বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ঊষার আলো




অনুদিদি, কতটা চাল নেবো আজ?

অনুদিদি, রুবির জ্বর তো নেমেছে, আজ কি স্কুলে যাবে?

অনুদিদি, আমার রঙ পেন্সিল নেই!

অনুদিদি, বাগানে কাজ করার লোক খুঁজছিলেন? রবিদাদু চারজনকে পাঠিয়েছেন।


ঊষা মাতৃ আশ্রম মানেই অনুদিদি। অনুদিদির অনুমতি, মতামত, আদেশ, নির্দেশ, যাই বলি না কেন, সেসব ছাড়া কেউ একপাও চলে না। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েগুলো পর্যন্ত যত আব্দার সব পেশ করে অনুদিদির কাছে। সেই ভোর সকালে ঘুম থেকে ওঠা ইস্তক একবার রান্নাঘরে, একবার মেয়েদের হলঘরে, একবার বাগানে নয়ত বর্ষীয়ানদের জন্য বানানো টানা বারান্দার লাগোয়া পর পর ঘরগুলোতে হাজার কাজ নিয়ে ঘুরতে থাকেন অনুদিদি, অনুশীলা। চা খাওয়া, জলখাবার খাওয়া এমনকি আয়েস করে দুপুরের খাবার টুকুও খেতে পারেন না একেক দিন। তবে রাত দশটার পর অনুদিদিকে কেউ বিরক্ত করতে পারে না। আশ্রমের প্রথম দিক থেকে আছেন যারা, তারাও বলেন। নটায় সকলের রাতের খাওয়া হয়ে যায়। সব দেখভাল করে, বাকি কাজের নির্দেশ দিয়ে আশ্রমের কর্মীদের সাথে নিজেও খাওয়া সেরে নেন। তারপর রাত দশটা বাজলেই তিনতলার একটা মাত্র ঘরে সেঁধিয়ে যান অনুদিদি। একেবারে জীবন মরণ জাতীয় সমস্যা না হলে তাকে ডাকা নিষেধ আছে। কেউ ভাঙে না সেই নিষেধ।


সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ ছাদেই হাঁটাহাটি করেন অনুদিদি। তখন তিনি পুরোপুরি অনুশীলা। মা ডাকত অনু, বাবা ডাকতেন শীলা। বাকিরা ঐ দুটো নামের কোন একটা। কেবল ব্রতীন বলত শীলু। মাত্র কুড়ি বছরের সংসার ওদের। নাহ্, দুজনের সংসারে তৃতীয় কেউ আসেনি। দোষটা কার জানা যায়নি। কারণ, ব্রতীন কোন চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে চাননি। কেবল নিজের ভেতরে নিজে ডুবে গেছিলেন। সারাদিনে হাঁ হু ছাড়া কথা বলতেন না। শেষদিকে তাও না। অনুশীলা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। আদর, অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, কোনকিছু দিয়েই সেই কঠিন অন্তর্মুখী মনটাকে ভাঙতে পারেননি। তারপর কবে যেন তিনিও ব্রতীনের মতোই হয়ে গেলেন। একটা বাড়ির একই ছাদের নীচে দুটো মানুষ বসবাস করলেন পাশাপাশি এতগুলো বছর, অথচ কারুর সাথে কারুর কোন কথা নেই। ব্রতীন অফিসে আর অনুশীলা তার স্কুলে, পরিচিত মহলে সব কথা শেষ করে এসে বাড়ি ঢুকত। তারপর নৈঃশব্দের অতলে তলিয়ে যেত গোটা বাড়িটা। এমনকি রান্নাঘরের হাতা খুন্তি, বাথরুমের জল, দরজা জানলার পাল্লা কিম্বা ঘড়ির কাঁটাও জেনে গেছিল, এখানে শব্দ করা নিষেধ। আশ্চর্য, যেদিন মাঝরাতে হার্ট এটাক হলো, সেটাও একেবারেই নিঃশব্দে হলো। অনুশীলা অবাক হননি, দুঃখ পাননি। কিন্তু সুখও পাননি, স্বস্তিও না। কেন জানি, নিজের রুটিনের ব্যতিক্রম করে উঠতে পারেননি। আশ্চর্য, বাড়ি ফিরলে একটা নৈঃশব্দের জগতে তলিয়ে যেতেই ভালো লাগত। ব্রতীন যেন অসীম সমুদ্রের মত একটা নিঃশব্দ পৃথিবীর উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে তাকে। একার জন্য একটু রান্না করা, বইপড়া আর কখনও কখনও ব্রতীনের ঘরে নিঃশব্দ পদচারণা, এই হলো তার রুটিন। ব্রতীনের ঘরটাকে কেমন অচেনা লাগত। বইএর তাকে শরদিন্দুর সমস্ত রচনাবলী সাজানো। নীচেই কালকূট, বনফুলের তিনটে খন্ড ছোটগল্প। কতবার দেখেছে আগেও। কিন্তু একলার এই অখন্ড অবসরে সেগুলোতে হাত দিলেই মনে হতো ব্রতীন অখুশি হচ্ছে! ধূলো ঝেড়ে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিতো। বিছানার চাদর টানটান করে রাখত। কিন্তু এক পলকের জন্য বসতে গেলেই মনে হত ব্রতীন পছন্দ করছে না। তবুও ব্রতীনের কাঠের পুরোনো আলমারী, একটু ঝাপসা হয়ে আসা আয়না, টিনের ট্রাঙ্কে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা চাদর সোয়েটার মাফলারের জগতে ঘুরতে ফিরতে সে ব্রতীনের মন্দ লাগা গুলোকেই খুঁজে বেড়াতো যেন! সেই জগতে থাকতে থাকতেই একদিন ব্রতীনের বিছানার নীচে এক গোছা লেখা খুঁজে পেল। ব্রতীনের মন্দ লাগা জগতের এলোমেলো টুকরো টুকরো প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল সেসব লেখাতে। 


ঊষা কলেজে পড়ত ব্রতীনের সাথে। হালকা একটা প্রেম হয়েছিল। ব্রতীনের ধারনা ছিল তেমন জমাট বাঁধেনি। গ্যাজুয়েশন শেষে ব্রতীন যখন প্রাণপনে ছোটখাটো কোর্স আর চাকরির চেষ্টা করছে, তখন ঊষা এম এ পড়ছিল। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় ব্রতীনের সাথে দেখা হতো, কথা হতো। ঊষার চোখ কিছু বলার জন্য উন্মুখ থাকলেও ব্রতীনের চোখ সেসব পড়ার সময় পেত না। তবু, এক বর্ষার সন্ধ্যায় ব্রতীনদের ফাঁকা বাড়ির নির্জনতার আছিলায় ব্রতীন ঊষাকে সর্বশরীরে গ্রহণ করে বসলো।


মাসখানেক বাদে ঊষা সেই সন্ধ্যার প্রগাঢ় ভালোবাসার ফল জানিয়েছিল ব্রতীনকে। ব্রতীন তৎক্ষনাৎ সহজ পন্থাটাই বাতলেছিল এবং নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। ঊষার আর খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি।


"তখন আমার পায়ের নীচে জমি নেই এক ছটাকও। বাবার রিটায়ারমেন্টের পর জমানো টাকায় সংসার চলছে। প্রতিদিন ভাবতাম, পরের মাসে কি হবে? কিন্তু এসব কি আসলে অজুহাত নয়? ঊষার মন ফুটে উঠত ওর দীঘল চোখে। বুঝতাম। অবহেলার ভঙ্গিতে কি একটু আস্কারা দিইনি? কখনও তো বলিনি ওকে, আমার কথা ভেবো না! বলিনি, তোমার অন্য জীবন হোক্! তাহলে কি আমি শুধুই সুযোগ নিতাম? একটা আদ্যোপান্ত অসফল ছেলে হয়েও একটি মোহমুগ্ধ চাহনির লক্ষ্য হয়ে ভেতরে ভেতরে তৃপ্তি পেতাম ?"


ঊষারা চলে গিয়েছিল পাড়া ছেড়ে হটাৎ। ব্রতীন শুনেছিল। ব্যস্, ঐটুকুই। বিশদে জানবার সময় কিম্বা ইচ্ছে হয়নি। মাস ছয়েক বাদে সে চাকরীটা পায়। ততদিনে বাবার জমানো পুঁজি শেষ। বাজারে অল্প স্বল্প ধারদেনা আর মায়ের বুকে চিরস্থায়ী ব্যথা। চাকরী পেয়ে বাবামায়ের সুবোধ সন্তানের মত সে সুখ কুড়িয়ে আনার চেষ্টা করেছিল বিস্তর। জোড়াতালির সংসারে স্থায়ী মেরামতির ঐকান্তিক চেষ্টা করেছিল। মায়ের কপালে ছিল না সে সুখ। এক বছর পর ভুগে ভুগে মা চলে যেতেই বাবা যেন আরো বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। পরের বছরেই অনুশীলার সাথে বিয়ে। বাবা থাকলেন ওদের সাথে মাস ছয়েক। তার পরেই বলতে গেলে ব্রতীনের জীবনে এলো অবিমিশ্র সুখ, শান্তি আর আরাম। ততদিনে একবারের জন্যও মনে পড়েনি কখনও ঊষার কথা। মনে পড়েনি সেই সন্ধ্যার কথা, মনে পড়েনি ঊষার সাথে শেষ দেখার কথা!


অনুশীলা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল মা ডাক শুনতে। সেই সময়েই একেক দিন, দিন ফুরোলে আকাশ লাল হলেই ব্রতীন বৃষ্টির গন্ধ পেত। পাখিদের কিচিমিচির সাথে নিভে আসা আলো তাকে মনে করাতো একটা হটাৎ পাওয়া স্বর্গীয় সুখের কথা। মনে পড়ত ঊষার গভীর চোখদুটি। মনে পড়ত তার কোমল মুখখানি। মনে পড়ত একটি অসহায় মেয়ের অধীরতা।


এমনিতে স্বভাব শান্ত, ঘরোয়া আর অমিশুকে বলে তেমন বন্ধুবান্ধব ছিল না তার। তবু খুঁজে পেতে ঊষাকে চেনে এমন পুরোনো মানুষ কাউকে কাউকে ব্রতীন খুঁজে বার করলো। তাদের থেকে পেল ঊষার আত্মীয়স্বজনের খোঁজ। সে সময়ে নিজের এই অবিশ্বাস্য উদ্যম দেখে অবাক হয়েছিল সে নিজেও।


"এই যে মনের গভীরে ঊষার জন্য এতটা উদ্বেগ, তা কি আগে ছিল না? নাকি ছিল! ছিল না শুধু দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে! কিম্বা সাহস! ঊষাকে কি আমি ভালো বাসতাম? ভালোবাসি কি এখনও? নইলে কেন এত খোঁজ করছি? কেন তার সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা যত বাড়ছে, তত উদ্গ্রীব হচ্ছি! একি আমার পাপ স্খালনের জন্য? শুধুই পাপ স্খালনের জন্য? ঊষার মুখের প্রতিটা রেখা, তার চোখের চিকচিকে জল, থিরথির হাতের কাঁপন- সবকিছু পরিস্কার মনে করতে পারছি কেন! এতদিন ভুলেই বা ছিলাম কেন!"


ব্রতীনের হৃদয়ের গভীরে আশা ছিল, ঊষার কোলে তাদের সন্তানটি হয়ত বড় হয়েছে। এতকাল পরে কেন তার এই কামনা, সে নিজেও তার ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না। অন্তরালে থেকে সে ঊষার খোঁজ খবর নিয়ে গেছে। ঊষার বর্তমান জীবন এবং সংসারে দখলদারির কোন সাধ তার ছিল না বলেই বিশ্বাস। ইচ্ছেও ছিল না, তার কারণে আরো একবার ঊষার জীবনে ঝঞ্ঝা নেমে আসুক। অথচ নিজেকে বিরতও করতে পারছিল না। অনুশীলা, শীলুর কাছেও সে অপরাধী হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে, নায্য কারণেই। এক সময়ে প্রতিজ্ঞা করে সে নিজের কাছে, একটিবার ঊষার সাথে দেখা হলেই সে গুটিয়ে নেবে নিজেকে। আবার ফিরবে নিজের সংসারে, যেখানে একমাত্র অনুশীলার অধিকার। যেখানে সে শুধু তার শীলুর।


"অবচেতনে আমি কি চেয়েছিলাম ঊষা যেন কেবল আমারই থাকে? তার গোছানো পরিপাটি সুখী একটা সংসার থাকলে কি আমি কষ্ট পেতাম? নাকি আমি ফিরতে পারতাম শীলুর কাছে! আমিই কি ঊষার সবকিছু কেড়ে নিলাম, নাকি ঊষাই আমার সবটুকু কেড়ে নিয়েছিল? শুধু একটা খোলস রয়ে গিয়েছিল ব্রতীন নামের! শীলুর দিকে চাইবার মত মুখটুকু কি আছে আমার ?"


তখন এই আশ্রমের নাম ছিল রাজপুর আশ্রম। অসহায় নিঃসহায় মহিলা আর দু চারজন অনাথা বালিকার ঠাঁই জুটেছিল। ঊষাকে দিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবাই। মায়ের মৃত্যুর পর অনুভূতিহীন জড় পদার্থের মত মেয়েকে তার দুই ছেলে আর বৌমারা যে দেখভাল করবে না, তিনি বুঝেছিলেন। বেঁচে থাকতেই তাই নিজের খরচে ওর এটুকু হিল্লে করে যেতে পেরেছিলেন। ব্রতীন যখন ঊষার খোঁজ পায়, তখন তার শেষ সময়। আশ্রমের লোকজন ঊষাকে মূক্ বলেই জানতেন। বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না তার। তাই খাওয়া পরা ঘুম কোনকিছুরই পরোয়া ছিল না। কেউ কখনও ধরে বেঁধে খাওয়ালে খেতো, স্নান করালে করত। বাবা ছাড়া আর কেউ তার ছিল বা এখন আছেন বলেও ওনারা জানেন না। ঊষার পূর্ব ইতিহাস একেবারেই অজানা। কাগজপত্রেও নাম আর নতুন ঠিকানা ছাড়া কিছুই নেই। ব্রতীন দুইবার মাত্র ঊষার পাশে বসতে পেরেছিল। অমসৃণ অপরিষ্কার হাতে হাত ছুঁইয়ে খুঁজতে চেয়েছিল চেনা ঊষাকে। চেনাতে চেয়েছিল নিজেকে। ঊষার চেতনা ছিল না। কিম্বা চেতনাতে ব্রতীন ধরা পড়েনি। হয়ত এই ব্রতীন নয়, ঊষার চেনা ব্রতীনই ছিল তার অবচেতনে। নাকি অতলান্ত অভিমানে অপমানে তাকে মুছে ফেলতেই নিজের পৃথিবীকে শব্দহীন করে ফেলেছিল ঊষা? তাদের সেই অনাগত সন্তান এসেছিল কিনা ব্রতীন জানতে পারেনি। ঊষার পৃথিবী শব্দহীন হয়েছিল তার বঞ্চনার কারণেই কিনা, ব্রতীন জানতে পারেনি। 


"শীলু, ডাক্তারি পরীক্ষা করলে হয়ত জানতে পারবে অক্ষমতা তোমার। কারণ আমার সক্ষমতার সাক্ষী ঊষা। সাক্ষী সেই অনাকাঙিক্ষত সন্ধ্যা! সেই সন্ধ্যায় যা পেয়েছিলাম তা আমার ভোগী স্বত্তাকে তৃপ্তি দিয়েছিল। কিন্তু যা পেতে চলেছিলাম, তা অবহেলায় ত্যাগ করে যে পাপ করেছিলাম তার শাস্তিই এখন পাচ্ছি। শীলু, তোমার উপরে সেই দায়ভার চাপাতে মন চাইছে না। আবার পুরোনো দিনগুলো তোমার কাছে তুলে ধরতেও যে পারছি না শীলু! না আমি তোমার ক্ষমার যোগ্য, না ঊষার! না চাইতেই এসেছিল যে, তাকে কোন পাঁকে ডুবিয়েছি আমি জানি না! কোন মুখে আমি সেই সুখ আবার আশা করবো শীলু?"


অনুশীলা একদিন পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই রাজপুর আশ্রমে। শুনেছিল ঊষার কথা। শুনেছিল ব্রতীনের কথা। ঊষা মারা যাওয়ার পরেও সে আসত। ঊষার ঘরখানি সে উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে চেয়ে নিয়েছিল। আশ্রমে বিনা পারিশ্রমিকে নিঃশব্দে শ্রমদান করে বিশ্রাম নিত ঐ ঘরেই। একেবারে একান্তে। ঊষার জিনিসপত্র বলতে টুকটাক যা ছিল সব রেখে দিয়েছিল। ঐ ঘর যেন তার কাছে ছিল মন্দির।


"ঊষা হয়ত কেবল মনেই মনে রেখেছিল আমাকে। পার্থিব কোন চিহ্ন রাখেনি। তার ছোঁয়া রেখে গেছে পরনের ছেঁড়া ফাটা কাপড়ে, বিছানার ময়লা চাদরে আর দেওয়ালের কাটাকুটি দাগে। এক টুকরো কাগজ নেই, কোন বই নেই, ছবি নেই তার ঘরে। দেওয়ালের কাটাকুটি দাগ সব কাঠ পেন্সিলে নয় ইটের টুকরোতে। কত খুঁজেছি তার মধ্যে, একটা ব কিম্বা ত অথবা ন! একটাও কোন চেনা শব্দ নেই! নেই! নেই! হিজিবিজি দাগের ভেতরে কেবল অনেক কিছু না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা দেখতে পেলাম। মুখ বুজে সেসব যন্ত্রণা নিজের ভেতরে কফিনবন্দি করে রেখেছিল মেয়েটা! আঙুল ছুঁইয়ে ছুইয়ে সেই যন্ত্রণা একটু একটু করে নিজের ভেতরে যদি নিয়ে নিতে পারি, ঊষা কি একটু খুশি হবে?"


অনুশীলা হিসেব করে দেখেছিল, নৈঃশব্দের প্রচীর গড়ে উঠেছিল ঠিক ঐ সময় থেকে। ঊষার যন্ত্রণা ছুঁয়ে থাকার চেষ্টায় ব্রতীন যন্ত্রণা দিয়েছে নিজেকে, যন্ত্রণা দিয়েছে অনুশীলাকে। কিন্তু আশ্চর্য! অনুশীলার অক্ষমতার যন্ত্রণাকে আড়াল করে রেখেছে। ব্রতীনকে দোষারোপ করতে করতে, ব্রতীনের অন্তর্মুখী মনটাকে আসামীর কাঠগড়ায় তুলতে তুলতে সে কখনো নিজেকে সন্দেহ করেনি। নিজের অপারগতার আশঙ্কা করেনি। ব্রতীনের মনকথা সাদায় কালোয় তার সামনে ফুটে উঠতেই আশ্চর্য অনুভূতি হয় তার। এত বছর পরেও হটাৎ নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। ব্রতীন তাকে দূরে ঠেলেছে, নাকি সেই ব্রতীনকে কাছে নিতে পারেনি - একটা আমোঘ জিজ্ঞাসার মত কুরে খেতে থাকে তাকে। অতীতের দাগছোপ মুছে ফেলা সহজ। সন্তানহীনতার দায়ভার তার কাঁধে চাপানোর মত নিশ্চিত উপায় ছিল ব্রতীনের। ঊষাকে মনে পড়লেও আরো দূরে ঠেলে দেওয়াই স্বাভাবিক ছিল তার পক্ষে। জড় পদার্থের মত ঊষার খোঁজ যখন পেল ব্রতীন, তখনও পিছু ফিরে সুখী গৃহকোণে চুপচাপ ঢুকে পড়াই স্বাভাবিক ছিল! তাও করেনি সে! এমনকি ঊষার পার্থিব শরীরটা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরেও তাকেই আঁকড়ে থেকেছে। স্মৃতিতে, চেতনে, অবচেতনে। অনুশীলা তবে কোথায় ছিল? কেন সে টের পায়নি ঊষা আর ব্রতীনের এই অদৃশ্য নৈকট্য! ব্রতীনের জন্য তার ভালোবাসাতে তো খাদ ছিল না। ব্রতীনও তাকে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েই বাঁচত। অন্ততঃ তাইই মনে হত তার। তবে বেহুলার বাসরঘরের মত কোন ছিদ্রপথে ঢুকে এসেছিল ওদের ফেলে আসা নিঃশব্দ প্রেম! হারিয়ে যাওয়া প্রেম!


অনুশীলা যেন ব্রতচারিনী। নিজের সর্বস্ব রাজপুর আশ্রমে দান করে এখন সে এখানেই থাকে। সকলের ভালোবাসার অনুদিদি সে। সকলকে অঢেল ভালোবাসা বিলোতে বিলোতে নিজের জন্য আর কিছুই রাখেনি। নিজের কাছে নিজে ব্রত রেখেছে। পূজারিনীর মত ব্রতীন ঊষার নৈঃশব্দকে মন্ত্র করে এক গহীন প্রণয় সাগরে ডুব দেয় রাত নামলেই। তার বিরহী বক্ষে অনুশোচনা নেই, অভিযোগ জমেনি, বেদনার লেশমাত্র নেই। কেবল একটু অনুভব করতে পারার ইচ্ছে নিয়ে সেও ভেসে যায় দেহহীন, অস্তিত্বহীন এক বিরহগাঁথায়।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু