বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

জেন্টিং -জনসন- অনিকেত

//১//


জেন্টিং-এ ঘুরতে এসে, এভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফেঁসে যাবে ভাবে নি অনিকেত। বছরের এই সময়টা সাধারণত ওয়েদার কদাচিৎ গন্ডগোল করে। সকালে যখন কুয়ালালামপুরে হোটেল থেকে বেরিয়েছিল, তখন ডেস্কে চাবি রাখার সময়, রাতে ফিরছে বলেই এসেছিল। জেন্টিং, মালয়শিয়া শহরের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হিল স্টেশন একখানা, এখানে অ্যামুজিং পার্ক আর নানা রকম রাইড আর খেলা আছে। সাথে একটা ছোট ব্যাগ আর ক্যামেরা ছাড়া কিছুই সঙ্গে নেয় নি সে। প্ল্যান ছিল, আজকে সারাটা দিন এই জেন্টিং-এ কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফিরে যাবে। আসার সময়, কেবল কারে করে এসেছে। যতই উঁচুতে উঠেছে কেবল কার, ততই স্পষ্ট হয়েছে নীচের জঙ্গল, সমুদ্র আর ডকে দাঁড় করিয়ে রাখা লাক্সারি ইয়ট গুলি। একটা আধুনিক সভ্য শহরে, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো জঙ্গলকে, তার আদ্যিকালের সব গাছপালা শুদ্ধ মেনটেইন করে রেখেছে মালয়শিয়া। এটা ভেবে মনের ভেতরে রোমাঞ্চ হচ্ছে। এত পুরোনো জঙ্গল আর কোন শহরের বুকে বজায় আছে বলে তার জানা নেই।
কেবল কার থেকে নেমে, অনিকেত উদ্দেশ্যহীন ভাবেই ঘুরতে থাকে জেন্টিং। কেবল জায়গাটাই এখানে আসার জন্য যথেষ্ঠ। অ্যামুজিং পার্কের বিশেষ আকর্ষণ নেই ওর। অনিকেত মধ্যবয়সের শেষ চরণে এখন। বিয়ে থা করে নি। ছোটবেলায় যাকে ভাল লেগেছিল, তাকে সে কথা বলারই সুযোগ পায় নি - কে জানে, হয়তো সেই মেয়েটি তাকে সে সুযোগ ইচ্ছে করেই দিতে চায় নি। বারবার কোন বাহানায় মুখোমুখি হওয়া থেকে এড়িয়েই গেছে। মরিয়া হয়ে অনিকেত, একটা পত্রও লিখেছিল - কিন্তু অনেক ভেবে সেটা আর তার হাতে বা ঠিকানায় পোস্টে দেয় নি। পড়াশুনো শেষ করে, ভাল চাকরি পেতে তার বেশি সময় লাগে নি। মা-বাবা ছেড়ে যাবার পরে, এখন সে একাই। ছোট ভাই আছে, সে নিজের কাজ আর সংসার নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকে। বছরে তার বাড়ি আসার বা ফোন করার তারিখ নির্দিষ্ট আছে; তার বাইরে সে নিজে থেকে যোগাযোগ করে না। অনিকেত মাঝে মাঝে ফোন করে ফেলে, তার এক আধটাই রিসিভ হয় অন্য প্রান্তে। তাই নিজেকে নিজের মত করে সে গুছিয়ে নিয়েছে। বছরে একটা সময়, আর সেটা ডিসেম্বরেই সাধারণত, সে লম্বা ছুটি আর অফিসের এল টি সি নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। এবারে মালয়শিয়া আর সিঙ্গাপুর তার ইটিনারিতে রয়েছে।
আজ ২৫-শে ডিসেম্বর, ভাল ঠান্ডা আছে এত ওপরে। অস্বাভাবিক ভিড়, সারা পৃথিবীর লোকজন সকলেই যীশুকে স্মরণ করতে, পাহাড়ের এই ছোট্ট শহরকেই যেন বেছে নিয়েছে। কেবল কারও সব ফুল এসেছে। ঘুরতে ঘুরতে অনিকেত ছবিও নিচ্ছে - সে যদিও প্রফেসনাল নয়, কিন্তু ভালই ছবি তোলে। কেবল কারে আসার সময়, নীচে জঙ্গলের মাথায় জমে থাকা অন্ধকার আর টুকরো টুকরো ভেসে থাকা মেঘের ছবিটা আজকের এখনও পর্যন্ত বেস্ট শট। দিনের আলো, মেঘেদের ঘন ঘন আসা যাওয়ায় কিছুটা ম্লান, সূর্য্যদেব মাঝে মাঝেই অন্তর্হিত হচ্ছেন। একটা জায়গা দেখে অনিকেত বসে পড়ে। তার একটু লেখালিখির বদভ্যাস আছে, তাই প্রায়শই সে চরিত্রের খোঁজে রাস্তায়, মলে, এয়ার পোর্টে বা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বা বসে মানুষ লক্ষ্য করে। আলাদা কিছু পেলে, নোট করে রাখে, সাথে তার একটা নামও দিয়ে দেয়। এমন কত চরিত্র তার ঐ নোটবুকে লুকিয়ে আছে - লেখার সময় জায়গা বুঝে, তাদেরকে হাজির করে ও। আজও তাই করছিল।
সময় কি ভাবে কেটে যায়, এই সময় তার খেয়ালই থাকে না। দুটি চীনে বাচ্চা, মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, ছেলে না মেয়ে - দুটো খরগোশ নিয়ে খুব আদর করছে রাস্তায় থেবড়ে বসে। রাস্তার ভিড় ওদের পাশ কাটিয়েই যাচ্ছে - যার বাচ্চা, সে নিশ্চয়ই কাছে পিঠেই আছে - নইলে এত ভিড়ে বাচ্চা দুটোর হারিয়ে যেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। অনিকেত নজরে রাখে ওদের। খরগোশ দুটো কোথা থেকে ওরা পেল, তাই ভাবছিল ও। এবার খেয়াল করে দেখতে পায়, সামনে একটা ঘেরা ঘাসের লন মত রাস্তার ওপারে, সেখানে অনেক খরগোশ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষের কাছাকাছি থাকতে থাকতে এরাও ভয় টয় আর পায় না।ওর বেশ মজা লাগছিল, ক্যামেরা তাক করে, পর পর ক'টা ছবি নেয়। বড় বড় শহরে, আজকাল পশু- পাখীদের প্রতি ভালবাসা দেখানোর লোকও কমে গেছে, আর সময়ও কেউ খরচ করে না। এ ছবিটি তার উচিৎ জবাব হতে পারে। অনিকেত, মাঝে মাঝেই ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে তার তোলা ছবি, ক্যাপশন লিখে, খবরের কাগজে পাঠায়। সব ছবি ছাপে না, তবে বেশ কয়েকটা ছবি কাগজে বেরিয়েও ছিল। এই ছবিটা সে পাঠাবে এখনই স্থির করে নেয়।
পেটে যেন একটু খিদে খিদে বোধ হচ্ছে - অনিকেত চারপাশে চোখ বোলাতে থাকে। এদের সব ডিশ খেতে পারবে না, তবে স্যান্ডউইচ বা হট ডগ চলবে। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।

//২//

আধা ঘন্টা পরে, অনিকেত ঠিক করে, যে কোন একটা রাইড বা খেলায় না চড়ে বা না খেলে গেলে জেন্টিং আসা অসম্পূর্ণ লাগবে। ঘুরে ঘুরে খুঁজতে থাকে কোথায় ভিড় কম। পাঁচটার আগে, ফিরে যাবার কেবল কার নেই, মানে ওর টিকিটে তাই বুকড। এখনও তিন ঘন্টা সময় হাতে। ভিড়ের যেন শেষ নেই। ঘুরে ঘুরে এবার কিছুটা খোলা জায়গায় এসে পড়ে ও। এদিকে পাহাড়ের গা সিধে নীচে নেমে গেছে৷ অসাবধান হলে সোজা পতন অনিবার্য্য - যদিও রেলিং দেওয়া আছে। আর তখনই পাহাড়ের শেষ খাঁজে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল হোটেলটা ওর চোখে পড়ে। মেঘের আড়ালে থাকার জন্য, এত কাছে দাঁড়িয়েও, একটুও দেখতে পায় নি এত উঁচু হোটেলটাকে। আশ্চর্য্য। যেন ভোজবাজির মত হঠাৎ ই শূন্য থেকে নেমে এল এটা। অবাক হয়ে দেখতে থাকে অনিকেত। এই পাহাড়ের মাথায়, এত বিশাল একটা হোটেল কে বানিয়েছে? হিম্মত আছে তার। আর কল্পনাও। সে রেলিং এর কাছে এসে সাবধানে দাঁড়িয়ে তার এই নতুন আবিষ্কার দেখতে থাকে।
'ইটস হন্টেড'।
পাশে দাঁড়িয়ে একটা লোক স্বগোতোক্তি করে। অনিকেত চোখ নামিয়ে এনে লোকটাকে দেখে। ধরতে পারে না, এই বিদেশী কোথা থেকে এসেছে।
'সরি,হোয়াট ডিড ইউ সে'? অনিকেত জিজ্ঞাসা করে।
'সাম অব দি রুমস ইন দিস হোটেল আর হন্টেড। ঘোস্টস স্টে দেয়ার'।
'ইস ইট ট্রু? রিয়েলি? হাউ ক্যান ইট বি পসিবল? দেয়ার ইজ নাথিং কলড ঘোস্ট'!
'নো, আই সে দি ট্রুথ। বিলিভ মি। আই স্টে দেয়ার। অ্যাক্টুয়ালি আই ওয়ার্ক দেয়ার'।
'সিন্স হোয়েন'? অনিকেত জিজ্ঞাসা করে।
'ফাইভ ইয়ারস নাউ। দে ডোন্ট ওপেন দোজ রুমস নাউ, আই হার্ড। বাট ঘোস্টস ক্যান গো টু এনি রুম। ইস ইট নট'!
'আই ডোন্ট নো। এ্যান্ড আই ডোন্ট বিলিভ অলসো'।
'ইফ ইউ স্টে, দেন অনলি ইউ উইল বিলিভ। গুড লাক'।
অনিকেত ঘাড় নামিয়ে গুড ডে বলার আগেই, লোকটা চলে যায়। কিন্তু এত দ্রুত কি করে যেতে পারে? রাস্তা এখানে একই দিকে, সেখানে লোকটাকে দেখতে পায় না অনিকেত। যেন উবে গেছে লোকটা। অনিকেত কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। চারপাশে সবাইকে দেখা যাচ্ছে, কেবল সে লোকটাই নেই। রেলিং ধরে, আরোও ক'জন হোটেলটাকে দেখছে, লোকটাকে সেখানেও লোকেট করতে পারে না। এমন অদ্ভুত ঘটনা, অনিকেত বুঝতেই পারে না, সত্যি সত্যিই হল কি?
হঠাৎ, দিনের আলো বেশ কমে যায়। আকাশে এত মেঘ কখন জমা হল? এই তো রোদ ছিল! অনিকেত এবার কেব্ল কার পয়েন্টের দিকে পা চালায়। যদিও অনেকটা সময় আছে হাতে, কিন্তু ওখানেই অপেক্ষা করবে সে। পার্কের রাইডে চড়ার আর মন নেই। সে নিজে কল্পনাপ্রবণ, তাই লোকটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। লোকটার অস্তিত্ব নিয়ে তার কোন সন্দেহ নেই মনে, কিন্তু কথা শেষ হবার সাথে সাথে লোকটার অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও।
'গোয়িং ব্যাক'?
পেছন থেকে সেই গলা শুণে, অনিকেত থমকে দাঁড়ায়। খুব ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। লোকটা সামনেই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
'পারডন স্যার"!
'গোয়িং ব্যাক? আই মিন আর ইউ লিভিং জেন্টিং'?
লোকটার এই গায়ে পড়া প্রশ্ন শুনে মনে মনে একটু বিরক্তই হয় সে, তবুও ভদ্রতা বজায় রেখে বলে, 'ইয়েস'।
'বাট ইউ ক্যান নট গো ব্যাক৷ ইয় হ্যাভ নট স্টেইড ইন দি হোটেল'!
'নো, আই এম নট স্টেয়িং দিস টাইম। ইফ আই কাম এগেইন, দেন পারহ্যাপস....'।
'বাট আই থিংক, টু-ডে, আই মিন টু-নাইট ওয়াজ গুড স্কোপ'!
'স্কোপ? হোয়াট স্কোপ'?
' ইউ উইল সি সুন। গুড বাই'।
এবার অনিকেত উত্তর দেয় না, লোকটার ফিরে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর দশ পা এগিয়ে যাবার পরে, লোকটাকে আর দেখতে পায় না। মেঘ এখন অনেকটা নীচে যেন নেমে এসেছে। সকলেই হাত দিয়ে মেঘ ধরার চেষ্টা করছে। ঠিক এই সময়ই হুড়মুড়িয়ে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামলো। যে যেদিকে পারে, বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে আশ্রয়ের খোঁজে দৌড় লাগায়। ক্যামেরাটাকে বগল দাবা করে, অনিকেতও আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে। লোকটা কেন বললো ওই কথাটা? মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে। আমি কি দেখবো? তাও আবার সুন? আমি তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নেবে যাব। অনিকেত এবার একটু অস্বস্তিও অনুভব করে। হঠাৎই তার খেয়াল হল, লোকটা যখন ওর সাথে কথা বলছিল, তখন আশে পাশের কেউ রাস্তায় ওদের দেখছে বলে মনে হচ্ছিল না। যে যার মতই পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাহলে কি সবটাই মনের ভুল? তা কি করে হয়? অনেক চেষ্টা করেও কোন খুঁত সে বের করতে পারে না। বৃষ্টি যেন বাড়ছে। অনিকেত এবার জোরে দৌড় দেয়।

//৩//

সারা এলাকা জুড়ে যে হৈ চৈ, বাচ্চাদের চেঁচামেচি, ভিড়ের গোলমাল এতক্ষণ ছিল, সব এই মুহুর্তে বৃষ্টির শব্দে চাপা পড়ে গেছে। অনিকেত একটা শেডের নীচে কোনরকমে দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছে। অধিকাংশ লোক ভিজছে, তারা বৃষ্টিকে সাথে নিয়েই মজা করতে করতে চলেছে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এখন, সেখান থেকে কেবল কার রাইডিং পয়েন্ট পোয়াটাক রাস্তা। বৃষ্টি একটু ধরলে রওয়ানা হবে, মনে মনে ঠিক করে। কিন্তু বৃষ্টির কমার কোন শীঘ্র লক্ষণ নজরে আসে না। এখন জোরে হাওয়াও দিচ্ছে - আর কি কনকনে ঠান্ডা! কয়েক মিনিটে পুরো আবহাওয়া আমূল বদলে গেল,কে বলবে একটু আগেই ও খরগোশের ছবি তুলেছিল! এখন কোন নাম নিশান নেই! পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে স্থানীয়। অনিকেত জিজ্ঞাসা করে, 'ডাস ইট রেইন দিস টাইম রেগুলারলি হিয়ার ইন জেন্টিং'?
'নো, নেবার, দিস ইজ এক্সট্রা অর্ডিনারী, ইট সিমস'।
'ওকে', আর কিছু বলার খুঁজে পায় না অনিকেত।
'দে হ্যাভ স্টপড কেবল সার্ভিস ডিউ টু উইন্ড এন্ড রেইন টুডে'।
অনিকেত চমকে ওঠে। এর মধ্যেই! এই তো মিনিট দশেক বড়জোর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আতংকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ' হাউ উই উইল গো ব্যাক টু হোটেল'?
'আই হার্ড, দে আর অ্যারেঞ্জিং বাসেস। বাট দ্যাট উইল বি ভেরি রিস্কি। ল্যান্ড- স্লাইডস আর কোয়ায়েট অফেন ডিউরিং দিস সর্ট অব রেইন'।
বলে কি রে? আর তখন মনে হল লোকটার শেষ কথাটা।
'ইউ উইল সি সুন'!
না, না এসব তার মনের ভাবনা। কিছু হবে না। এত লোক আটকে আছে জেন্টিং এর ওপরে, অথরিটি কিছু একটা ব্যবস্থা তো করবেই। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে।
এই সময় একটা ল্যান্ড রোভার রাস্তায় এসে ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়। মাইকে কিছু একটা বলছে, কিন্তু অনিকেত এক বর্ণও ফলো করতে পারে না। পাশের লোকটা উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পরে, লোকটার মুখে হাসির আভাস দেখে, অনিকেত কিছুটা ভরসা পায়।
'হোয়াট দে ওয়্যার টেলিং? আই কুড নট গেট ইট'!
'বাসেস উইল বি কামিং সুন। দে উইল মেক রিপিট ট্রিপস, ডোন্ট ওয়রি'।
'ওকে, দেটস গুড নিউজ'।
'ইয়েস। ইউ আর ফ্রম ইন্ডিয়া '?
'দেটস রাইট। ইউ আর..'?
' আই স্টে হিয়ার অনলি ইন কুয়ালালামপুর'।
'ওকে। লেট আস ওয়েট দেন ফর বাসেস'।
'ইয়া। বাট আই স্টিল ফিয়ার ফর ল্যান্ড স্লাইডস। দিস মাউন্টেন ইস নট মেড আপ অফ হার্ড রকস। দিস রকস স্লিপ্স হোয়েন ইট ইজ সাফিসিয়েন্টলি ওয়েট উইদ ওয়াটার'।
'ওকে। লেট আস হোপ ফর দি বেস্ট। নাথিং লাইক দ্যাট হ্যাপেন্স টু-ডে'।
'ইন সা আল্লাহ'।
'হোয়াট ইজ ইয়োর নেম'? অনিকেত জিজ্ঞাসা করে ফেলে।
'করিম হাকা, ইয়োরস'?
'অনিকেত চ্যাটার্জী, ফ্রম ক্যালকাটা, ইন্ডিয়া'।
'বেঙলি'?
'ইয়েস, হাউ ডু ইউ নো'?
'আই নো দি বেঙলি সারনেমস, ইন মাই অফিস, মেনি বেঙলিস আর দেয়ার'।
একটা কথায় পাশের মানুষটা অনিকেতের অনেক কাছাকাছি চলে আসে। মনে হয় যেন কতদিনের পরিচিত। আর কিছু না হোক, একটু ভরসা পায় সে মনে।
বৃষ্টি আর হাওয়ায় এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভিজতে হচ্ছে। মাথাটা কোন রকম রক্ষা পাচ্ছে। সাথে ছাতাও নেই, তবে এই হাওয়ায় সেটা কোন কাজে আসতো না। অনিকেতের ঠান্ডা লাগছে রীতিমত।
চারিদিক বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। অ্যামুজমেন্ট পার্কের আলোগুলি বৃষ্টির মধ্যে ছায়া ছায়া তারার মত জ্বলছে নিভছে। বাতাসে ভারী বর্ষার গন্ধ আর সাথে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ মিশে কেমন একটা আবেশ তৈরী করেছে। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা যাচ্ছে না। একটু বসতে পেলে বেঁচে যেত অনিকেত। কিন্তু যেমন ভাবে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, তাতে সে আশা করা ভুল।
পাশের লোকটি ইতিমধ্যে আরোও বন্ধু করে ফেলেছে। তাদের সাথে, নিজেদের ভাষায় অনর্গল বকে যাচ্ছে। আশ্চর্য্য লোকটার মধ্যে কোন টেনশন দেখতে পায় না অনিকেত। এইজন্য বাঙালির কিছু হল না। সব কিছুতেই চিন্তা, না দুশ্চিন্তা করাটা, তার জিন ক্যারেকটার। তার ওপরে কল্পনাপ্রবণ উর্বর মস্তিষ্ক। একটু প্র‍্যক্টিকাল হলে, এ জাতটা অনেক আগেই অনেক এগিয়ে যেত। অনিকেত মনে মনে ফুঁসতে থাকে। আগামীকাল তার বাস, সিঙ্গাপুর যাবার জন্য, অবশ্য বিকেলে। আশা করা যায়, তার মধ্যে যে করেই হোক হোটেলে পৌঁছে যাবে। এই সময় একটা বড় আওয়াজ করে কিছু যেন পড়ার মত শব্দ হল, মনে হল। অনিকেত এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে লোকে মাথা চাপড়াচ্ছে। করিমের দিকে তাকাতেই সে বলে ওঠে, 'আই টোল্ড ইউ! ল্যান্ড স্লাইডস স্টার্টস। হো আল্লাহ রেহম'!
অনিকেতের শ্বাস এক মুহুর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায় যেন। সব কেমন পর পর ঘটে চলেছে - 'ইউ উইল সি সুন', লোকটা কি এগুলোই বোঝাতে চেয়েছিল?
'বাসেস মে নট কাম নাউ, অনলি হোপ, রেইন স্টপস, উইন্ড স্টপস - দেন কেবল উইল স্টার্ট এগেইন'।
'হোয়েন'?
'উই হ্যাভ, নাথিং টু ডু - এক্সেপ্ট ওয়েটিং'।

//৪//

শেডের তলায় এখন গুটি কয়েক মানুষ। সকলেই ভিজে কাক। তাই যে যার রাস্তা ধরছে, বৃষ্টি মাথায় করেই। দু একটা ছোট গাড়ি নীচের দিকে যাচ্ছে, তাতে কিছু লোক পয়সা দিয়ে উঠে গেল। করিম হাকাও সেভাবে চলে গেছে। অনিকেত জায়গা পায় নি, সে গাড়িতে। সে জন্যে করিম ছেড়ে দিচ্ছিল গাড়িটা, অনিকেত ওকে জোর করেই পাঠিয়ে দেয়। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে আসছে। ওর হোটেলে ফোন করে সাহায্য চাইলে কেমন হয়? এতক্ষণ এইটে কেন মাথায় আসে নি, বুঝতে পারে না। ওরা একটা হদিশ তো দিতে পারবে। এ রকম সময় কি করা উচিত। ভাগ্যিস হোটেলের নম্বরটা প্রথম দিনে এসেই ফোনে সেভ করে রেখেছিল।
নম্বরটা ডায়াল করে অনিকেত। কি সৌভাগ্য, লেগেও যায়। প্রত্যেকটা রিং এর সাথে অধৈর্য হতে থাকে, কেউ তুলছে না কেন? যখন প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছে, তখন কেউ লাইনটা তোলে।
হ্যালো!
রুম নম্বর আর নাম বলে অনিকেত নিজের পরিচয় আর বর্তমান সিচুয়েশান জানায়।
কিছুক্ষণ পরে, ও দিক থেকে জবাব আসে, চিন্তা করবেন না। জেন্টিং হোটেলে আপনার আজকের রাতের বুকিং ট্রান্সফার করা হচ্ছে। আপনি ওখানে চলে যান৷ রেফারেন্স দিলে, ওরা আপনাকে রাতের জন্য ঘর দিয়ে দেবে। কুয়ালালামপুরে ফ্ল্যাশ ফ্লাডে এখন চারিদিকে জল। আপনি আসতে পারবেন না।
এর চেয়ে বড় ধাক্কা আজ সারা দিনে অনিকেত পায় নি। লাইন কেটে গেছে। জেন্টিং হোটেল মানে কি সেই পাহাড়ের ধারের হোটেলটা? করিম থাকলে সুবিধে হত। রাস্তা আগের চেয়ে আরোও খালি লাগছে। কেবল পার্কের লাইটগুলি এখনও জ্বলছে। শেডের নীচ থেকে বেরিয়ে আসে অনিকেত। তার সারা শরীর ঠান্ডায় আর ভয়ে কুকড়ে গেছে। সামনে দিয়ে এক মহিলা পাশ করছিলেন, অনিকেত তাকে জিজ্ঞাসা করে 'জেন্টিং হোটেল,হুইচ ওয়ে'?
' কাম এলঙ, আই এম গোয়িং দেয়ার অনলি। ইউ হ্যাভ বুকিং'?
'ইয়েস। নো, রাদার ইয়েস'।
'ওহ, ফানি ম্যান!ওয়ান্ট টু কাম'?
'ইয়েস,ইয়েস…’
যা ভেবেছিল, তাই ই। মেয়েটি যেদিকে হাঁটছে, অনিকেত বুঝতে পারে, এই রাস্তা দিয়েই কিছুক্ষণ আগে উল্টো দিকে, সে দৌড়াচ্ছিল- যখন বৃষ্টিটা হুড়মুড়িয়ে এল। তার মানে জেন্টিং হোটেল, ওর দেখা সেই মস্ত হোটেলটাই। কিন্তু কোথাও নাম লেখা ছিল বলে খেয়াল পড়ছে না। ভাবলো মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে।
'নো, ইতস নেম ইজ ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড হোটেল। কমনলি কলড জেন্টিং হোটেল। ডু ইউ নো, ইট হ্যাজ দি হাইয়েস্ট নাম্বার অব রুমস - মোর দ্যান সেভেন থাউজেন্ড'।
'নো, আই ডিড নট নো। ইজ ইট গুড হোটেল'?
'অব কোর্স। ইউ উইল সি সুন'।
আবার সেই একই কথা। অনিকেত খুব জোরে চমকে যায় এবার। মেয়েটি জোরে হেসে ওঠে।
'হাউ ফার' অনিকেত ভয় কাটাতে জিজ্ঞাসা করে। যদিও সে আগে দেখেছে, রাস্তা নিয়ে একটা আইডিয়াও আছে, তবুও জিজ্ঞাসা করে।
'সুন উই উইল রিচ' মেয়েটির ছোট্ট জবাব।
এর পরে আর কথা হয় না। অনিকেত চলতে থাকে। কিন্তু মেয়েটির সাথে তাল রাখতে পারে না। এত রোগা-পাতলা একটা মেয়ে, তার থেকে জোরে কি করে হাঁটছে? পায়ে হাই হিলও আছে। নীচের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে আর অল্প আলোয়, অনিকেতের মনে হল, মেয়েটি রাস্তার একটু ওপরে বাতাসে ভেসে আছে। চোখের ভুল নিশ্চয়ই। এমন কি করে হতে পারে? তবু সন্দেহ একটা মনের ভেতর গেঁথে যায় তার। একটু পরে, চিন্তা করে, তার এই অবস্থায় পরে, স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনাগুলোও কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। আবার নীচের দিকে তাকায়, না মেয়েটি তো রাস্তা দিয়েই হাঁটছে। তাহলে এই যে দেখলো, সেটা কি ছিল?
খানিকটা দূরে অন্ধকারের মধ্যে একটা লাল আলোর আভা দেখা দিচ্ছিল। যত এগোচ্ছে, সেটা স্পষ্ট হতে থাকে - ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড হোটেলের লাল নিয়ন লাইটগুলো অন্ধকার চিরে জ্বলজ্বল করছে।
'হিয়ার উই আর...' মেয়েটির স্বগোতক্তি।
দিনের বেলায় চোখে পড়েনি, এখন মেয়েটির সাথে সাথে চলতে গিয়ে, অনিকেত টের পায়, মেইন রোড থেকে, সিঁড়ি কেটে নামানো হয়েছে, হোটেলের লবিতে পৌঁছানোর জন্য। যেটা নীচে রাস্তার সাথে গিয়ে মিশেছে। বাসে বা কারে আসলে হিল টপে ওঠার দরকার নেই - স্বচ্ছন্দে রাস্তা ধরেই হোটেলটায় আসা যায়। হোটেলটা ওপর থেকে যেমন মনে হচ্ছিল,পাহাড়ের খাঁজে বসানো, তা নয়। নীচের জমি সমতলই। একটা কৌতুহলের নিবারণ হল। লবিতে অনেক লোকজন। কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই - সকলেই প্রায় বর্ষাতি পড়া। লবিটা নানা রং-এর রেইনকোটে এই রাতের বেলাও ওপরের সিঁড়ি থেকে একটা ফুলের বাগান মনে হল ওর। সিঁড়ি শেষ করে, লবির মুখে এসে মেয়েটি হাত তোলে- লোকজন, আলো আর ঘরের ব্যবস্থা নিশ্চিত জেনে, অনিকেত অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে, মেয়েটির সাথে করমর্দন করতে যায়। মেয়েটি চোখের পলকে সরে যায়। হাত তোলে। কলকাতার বাঙালি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে ম্যানেজ করে। রং বেরং রেইন কোটের মধ্যে মেয়েটি মুহুর্তে হারিয়ে যায়। আর তখনই অনিকেতের মনে হয়, মেয়েটির গায়ে তো কোন রেইন কোটই ছিল না। এত জোর চমকে ওঠে, যে হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে যায়। নীচু হয়ে ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে বিকেলের সেই লোকটা। অনিকেত হকচকিয়ে চার কদম পিছিয়ে যায়।
'ওয়েলকাম স্যার। সি, আই টোল্ড ইউ, নাউ হিয়ার ইউ আর..'।
' ইউ.... '? অনিকেত এটুকুই বলতে পারে।
'ইয়েস, মি! আই ওয়ার্ক হিয়ার, সো আই স্টে। ফাইভ ইয়ার্স পাসড। আই লাভ দিস হোটেল'!
'ওকে। আই হ্যাভ ওয়ান নাইট বুকিং, হিয়ার। ক্যান ইউ চেক'?
'নো, আই ওয়ার্ক ইন দি ক্যাসিনো এট দি 22nd ফ্লোর। ইউ গো টু দি রিসেপশন, দে উইল অ্যারেঞ্জ। বাই দি ওয়ে, হোয়ার ইজ ইয়োর লাগেজ'?
'নো লাগেজ। অনলি টুনাইট। মর্নিং আই উইল লিভ'।
'ওকে, কাম টু মাই ক্যাসিনো। ইট ইজ ওপেন টিল টু এম'।
'আই ডোন্ট গ্যামবেল'।
'অল রাইট, বাট ইউ ক্যান সি পিপল প্লেয়িং দেয়ার'!
'মে বি। আই নিড হট বাথ ইমিডিয়েটলি'।
'ওকে, সি ইউ সুন'। লোকটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যায়।
অনিকেত ভাবতে থাকে, আজ দুপুরের পর থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটে গেল, তার কোন ব্যাখা নেই। লোকটা কি ভবিষ্যত দেখতে পায়? এই সব দেশে এমন অদ্ভুত মানুষ পাওয়া যায়, যারা মনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কোথায় যেন পড়েছিল। কিন্তু এ লোকটা তো বিদেশী, তারই মত।
রিসেপশনে, নাম ধাম আর আগের হোটেলের নাম বলতে, সত্যি সত্যিই তার নামে রুম বুক করা পাওয়া গেল। একুশ তলায়, চার নম্বর রুম। চাবির গায়ে লেখা ২১৪। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি চাবি নিয়ে তার সাথে চললো রুম খুলে দেবার জন্য। এ দেশে, মেয়েদের মধ্যে কোন ইনহিবিশন নেই, সব কাজই কাজ। আমাদের দেশে কবে এমন দিন আসবে।
'ইউ ওয়ান্ট এক্সপ্রেস লিফট স্যার? উই ক্যান গো আপ ফাস্টার'।
'সিওর'। অনিকেত ছোট করে জবাব দেয়।
করিডর পেরিয়ে অন্য সাইডে নিয়ে এল মেয়েটি।এখানে লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে। তবে লিফটগুলো বেশ বড়, ঘরের মত, একবারে চল্লিশ জন চলে যাচ্ছে আরামসে।
একটু দাঁড়াতেই লিফট চলে এল। মাঝে উনিশ তলায় একবার দাঁড়িয়েছে। তারপরে সোজা ২১ তলা। রুম খুলে আলো জ্বেলে, ফ্রিজ অন করে মেয়েটি ফিরে যায়। সেন্ট্রাল এ সি, তাই ঘর ঠান্ডাই ছিল। অনিকেতের রুমটা ভালই লাগে। দরজা বন্ধ করে, সোজা বাথ্রুমে।

//৫//

এক ঘন্টা বাদে, ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল জড়িয়ে যখন অনিকেত রুমে এসে বসে, তখন অনেকটা চাঙা লাগে তার। সমস্ত পোষাক শুকোতে দিয়েছে। স্নান করার পরে বেশ লাগছে। রুমের আলমারিটা খুলে একবার উঁকি দেয়, যদি স্লিপিং স্যুট থাকে বাই চান্স। আর কি আশ্চর্য, একটা ধপধপে কাচা ইস্তিরী করা স্লিপিং স্যুট সত্যিই আলমারিতে ঝুলছে। টাওয়াল ছেড়ে ঝটপট গলিয়ে নেয় সেটা। একটু টাইট হয়েছে, তবে ভালই চলে যাবে। এক রাতের ব্যাপার।
ইন্টারকম তুলে স্যান্ডুইচ আর কফির অর্ডার দিয়ে দেয়।
টিভি খুলতেই, প্রকৃতির ধ্বংস লীলাখেলা পর্দায় ভেসে ওঠে। ল্যান্ডস্লাইডে কিছু মানুষের মৃত্যুও ঘটে গেছে, এখনও বডি রিকভারির কাজ চলছে। রাস্তা অনেক জায়গাতেই নষ্ট হয়েছে তার দরুন। কি ভাগ্য, সে একদম ওপরে ছিল, কেবল কার এখনও চালু হয় নি। নিজের বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না। ভাগ্যিস ফোন করার কথাটা মাথায় এসেছিল। তখনই মনে পড়ে, মোবাইলে চার্জ নেই। ও চার্জার নিয়ে বেরোয় নি। রুমেও চার্জার নেই - যদিও প্লাগ পয়েন্ট আছে। আবার ডেস্কে ফোন করে। ওরা ডিনারের সাথে পাঠিয়ে দেবে। ততক্ষণ টিভি-র রিমোট টিপে অলস ভাবে অনিকেত চ্যানেল চেঞ্জ করতে থাকে। রুমের একপাশে বড় একটা কাঁচের জানালা, না জানালা নয়, কাঁচের দেওয়াল - পর্দা টানা। পর্দা সরালে, অনেক নীচে জেন্টিং এর রাস্তা আর অ্যামুজমেন্ট পার্ক আন্দাজ করা যায়। কিন্তু আজকে বেশি আলো দেখা যাচ্ছে না। আরোও চারটে তলা ওর ওপরে আছে। তার ওপরে বিশাল লাল নিয়ন লাইটে হোটেলের নাম। সারা ঘরটা লাল আভায় ভরে গেছে। অনিকেত পর্দাটা ভাল করে টেনে দেয়। ঘরে আলো আসলে ওর ঘুম আসতে চায় না। আর নতুন জায়গায় তো একেবারেই না। সেটা নিয়ে অতটা চিন্তা নেই, সে রেগুলার ওষুধ খায় শোবার আগে। কিন্তু আলো একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না। প্রথম ভাল লাগাটা একটু ফিকেই হয়ে গেল। দেখা যাক, হয়তো রাতে এরা আলোটা নিভিয়ে দেবে। রাত কিছুই হয় নি তেমন। কলকাতায় থাকলে এখন আর এক প্রস্থ চা হত। কিন্তু সারাদিনের ধকলে অনিকেত ক্লান্ত বোধ করে। এখন আটটা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে। সাড়ে আটটা- ন'টার আগে চার্জার বা খাবার কিছুই আসবে বলে মনে হয় না। টিভি-টা চলতে থাকে, অনিকেত বিছানায় শুয়ে পড়ে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতে পারে না অনিকেত। দরজায় কেউ বেল বাজাচ্ছে, সেই শব্দে, ধরমড়িয়ে উঠে বসে। দরজা খুলে দিতেই, একটি মেয়ে হাতে প্লেট আর চার্জার নিয়ে দাঁড়িয়ে।
'ইউ ওয়্যার স্লিপিং'?
'ইয়েস, জাস্ট গট স্লেপ্ট'।
'ওকে স্যার, ইয়োর ডিনার এন্ড মোবাইল চার্জার। এনি থিং মোর ইউ নিড? আফটার ওয়ান ও ক্লক নো রুম সার্ভিসেস অ্যাভিলেবল'।
'নো থ্যাংক ইউ, ইটস অলরাইট। গুড নাইট'।
মেয়েটি চলে যায়। অনিকেত বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ আবার ধুয়ে আসে। মোবাইল চার্জারে দিয়ে, প্লেটের ওপরের ঢাকনা খুলে স্যান্ডুইচের প্যাকেটটা খুলতে থাকে। আজ সারাদিন এই খেয়েই কেটে গেল, হায়রে বাঙালি। মনে মনে হাসে। মা যখন বেঁচে ছিলেন, ভাত না হলে না'কি খাওয়াই হল না, উনি বলতেন। আজ কতটা দূরে এক অন্য জগতে চলে এসেছে সে। মা'র কথা মনে হওয়ায়, বুকের মধ্যে একটা শিরশিরানি টের পায় সে। এই বোধটা যাবার নয়, যতদিন বেঁচে আছে- এর থেকে মুক্তি সে পাবে না।
খাবার শেষ করে, হাত ধুতে আবার টয়লেটে যায় অনিকেত। হাত ধুয়ে, বেরিয়ে এসে দেখে, প্লেটটা দরজার কাছে রাখা। তার পরিষ্কার মনে আছে, ও সেন্টার টেবিলেই ছেড়ে গেছিল প্লেটটা। তাহলে?
না'কি ওই নামিয়ে রেখে তারপরে টয়লেটে গেল? এতটা ভুল কি করে হতে পারে? হয়তো বাড়ির অভ্যাস মত, টেবিল থেকে প্লেট তুলে সিংকে রাখার মত, এখানেও তুলে নিয়েছে। সিংক না পেয়ে দরজার কাছে রেখে দিয়েছে। কিন্তু সেটা ওর মনে পড়ছে না, ও করেছে বলে। তবে অভ্যাসের কাজ সব সময় খেয়াল করেও হয় না। তাই হবে। মন শান্ত করে টিভি-তে চোখ রাখে। কোন একটা নাচের অনুষ্ঠান চলছে। মন্দ লাগছিল না, কিন্তু তবুও ও চ্যানেল বদলাতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে, মোবাইল চেক করে। এখনও পুরো চার্জ হয় নি। রাত দশটা প্রায় বাজতে চলেছে। এদিকে সময় আধা ঘন্টা এগিয়ে। রাত তাড়াতাড়ি তো ভোরও তাড়াতাড়ি। আর কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে, ব্যাগ চেক করে পাশপোর্ট, পয়সা সব গুছিয়ে রেখে, অনিকেত শোবার তোড়জোড় করে। তখনই মাথায় যেন বাজ পরে। সে তো ওষুধ সাথে নিয়ে বেরোয় নি, তার তো আজ ফিরে যাবার কথা ছিল। যদিও ঘুমের ওষুধ না ওটা, কিন্তু না খেলে কেমন লাগবে অনেকদিন ধরে, কোন অভিজ্ঞতা নেই। এখন ব্যাস্ত হয়ে লাভ নেই৷ যদি একান্তই প্রবলেম হয়, তো জেগেই কাটিয়ে দেবে। মনে জোর পায় কিছুটা। এক রাত জাগা কোন ব্যাপার নয়।
ঠিক এই সময় দরজায় বেল বাজে। কাউকে তো ডাকে নি। তবে!?
দরজা খুলে দেখে, সামনে সেই বিদেশি লোকটি।
'হ্যালো, কাম টু মাই ক্যাসিনো'।
'থ্যাংক ইউ, বাট আই এম টায়ার্ড। আই ওয়ান্ট টু স্লিপ'।
'সিওর ইউ আর? ইট উড হ্যাভ বিন ফান ফর ইউ'।
'নো, ইটস অলরাইট। গুড নাইট'।
'গুড নাইট। বাট,বাট ইফ ইউ ফিল টু কাম, প্লিজ কাম, আই এম ওপেন টিল টু এম'।
'ওকে'।
দরজাটা বন্ধ করে, বিছানায় এসে বসে। এই লোকটাকে আর নিতে পারছে না ও। গায়ে পড়া তো বটেই, আর কেমন যেন ভীতিকর। লোকটার ক্যাজুয়াল এ্যাপ্রোচটাই কেমন যেন ডবল মিনিংফুল।

//৬//

টানা দু-ঘন্টা চেষ্টা করেও ঘুমের দেখা নেই। হোটেলের ছাদের লাল নিয়ন এখনও জ্বালাই আছে। অনিকেত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। না ঘুমিয়ে শুধু শুয়ে থাকাটা বড় কষ্টকর। বুকের মধ্যে এমন চাপ লাগছে যে শুয়ে থাকতে পারছেই না। এখন আফসোষ হচ্ছে, যদি খাবারের অর্ডার না দিত, তাহলে কিছুটা ঘুম হয়তো হয়ে যেত এতক্ষণে। যাকে বলে রিচার্জিং স্লিপ।
হঠাৎ মনে হল, একবার ক্যাসিনোটা ঘুরেই আসবে। কিছুটা টাইম তো কাটবে। কিন্তু সে লোকটার মুখোমুখি হতে ওর মন থেকে ইচ্ছে করছে না। তবে এখন যদি লোকটা না থাকে! হতেও পারে। যদিও সম্ভাবনা খুব কম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিকেত স্লিপিং স্যুটের সাথে চপ্পল পড়ে, চাবি লাগিয়ে করিডরে বেরিয়ে আসে। লিফটে না চেপে, অনিকেত ঠিক করে সিঁড়ি ধরে যাবে। একতলাই তো ওঠা।
ক্যাসিনোর দরজায় সিকিউরিটি। ওকে আটকে দেয়। শুধুমাত্র খেলার জন্যই ভিতরে যাওয়া যায়। দেখার জন্য অবশ্য কেউ কেউ যায়, কিন্তু সেটা লম্বা প্রসেস। এখন পারমিশন দেবার মত, অফিস খোলা নেই, সরি স্যার। ফিরেই আসছিল, এমন সময় পেছন থেকে সেই আওয়াজ।
'প্লিজ কাম মাই ফ্রেন্ড'। কাঁচের দরজার ওপাশে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লোকটা।
অনিকেত ইশারাতে, সিকিউরিটির লোকটাকে দেখায়।
'হোল্ড মাই হ্যান্ড, নো ওয়ান ক্যান সি ইউ'।
অনিকেত দ্বিধা ভরে, হাত টা ধরতেই, তার শরীরে যেন বিদ্যুত খেলে গেল। কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে বিনা বাধায় ও ভিতরে চলে আসে। আশ্চর্য ব্যাপার। লোকটার হাতটা কি অসম্ভব ঠান্ডা! হাত ছাড়ার পরেও অনিকেত এখনও তা অনুভব করতে পারছে।
'আর ইউ আ ম্যাজিশিয়ান? ইউ ব্রট মি থ্রু গ্লাস ডোর! হাউ'?
'ডিয়ার ফ্রেন্ড, নাউ অনওয়ার্ডস ইউ ক্যান অলসো ডু দি সেম টু অ্যানি ওয়ান ইউ ওয়ান্ট'।
অনিকেত কথাটা ঠিক মত গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। কি যেন একটা গোলমাল লাগে ওর৷ ছুটে বেরিয়ে যেতে চায় ও। দরজার হাতলটায় হাত দিতে চাইছে, কিন্তু ধরতে পারছে না সেটাকে। তার হাতের তালুর এপিঠ- ওপিঠ দুদিক দিয়েই হ্যান্ডেলটা দেখা যাচ্চে। যেন ওর হাতটাও একটা কাঁচের মতই। এখানে আসার সময় তো ছিল না এমন। তবে কি ওই লোকটার হাত ধরতেই ও বদলে গেল? তা কি করে হয়!?
দ্রুত পায়ে অনিকেত সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। ওর চটির কোন আওয়াজ হচ্ছে না সিঁড়িতে! কেন?
২১-তলায় নেমে ২১৪ নম্বর রুমের দরজাটা যেখানে থাকার কথা, সেখানে কিছু নেই। শূন্য স্থান। না, ঠিক শূণ্য নয় - কিছু একটা ভাসছে শূণ্যে। অনিকেত ওটা কি ভাবতেই, সেটার কাছে পৌঁছে যায়। একটা সাদা বিছানা, নিজেকে দেখতে পায়, শুয়ে আছে পরম নিশ্চিন্তে। এ কি করে সম্ভব! এই তো আমি অনিকেত, ওখানে তাহলে কে? গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে ও। কিন্তু কোন আওয়াজ শুণতে পায় না। অনিকেত নিজেকে এবার ভাল করে দেখে। তার শরীরে স্লিপিং স্যুটটা আর নেই, পায়ে হোটেলের চপ্পলও নেই। সে কোথাও দাঁড়িয়ে নেই, সে এক টুকরো মেঘের মত ভেসে আছে। এভাবে তার অবস্থার পরিবর্তন কখন হল? ও তো কিছু মনে করতে পারছে না। মন, স্মৃতি সব মুছে যাচ্ছে। তবুও মনে করার চেষ্টা করে। একটু মন সংযোগ করতে অনেক পরিশ্রম করতে হল। ২১৪ নম্বর ঘরের ভেতোরে ও এখন। শুয়ে আছে, হাত-পা নড়ছে। কিন্তু, এ কি? সেই লোকটা তার বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে বিচিত্র হাসি। ও কি করতে চাইছে? বিছানায় অনিকেত ওঠবার চেষ্টা করেছে, হাওয়ায় থাকা অনিকেত বুঝতে পারে। বিছানায় অনিকেতের শ্বাস একটু করে আটকে আসছে। ওই তার শেষ শ্বাসটুকুও শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। লোকটা মুহুর্তে বড় কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে বেরিয়ে গেল। একটু পরে, অনিকেত বিছানার শরীর থেকে বেরিয়ে, চপ্পল পড়ে, দরজায় চাবি লাগিয়ে ওপরে যেতে থাকে। বাতাসের অনিকেত ওকে আটকাবার চেষ্টা করেও পারে না। খুব জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, অনিকেত,ওপরে যেও না। অনিকেত বুঝতে পারে না, অনিকেতকে থামাবে কি করে!
একটু পরে, দিনের আলো এসে পড়ায়, অনিকেত যেন জেগে ওঠে। এতক্ষণ নিজের বিছানার শরীরের সাথে যুক্ত হয়ে ভেসেছিল আর একটা অজানা কষ্ট পাচ্ছিল। রুমের দরজা খুলে হোটেলের লোকজন, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্রেচার হাতে চারজন একসাথে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসে। অনিকেতের শরীর তুলে নেয় সাদা স্ট্রেচারের বিছানায়। পুলিশ তার ব্যাগ খুলে দেখছে। পাশপোর্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অনিকেতের শরীর যতক্ষণে লিফটে করে নামে, হাওয়ার অনিকেত তার আগেই অ্যাম্বুলেন্সের কাছে পৌঁছে গেছে। তার শরীরটাকে এরা তার সামনেই নিয়ে যাচ্ছে, অনিকেতের ভীষণ ইচ্ছে হল, বাধা দেয়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও, সে কিছুই করতে পারে না।
অ্যাম্বুলেন্স চলে যাবার পরে, অনিকেত উঠে আসে ২১৪ নম্বর ঘরে, কাঁচের দেওয়ালের ভেতর দিয়ে, অনায়াসে। লোকটা ঠিকই বলেছিল। টয়লেট থেকে তার শুকিয়ে আসা জামা কাপড় পরে নেয়, এবার এক্সপ্রেস লিফটে আবার নীচে নেমে আসে। ডেস্কের মেয়েটিকে চাবিটা ফেরত দেয় - 'ইওয়র কি ম্যাডাম, রুম নম্বর ২১৪'।
চেয়ারে বসেই মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে যায়।
অনিকেতের ফিরে দেখার সময় নেই। তাকে হোটেলে পৌঁছাতে হবে। কুয়ালালামপুর! তার আজ বিকেলে সিঙ্গাপুর যাবার বাসের টিকিট কাটা যে। একটা চলন্ত কেবল কারের ছাদে বসে পড়ে ও। এক আশ্চর্য ক্ষোভে, পাহাড় থেকে নামার সময়, হোটেলের ছাদের নিয়ন গুলোর দিকে নজর দেয় - বিকট শব্দে বালবগুলি সব এক সাথে ফেটে পড়ে। পাহাড় আর জঙ্গল সেই শব্দ নিজেদের মধ্যে শুষে নিতে থাকে। অনিকেত হালকা হয়ে উড়তে থাকে কেবল কারের সাথে সাথে। আজ থেকে তার আর কোন ঘর সত্যিই থাকলো না। মা’য়ের দেওয়া নাম সার্থক করতে পেরেছে সে।

আবশ্যকিয় সূচনা ঃ বিদেশী লোকটি পাঁচ বছর আগে বেড়াতে এসেছিল। ক্যাসিনোতে সর্বস্ব হারানোর পরে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। একুশ তলার ২১৪ নম্বর রুম থেকে জানালা খুলে নীচে ঝাপ দেয়। একমাত্র এই রুমেই পরে জানালা না রেখে পুরু কাঁচের দেওয়াল তুলে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। সেই থেকে জনসন এখানেই থেকে গ্যাছে। আর ২১৪ নম্বরে কোন বোর্ডার এলে তাকে প্রলোভিত করে ক্যাসিনো যাবার জন্যে। যে খেলে, আর হেরে যায়- তখন জনসন গভীর তৃপ্তি পায়। আর যে ওর কথা শুণেও খেলতে রাজী হয় না, তাকে ও গলা টিপে মেরে ফেলে- তার দলে নিয়ে আসে। পরের সকালে আবার বোর্ডার খুঁজতে বেরোয়।
অনিকেত দুটো ভুল করে ফেলে। এক পাহাড়ের ধারে চলে যাওয়া- ও তখনও মরতে পারতো। কিন্তু আজ বেশি ভিড় দেখে জনসন সেটা করেনি, কারন তাহলে সাহায্য পেয়ে যেতে পারতো অনিকেত। আর দ্বিতীয় ভুলটা হল, যখন ডিনারের পরে জনসন ওকে ডাকতে আসে, তখন রুডলি ওকে ফিরিয়ে দেওয়া।
গিনিস বুক অব রেকর্ডসে এই হোটেলটির উল্লেখ আছে, হন্টেড বলে। সেটাই এই গল্পের বেস। আর আমি নিজেও এখানে সশরীরে ঘুরে এসেছি- সত্যিই স্পুকি জায়গা।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু