চুপকথা হলো রূপকথা
"চুপকথা হলো রূপকথা"
✍ সুস্মিতা মালাকার ঘোষ
শ্রেয়া আর রাহুল সহকর্মী।
সেক্টর ফাইভের একটি তথ্য-প্রযুক্তির অফিসে তারা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চাকরি করছে। ওদের দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভীষণ ভালো। ওরা দুজন-দুজনের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে এই ক'বছরে।
রাহুল খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। কোনো কথা সহজে মুখ থেকে বেরোয় না তার- সে কোনো কিছু ভালো লাগলেই হোক, বা খারাপ লাগার কথাই হোক, পছন্দ-অপছন্দ, শরীর খারাপ, এমনকি খিদে পেলেও ওর মুখ থেকে সহজে বের হতে চায় না ওর অনুভূতির কথা। এদিকে শ্রেয়া রাহুলের একদম বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। এত কথা বলে যে কথা থামতেই চায় না ওর। যে কোন কথা বলতে শুরু করলে আর তা শেষ হতে চায় না ওর। বকবক করে করে শ্রেয়া ওর বন্ধুদের কানের পোকাগুলো সব নাড়িয়ে দিয়েছে। রাহুলেরও সেই একই অবস্থা হয়েছে এত দিনে। দুজনে একসাথেই অফিসে যায়-আসে।পাশাপাশি বসে অফিস আওয়ারে তাদের কাজও করে। দুজনই দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছে এটা ওরা দুজনই বোঝে। তবে শ্রেয়া যদিও হাবে-ভাবে তা হামেশাই রাহুলকে বোঝায় কিন্তু মনের কথা কিছুতেই রাহুলের কাছ থেকে আদায় করতে পারে না।
এদিকে শ্রেয়ার বিধবা মাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বেশ কিছুদিন ধরেই ওর মা ওকে বিয়ের জন্য বলে চলেছেন। সত্যিই তো মার ইচ্ছে পূরণ করা দরকার। কিন্তু ভালোবাসার কথা রাহুলকে নিজের মুখ ফুটে বলতে তো হবে-শ্রেয়া নিজে বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারে না,রাহুলের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
এরমধ্যেই শ্রেয়া ভাবে যে একটা ছোটখাটো নাটক করলে কেমন হয় যদি রাহুলের মুখ থেকে বার করা যায় তার মনের কথাটা। সুযোগটাও এসে গেলো একদিন। শ্রেয়ার খুব কাছের বন্ধুর বিয়ে। সঞ্চারী সেদিন ওদের বাড়িতে এলো বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে। শ্রেয়া তো অবশ্যই যাবে কিন্তু হঠাৎই ওর বিয়ের কার্ডটা হাতে নিয়ে শ্রেয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
পরের দিন সকাল থেকেই ও একটু চুপচাপ রইলো অফিসে। রাহুল বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো যে ওর শরীর খারাপ কিনা কারণ ও তো এতো চুপচাপ থাকার মেয়ে নয়। সে খুব একটা উত্তর দিলো না। ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে খুব নাটকীয় ভাবে গম্ভীর মুখে শ্রেয়া ব্যাগ থেকে বিয়ের কার্ডটা বের করে গম্ভীরভাবে রাহুলের দিকে সেটা এগিয়ে দিল। রাহুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকাতে শ্রেয়া বললো যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তিন সপ্তাহ পরে ওর বিয়ে। ছেলে বিদেশে থাকে। বিয়ের পরেই ও চাকরি ছেড়ে বরের সাথে বিদেশে পাড়ি দেবে। রাহুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চলতে চলতে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লো ও। ওর মুখটা তখন দেখার মতো। শ্রেয়ার ভেতর থেকে দমফাটা হাসি পাচ্ছিলো, ইচ্ছে করছিলো যে এই মুখের একটা ছবি তুলে রাখে কিন্তু তা তো করা চলবে না। গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হবে যে করেই হোক। যাইহোক তারিয়ে তারিয়ে রাহুলের অবস্থাকে উপভোগ করতে লাগলো ও।
রাহুল অত্যন্ত ব্যথাপূর্ণ কণ্ঠস্বরে প্রায় চোখে জল চলে আসে এরকম অবস্থায় শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে আমাদের কি আর কোন দিনও দেখা হবে না?
শ্রেয়া গম্ভীরভাবে বললো, তুমি যা চাইবে তাই হবে, তুমি চাইলে নিশ্চয়ই দেখা হবে।
রাহুল অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিজের কষ্টকে আপ্রাণ চাপতে চেষ্টা করলো আর বলল, আমি চাইলেই কি আর সব হবে?
শ্রেয়া গম্ভীরভাবে বললো, একবার চেয়েই দেখো না, মুখ ফুটে বলেই দেখো না,হয় কিনা! মিরাক্কেল বলে একটা শব্দ শুনেছো নিশ্চয়ই। সেটা কিন্তু সবসময়ই হয়।যদি তুমি মন থেকে কিছু চাও তবে সেটা হতে বাধ্য।
রাহুল কিন্তু শ্রেয়াকে লক্ষ্যই করছিলো না।
আচমকা আঘাত পেয়ে কেমন যেন হয়ে গিয়ে বলতে লাগলো, মন থেকে চাইলে সবকিছু হয় না, আজ বুঝলাম সেটা।
শ্রেয়া বললো, তাই! কিন্তু মনের কথা মনে রাখলে হবে কি করে? যেটা চাইবে সেটা তো মুখে বলতে হবে,নাহলে লোকজন বুঝবে কী করে যে তুমি কী চাইছো?
রাহুল গম্ভীরভাবে বললো ঠিকই বলেছো তুমি। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
শ্রেয়াও হাসি চেপে বললো,হ্যাঁ, ঠিক তাই, অনেক দেরি হয়ে গেল, এই বাসটা পাবো না আর, পরের বাসটার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
ওদিকে রাহুলের আর চলার ক্ষমতা নেই বলে মনে হলো। খুব ধীরে ধীরে পা ফেলতে লাগলো ও।
শ্রেয়াও নাছোড়বান্দা,আজ তো বলিয়েই ছাড়বে রাহুলকে দিয়ে ও। কই বললে না তো কি চাইলে?আর কি পেলে না - কি সব বিড়বিড় করছিলে যেন।
আরে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান কোথায় হবে?কী কী শপিং করলাম -কিছুই তো জানতে চাইলে না।
কেমন বন্ধু গো তুমি? আর হ্যাঁ, ঠিকানাটা বুঝে নাও ঠিক করে। কাকু কাকিমাকে নিয়ে অবশ্যই যেতে হবে কিন্তু তোমাকে। তুমি না হলে কি করে আমার বিয়ে হবে বলো? তুমি আমার কত ভাল বন্ধু।
রাহুল বললো, না ঠিক আছে, বাড়ি গিয়ে দেখবো সবকিছু।
শ্রেয়া রাগ দেখিয়ে বললো,তোমার শুধু পরে পরে। একটু সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে শেখোতো,নাহলে সারাজীবন পরে পরে করে কাটাবে নাকি! সবকিছু কিন্তু হাতের বাইরে চলে যাবে এভাবে।
রাহুল মাথা নিচু করে বললো, ঠিকই তাই।সবকিছুই হাতের বাইরে চলে যাবে,চলে গেলো। রাহুল শেডের তলায় বসে কাঁপা কাঁপা হাতে কার্ডটা খুললো। খুলেই খুব অবাক হলো। এই সঞ্চারীটা কে আবার? তোমার নাম সঞ্চারী কবে থেকে হলো?
শ্রেয়া তখন বললো, ও তোমাকে বলা হয়নি না, আমার কুষ্টিতে এই নামই আছে। আর পুরোহিত মশাই এই নামটাই কার্ডে ব্যবহার করতে বলেছেন। আর বলেছেন,তাতে আমরা সুখী হবো।
রাহুল তারপর আবার প্রশ্ন করলো, ওমা এখানে তো তোমার বাবা-মায়ের নামও ভুল আছে দেখছি। তাঁদের নামও কি অন্য লিখতে বলে বলা হয়েছে নাকি। এইবার আর শ্রেয়া নিজের হাসি চাপতে পারলো না। প্রচন্ড হাসতে শুরু করল আর বললো, উফ্! তোমাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। আরে বাবা,সত্যি সত্যিই সঞ্চারীর বিয়ে। সঞ্চারী আমার ছোটবেলার বন্ধু,বুঝলে! রাহুল অবাক হয়ে বললো, মানে?
শ্রেয়া এবার রেগে বললো, মানেটাই তো বুঝতে চাইছি।মনের কথাগুলো কি মনেই রাখবে সারা জীবন নাকি এবার অন্ততঃ মুখ ফুটে বলবে।
এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো রাহুলের কাছে। ওর ফ্যাকাসে মুখের মধ্যে ধীরে ধীরে যেন রক্তকণিকা জমতে শুরু করলো এতক্ষণে। রাহুল খুব হাসতে শুরু করলো হঠাৎ সব বুঝতে পেরে। শ্রেয়া অবাক হয়ে ওকে দেখতে থাকলো, কোনদিনও শ্রেয়া রাহুলকে এভাবে প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখে নি। ওর হাসির সাথে শ্রেয়াও যোগ দিলো। তারপর হাসি থামলে রাহুল শ্রেয়ার হাতটা আলতো করে ধরে নিয়ে বললো,সব কথা কি মুখে বলতে হয়? শ্রেয়া অমনি কপট রাগ দেখিয়ে ওর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ কিছু কথা মুখে বলতে হয়, না হলে....রাহুল জিজ্ঞেস করলো, না হলে.... শ্রেয়া বলল না হলে মনের মানুষ অন্যের হাত ধরে বিদেশে পাড়ি দেয়, বুঝলে মশাই? আর হ্যাঁ,
শ্রেয়া মিষ্টি হেসে বললো, সব কথা মুখে বলতে হয় না ঠিকই তবে কিছু কিছু কথা অবশ্যই বলতে হয়। কিছু কিছু কথা শুনতেও ভালো লাগে। রাহুল হাসতে হাসতে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে,পরের কার্ডটায় আমাদের দুজনের নাম ছাপা হবে, বুঝলে! শ্রেয়া বললো, ওমা তাই! চলো চলো, কার্ডে নাম ছাপার আগের কাজগুলো করতে হবে তো। তাড়াতাড়ি চলো। রাহুল হাসতে লাগলো। শ্রেয়া বলল আচ্ছা কাকু - কাকিমাকে কি আমাকেই বলতে হবে নাকি? তুমি বলতে পারবে? আমাকে বলতেই তো এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলে,দেখো আবার কাকু- কাকিমাকে তাড়াতাড়ি জানিও,না হলে কিন্তু.....দুজনে মজা করতে করতে বাস ধরতে এগোলো।
