্যে রোহিত একবারও ঘর থেকে বের হয়নি। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে পড়ে থাকল। ওর বাবা, মা ওর এই অবস্থা দেখে ওকে মামার বাড়ি যেতে বললেন। ও কিছুতেই যেতে রাজি হল না। শেষ পর্যন্ত, ওকে জোর করে ওঁরা মামার বাড়ি নিয়ে গেলেন, যাতে ওর মন একটু হালকা হতে পারে। কিন্তু, সেখানেও ও কারুর সঙ্গে মিশতে পারল না। একা একাই থাকল। ওঁরা শেষে ঘরে ফিরে এলেন। এক দিন রোহিত ভেতরের ঘরে একা বসে আছে। বাবা অফিস থেকে ফেরেননি তখনও। কেউ কলিং বেল টিপল। মা গেলেন দরজা খুলতে। রোহিত তো এখন দরজা খুলতেও যায় না। মা অনেকক্ষণ পর ওর ঘরে এসে ওকে বললেন, “তুই যা তো একটু সামনের ঘরে! কেউ তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে”। ও সোজা বলে দিল, “আমি কারুর সঙ্গে দেখা করতে চাই না, মা। তুমি বলে দাও”। মা বললেন, “এক বার দেখ তো, কে এসেছে!” বাধ্য হয়ে ও উঠল।
সামনের ঘরে গিয়ে ও যাকে দেখল, কোনো দিন কল্পনাও করেনি, যে ওকে এখানে দেখতে পাবে। রুচিকা এসেছে, প্রীতির সঙ্গে। ও আবার ঘরের ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। প্রীতি বলে উঠল, “অ্যাই রোহিত! তুই কি রে? আমরা তোর ঘরে এসেছি শুধু তোর সঙ্গে দেখা করতে! তুই তাও আমাদের সঙ্গে কথা বলবি না! এটা কিরকম ব্যাপার?” রোহিত ওর কথা শুনেও ফিরে যাচ্ছিল। তখন ওর বাবা এসে ঢুকলেন ঘরে। রোহিতের কলেজের বন্ধু বলে ওরা পরিচয় দিতে, উনি ছেলেকে বললেন, “নে! তোর বন্ধুরাও এসে গেছে। বস ওদের সঙ্গে। কথাবার্তা বল। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি”। বাবার কথা ফেলতে পারল না ও। বাধ্য হয়ে ওদের সঙ্গে বসল।
“আই আম সো সরি, রোহিত!” রুচিকা নিজের থেকে কথা শুরু করল, “তোর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি অত রাগ না করলে, আজ তোর এই অবস্থা হোতো না। তুই কি আর সত্যি সত্যি আমার উপর অ্যাসিডের শিশিটা ফেলতে পারতিস? কক্ষনো ফেলতিস না। তুই তো আমাকে ভালবাসতিস। নয় কি?”
রোহিত তখনও ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। মা এসে ওদের সামনে চা’ জলখাবার এনে রাখলেন। রুচিকা চা খায় না। মিষ্টি তুলে খেল। প্রীতি চা’ খেয়ে অভ্যস্ত। ও চা’ নিল। মা ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। রোহিত তখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। মা চলে যেতে, রুচিকা আবার বলে চলল, “দেখ রোহিত! তুই এরকম করিস না। তাহলে আমার খুব কষ্ট হবে, বলে দিচ্ছি!” রোহিত তাও চুপ করে বসে থাকল। ও যেন স্থাণু পালটে গেছে। কোনো হুঁ চুঁ কিছুই করছে না। একজন জেল ফেরত আসামীর মতন মুখ নিচু করে বসে আছে শুধু। এবার রুচিকা ওর একদম কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘরের মধ্যে ওরা তিনজন ছাড়া তখন আর কেউ নেই। রোহিতের মা বোধহয় রান্না ঘরে ঢুকেছেন স্বামীর জন্য চা’ জলখাবার তৈরি করতে। এই সুযোগে রুচিকা রোহিতের মুখটাকে দু হাতে ধরে ওর গালে একটা উত্তপ্ত চুম্বনের চিহ্ন এঁকে দিয়ে, ওর কানের কাছে এসে বলল, “আই লাভ ইউ সো মাচ! আই রিয়ালি লাভ ইউ”। প্রীতি তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এই অস্বস্তিকর ব্যাপারটা ও আর দেখতে চাইল না। মনে মনে ভাবল, মেয়েটা ওকে এত ভালবাসে, আর ও কিনা একবারের জন্যও মুখ তুলে তাকাল না! এত রাগ!
কিন্তু, সত্যি কী, রোহিত তখন রুচিকার মুখের তাকিয়ে ছিল না? অবশ্যই তাকিয়ে ছিল, যখন ওর হাতে রুচিকার চোখের জল এসে পড়ল। রুচিকা কাঁদছিল। সে কান্না অভিনয়ের শিল্প দিয়ে ফুটিয়ে তোলা কান্না নয়, সত্যিকারের নির্ভেজাল অনুতাপের কান্না। রোহিত সেদিন বুঝতে পেরেছিল, উইংসের ভেতরে ও যখন রুচিকাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ছিল, তখন রুচিকাও ওকে কাছে পেতে আকুল ছিল। তখনই ও ওকে ভালবেসে ফেলেছিল। ভালবাসার আগুণ দু দিকেই জ্বলে উঠেছিল। তবু কেন ও সেদিন ওরকম করল? ও কি ভেবেছিল, যে উইংসের ভেতরে আরও কেউ আছে, যে ওদের এই ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে! দুর্নামের ভয়েই কী ও সেদিন ওকে চড় মেরেছিল? একটা অত্যন্ত ভদ্র ঘরের ছেলেকে একটা মেয়ে ঐরকম ভাবে চড় মারে? কি পাপে? ওকে ভালবাসে বলে? যেটা রুচিকা বলতে সাহস পায়নি তখন, সেটা ও আবেগের বসে করে ফেলেছিল বলে! মনে মনে বলল, “না, রুচিকা, না। আমি আর তোমাকে কক্ষনও ভালবাসতে পারব না। ওয়ান্স বিটেন, টোয়াইস শাই। তোমার উপর যে টানটা আমার ছিল, তা সেদিন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তোমার হাতের চড় খেয়ে। ওটাকে আর জোড়া লাগানো যায় না। কক্ষনো না”। ওরা চলে গেছিল। তবু রোহিত নিজের জায়গা থেকে উঠতে পারেনি। অনেকক্ষণ বসে ছিল সেখানে। ওরও চোখে জল এসে গেছিল। রুচিকা ওর ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিয়েছে বলে নয়, ওর হৃদয়ের একটা সুক্ষ্ম অনুভূতিকে ভেঙ্গে চুর্ণবিচুর্ণ করে দিয়েছে বলে।
প্রথম দিন রোহিত কলেজে যেতে চায়নি। ওর মন একেবারে ভেঙ্গে গেছিল। ওর বাবা, মা বহুত চেষ্টা করে ওকে পাঠালেন। প্রথম ক্লাসে রোহিতের একদমই মন ছিল না। ক্লাসে, ছেলেদের বসার জায়গার একেবারে শেষের দিকের বেঞ্চে গিয়ে বসে ছিল। রোল কল করার সময় অধ্যাপক দু দুবার ওর নাম ধরে ডাকার পর সাড়া দিল। সে জন্য ওকে বকুনি পর্যন্ত খেতে হল। নতুন ক্লাস। সবাই অচেনা। তাই ও আর ওটাকে অত গায়ে মাখাল না। ওর শুধু একটাই ভয় ছিল সেদিন। রুচিকা ওকে দেখতে পায়নি তো! দৈবাৎ যদি ওকে দেখে ফেলে! ও কি আর সহ্য করতে পারবে সেটা! মনে হয় না। ভয়ে ভয়ে ক্লাসের সবাইকে দেখছিল সেদিন। না, রুচিকা এখানে নেই। ও তো এখন নিশ্চয় গ্রাজুয়েশনের ক্লাসে ভর্তি হয়ে থাকবে। এই কলেজেই ভর্তি হয়ে থাকবে, তার তো কোনো মানে নেই! অন্য কলেজেও গিয়ে থাকতে পারে! ধীরে ধীরে রোহিত আবার পড়াশোনায় মন বসাল।
প্রায় দু মাস পরে ওদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে নাম লেখাল। কোনো কারণে ও হয়ত প্রথম দিকে আসতে পারেনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ওকে বিশেষ অনুমতি দিয়েছেন নাম লেখাতে। এই মেয়েটাও প্রথম দিন থেকে মেয়েদের বসার জায়গার একদম শেষের দিকে গিয়ে বসল। ও আবার হিজাব পরে এসেছে। মুসলমান হবে হয়ত! রোহিতের এমনিই কারুর দিকে তাকানোর আর মানসিকতা নেই। কাজেই, কে কি পরল আর কোথায় বসল, তাতে ওর এখন আর কিছুই যায়াসে না। ও নিজের পড়াশোনায় ডুবে থাকল। ক্যারিয়ারটাই হল আসল। ওটা না থাকলে, তোমাকে এক চিলতে সম্মান পর্যন্ত কেউ করবে না।
রোহিত এখন বেশ সহজ হতে পেরেছে। প্রায় এক বছর হয়ে গেল। প্রথম বছরের পরীক্ষায়, ও বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করল। এবার আর একটা বছর। তারপরে উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে ও হয়ত ইঞ্জিনিয়ারিং কিম্বা মেডিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়বে। মেডিক্যাল সায়েন্স পড়ার জন্য ওর আগ্রহ খুব। এখন থেকে ও সেই জন্য কোচিং ক্লাসে যাচ্ছে। কলেজ থেকে ফিরে ওকে কোচিং ক্লাসে যেতে হয় সাইকেল নিয়ে।
সেদিন ক্লাস থেকে ফিরে ও নাকে মুখে দুটো কোনোরকমে গুঁজে, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আকাশে মেঘ ছেয়ে আছে। যে কোনো সময় ঢালতে আরম্ভ করতে পারে। যা গরম, তাতে একটু বৃষ্টি হলেই বরং ভালো হয়। কোচিং সেন্টারটা প্রায় দু কিলোমিটার দূরে। তাই, ও বেশ জোরেই সাইকেল চালাচ্ছিল। কিন্তু, তাও শেষ রক্ষা হল না। প্রথমে কালবৈশাখীর মতন ধুলো ঝড় উঠল, আর তার পরেই মুষল ধারায় বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে ওকে একটা ঘরের ছোট্ট বারান্দায় গিয়ে উঠতে হল। বারান্দায় সেরকম জায়গা নেই। তাই সাইকেলটাকে তলায় ভিজতে ছেড়ে দিল। এমন সময় একটা মেয়ে দৌড়তে দৌড়তে ঐ বারান্দাতেই ওর বাঁ পাশে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটা হিজাব পরে আছে। পুরো ভিজে গেছে। ওকে দেখে রোহিতের হাঁসি পেল। সাদা হিজাবটা ভিজে ওর গায়ে জড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বেশ জোরে ঝড়ের ঝাপটা আসছে। মেয়েটার হিজাব উড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ও কোনোরকমে সামলাচ্ছে। একবার তো হিজাবটা পুরো উড়েই গেল ওর মুখ এর উপর থেকে। রোহিত হেঁসে ফেলে ছিল। কিন্তু, ও তখনই দেখল ব্যাপারটা। দেখে কুঁকড়ে গেল। উঃ! মেয়েটার গালের কি সাংঘাতিক অবস্থা! ওর বাঁ দিকের গালের উপর যেন মাংস চাপানো আছে। ওঃ মা গো! ঠিক যেন কেউ ওর গালটাকে পুড়িয়ে দিয়েছে। ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। তখনই মেয়েটা কথা বলে উঠল, “কি দেখলে? আমার গালের অবস্থা? দেখে খুব কষ্ট হল, তাই না?” রোহিত এবার সোজা ওর মুখের দিকে তাকাল। বিকৃত গাল নয়, ওর গলার স্বর শুনে তাকাল। এটা তো ওর চেনা গলা! কিন্তু, তা কি করে হয়? না! এ তো অসম্ভব! মেয়েটা এবার ওর সামনে চলে এলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যদি সেদিন আমার উপর অ্যাসিডের শিশিটা ছুঁড়ে দিতে, তখনই আমার এই অবস্থা হয়ে যেত!”রোহিত যেন বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। এ কাকে দেখছে ও? হায় ভগবান! কি অবস্থা করেছ ওর! ওর মুখ থেকে শুধু একটাই কথা বেরিয়ে এলো, “রুচিকা, তুমি! তোমার এই অবস্থা কে করল?”“কেউ করেনি, রোহিত! কেউ করেনি!” বলতে বলতে ও চোখের কোলটা মুছল। হয়ত বৃষ্টির জল জমেছিল, নয়ত! নয়ত, চোখের জল। দুটোর মধ্যে তফাত কি? কিছুই না। দুটোই জল। একটা ভেতর থেকে উপচে পড়ে, আরেকটা আকাশ থেকে নেমে আসে।
রুচিকা রোহিতকে বলতে পারল না সেদিন কি হয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল ক্লাসে আসতে ওর একটু দেরি হয়ে গেছিল। ছুটে এসে ঢুকতে চেষ্টা করছিল, যাতে অধ্যাপক ওর দেরি দেখে বকুনি না দেন। কিন্তু, ও লক্ষ করতে পারেনি, ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট কন্সেন্ট্রেটেড হাইড্রক্লোরিক অ্যাসিডের একটা বড় জার নিয়ে দরজার দিকেই এগোচ্ছে। ল্যাবে অ্যাসিডটা রাখা ছিল। কোনো ঢাকনা ছিল না জারটার মুখে। অধ্যাপকের নির্দেশ অনুসারে যতটুকু দরকার ততটুকু ল্যাবের একটা ছোটো জারে ঢেলে, বাকিটা নিয়ে স্টোরে রাখতে যাচ্ছিল। ধাক্কা লেগে গেল দুজনের। রুচিকা টাল সামলাতে না পেরে ডান পাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টও ওর পাশেই পড়ে গেল। ওর হাত থেকে জারটা খসে পড়ল । প্রায় পুরো অ্যাসিডটা পড়ে গেল ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের গায়ের উপর। কিছুটা গিয়ে পড়ল রুচিকার ডান দিকের গালে। ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সেখানেই প্রাণ হারাল, আর রুচিকা নিজের সৌন্দর্য। ওর চোখ দুটো কোনোরকমে বেঁচে গেছে।রুচিকা আর কলেজ যেতে পারেনি তারপর থেকে। অনেক অস্ত্রোপচারের পর, প্লাস্টিক সার্জারি করে ওর মুখের আদল ডাক্তাররা কিছুটা ফেরাতে পেরেছে। তাই ও পরের বছর সেই একই ক্লাসে এসে পড়ে। নিজের মুখের বিকৃত রূপকে সব সময় হিজাবের মতন একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। কিন্তু, এসব কথা ও রোহিতকে বলতে পারল না। ওকে কেউ দয়া দেখায়, তা ও চায় না। শুধু বলল, “আমি তোমার উপর রাগ করে তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছিলাম। তাই ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিলেন। এখন অন্তত আমাকে ক্ষমা করে দাও!”
তখন যেন বৃষ্টির ঢল নেমেছে। সামনের রাস্তাটাও আর দেখা যাচ্ছে না। রোহিত এবার রুচিকার ঘাড়ে ডান হাত রেখে, ওকে নিজের দিকে টেনে আনল। জড়িয়ে ধরে ওর গালে, মুখে চার দিকে চুম্বন করতে লাগল। মুখে ওর তখন একটাই কথা বের হয়ে চলেছে, “না, রুচিকা। আমি কখনওই তোমার এই অবস্থা দেখতে চাইনি! বিশ্বাস করো, আমি সত্যি তোমার উপর অ্যাসিডের শিশিটা ছুড়ে ফেলতে পারতাম না। কক্ষনো না! আমি যে তোমাকে ভীষণ ভালবাসতাম! আজও আমি তোমাকে ভালবাসি”। ওর চোখেও তখন জল চিকচিক করছে। কিন্তু, সে জল যে ও মুছতে চায় না। দুজনকার চোখের জল সেদিন মিশে গেছিল বৃষ্টির জলের সঙ্গে, ঠিক যেন নদীর জল গিয়ে সমুদ্রের বুকে গিয়ে পড়ে। সেই চোখের জলই ওদের দুজনের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসাকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল।
