বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

আঁধার কালো

আবার সব রঙ মিশিয়েছিস? এত সুন্দর সুন্দর রঙগুলো তোর মনে ধরে না? কেবল কালো করে ফেলিস সব মিশিয়ে... কত রঙ নষ্ট হলো বলতো! গজগজ করতে করতে শ্যামা রঙের শিশি, জলের বাটি, তুলি, কাঠি সব সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের কোনে মুখ গোঁজ করে তখনও বসেই থাকে নবু। আঙুলে গালে আবছা লাল সবুজের সাথে ঘন কালো রঙের ছোপ।


ছেলেটার হাতের কাজ বড্ড ভালো। এই বয়সে শ্যামাও এত সুন্দর পুতুল গড়তে পারত না। কৃষ্ণের বাঁশীর মত নাক, বুড়ি পুতুলের বাঁকা কোমর, খুকি পুতুলের ফোলাফোলা গাল নিখুঁত বানায় নবু ওর চোদ্দ বছরের নরম আঙুল দিয়ে। বানাতে পারে পেলেট ভর্তি রকমারি মিস্টি আর ঝুড়ি বোঝাই সবজিও। কিন্তু রঙ করতে বসলেই ও কানা! শ্যামা খেয়াল করে দেখেছে, ও মোটেই রঙকানা নয়। নীল রঙের শিশিটা দে। সবুজ আর হলুদ আম দুটো পাশাপাশি রাখ! এসব হুকুম খুব সহজেই নির্ভুল পালন করে সে। কিন্তু তুলি দিয়ে রঙ করতে বসলেই সে সব রঙ মিশিয়ে কালো করে ফেলবে প্রথমেই। তারপর বোবা দৃষ্টি মেলে বসে থাকবে। শ্যামা বিস্তর বকাঝকা করেও লাভ হয়নি। অগত্যা রঙের কাজটা নিজেই করে। তবে নবু পুতুল গড়তে শুরু করার পর বিক্রি বেড়েছে বেশ। নবুর জন্মের ঢের আগে থেকেই সে পুতুল বানায়। ঝাঁকায় করে বিক্রি করে বছরভর। কাছে দূরের সব কটা মেলাতে বসে তার পসরা সাজিয়ে। শীতে আর পুজোতে তো সে বাড়িই থাকতে পারে না। কখনও কখনও হপ্তা পেরিয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। প্রথম প্রথম বিন্দু রাগ করত, অভিমান করত। একসময় শ্যামার বিন্দুবাসিনী রাগ অভিমান সব ভুলেই গেল।


শ্যামাপদর পরের ভাই বিষ্ণুপদ তখন নওল-কিশোর। নরম গোঁফ আর চকচকে শরীরে কাঁধ চওড়া হচ্ছে, কবজি শক্ত হচ্ছে। বৌদির সাথে হাসিঠাট্টার ধরণ বদলাচ্ছে। তার চোখের চোরা চাহনিতে আর বিন্দুর মুচকি হাসিতে অচেনা রঙ ধরছে। মাটির পুতুলের কারিগর শ্যামাপদরও রঙ নিয়ে কারবার। তাই চোখে পড়ে কিছু, কিছু কানে আসে। সেসবের মধ্যেই নবুর জন্ম। বাপ কাকার মত কচি শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, কোঁকড়া চুল আর মায়ের মত কটা চোখ নিয়ে সে মায়ের চাইতে বেশি বাপ ন্যাওটা হয়ে উঠলো। শ্যামা বাড়ি থাকলেই বাপ ছেলের খুনসুটি, আগড়ুম বাগড়ুম গপ্প, একসাথে খাওয়া শোয়া। শ্যামা বাড়ি না থাকলে বিন্দুর সূক্ষ্ম অমনোযোগ তার কচিপ্রাণেও আঁচড় কাটে। সে একরকম দ্বৈতস্বত্তা গড়ে তোলে নিজের ভেতরে। বাপ বাড়ি থাকলে একরকম, না থাকলে আরেকরকম। মায়ের কাছে সে বাড়ির একজন বাসিন্দা মাত্র। আদরযত্ন জোটে, কিন্তু নিয়ম মেনে। সেখানে গল্প বলার উচ্ছ্বাস, হটাৎ গলা জড়িয়ে ধরার আদিখ্যেতা, আঁচলে মুখ মোছার বাৎসল্য প্রশ্রয় পায় না। সেই সময়েই এক রাতে খিড়কি পুকুরে ডুবে মরে বিষ্ণুপদ। সাঁতার জানতো, কিন্তু ধেনোমদ গিলে হুঁশ ছিল না মোটেই। সবাই বললো, পাপের শাস্তি।


কিসের পাপ নবু জানে না। সে শুধু জানে, তার মা আজও পুকুরঘাটে গিয়ে বসে। ছমছম্ চাঁদনিতে পুকুরপাড়ের গাছপালার সাথে মাকেও কালো লাগে। নবু হাঁ-করে দেখে সেই কালো অবয়ব। যেমন দেখতো বাবা না থাকলে পাশের ঘরে মাঝরাতে পিদিমের আবছা আলোতে! মৃদু লালচে আলোকে ঢেকে দুটো কালো শরীর সাপের মত হিলহিল করত! নবু হাঁ-করে সেই নিষিদ্ধ কালো রঙের চলন দেখত। তার চোখ থেকে আস্তে আস্তে সব রঙ মুছে যেত। পুরো পৃথিবীটাই কালো হয়ে উঠত। বিছানার পাশে জানলা, জানলার বাইরে খোলা উঠোন, উঠোনে রাখা গরুর গাড়িটা- সব। নবুর মাথার ভেতরে একটু একটু করে কালো রঙের দুটো শরীরী বিভঙ্গ দখল করে নিত অন্য সব রঙ। মস্তিষ্কের ভাঁজে জমাট বেঁধে বসে যেত কালো সিল্যুট!


সেদিনও কালোই দেখেছিল নবু। সেদিনও চাঁদের আলো ছিল। কাকার অতিচেনা সুঠাম চেহারাটা এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে আসছিল বাড়ির দিকে। চাঁদের আলোয় ঘোর কালো চলন্ত শরীর। হটাৎ মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো একজন। বিছানায় মা তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বাবা নেই। দ্বিতীয় অবয়বটা যে বাবার, এক লহমাতেই চিনেছিল নবু। মাতাল কাকাকে নিয়ে বাবার চেহারাটা মিলিয়ে যায় খিড়কি পুকুরের দিকে। একটু পরেই ঝুপ্ করে আবছা একটা শব্দ। কিছুক্ষন পর নবুর বাবা এসে বসেন দাওয়াতে। জানলা দিয়ে শুধু কালো পিঠের দিকটা দেখতে পাচ্ছিল নবু। ফুলে ফুলে উঠছে নিঃশব্দ কান্নার দমকে।


বিষ্ণুর ফুলে উঠা শরীরটা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল শ্যামা। বিন্দু পাথরের মত বসেছিল দাওয়ায়। বিষ্ণুর মৃত শরীরটার দিকে তাকাতেই আচমকা বমি পেল নবুর! এত সাদা কেন! ছটফট করে ওঠে নবু। চোখ বন্ধ করে কালো রঙ খুঁজতে থাকে আঁতিপাঁতি করে। প্রদীপের ছায়ায় মাখামাখি কালো রঙের চেনা অবয়ব খুঁজতে থাকে। যারা ঢেকে ফেলবে নিমেষেই ঐ ফুলে ওঠা ফটফটে সাদা অচেনা শরীরটা! শিরায় উপশিরায় তার কালো রক্তের ফিনকি ছোটে! নবু মনে মনে সব রঙের শিশি উল্টে ফেলে দিয়ে লাল নীল সবুজ হলুদ রঙ একসাথে মেশাতে থাকে প্রাণপণে!

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু