বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সে পরবাসে কে

কি প্রচন্ড বৃষ্টি! বাপ রে বাপ্! যেন বালতি করে জল ঢালছে আকাশ খুড়ো। ছাতা টাতা মানে নাকি এই বৃষ্টিতে। স্টেশন থেকে নেমেই দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছিল কিশোর। তখন জাস্ট নামবে নামবে করছে বৃষ্টি। একেই রাত এগারোটা, তার মধ্যে এই ওয়েদার। টোটো বা রিক্স পাবে না জানতোই। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর জন্য শর্টকাটটাই নিলো। ভাঙা কারখানার নির্জন গলিটা পেরলেই দুপাশে কিছু ঝুপড়ি। শুনশান আজ সব। ওগুলো পেরতেই নেমে গেল ধুন্ধুমার বৃষ্টি। তেমনই গর্জন। মল্লিকদের আমবাগান একপাশে, আরেক পাশে গোল পুকুর। সেখানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বাধ্য হয়েই দৌড়ে পাঠকবাড়ির ভাঙা গেট খুলে গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেল।


কিশোরের সাহস আছে মানতেই হবে। দিনের বেলা এ চত্বরে ছেলে ছোকরাদের খেলাধূলো আড্ডায় দেখা গেলেও সন্ধ্যার পর কেউ থাকে না। রাত বিরেতে তো নয়ই। বৃষ্টির হাত থেকে নিস্তার পেয়ে কিশোর একটু এদিক ওদিক দেখার সুযোগ পেল। 


আরে! এ বাড়িতে লোক এসেছে নাকি? গাড়ি বারান্দা থেকে মূল বাড়িতে ঢোকার সদর তো বন্ধই। তার বাঁদিকে আলাদা দরজা ছিল? চোখে পড়েনিতো! পায়ে পায়ে সেদিকে উঁকি মেরে দেখে হ্যাঁ, ছোট মাপের একটা খিড়কির দরজার তলা দিয়ে আলো আসছে হালকা। যাক্, ভয় ভয় ভাবটা আরো অনেকটা কমে গেল কিশোরের। ডানদিকে ঝোপ জঙ্গল বেশি। সে বাঁদিক ঘেঁষেই দাঁড়ালো। রুমাল বার করে মাথাটাথা মোছামুছি করতেই একটা আওয়াজ পেল। ঘাড় ঘোরাতেই দেখে সাদা ধুতি শার্টে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে তাকেই ডাকছেন!


আরে ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন। বৃষ্টি এখনি থামবে না। বাজও পড়ছে তো। ভদ্রলোক ভারি অমায়িক গলায় এমন ভেবে ডাকলেন যেন বহুদিনের পরিচিত। কিশোরের হাসি পেয়ে গেল। এই বয়সী মানুষকে ধুতি পরা দেখা যায় না তো!


খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। একি, পাঠক বাড়ির ভেতরে তারা যতটুকু দেখছে ভাঙাচোরা, বিবর্ণ। এ তো একেবারে সাফসুতরো, দিব্যি পরিপাটি। লোকজনও ভালোই আছে মনে হচ্ছে। এত রাতেও বাচ্চাদের গলার আওয়াজ! রাত জাগা পাবলিক তবে এনারাও কিশোরের মতোই। ভালোই হলো। একটু বসলে মনে হয় চা-ও পাওয়া যাবে।


সন্দীপন, কিশোরীলালকে চেয়ার দাও তো। ওগো শুনছো, একটু চা হবে নাকি। ধুতিবাবু বেশ হাঁকডাক শুরু করে দিলেন।


লে হালুয়া! কিশোরীলাল করে দিলেন যে কিশোরকে! চেনেন নাকি? একটু লজ্জা পেল কিশোর। এমন আগেও ঘটেছে। পাড়ায় সে একটু ডাকাবুকো নেতা গোছের হওয়ায় অনেকেই তাকে চেনেন, কিন্তু সে চিনে উঠতে পারে না সকলকে। ভীষণ অস্বস্তিকর হয় ব্যাপারটা। কিন্তু পাঠকবাড়িতে বহুদিন সে না এলেও এনারা এখানে এসেছেন  থাকছেন সে কথা কানে আসেনি তো! যাক্ গে। আগে তো বসি- ভাবল সে। মস্ত বড় কাঠের চেয়ারটা টেনে আনল যে ছেলেটি, সে কিশোরের বয়সীই। মিটিমিটি হাসছে তার দিকে চেয়ে। কিশোরও হাসলো দোনোমনো করে। 


মল্লিকবাগানে এবার চড়িভাতি হবে না দাদা? আমার কলকেতার বন্ধুরা আসতে চেয়েছে। চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটি বলে। গলার স্বর আর বাচনভঙ্গিটা অদ্ভুত তো! একে কিশোর চেনে? কিছুতেই মনে পড়ছে না কেন! অথচ, এনারা কেউ ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার মত মানুষ নন্। 


সন্দীপন, এখন এসব ছাড়ো। দাদাকে একটু বসতে দাও। ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই ছুম্ ছুম্ নূপুরের শব্দ এলো কানে। মস্ত বড় একটা ট্রেতে চায়ের নানা রকম সরঞ্জাম হাতে একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে বারান্দা ধরে। খোলা কোঁকড়ানো কালো একঢাল চুল ফর্সা সুগোল মুখটা ঘিরে। চোখ নীচে নামানো, কিন্তু মুখের লাজুক হাসিটা যেন সেই চোখেও ধরা পড়েছে। মেয়েটির পিছনেই তার মা বোধহয়। তাঁর হাতের রেকাবিতে কত রকম খাবার। সন্দীপন নামের ছেলেটি একটা টিপয় এনে রাখে। তার উপরে ট্রে নামিয়ে মেয়েটি কিশোরের দিকে তাকায়। তারপর লজ্জারুণ মুখেই ঝলমল করে হেসে উঠে এক ছুট্টে ঘরে পালায়। ওর মা এসে কিশোরের হাতে একটা মস্ত মিস্টি ভর্তি প্লেট তুলে দেন। মেয়ের লজ্জাই কাটছে না- গদগদ স্বরে বলেন তিনি। তুমি খাও বাবা। এমন দিনে এলে একটু যত্ন করতে পারছি না। যা বাদলা। ওগো, দেখোনা রবি যদি একটু পান এনে দিতে পারে।


হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি দেখছি। তুমি খাও.... এই দেখো! তুমি বলে ফেললাম। কিছু মনে করলে না তো?


ন্না না ...ঠিকাছে। কিশোরের চোখে এখনও ঐ গোল মুখটাই ভাসছে। ওনারাও খেয়াল করলেন বোধহয়। মুখ টিপে হেসে মহিলা বললেন, তুমিই তো বলবে। আজ না হোক্ কাল। কদিনই বা বাকি আছে বিয়ের। ও মল্লি, পাখাটা নিয়ে একটু দাঁড়া না এখেনে!


ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা দুজনে দুদিকে চলে গেলেন। প্লেট থেকে একটা মিস্টি তুলে মুখের কাছে আনতেই গোলাপজল আর টাটকা ক্ষীরের অপূর্ব সুবাস নাকে এলো। তক্ষুনি সেই মেয়েটি নিঃশব্দ চরণে আবার এসে দাঁড়ালো। হাতে হাতপাখা। কিন্তু কিশোর আশ্চর্য হলো মেয়েটির মুখ দেখে। সেই লাজুক হাসিটা নেই। বদলে একটা ভয়ার্ত ছাপ। এদিক ওদিক দেখেই ফিসফিস করে বললো, পালাও পালাও। এই জন্মেও তোমাকে পাবো না আমি, জানি। কিন্তু তুমি এবার অন্তত প্রাণে বাঁচো! পালাও...


ভ্যাবাচ্যাকা কিশোর যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে পালাতে যেতেই মেয়েটি তার কবজি টেনে ধরলো। কি ঠান্ডা হাত! এদিকে এসো। হিড়হিড় করে টানতে টানতে ছুটতে থাকে বারান্দা ধরে। ছুম্ ছুম্ নূপুরের সাথে মেয়েটির রিনরিনে গলাও বাজতে থাকে- বুঝতে পেরেছি তুমি চিনতে পারোনি। কোন বারেই পারোনা। তাও বাবা মা আর দাদা তোমাকে ধরে আনে প্রতিবার। এইদিনেই। প্রতিবারেই বাজ পড়ে সবাই একসাথে...


কিশোর দাঁড়িয়ে পড়ে! এ তো পাঠকবাড়ির সামনের গেট। ঐ তো গাড়ি বারান্দা, ঐ তো ঝলমল আলোতে দেখা যাচ্ছে বিরাট ফটক। কিন্তু...  কিন্তু... 


পালান পালান .... 


মেয়েটিকে দেখতে পেলো না আর। কিন্তু ফিসফিসিয়ে ঐ রিনরিনে কন্ঠস্বরটা তার চারপাশে ঘুরতে লাগলো। কিশোর প্রাণপণ শক্তিতে দৌড় লাগালো। পাঠকবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়াতেই প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো। তারপর নিঃসীম অন্ধকার চতুর্দিকে। কিশোরের যেন হুঁশটুকুও নেই। 


কতক্ষণ পরে জানে না। চেতনা ফিরতে দেখে বৃষ্টি একটু ধরেছে। সে পাঠকবাড়ির সামনের গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। চারপাশে ঘন অন্ধকার, ঝিঁঝি ডাকছে। অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য ছেয়ে আছে। সমস্ত শরীরের সাড় ফিরতেই পা চালায় দ্রুত বাড়ির দিকে। খানিক এগোতেই মনে হলো ডানহাতের আঙুল দুটো চটচট করছে। নাকের সামনে ধরতেই গোলাপজল আর টাটকা ক্ষীরের অপূর্ব সুবাস পেল!

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু