বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

শেষ আশ্রয়

আশ্চর্য একটা মিঠে হাওয়া চলছিল তখন। না না মিঠে ঠিক নয়! ভেজা ভেজা বললেও সবটা বোঝানো যাবে না। কোথাও যেন কেউ একজন সুগন্ধী পদ্মদিঘীতে ডুবস্নানের পর হেঁটে গেছে আস্নাত শরীরে! তার সিক্ত শরীর থেকে উদ্গত আর্দ্র সুবাস তার চলার পথকে বাকি পৃথিবীর থেকে আলাদা করে ফেলেছে। রুমকি হাতের বইটা বন্ধ করে চোখ বুজে বসেছিল কতক্ষন জানে না। হটাৎ দুপদাপ পদশব্দে দেখে অচেনা একটা ছেলে দৌড়ে আসছে তার দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় যেটুকু হতচকিত হয়ে পড়েছিল, সেটা কেটে গেল তড়বড় শব্দে বৃষ্টি নামতেই। বইতে ডুবে থেকে সে খেয়ালই করেনি কখন ঘণ মেঘ জমেছে। খেয়ালই করেনি পদ্মপুকুরে ডুব দিয়ে আসলে প্রকৃতিই আসছেন এপথে!


ছেলেটি বনান্ত। বন্ধুদের সাথে এসেছে দুদিনের ট্রিপে। যদিও তখন সে একাই পায়চারী করছিল অনেক্ষন ধরে। আসলে বুকের ভেতরের একটা উথালি পাথালি ঝড় তাকে স্থির বসতে দিচ্ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গও সেই মুহূর্তে তার ভালো লাগছিল না। আনমনা উদাস থাকায় মাথার উপরে কালো ছাতার মত জমতে থাকা মেঘ তাকেও ছুঁতে পারেনি। আচমকা ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তেই সে খেয়াল করে। দেখে, ধেয়ে আসছে তুমুল ধোঁয়াশার মত বৃষ্টির একটা মস্ত আস্তরণ। দুদ্দাড় পায়ে সামনের ছোট্ট ছাদওয়ালা বসার জায়গাটার দিকে ছুটে এসেছে কিছু না ভেবে। আসতে আসতেই নজরে পড়েছে, পিলারে হেলান দিয়ে হাতে বই নিয়ে বসা মেয়েটি ভয়ার্ত চোখে দেখছে তাকে। বৃষ্টি আর বনান্ত একসাথেই মেয়েটির কাছে পৌছেছিল। দুজনের কাউকে তাই আর অজুহাত দিতে হয়নি ঐ হটাৎ আসার। 


সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই, সেই আইডিয়া ছিল ওদের। কিন্তু বৃষ্টি এভাবে হতেই থাকবে, সেটা অনুমান করেনি কেউ। নদীর ধারের এই বহুল পরিচিত টুরিস্ট স্পটে রুমকি এসেছিল ওর দিদির বন্ধুদের দলের সাথে। ওদের সাথে প্রায়ই বেরয় রুমকি, আবার ওদের থেকে দলছুট হয়ে নির্জনে একটা বই হাতে বসেও পড়ে। আজও সে লেকের পাড়ে এই ফাঁকা ভাঙাচোরা ঘরটা দেখে বসে পড়েছিল বই হাতে। তারপরে আকাশ জুড়ে কত কি ঘটে গেছে,  সে খেয়ালই করেনি। কুয়াশার চাদরের মত চারপাশ ঢেকে মিহিগুঁড়োয় বৃষ্টি নেমেছে এখন। হালকা জলের ছাঁট আসছে রুমকির মুখে। দীর্ঘ আঁখি পল্লবে এক দুফোঁটা জমে গেছে, যেন ধানের শিষের উপর শিশিরবিন্দু!


ভিজে যাচ্ছো, এদিকে সরে এসো। বনান্ত ডাকে রুমকিকে। রুমকি একটু চমকে উঠলেও সরে আসে বনান্তের দিকে। একটা পিলারে হেলান দিয়ে ভাঙা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসেছে সে। বেশ অপরিস্কার জায়গাটা। ফু দিয়ে একটু ধুলো ঝেড়ে রুমকিও বসে পড়লো। ততক্ষনে অন্ধকার আর বৃষ্টি দুটোই বেড়েছে। ভাগ্য ভালো ল্যাম্পপোস্টটা কাছেই এবং সেটাতে আলো জ্বলছে। বৃষ্টির ছাঁটের সাথে ল্যাম্পপোস্টের আলোর কারুকাজ দেখতে দেখতে রুমকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আজও কি একই ঘটনা ঘটবে?


বনান্ত ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপলক। আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষনে। কিন্তু দুজনের তাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সাত বছর আগের এইদিনে ঠিক এই সময়ে দুজনের জীবনে আলোআঁধারির তফাৎ ঘুচে গেছিল। প্রবল বৃষ্টির সাথে মুহুর্মুহু বাজ পড়ছিল। অচেনা দুটি ছেলেমেয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছিল। তবু প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচেনি। আকাশ চিরে তীব্র এক ঝলক! চড়চড় শব্দে চতুর্দিক কাঁপিয়ে ঘাঙাচোরা ঘরটা হটাৎ আলোতে ভরে ওঠে। অপার্থিব সেই আলোটা উপভোগ করতে পারেনি প্রকৃতি প্রেমিক বনান্ত আর রুমকি। 


আশ্চর্যের ব্যাপার হলো দুজনে দুজনার অচেনা হলেও, পাশাপাশি পাওয়া মৃত শরীর দুটো অন্য বার্তা পৌছে দিলো চেনা পরিচিতদের কাছে। ওরা যেন গোপনে প্রেম করছিল! যেন কোন অপরাধের সম্পর্ক বয়ে নিয়ে এসেছিল ঐ নির্জন প্রান্তে। তার শাস্তি পেয়েছে নির্মম প্রকৃতির হাতে! বনান্তের প্রেমিকা পূবালী সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। এই ট্রিপে আসার আগে তার সাথে এক টুকরো ঝগড়া হয়েছিল। যে কারণে বনান্তর মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল। সেই পূবালী চরম ভুল বুঝলো! এমনকি মৃত বনান্তকেও ক্ষমা করে উঠতে পারলো না। রুমকির বাবা মা মেয়ের মৃত্যুর চাইতেও বেশি দুঃখ পেলেন বনান্তের সাথে তাকে আবিষ্কার করে! সেই থেকে প্রতি বছর ওরা ফিরে আসে এইদিনে এইখানে, যদি বোঝানো যায় কাউকে কোনভাবে যে সকলের এই ধারনা ভুল! একেবারেই ভুল। তারা দুজনেই নিজেদের মত করেই বাঁচতে চেয়েছিল। তাই ঠাঁই নিয়েছিল এক ছাদের নীচে।


অন্ধকারে বনান্তের চোখদুটো আজ যেন অন্যকিছু বলছে। রুমকি অবাক হয়। কায়াহীন অনুভবেও একটা শিরশিরানি কাঁপন জাগে। এই কাঁপন তো অচেনা নয়! পাশে এসে বসে বনান্ত। হিমশীতল হাতে হাত রাখে। বলে, অনেক তো হলো রুমকি! আর কেন ভুল ভাঙানোর চেষ্টা। তারচেয়ে ভুলটাই সত্যি হোক্ না!


রুমকির মনে পড়ে, সাতবছর আগের সেই রাতে বাজ পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছিল বনান্তকে। আশ্চর্য! অচেনা মনে হয়নি তো একদম! বরং মনে হয়েছিল একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়!


আজও দুটো অশরীর পরস্পরের সাথে মিশে যেতে যেতে ভাবে, এই তাদের আশ্রয়! এইই সত্য হোক্। নশ্বর পৃথিবীতে যা আসলে ঘটেনি, তাইই ঘটুক তাদের অশরীরী জগতে!

******

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু