বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মন রে!

মঞ্জিল মিটিমিটি হেসে গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল। এই রকমই ওর স্বভাব। অন্যের কথা শোনে বেশি, নিজের কথা বলে কম। বিয়ের কথা উঠলে তো আরোই কম বলে। তখন বোধহয় শোনেও কম। ঐ মন ভোলানো মিটিমিটি হাসিটুকুই কেবল ফুটে থাকে ওর সুন্দর মুখে। যেন কুমোরটুলির কোন দক্ষ কারিগর তুলি দিয়ে হাসিটুকু এঁকে রেখে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মঞ্জিলের বাবা আর দিদিরাও হাল ছেড়েছেন। মা-ই কেবল, এখনও, মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সে কি মঞ্জিলের জন্য নাকি শ্রীরূপার জন্য? কে জানে!


ঝড়ের মত মেয়েটা এসেছিল মঞ্জিলের জীবনে। অতনুদের বাড়ি ভাড়া থাকত। শ্যামলা চেহারাতে কোমলতা বিশেষ ছিল না। বরং চওড়া কাঁধ আর ছোট করে ছাঁটা চুলে একদম পারফেক্ট ফুটবল প্লেয়ার। রাতদিন ছেলেদের সাথে মাঠে বল খেলত। তারপর তো কোচিং, স্কুল লেভেল থেকে ডিস্ট্রিক্ট, শেষে প্রত্যাশিত ভাবেই ন্যাশনাল টীমে চান্স পেল। শ্রীর বাবা সবদিনই মেয়ের পাশে ছিলেন। চান্স পেতেই আর দু'বার ভাবেননি। পাততাড়ি গুটিয়ে সপরিবারে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। 


পড়াশোনায় ভালো, সুদর্শন, শান্ত, মুখচোরা মঞ্জিলের সাথে কি করে যে ঐ মেয়ের বন্ধুত্ব হয়েছিল কে জানে। যেদিন ভোরে ওরা দিল্লি রওনা হবে, তার আগের দিন মঞ্জিল বড় অস্থির হয়ে উঠেছিল। সারাদিন নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছিল। সন্ধ্যার আগে ছাদে উঠে এসেছিল। একা একা পায়চারি করতে করতেই তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে কবিতা। তার প্রথম কবিতা, তার দ্বিতীয় প্রেম।


যা না চাইবার তার বাসনাই বুঝি এই ডুবজল।

মন রে! সেই গহীন গাঙে চল রে ভাসাই নাও।

ওপারেও সে এক শূন্যতা, এক অসীম রিক্ততা!

পূর্নতার আকাঙ্ক্ষায় ভুল করে কেন তারে চাও!


শ্রীরূপা কখন যেন উঠে এসেছিল চুপিসাড়ে। দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল মঞ্জিলের অস্থিরতা। তারপর একসময় একছুটে এসে জড়িয়ে ধরে মঞ্জিলকে আস্টেপৃষ্ঠে। শ্রীর অচেনা বাহুবন্ধনে থরোথরো কাঁপতে শুরু করেছিল মঞ্জিল। আচ্ছা, আচমকা শ্রীকে ঐভাবে পেয়ে মঞ্জিল একেবারেই বিবশ হয়ে পড়েছিল কি! নাকি এই রকম একটা পরিস্থিতি আসতে পারে এমনটা ভাবতেই পারেনি! কে জানে! শ্রীরূপা যখন ধীর পায়ে ফিরে যাচ্ছিল, একা, একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, নিঃশব্দে, মঞ্জিল আর ওর মধ্যে দূরত্বটাও যেন একশ যোজন করে বেড়ে যাচ্ছিল প্রতি পদক্ষেপে। মঞ্জিল পিছু ডাকেনি ওকে, একবারও না। এমনকি, খবরের কাগজে শ্রীর একের পর এক ব্যর্থতার সংবাদ, তারপরে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার খবরে বুকের ভেতরে তোলপাড় উঠলেও মুখে ফোটেনি তার চিহ্ন। তবুও মা, মঞ্জিলের মা, কি করে কি জানি কি বুঝলেন! বহুবার সেই সময় বলতেন শ্রীরূপার সঙ্গে যোগাযোগের কথা। বলতেন, এসময়ে মেয়েটার পাশে থাকলি না! ততদিনে মঞ্জিল চুপ করে মিটিমিটি হাসতে শিখে গেছে।


শুধু অনিমেষই কিছু বলেনা মঞ্জিলকে। নয়ত ওর বৌ রুবীও ছাড়ে না। সবার মতোই এক কথা তারও। এত ভালো চাকরি, এত বড় ফ্ল্যাট, গাড়ি, বছরে দু'তিন বার ফরেন ট্রিপ! কিসের অভাব আপনার? কেন বিয়ে করবেন না? কত মেয়েরা ঘুরঘুর করছে পিছনে, দেখতে পান না কেন বলুন তো? 


অনিমেষ বলে- দেখো, এইজন্য তুমি বাড়ি থাকলে ও কম আসে। ও আসলে ভয় পায় বোধহয় মেয়েদের, বুঝলে! সেই জন্য তুমি না থাকলেই বেশি আসে এবাড়ি।


সেটা কিসের টানে তা কি আমি জানি না ভেবেছো? খরখর করে ওঠে রুবী। সবকটা বোতল তো ঐ আমি না থাকলেই শেষ করো দুজনে মিলে! আচ্ছা মানুষ বাপু। ধরে বেঁধে বিয়েটা দিতে পারছো না বন্ধুর?


আরে ধুর্! কি হবে বিয়ে করে। এই আমার মতই জ্বলবে দিনরাত, আর কি!


কি! তোমাকে জ্বালাই আমি? দিনরাত জ্বালাই? তবে রে! কপট রাগে ঝাঁপিয়ে পড়ে রুবী অনিমেষের উপরে। আট বছরের বিবাহিত জীবনে ওরা এখনও দোকলাই। রোমান্সেও ভাঁটা পড়েনি। মাসে দু'তিনবার করে রুবী নিজের বুটিকের প্রয়োজনে শান্তিনিকেতনে বাপের বাড়ি যায়, থেকে আসে তিনচার দিন। সেই নিয়মিত অভ্যস্ত বিরহের ছলেই হয়ত ওরা রোমান্সটুকু আজও বাঁচিয়ে রেখেছে নিভৃতে। যদিও রুবীর অনুপস্থিতিতে কখনোই একা হয় না অনিমেষ। মঞ্জিল চলে আসে অফিস ফেরত। রুবী বলে, জানি জানি। আস্ত ভীতুর ডিম তুমি। রাতে একা থাকতে ভয় পাও, তাই বেচারাকে টেনে আনো! নেশার চোটে সে-ও আর বাড়ি মুখো হয়না।


আজও নেশার চোটে রয়ে গেছে মঞ্জিল অনিমেষের বাড়িতে। রুবী থাকলে এ কথাই বলত। শুনে মিটিমিটি হাসে মঞ্জিল। ডিনারের পর একটা সিগারেট ধরিয়ে অনিমেষ খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ওর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা সুঠাম পিঠে হাত রাখে মঞ্জিল।


নতুন কি লিখলি?


ভোরের আলোর মত নরম কথাটা কি ঠিক!

এই যে নিদ্রাহীন একেকটা রাতের পর,

স্বপ্নহীন একেকটা নির্ঘুম তুমুল এপাশ ওপাশের পর

জানলার শিল্পিত অবয়বে ফুটে ওঠে লালচে ভোর,

তার আলোতেই জেগে ওঠে আরেকটা কঠিন দিন!

ভোরের আলোর মত নরম কথাটা, বোধহয় ঠিক নয়।


সিগারেট ফেলে দিয়ে অনিমেষ জড়িয়ে ধরে মঞ্জিলকে। আর ওর চওড়া রোমশ বুকে মুখ গুঁজে তীব্র আশ্লেষে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় মঞ্জিল। তারপর হাতে হাত রেখে বেডরুমের দিকে পা বাড়ায় দু'জনে। রাতের আকাশে একটা তারা খসে পড়ে ওদের অগোচরে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মঞ্জিলের মা, নিজের বারান্দায় বসে। একা, নির্ঘুম।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু