বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অবেলায় তুমি এলে

- বউমা ,একবার একটু নিচে এসোতো ।

- যাই মা ।

    সুদীপা  উপর থেকে  নামতে নামতে দেখে নিচে তার কাকা দাঁড়িয়ে রয়েছেন ।

- কাকাবাবু যে , হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে । তা  কখন এলে ।

- এই তো সবে এলাম , বাড়িতে অনুষ্ঠান রয়েছে নিমন্ত্রণ করতে এলাম ।

- ও তাই বলো ,তা না হলে  তুমি আমার বাড়িতে আসবে এমন সৌভাগ্য আমার হয়নি । মেয়েটা কেমন আছে খোঁজও নাও না । বিয়ের পর থেকে একদিনও আসোনি ; এই প্রথম এলে ।

- বৌমা , তুমি চায়ের ব্যাবস্থা করো ,আমি ভোলাকে বাজারে পাঠাচ্ছি । দেখি সে আবার গেল কোথায় ।

- জামাই বাবাজিকে তো দেখছি না ।

- ওর কথা আর বোলো না , একদিন বাড়ি থাকে তো একদিন বাইরে ।এখন মুম্বাই-এ আছে , পরশুদিন ফিরবে -- কাজে খুব ব্যস্ত ।


          কাকাও খুব ব্যস্ত লোক , পেশায় ডাক্তার  ; তাই কোথাও বেশিক্ষন থাকা তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয় ।

কোনোক্রমে দুপুরবেলাটা থেকে বিকেলেই  নিমন্ত্রণ করে চলে গিয়েছেন ।কাকা নতুন বাড়ি কিনেছে , সেই বাড়িতেই অনুষ্ঠান রয়েছে ।


        ছোট থেকেই শান্ত প্রকৃতির মেয়ে সুদীপা ।বাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসে তার ব্যবহার আর আচরণের জন্য । কখনো কাউকে ছোটবড় কথা বলতো না সে , তার স্বভাব ছিল সবাই কে মান্য করে চলা । বাবা মাকে যেমন ভালোবাসে ঠিক তেমনি শ্বশুর- শ্বাশুড়িকেও ভালোবাসে সুদীপা ।

       

        সুদীপার স্বামী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । মাসে মোটা টাকা মাইনে পায়  ,কিন্তু প্রায়শই তাকে বাইরে বাইরে কাটাতে হয় ।কখনো সুদীপাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়  আবার কখনো বাড়িতে রেখে যায়  ।তবে বেশিরভাগ সময় রেখেই যেত ।সুদিপাও শিক্ষিতা , ভূগোল নিয়ে স্নাতক  পাশ করেছে ; তারপরেই বিয়ে । পড়াশুনা করার ইচ্ছা থাকলেও সংসারী হয়ে যাওয়ার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি ।


টেবিলের উপর ল্যান্ড ফোনটা বাজতে থাকে , সুদিপা শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকাতেই ----

শ্বাশুড়ি বলেন , যাও ফোনটা ধরো।

মনটা কেমন যেন আজ একটু  খুশি খুশি ভাব লাগছে সুদীপার । বাপের বাড়ির লোক এসেছে বলে কি এই আনন্দ ? অবশ্য বাপের বাড়ির লোক দেখলেই যে কোনও মেয়ে যেন একটু খুশিই থাকে।

সুদিপা তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা তুলতেই ওপার থেকে আওয়াজ আসে---

-মা , আমি----------

-আমি ,আমি সুদিপা ।

-ও তুমি ,কেমন আছো ?

- ভালো আছি ।তুমি ?

- ভালো , বলছি ---

কথা শেষ করতে না দিয়েই সুদিপা বলে ,

-ফিরছো কবে ?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে , আমি পরশু ফিরতে পারবো না । তুমি মাকে জানিয়ে দিও ।

বলেই ফোনটা কেটে  দেয়।

     ফোনটা ওই অবস্থায় কিছুক্ষণ ধরে রেখে,  তারপর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রান্না ঘরের দিকে যায় ।

           

           মনটা খারাপ হয়ে গেল সুদীপার ,আর হয়তো বাপের বাড়ি যাওয়া হবে না । সে রান্না ঘরে গিয়ে শ্বাশুড়িকে সব বলল। শ্বাশুড়ি হাসতে হাসতে বলল ,---


-ছেলে আসবে না ,এ তো নতুন কিছু নয় । তার থেকে তুমি এক কাজ করো , কটা দিন বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এসো ।ছেলে এলে আনতে যেতে বলবো ।


          শ্বাশুড়ির সাথে সুদীপার বন্ধুর মতো সম্পর্ক । শ্বাশুড়িমা হয়তো অনেক চিন্তা করেই কথাটা বলেছেন। সুদীপার মনের অবস্থাটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন ।


     কথাটা শুনে সুদিপা মাথাটা নিচু করে বলল , "আমি কালই যাবো । আর ও না আনতে গেলে আসবো না ।"

     শ্বাশুড়ি মা সুদীপার কাছে গিয়ে দু হাত দিয়ে মুখটা তুলে বলল , আমি গেলেও না ? আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি ?

    - ওতো এমনি বললাম মা। আমি কি কখনো তোমাদের ছেড়ে থাকি , নতুন ঘরের পুজো হয়ে গেলে আমি নিজেই চলে আসবো ।

  বাড়ির একমাত্র মেয়ে সুদীপা । কাকার দুই ছেলে , কোনো মেয়ে নেই । কাকা - কাকিমা সহ বাড়ির সবাই সুদীপাকে খুব ভালোবাসে ।


         সুদীপা বাড়ি যেতেই সবাই খুব খুশি । সবাই কত আদর করছে ওকে । কাকার দুই ছেলেই ওর থেকে ছোট । একজন ক্লাস নাইনে ও আরেকজন ক্লাস ফাইভে পড়ে ।ছোট ভাই খুব করে ধরেছে ,ওকে নিয়ে বিকেলে বাজারে যেতে হবে ।

         বিকেল চারটে , ভাই কে নিয়ে বাজারে যায় সুদীপা । বাজারে কেনাকাটি করে দুই ভাই বোন কত গল্প , হাসি ঠাট্টা করে একসাথে ফিরছে ;  এমন সময় উল্টো দিক থেকে  একটা ছেলে সাইকেলে করে আসতে আসতে ওদের কাছে এসে দাঁড়ায় । সুদীপার মুখের দিকে তাকায় সে ,  সুদীপাও মুখ তুলে ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি কিছু একটা বলতে যাবে , ঠিক তখনি সুদীপা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যায় । ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে সুদীপার দিকে চেয়ে থাকে , পিছন দিক দিয়ে ডাকবে ভেবেও ডাকতে পারেনি । সুদীপা ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে  ; তাও সে সুদীপার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্থির ভাবে ।

         বাড়ির সবাই কত আনন্দ করছে , কিন্তু সুদীপার মুখে কোনো হাসি নেই  , কিছুক্ষণের মধ্যে   সে যেন কত চুপচাপ হয়ে গেছে । তার কিছু ভালো লাগছে না , মনে মনে কি যেন চিন্তা করে চলেছে । আর বার বার একটাই ঘটনা  তার মাথায় ঘুরছে ; সাইকেল চালিয়ে এলো , দাঁড়ালো , তার দিকে তাকালো আর  সুদীপা চলে এলো । বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই কথা ।

         ঘুমাতে গেলেও ঘুম আসছে না তার , কত কথায় যেন জড় হয়েছে মাথায়  কিন্তু সে সব কথা  সে কাউকে যে বোঝাতে পারবে না ; তার যেন মনে হচ্ছে সে খুব একা -- তার পাশে কেউ নেই আজ।

         সকাল হতেই সে তার মাকে গিয়ে বলে , " মা অনেক দিন দেবযানীর বাড়ি যাওয়া হয়নি , একটু দেবযানীর বাড়ি যাচ্ছি "।

         দেবযানী , সুদীপার খুব ভালো বন্ধু , তাই মা না বলেননি , তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলেছেন ।

         দেবযানীর বাড়িতে যাওয়ার পথে সেই সাইকেল চালিয়ে যাওয়া ছেলেটির সাথে তার আবার দেখা । হয়তো সুদীপা এই আশায় বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিল। নির্জন রাস্তা , রাস্তার দুধারে বড় বড় ঝাউ গাছ , সেই ফাঁকা রাস্তাতে শুধু দুজন প্রাণী একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে  কিন্তু তাদের মুখে কোনো কথা নেই । কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর ছেলেটি চলে যেতে থাকলে , সুদীপা তার উদ্দেশ্যে বলে ---  অরূপ ! দাঁড়াও অরূপ । 


অরূপ সুদীপার অনেক দিনের বন্ধু । অরূপ আর সুদীপা ভূগোল নিয়ে একই কলেজে পড়তো । তখন থেকেই দুজনের প্রেম । দু'জন দু'জনকে খুব ভালোবাসতো , দু'জন দু'জনকে মনে মনে চাইতো । তারা একই সাথে ঘুরতো , পড়তে যেত , কলেজেও যেত একইসঙ্গে  ।

         অরূপ মামাবাড়িতে থাকতো , তার মামাবাড়ি সুদীপার বাড়ির কাছাকাছি । তাই দেখাসাক্ষাৎে তাদের খুব একটা অসুবিধা হতো না । তাদের এই সম্পর্কের কথা কারো জানা ছিল না । ধীরে ধীরে সবাই জানতে পারে । প্রথমদিকে কোনো অসুবিধা না হলেও , খবরটা যখন সুদীপার বাবার কানে গেল তখন সুদীপার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ার অবস্থা ।  সুদীপার বাবা , অরূপের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয় । এতে সুদীপা ও অরূপ দুজনই তাদের মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়ে ।

         কিন্তু সুদীপার বাবা - মা তাকে অরূপের থেকে দূরে রাখতে পারেননি । মাঝে মাঝে সুদীপা সুযোগ খুঁজে অরূপ এর সাথে দেখা করতো ।

         এই ভাবে একটা নিয়মের মধ্যদিয়ে চলতে থাকে সুদীপার জীবন । একদিকে তার ভালোবাসা আর অন্যদিকে তার বাবা- মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ; এই দুইয়ের মাঝে পরে সে যেন ধীরে ধীরে কেমন একটা জড় বস্তু হয়ে গেছে । সে কি করবে , কি করতে চায় তার কিছুই বুজে উঠতে পারছে না ।

         সুদীপার মা কিন্তু এসব কিছুই লক্ষ্য রাখে , সুদীপা আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে  , ঘরে একা চুপচাপ বসে থাকে , কথা বলতে গেলেও বেশি কথা বলে না । যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু । এসব দেখতে মায়ের একদম ভালো লাগে না ।তাঁর একমাত্র মেয়ে সারাদিন এই ভাবে ঘরে মন মরা হয়ে পড়ে থাকবে তা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি । তাই তিনি  সুদীপার বাবা কে বোঝাতে থাকেন , কিন্তু বাবা অনড় ;  কিছুতেই ওই ছেলেকে মেনে নিতে রাজি নয় ।  মা নিরুপায় হয়ে

মেয়েকে বোঝাতে থাকে , যা হয়েছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই ওই রকম অনেক ছেলে পরে জীবনে আসবে , এ বয়সে এই রকম ভুল হয়ে থাকে ।

         সুদীপা কোনো উত্তর করলো না , শুধু মনে মনে ভাবল ভুল সে করেছে অরূপকে ভালোবেসে , ওকে যদি ভালো না বাসত তাহলে হয়তো আজ তার এত কষ্ট পেতে হতো না ।

         এই ভাবে লুকো চুরি প্রেম করতে করতে কেটে যায়  তাদের জীবনের তিনটি বছর , এর মধ্যে তাদের কলেজ জীবনেরও সমাপ্তি ঘটে ।

         লুকিয়ে মেলামেশা টুকটাক বাবার কানে আসছিল কিন্তু বাবা এত দিন কিছু জোর দিয়ে বলেননি। ডিগ্রি কোর্স শেষ হলেই বাবা তাকে নিয়ে যায় মামাবাড়িতে । সেখানে আগে থেকে ছেলে দেখা ছিল   । মামাবাড়িতে সুদীপার অমতে নিজেদের পছন্দের ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়  । বাবা মায়ের জোরাজুরিতে বিয়ের পিঁড়িতে উঠতে বাধ্য হয় সে  , অসহায় সুদীপা শেষ কথাও বলতে পারেনি অরূপের সাথে , কাউকে দিয়ে খবরও পৌঁছে দিতে পারেনি সে তার অরূপকে ।

         এদিকে অরূপ দু'মাস কোনো খবর পাইনি সুদীপার , শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দেবযানীর কাছে গিয়েছে সুদীপার খোঁজ আনতে ।

         দেবযানী সব কিছু জেনেও কি করে অরূপকে বোঝাবে তা সে নিজে বুজে উঠতে পারছিল না । শেষে অতি কষ্টে বলে ফেলে যে সুদীপার বিয়ে হয়ে গেছে ।

         অরূপ তো সেকথা শুনে হেসে উড়িয়ে দেয় , কিছুতেই বিশ্বাস করে না । কিন্তু দু'চার দিন পর অরূপ জানতে পারলো যে সত্যি সত্যি তার সুদীপার বিয়ে হয়ে গেছে । তার সুদীপা এখন আর তার নেই , সে এখন অন্য কারো হয়ে গেছে । রাগে , ক্ষোভে যেমন তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ঠিক তেমনি দুঃখে , অভিমানে সে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছে । মনে মনে সে ঠিক করলো --- সে আর মামাবাড়ি থাকবে না , সে নিজের বাড়ি চলে যাবে ।


        তারপর থেকে  সুদীপা যখন বাপের বাড়ি এসেছে কখনো অরূপকে দেখতে পায়নি । দেড়বছর তার বিয়ে হয়েছে , এই সময়ের মধ্যে যখন সে বাপের বাড়ি আসে প্রতি বারে ঘুরতে বেরিয়ে কিছু খুঁজে যায় , কখনো হাসে কখনো চুপ করে থাকে কিন্তু তার মনের কথা কাউকে বুজতে দেয় না।

        অরূপ মামা বাড়ি দিয়ে চলে যাওয়ার পরে আর কখনো আসেনি , মামার মেয়ের বিয়ে রয়েছে সেই উপলক্ষে সে মামাবাড়ি এসেছে । পুরানো স্মৃতি তার মনের মধ্যে জমা হয়েছে , তাই আজ সে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে এমনভাবে সুদীপার সাথে পর পর দুদিন  দেখা হয়ে যাবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি অরূপ ।

       সুদীপা অরূপকে ডাকতেই , অরূপ সেখানে দাঁড়িয়ে পরে , তার দু'চোখ দিয়ে ঝড় ঝড় করে জল পড়তে থাকে । সুদীপা অরূপের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে  থমকে দাঁড়িয়ে পরে , তার শরীরে আচমকা  একটা শিহরণ জাগে , কিছু একটা যেন তাকে পিছু টানছে । যে টান তাকে অরূপের কাছে যেতে বাধা দিচ্ছে । তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার পরিবার ।সুদীপা আর না এগিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে । অরূপ এগিয়ে আসে সুদীপার কাছে , এসে বলে -------

    ---   কেমন আছো সুদীপা ?

       চুপ করে থাকে সুদীপা , সে কি কথা বলবে তা বুজে উঠতে পারছে না । অরূপ এর দিকে একবার মাথা তুলে তাকিয়ে আবার মুখ নিচু করে নেয় ।

       কিছুক্ষন চুপ থাকার পর অরূপ আবার বলে ,

     ---  কই কিছু বলছো না যে -----

       সুদীপা মৃদুকণ্ঠে বলে ,

  ---    আমি ভালো আছি , তুমি কেমন আছো ?

    --   ভালো আছি , তুমি এত উদাস কেন ?

      -- কেনো তা ঠিক নিজেই জানি না ।

      -- তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে সুদীপা , হাতে শাঁখা , মাথায় সিঁদুর ।

       কথাটি বলতেই সুদীপা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে । সুদীপা আগে যেমন ছিল আজ ও ঠিক তেমন রয়েছে ; তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি , শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক পরিবর্তন হয়েছে তা তার মাথার সিঁদুর ও হাতের শাঁখা ; এই দুটো জিনিস তাকে অরূপের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছে ।

       কিছুক্ষন চুপ থাকার পর সুদীপা বলে ,

       --- আমাকে ক্ষমা করতে পারবে অরূপ ?

সাথে সাথে অরূপ বলে ,

----- ক্ষমার কথা আসছে কী করে ?কারোর জন্যই কারো জীবন থেমে থাকে না , সবাইকে এগিয়ে চলতে হয় --- চলার পথে কখনো কখনো ভুল হয়ে যায় ।

----- ভুল তুমি তো কিছু করোনি ।

---- কি ভুল , আর কি ঠিক তা না ভাবাই ভালো , তুমি বিবাহিতা , সংসারী । আশা করি নতুন জীবনে ভালো ভাবে অগ্রসর হবে  , অতীতকে ভুলে  ।

-- তোমাকে অনেক বড় হতে হবে অরূপ ,  তোমার সফলতা কামনা করি ।

" সফলতা " কথাটি ঠিক যেন পছন্দ হলো না অরূপের , সে বলে -------

      " সাফল্য আর ব্যার্থতা সব সময় মানুষের সাথেই থাকে ; সাফল্য সামনে আর ব্যর্থতা  পিছনে ,  পিছন ফিরলে ব্যর্থতার শিকার হয় আবার ঘুরে দাঁড়ালে সফলতা ; সুতরাং সুখ দুঃখের মতোই সাফল্য-ব্যর্থতা জীবনে আসে আর যায়।  "

      অরূপ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সুদীপার দিকে তাকিয়ে বলে , " আমি আসছি , তুমি ভালো থেকো " ।

      অরূপ সাইকেল চালিয়ে এক দৃষ্টিতে কোনো দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় । সুদীপা ঠায়  একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ।


যার জন্য এত অপেক্ষা , তার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত  আচরণ  পেয়ে মুম্বাইতে স্বামীর কাছে চলে যাবে ঠিক করে সুদীপা । এ দিকে সুদীপার স্বামী বাড়ি ফিরে আসায় আর তার মুম্বাই যাওয়া হয়ে ওঠেনি । বাড়ি ফিরেও সব সময় অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সুদীপার বর , সে জন্য মাঝে মাঝে ঝামেলাও হত । আসলে সুদীপা কখনই তার স্বামীকে  মন থেকে মেনে নিতে পারেনি । তার মন যেন আজও অরুপের জন্য অপেক্ষা করছে । সুদীপা সব সময় চারিদিকে দেখে , সব কিছু তার চোখের সামনে রয়েছে  শুধু নেই  তার ভালোবাসা , নেই  তার জীবন সঙ্গী ।সে যেন চলার পথে নিঃসঙ্গ । বাবা , মা সবাই যেন আজ তার কাছে অপরিচিত , সবাই যেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে ; জীবন শেষ হতে চলেছে তার ।

       চিন্তায় চিন্তায় কেমন একটা হয়ে গেছে সুদীপা । বাড়ির সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে সুদীপার ।  বাড়িতে থাকতে হয় তাই  রয়েছে । দীর্ঘ দিন স্বামী - স্ত্রী এর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই । স্বামী স্বামীর মতো , আর সুদীপা সুদীপার মতো । এই একঘেয়েমি জীবন তার যেন আর ভালো লাগে না , সে ফিরে পেতে চায় তার পুরানো জীবন , ফিরে পেতে চায় তার ভালোবাসা , সে আবার পড়াশুনা করতে চায় । বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে সে থাকতে চায় না ।

       আবার পড়াশুনার কথা ভালো ভাবে নেয়নি তার স্বামী , তাই পড়াশুনার চিন্তা ত্যাগ করতে হয় । নাই বা হলো পড়াশুনা , তার মনের যে একটা খিদে রয়েছে তা কে মেটাবে । স্বামীর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে জন্মাতে এমন হয়ে গেছে যে স্বামীর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না তার । তাই ঠিক করলো পালিয়ে যাবে সে এই সংসার ছেড়ে , চলে যাবে অনেক দূরে ।

       পালিয়ে যায় সুদীপা । সোজা চলে যায় দেবযানীর বাড়ি । দেবযানী তাকে ফিরে যেতে বললেও সে ফিরবে না জানিয়ে দেয় । দেবযানী উপায় না পেয়ে তাকে নিজের বাড়িতে থাকতে দেয় ।

        সুদীপা সব কথা বলে দেবযানীকে । সে দেবযানীকে জানায় , সে অরূপের সাথে থাকতে চায় , নতুন করে ঘর বাঁধতে চায় ।

        কথা শুনে প্রথমে চমকে যায় দেবযানী , পরে ঠিক করে বান্ধবীকে সহযোগিতা করবে । কিন্তু অরূপ !  সে কি আর ঘর বাঁধতে চায় সুদীপার সাথে  , সে কি আর তার পুরানো  স্বপ্ন ফিরাতে চাইবে । সে তো জানে সুদীপা সংসারী । অনেক চিন্তা এখন ঘিরে ধরেছে দেবযানীকে । শেষপর্যন্ত  অরূপের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে ফোনটি এগিয়ে দেয় সুদীপার দিকে --------

        অরূপ ফোন রিসিভ করতেই সুদীপা বলে ,

        ---- অরূপ , তোমার সাথে দেখা করতে চাই

        গলার স্বর চিনতে এতটুকু ভুল হয়নি অরূপের । রোজ এই স্বর তার কানে বাজে । সুদীপার প্রতি তার ভালোবাসা আজও অটুট । অরূপ জানে এখন সুদীপার সাথে দেখা করা মানে নতুন ঝামেলার সম্মুখীন হওয়া

        অরূপ সুদীপাকে জানায় ,

        -- সুদীপা , আমি কিছুদিন ব্যস্ত আছি। তাই দেখা করা আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয় ।

  সুদীপা বলে ,

  --- আমি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছি অরূপ , আমি তোমার সাথে থাকতে চাই ।

  কথাটি শুনে চুপ করে যায়  অরূপ , সে কি বলবে ঠিক করতে পারছে না , তাও মাথা ঠান্ডা রেখে বলে -----

  ----- ভালোবাসলেই তাকে কাছে পেতে হবে এমনটা সব সময় আশা করা উচিত নয়  । তুমি সংসারী , তোমার উচিত ভালো করে সংসার করা ।

   

      অরূপের কোনো কথাই  যেন  ভালো লাগে না সুদীপার , সে জোড় দিয়ে বলতে থাকে ,

   -----    আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না অরূপ ।

------ ভালোবাসা মানে জীবন শেষ নয় , ভালোবাসা জীবনের মধ্যে প্রানের সঞ্চার ঘটায় ; আর তুমি জীবন শেষ করে দিতে চাইছো ?

      একই কথা বলতে থাকে সুদীপা , অরূপ বোঝালেও  বুঝতে চাইছে না । সুদীপা সংসারে ফিরতে রাজি নয় ।

      অরূপ ভাবে এভাবে বোঝালে হবে না , একে এমন কিছু বলতে হবে যাতে ভুল বুঝে সংসারে ফিরে যায় ।

      অরূপ চড়া স্বরে বলে ,

      --- তুমি বিবাহিত , তুমি কারো স্ত্রী , তুমি আমার সাথে থাকতে পারো না । তুমি একজায়গায় সংসার করতে পারছনা যখন কোথাও সংসার করতে পারবে না । তুমি আমার ভালোবাসা অনেক দিন আগেই হারিয়েছ , আমি এখন আর তোমায় ভালবাসি না ।

        কথা গুলো বলে ফোনটা রেখে অরূপ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে ।

        দেবযানী সুদীপাকে বোঝানোর চেষ্টা করে । সুদীপার মনের মধ্যে যে ঢেউ উঠেছে ,তা কি ভাবে শান্ত করবে দেবযানী ।

        রাতে সুদীপাকে থাকার জন্য দেবযানী আলাদা একটা ঘর দেয় । সুদীপা সেই ঘরে চুপ চাপ বসে রয়েছে । তার চোখে কোনো ঘুম নেই , মনেতে রাশি রাশি আবেগ , ক্ষোভ , দুঃখ সব জমা বেঁধে  সুদীপার মন টাকে ভারী করে তুলেছে ।

        সে বসে বসে ভাবতে থাকে কি ভাবে সময় কাটাতো অরূপের সাথে , কি ভাবে থাকতো পরিবারের সাথে  ,  সব কিছু  তার মাথাতে জট পাকিয়ে যাচ্ছে । সে ভাবে ,সে  সব কিছুতেই ব্যর্থ হয়েছে ;  না পেরেছে তার ভালোবাসার সংস্পর্শে থাকতে , না পেরেছে তার স্বামীর সাথে ঘর করতে ।

        সুদীপা সব সময় মনে মনে ভাবত যে , তার সম্পর্কে যে যাই ভাবুক অন্তত অরূপ তাকে বুজবে । সে তো অরূপের সাথে কখনো অন্যায় করেনি । পরিস্থিতি আর সমাজ তাকে বাধ্য করেছে অরূপের থেকে দূরে থাকতে । সে তো দূরে থাকতে চায়নি । তাই তো সব কিছু ছেড়ে আজ ছুটে এসেছে ।

        এইসব ভাবতে ভাবতে তার দু'চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে । সে আজ মেনে নিতে পারেনি অরূপের কথা । সে কখনো কল্পনা করতে পারেনি  অরূপ তাকে প্রত্যাখ্যান করবে । আজ তার কোনো মূল্য নেই অরূপের কাছে । তাই সে  নিজেই নিজের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে , নিজেকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।

        কিন্তু ! তার তো কিছুই করার নেই , সে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে বলতে থাকে ------

      

     ‎

" ফুল হয়ে ফুটে আমি

               পাপড়ি মেলেছি ,

  ভালোবেসে শুধু বুকে

  ‎             ব্যথা পেয়েছি ;

  ‎সে শুধু দেখেছে আমায়

  ‎             পাপড়ি মেলিতে ,

  ‎দেখেনি কভু , প্রজাপতি হয়ে

  ‎             কাছে আসিতে।


ভালোবাসা হারায়ে

               হয়েছিনু গৃহিনী ;

   পিছুটানে , অভিমানে  ব্যর্থ হয়ে --

   ‎           আজ আমি ভিখারিণী  ।।


ব্যর্থ জীবন আমার

            ব্যর্থ সবকিছু ;

ছারিছেনা  ব্যর্থতা ------

‎                  আমার পিছু  ।। "



               সুদীপার বেদনার কথা কেউ শুনুক বা না শুনুক একজন কিন্তু ঠিক শুনেছে । বহুদূর থেকে সে তার কিরণ সুদীপার কাছে পৌঁছে দিয়েছে , রাতের জোৎস্নার আলো ঘরের জানালা দিয়ে সুদীপার মুখের উপর গিয়ে পড়েছে , তার সুন্দর ফর্সা মুখখানি চাঁদের আলোতে ঝলমল করে উঠেছে , তাকে আরও সুন্দর লাগছে । চোখের দু'ধার দিয়ে ঝড়ে পড়া অশ্রুধারা চাঁদের আলোতে চিকচিক করে উঠছে , কে যেন তার সারা মুখে দুঃখের অভ্র মাখিয়ে দিয়েছে । তার বেদনা  ক্ষীণ জোৎস্নার আলোর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে । জোৎস্নার আলোর যেমন জ্বলার ইচ্ছা নেই ঠিক তেমনি সুদীপার যেন বাঁচার ইচ্ছা নেই , দেহে প্রাণ রয়েছে তাই সে বেঁচে রয়েছে । বাঁচা আর মরা দুটোই তার কাছে সমান ।

               চাঁদের আলো তার কানে কানে ক্রমাগত যেন বলে চলেছে , " চলো সুদীপা আমরা হারিয়ে যাই বহুদূরে , যেখান থেকে  আর কখনো ফিরে আসতে হবে না । যেখানে সুখ নেই  , দুঃখ নেই , বেদনা নেই  ;  তোমার ভাগ্য নির্ধারণ করার কেউ থাকবে না , শুধু থাকবে বিশ্রাম আর বিশ্রাম " ।

                 সুদীপা চিরনিদ্রায়  নিদ্রিত হয়ে পারি দেয় চাঁদের দেশে ।।         



         -------*****-----------*****---------




পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু