বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

গম-ই-তানহাই

আজ মহালয়া। পুজো পুজো রব চারিদিকে। মাঠে ঘাটে কাশের সমারোহ। আকাশে পেঁজা মেঘ।বাইরে পুজো পুজো আবেশ মাখা প্রকৃতি। ভোরের আলোর আগেই সব বাড়িতে আলো ফুটেছে আজ। বছর দশেকের মিতুন তখনও বিছানায় আড়মোড়া ভাঙছে। কুহেলি এসে আদর করে মিতুনকে তুলছে ঘুম থেকে। কিন্তু মিতুন বায়না ধরেছে শুয়ে শুয়েই মহালয়া শুনবে। ছেলের আবদারের কাছে মা হার মেনে নিয়ে , সবাই একসাথে চন্ডী পাঠ শুনতে বসলো। 

মিতুনদের ঠিক সামনে ব্যানার্জী বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়। বহু পুরোনো পুজো। মহা সমারোহে পালন হয়। বাড়ির সবাই আসে। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরে যায়। সে এক হৈ হৈ রব। ওই বাড়ির মেজ ছেলে চাকরি সূত্রে গুরগাঁও তে থাকে। তারাও প্রতিবার এইসময়ে আসে। এবারেও তারা আসবে এক দুদিনের মধ্যেই। মিতুন খুব খুশি। মিতুনকে ওই বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে। আর তিতলি হলো মিতুনের বন্ধু। তারা সমবয়সী। তিতলি এলে ওরা দুজনে একসাথে সারাক্ষন হৈ হৈ করে সময় কাটায়। তিতলি ওই বাড়ির মেজ ছেলের মেয়ে। কলকাতার বাইরে থাকলেও বেশ সাবেকি মনের মানুষ তিনি । কুহেলির সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক ওই বাড়ির।পুজো যে কখন চলে যায় তা বোঝাই যায় না। 

মিতুন ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করছে কখন তিতলি আসবে। ওদের একটু পরই আসার কথা। এই কটা দিন পড়াশোনা নেই সে ভাবে। শুধু মজা আর খেলা। বছরে একবার তিতলির সাথে দেখা হওয়ার আনন্দই আলাদা। অনেক অপেক্ষার পর তিতলিররা এসে পৌঁছলো। খুব মজা খুব আনন্দ। নাটমন্দিরে ঠাকুর তৈরি হচ্ছে। খুব মন দিয়ে দুজনে দেখে ঠাকুর গড়া। 

মা দুর্গার চক্ষু দান থেকে অস্ত্র সাজানো সবটা। এর মাঝে বাগানে ঘুরে বেড়ানো। পেয়ারা পেড়ে খাওয়া। আবার গাছে ওঠাও শিখিয়েছিল তিতলিকে। পুকুরের ঘাটে আম গাছটা এমন ভাবে হেলে আছে সেই দেখে তিতলি এত পায় যে মিতুন মাঝে মাঝেই সন্ধ্যে বেলা ওকে ভূতের ভয় দেখায়। অষ্টমী পুজোর সকালে তিতলির কানে এলো পতিতালয়ের মাটির কথা। 

সাথে সাথে কাকিমা কে জিগেস করাতেও সেভাবে কোনো উত্তর পাই নি তিতলি। বরং অন্য কথা বলে বলেছিল পুজোতে ওই মাটি লাগে। শান্ত তিতলি তাই মেনে নিয়েছিল। এভাবে বছর বছর পুজো আসে যায় মিতুন ও তিতলি বড় হয়ে ওঠে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বেশ গভীর হয়েছে। বন্ধুত্ত্ব ছাপিয়ে ভালোবাসার রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তিতলি বাইরে থাকলেও মিতুনকেই ভালোবাসে, মনে প্রানে। আর মিতুনও তিতলি ছাড়া কিছুই ভাবে না। এখন ওরা দুজনেই বড় হয়েছে। কলেজে পড়ছে। মিতুন মনে মনে ঠিক করেছে এবার পুজোতে তিতলি কে নিজের মনের কথা জানাবে। তাই অপেক্ষা। পুজো এখনো মাসখানেক বাকি। ওদিকে তিতলিও অধৈর্য্য, কবে আসবে , মিতুনকে দেখবে এই ভেবে। 

এই একটি মাস মিতুন যৌবনের স্বপ্নে কাটিয়ে দিলো। যথা সময়ে তিতলিও এসে গেছে। রোজই তাদের দেখা হয় কথা হয় জমানো গল্প সব বলে একে অপরকে। কিন্তু মিতুন কিছুতেই মনের কথাটা তিতলিকে বলতে পারে না। সপ্তমী ও কেটে গেল। কাল অষ্টমীর সকালে মনের কথা জানাবেই ঠিক করলো সে। সকাল সকাল স্নান সেরে নীল পাঞ্জাবি পরে মিতুন ঠাকুরের সামনে হাজির। একটু একটু নার্ভাস। অপেক্ষা তিতলি কে দেখার। তিতলিও শাড়ী পড়বে। নীল ঢাকাই আর এলো চুলে তিতলি কে অপরূপা লাগছিল মিতুনের। বেশ লজ্জা লজ্জা হাসিতে তিতলির পেছনে এসে দাড়ালো অঞ্জলীর জন্য। হাতে ফুল ও বেলপাতা, অঞ্জলিও শুরু। প্রতি অঞ্জলীর শেষে তিতলির মাথায় ফুল দিয়ে মিতুন বলেছিল,

---" আমার ভালোবাসার ফুল তোকে দিলাম, তুই নিবি তো?"

তিতলির লাজুক চোখ সব বুঝিয়ে দিয়েছিল । মুখে কিছু বলতে হয় নি। হালকা হাতের স্পর্শে একে অপরকে নিজের করেছিল মা দুর্গার সামনে। মাকে যখন বরণ করে সবাই সিঁদুর খেলায় মত্ত্ব তখন তিতলি কে একটা টিপ পরিয়ে দেখেছিল বউ সাজলে কেমন লাগবে। এক প্রেমের জোয়ারে ভেসেছিলো তারা। শুধু চাকরির অপেক্ষায় দুজনে। তারপরই দুবাড়িতে জানিয়ে দেবে । দুজনেই খুশি ছিল এত ভালো সম্পর্ক দুইবাড়ির এই ভেবে।তাই খুব সুন্দর করেই মেনে নেবে হয়তো। যথা সময়ে তিতলিও চলে গেল। ওদের ফোনে কথা হয় নিয়মিত। এভাবে বছর দুই চললো। আগামীর পরিকল্পনাতে দুজনের চোখে রঙিন স্বপ্ন। মিতুন ও চাকরির চেষ্টা করছে। 

একদিন সকালে সকাল তিতলির ফোন বেজে উঠলো,

---"হ্যালো, কিরে এত সকাল সকাল ফোন করলি, সব ঠিক আছে তো?"

---"হ্যাঁ রে সব ঠিক আছে"। একটু গম্ভীর গলায় মিতুন বললো।

----"না তোর গলা টা কেমন যেন শোনাচ্ছে। ঠিক করে বল সব ঠিক তো? কিছু খারাপ খবর?" চিন্তায় তিতলি।

----" তবে শোন, একটা খুব খারাপ খবর আছে, তোকে বলতে একটু সংকোচ হচ্ছে, কি যে করি"।

----" ভনিতা না করে তাড়াতাড়ি বল প্লিজ"

---"আসলে হয়েছে কি, আমি একটা চাকরি পেয়েছি, তবে সেরম কিছু নয়, বেতনও খুব কম। তাই জানাতে সংকোচ হচ্ছে আর কি।" 

---"কি!! কি বললি, এত  ভালো খবরটা আমাকে বললি এত বদমাইসি করে। দাঁড়া, তোকে কাছে পাই, দেখাবো মজা।"

দুজনের আনন্দের শেষ ছিল না সেদিন। এবারে বাড়িতে জোর গলায় বলতেও কোনো অসুবিধে নেই। ভালোবাসাকে একদম নিজের করে পাওয়ার স্বস্তির নিঃশ্বাস যেন। তিতলিও চাকরির চেষ্টা করছে । আর ধীরে ধীরে মিতুনও আরো ভালো চাকরি করবে।

এবারে নিজেরা প্লান করে দুই বাড়ির সবাইকে বলার সিন্ধান্ত নিলো। বিয়ে পরে করলেও এখুনি জানিয়ে রাখা ভালো, এই ভেবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তারা জানালো সব কথা। মিতুনের বাড়িতে সব শুনে খুব ভালো ভাবে মেনে নিল সব। কুহেলি তিতলিকে খুব ভালোবাসতো। খুব খুশি মিতুন। যথা সময়ে মিতুন ফোন করলো । তিতলি ফোন তুললো না। সেদিন চলে গেল, পরের দিনও। তিতলির কোনো খবর পাচ্ছে না মিতুন। এই অবস্থায় কুহেলি ব্যানার্জী বাড়িতে গিয়ে সব বললো। বলতেই  জানালো, তারা সব জানে। মিতুন কে তাদের খুব পছন্দ হলেও তাদের মেজ ছেলের পছন্দ নয়। তিতলির বাবা তিতলির জন্য  একজনকে মনস্থ করেছে। সে উচ্চপদস্থ আধিকারিক। তাই মেয়ের  জন্য  সঠিক পাত্র নির্ধারণ করেছে এমন ভাবনা। আর সেই পাত্রটি ব্রাহ্মনও। সব মিলিয়ে তিতলির বিয়ে সেখানেই দেবে। এইসব শুনে তো কুহেলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। কারন সে তার ছেলেকে ভালো করে চেনে। 

ওদিকে তিতলিও নাছোড়। ও বিয়ে করলে মিতুনকেই বিয়ে করবে। কে কার কথা শোনে। তিতলির ফোন অবধি কেড়ে নিয়ে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে এক সপ্তাহের মধ্যে তিতলির বিয়ে হলো বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথে। অনেক চেষ্টা করেও মিতুনের সাথে কথা বলতে পারল না তিতলি।

বিয়ে হলেও মানতে পারেনি সে। আর মানবেও না কোনোদিনও। দীপেশকে বলে দেবে মিতুনের কথা। বৌভাতের রাতে ফুলশয্যার খাটে বসে বসে সাত পাঁচ ভাবতে লাগলো তিতলি। নাম সোহাগ রাত হলেও সেই রাত ছিল তিতলির কাছে অভিশপ্ত। ঘড়ির কাটা টিকটিক অবিরাম এগিয়ে চলেছে। তখনও দীপেশ ঘরে আসে নি। ঘুমের ভান করে শুয়ে তিতলি মনে মনে এটাই চাইছিল। বাইরে তখনও বেশ আড্ডা চলছে রঙিন জলের অস্বাদনে। বন্ধ চোখের অবগুণ্ঠনে মিতুনের অবয়ব। ঘরের ভেতর নিঃস্তব্দতা বিষন্নতার সাগরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ। আঁতকে উঠে জড়োসর হয়ে খাটের এক কোনে বসলো তিতলি। মদ্যপ দীপেশের সাথে আর এক লোক। বৌভাতের অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়েছিল। কিছু না বলেই ওই লোকটাকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো দীপেশ। তিতলির কাছে সব ধোঁয়াশা। মাথা কাজ করছে না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।  এত দিন যেসব খবর পেপার ও খবরে পড়ে ও শুনে এসেছিল সেই ঘটনার স্বীকার সে নিজেই। বাবার প্রতি ঘেন্নায় তার মন বিষিয়ে উঠেছিল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তিতলির। গলার আওয়াজ আটকে গেছে । চিৎকার করে কাউকে ডাকতে পারছে না। ততক্ষনে তিতলি বুঝে গেছিল ডেকেও কোনো লাভ হবে না। 

লোকটা তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চোখে লোলুপ দৃষ্টি। মুখে শয়তানের হাসি। তিতলির মনে পড়ছিল সেই ছোটবেলার ঠাকুর তৈরির সময় অসুরের নৃশংস মুখটা। অনেক কাকুতি মিনতিতেও কাজ হলো না। বরং শুনল 'একদম ফ্রেশ আইটেমের জন্য বেশি দাম দিয়েছি, টাকাটা তো আর জলে দেব না।' তখন অবাক হওয়ার সময়টুকুও ছিল না। আঁচড়ে কামড়ে অনেক ধস্তাধস্তি করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে নি তিতলি। ক্ষুধার্ত পাশবিক নখর থাবায় সারা শরীর রক্তাত্ব। অচৈতন্য তিতলির জ্ঞান যখন ফিরলো তখন সে পতিতালয়ে। সব কিছু বোঝা না বোঝার মাঝে সে এখন অসহায়। উচিত অনুচিতের মাঝে ঘোর দ্বন্দ। অঝোর কান্না ভেজা বালিশ স্যাঁত স্যাঁতে। 

এক হাত চুড়ি আর পায়ে নুপুরের আওয়াজ করতে করতে কে যেন এসে কর্কশ গলায় বলে উঠলো" নে তৈরি হয়ে নে আজ তোর প্রথম দিন। কতদিন আর ইনকাম নষ্ট করবি ছুরি।" কিছু না বলে তিতলি জানতে চেয়েছিল সেই রাতের ঘটনা। ওই মহিলা বলেছিল," তোর বর তোকে বিক্রি করেছে আমাদের কাছে। এটাই ওদের ব্যবসা।" তিতলির কাছে এই পুরো ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত। একে মিতুনকে না পাওয়ার যন্ত্রনা তার ওপর নিজেকে পতিতা দেখে তার বেঁচে থাকার সব ইচ্ছেটা ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে বাধ্যতামূলক আজ সে পতিতালয়ের একজন। রোজ রাতে সেজেগুজে বসে রূপের পসরা সাজিয়ে। কদিন পর দুর্গা পুজো। তার মনে পড়লো সেই কথাটা। আজ সে জানে পতিতালয়ের অর্থ। এখন সেই মাটি যাবে তার আঙন থেকেই। হালকা চোখের কোণ ভিজে যায় তিতলির। বিরহী মন অপেক্ষায় নতুন ঘর বাঁধার, মিতুনের সাথে। হলোই না হয় স্বপ্ন!!! তবু তিতলি আশাবাদী। আর মিতুনের চোখ খুঁজে বেড়ায় আজও সর্বত্র তার তিতলিকে।

                       ***************






পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু