বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চ্যালেঞ্জ

কলেজ ক্যান্টিনে পল্লবীর দেওয়া একটা চ্যালেঞ্জ রক্ষা করতে গণেশ এবং সুমিত সার্কিট হাউসে পৌঁছুলে চাকর রতনলাল একটু অদ্ভুত ব্যাবহার করে। সে রাতে ওখানে থাকতে চায় না। রাতে সুমিত এক ভয়ংকর অলৌকিক ঘটনার সামনে করে। সেই ঘটনায় গণেশ ওর সঙ্গে থাকলেও অস্বীকার করে এবং মিথ্যা স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয়।ওদের রুমে একটা আলমারি ছিলো যার চাবি ওরা বিছানার তলা থেকে পায়। আলমারির ভিতর থেকে একগুচ্ছ চাবি আর পল্লবীর একটা ডাইরি ওরা খুঁজে পায়। তারপর-----

      ডাইরির প্রথম পাতায় রজত এবং পরিচিত শহর ছেড়ে এখানে চলে আসার জন্য পল্লবীর মনঃকষ্ট আবার বাবার বদলি হওয়া জীবনের সঙ্গে এইভাবে চলার অভ্যাস সম্মন্ধে লেখা। প্রায় ৫টা পাতা জুড়ে এইসব লেখা ৬নম্বর পাতা থেকে পল্লবীর লেখা এইরকম-----

     জায়গাটা সম্মন্ধে গুগুল সার্চ করে যতটা জেনেছিলাম এটা তার থেকে সুন্দর। আমাদের সার্কিট হাউসের কিছুটা দূরে একটা নদী আছে।সামনের লনে বাহারি ফুলের গাছ,সারা বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছে পাইন গাছ দিয়ে। বাড়ির পিছন দিকটা সূর্যের আলো কম পড়ায় সেখানটা একটু স্যাত সেঁতে একটু গা ছম ছম করে বটে। এমনিতে আমি একটু ভুত বিশ্বাসী,সবাই আমায় খেপাতে ছাড়ে না সেজন্য। আমার বাবার এখানের বর্ডারে পোস্টিং সকাল বেলা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে যান ফিরতে ফিরতে সেই বিকাল। মা একটু এদিক ওদিক করা ফুল গাছে জল দেওয়া আর উল বোনা নিয়ে পরে থাকেন। আমি একা কি করবো বাগানে বাড়ির চারপাশে ঘুরেই সময় কাটাই, এখানকার লোকজন এদিকে খুব একটা আসে না। রাঁধুনি কাকাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তবে এবাড়ীতে কেউ রাত কাটাতে চায় না, কেনো চায়না বুঝতে পারিনা। কে জানে বাবা এখানে কি তবে ভুত আছে,বাবাকে জিজ্ঞাসা করায় একদিন খুব বকা খেলাম, বাবা এই সব ভুত প্রেতে বিশ্বাস করে না।

    এতটুকু পড়ার পর গণেশ বিরক্ত হয়ে বলে ধুর এই পল্লবীর প্যাণ প্যানানি মেয়েলী গল্প তুই পড় গে যা আমি ততক্ষণ বাড়িটা ঘুরে দেখি। কাল সন্ধ্যা হয়ে গেছিল ভালো করে দেখা হয়নি।আমার দিকে তাকিয়ে বলে চাবির গোছাটা দে তো দেখি এর মধ্যে উপর তলায় যাবার কোনো চাবি আছে কি না।

    আমি বলি কি দরকার রতনলাল যখন বলছে উপরে সাপ খোপ থাকতে পারে সেখানে যাওয়ার কি দরকার।

  গণেশ খেঁকিয়ে ওঠে,পাগলের মতো কথা বলিস না সুমিত ওপরে সাপ খোপ থাকলে বাইরের বাগানে তার থেকে ঢের বেশি আছে,চাবিটা দে আমার কিচ্ছু হবে না। অগত্যা আমি চাবিটা ওকে দিয়ে দিলাম আবার ডায়রিতে মন দিলাম।

    আজকে নিয়ে দুদিন হলো আমরা এখানে এসেছি। কেনো জানিনা আমার কেবলই মনে হয় আমার উপর কেউ নজর রাখছে। রজতকে বলায় সে ফাজলামী শুরু করে দিলো।গতকাল রাতে একটা পচা গন্ধে আমার ঘুম ভেঙে গেছিলো।পাশের ঘরে বাবা মা থাকেন,উপরে যাওয়ার সিঁড়িটা তালা চাবি দেওয়া ওটায় আমাদের কোনো অধিকার নেই। কেনো জানি আমার মনে হচ্ছিল এই পচা গন্ধটা উপর থেকেই আসছে।আমার ঘরের চারপাশে তাকাতেই দেখলাম একটা কালো মতো ছায়া মেঝের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে গেলো। শুনেছি এসব অঞ্চলে বন বিড়াল, ভামের অনেক উৎপাত আছে। এসব ভেবে আমার তো ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হবার যোগাড়। তবুও কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে টর্চ জ্বেলে চারপাশ দেখলাম কিছুই দেখতে পেলাম না। ঘরের বড়ো আলোটা জ্বেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলাম না। আবার বিছানায় কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়েছিলাম। ভোররাতে একটা মেয়ের কান্না আর উপরে দুমদাম আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে আমার কান্না পেয়ে গেলো,এমন সময় দরজায় বাবা ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলে ধরে প্রাণ পাই। তারমানে আওয়াজটা আমি একা শুনিনি বাবা মাও শুনেছেন। সে রাতে আমি আর একা শুইনি মা আমার কাছে এসে ঘুমোয়। পরদিন বাবা কেয়ারটেকারকে ডেকে উত্তম মধ্যম দেয় তখুনি উপরতলা সাফা করার হুকুম দেয়।কেয়ারটেকার জানায় তার কাছে চাবি বা পারমিশন কিছুই নেই। দিনটা শনিবার ছিলো বাবার ছুটি কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে নিজেই হাট থেকে চাবিওয়ালা ধরে এনে উপর তোলার চাবি বানায়। মা আমি বারণ করলেও বাবা শোনেনা,বাবা সেদিন যদি আমাদের কথা শুনতো তাহলে বোধহয়---

    সেদিন সারাদিন বাবা একাই উপরে উঠে কি সব খুটুর খাটুর করছিলো। ১২টা নাগাদ নিচে নেমে এলো আমায় বললো মামনি শাবলটা একবার দে তো। আমি কি হবে জিজ্ঞাসা করায় বলে দুর্গন্ধের রহস্য বোধ হচ্ছে খুঁজে পেয়েছি।বাবা শাবল নিয়ে উপরে চলে যায়। দুটোর সময় অব্দী স্নান করতে না আসায় মা বাবাকে অনেক ডাকাডাকি করেও  সাড়া না পেয়ে আমাকে উপরে গিয়ে বাবাকে ডেকে আনতে পাঠায়। উপরের ঘর গুলোর সামনে আসতেই আমার গা টা কিরকম ছম ছম করতে থাকে। আমি বাবা বাবা বলে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো আওয়াজ পাইনা। একটা ঘরের দরজা কিছুটা ফাঁক করা দেখে আমি সেটা ঠেলে দেখি ভিতরে নিকেশ অন্ধকার, বাইরের আলো ভিতরে যেটুকু ঢুকেছে তাতে দেখলেই বোঝা যায় বহুদিন এ ঘরে কেউ ঢোকেনি, একটা বিচ্ছিরি গন্ধ সারা ঘর জুড়ে।বেশ বোঝা যাচ্ছে এই বাড়ির উপর তলার সংস্কার হয় নি। সরকারী কাজ হলে যা হয় নীচের ঘর সংস্কার করে বাইরে রং চং করে পরে হবে মনোভাবে উপরটা ছেড়ে রেখেছে। বাবা কে সেখানে ডাকাডাকি করে না পেয়ে আমি সিঁড়ি ধরে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। একটা বাঁক পেরোতেই দেখতে পেলাম ছাদের দরজা হাট করে খোলা, বাইরের আলো ভিতরে ঢুকেছে। ছাদে পৌঁছে দেখি সেই বিশাল ছাদের একটা কোনা ধসে পড়েছে, আগাছায় ভরা। আমি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বাবা বাবা করে ডাকি কোনো সাড়াশব্দ পাইনা। হটাৎ নজরে পড়ে দক্ষিণ দিকে একটা জলের ট্যাংকের মতো করা ,তার সামনেটা সদ্য ভাঙা। আমি পা টিপে টিপে সেদিকে যাই জানিনা সে মুহূর্তে আমার মধ্যে সেই সাহস কোথা থেকে এসেছিলো। সেই ভাঙা জায়গার সামনে এসে দেখি আসলে কোনো একটা ঘরকে কেউ পাঁচিল গেঁথে ওই ভাবে ঘিরে রেখেছিল। সেখানে থেকে আমার নাকে সেই বিশ্রী গন্ধটা হাওয়ায় ভেসে ঢুকছিল, সেখানে পৌঁছে দেখি একটা দরজা,তার উপরের মস্ত তালাটা ভাঙা হয়েছে। আমি কম্পিত হাতে দরজাটা ঠেলে একবার বাবা,ও বাবা বলে ডাকি। দরজাটা একটু ফাঁক হতেই সেই বিশ্রী গন্ধটা আমার নাকে ঢোকে আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। হটাৎ ই বাবা ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে। একটু রুক্ষ মেজাজে বলে কি হলো কি? বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে ওঠে।তার চোখগুলো লাল টকটকে যেনো কোঠোর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে।বহুদিন কেউ ঘুমিয়ে ওঠার পর তার শরীরের যেরকম অলসতা দেখা যায় বাবার হেঁটে আসাটা খানিকটা সেরকম। আমাকে জোরে ঠেল দেয় আমি পড়ে যাই,আমার চুড়িদারের ওড়না হওয়ায় ঊরে নীচে পরে যায়। বাবা আমার দিকে অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে খানিক্ষণ চেয়ে থেকে একটা বিশ্ৰী হাসি হেসে ছাদের খোলা দরজা দিয়ে নীচে চলে যায়।

     আমি পরের পাতা আগ্রহ নিয়ে ওল্টাতে যাবো হটাৎ গণেশ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে, আমায় বলে সুমিত তুই তো পল্লবীর ডায়েরি ছেড়ে এখন উঠবি না। আমি একটু গ্রামটা ঘুরে আসি,বাইরে বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে,ও হ্যাঁ এই নে চাবি, ওপরের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। এই বলে চাবির গোছা আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাইরের লনের থেকে চিৎকার করে বলে আমার অপেক্ষা করতে হবে না,আমার দেরি হলে দুপুরের খাওয়া তুই খেয়ে নিস। আমি কিছু বলতে যাই তার আগেই গণেশ হাওয়া।গণেশের উপর খানিকটা বিরক্ত হই, যাইহোক আমি ডাইরির পাতা উল্টাই।

    ছাত থেকে বাবার পিছু পিছু আমি প্রায় দৌড়ে নীচে নামি। ততক্ষণে বাবা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাবার এরকম আচরণ আমি আগে দেখিনি, নোংরা অবস্তায় বাবা কোনোদিন ঘরে ঢোকেনা। মা অনেক ডাকাডাকি করলেও বাবা সাড়া দেননা।কিছুক্ষণ পরে বাবা দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন,মা স্নান খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করতে পথ আগলে ধরলে বাবা মাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে গাড়ী নিয়ে চলে যায় গ্রামের দিকে। সেদিন আমাদের খাওয়া হয় না,আমি আমার ঘরে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা হটাৎ সেই বিশ্ৰী গন্ধে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। আমি ভিত চকিত চোখে দেখি আমার খাটের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে একটা বীভৎস জন্তু সেটা কুকুর ও নয় বিড়াল ও নয়। একটা অদ্ভুত বীভৎস মুখ,সারা গা কালো কুচ কুচে পায়ের থাবা গুলো মানুষের আঙুলের মতো সেখানে বিরাট বড়ো বড়ো নখ। রক্তঝরা চোখে একদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি আতঙ্কে মা মা বলে চিৎকার করে উঠি, মা হন্ত দন্ত হয়ে আমার ঘরে ঢোকে, কিন্তু জন্তুটা চোখের নিমিষে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি। আমি মাকে জড়িয়ে খুব কাঁদতে থাকি।

       সেদিন বিকেল থেকে কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে,শো শো করে হাওয়া তার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমাদের জেনারেটর ঘরে জল ঢুকে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল,একটা মোমবাতির আলোয় আমি আর মা ,দুজনেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম,বাবার ফেরার পথ চেয়ে বসে রইলাম।রাত তখন আটটা কি নটা হবে বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেলাম,তারমানে বাবা এসে গেছেন।আর ভয় নেই বাবাই রুমের আলো জ্বেলে দেবেন।৫ মিনিট,১০মিনিট,২০মিনিট কিন্তু বাবা আসে না।বাবা বাড়ি ঢুকলেই আমায় মামনি মামনি বলে ডাকে। আজ সেই ডাক ও শুনতে পাচ্ছি না,মা আর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার ঘরের দিকে যাই। দরজা হাট করে খোলা,আলো নিয়ে সে ঘরে ঢুকতে যাবো মা আর আমি একসঙ্গে সেই ভয়ংকর জন্তুটাকে দেখি ঘর আগলে দাঁড়িয়ে আছে । প্রচন্ড ভয়ে মা আর আমি চিৎকার করে উঠি। এমন সময় দেখি সিঁড়ির কাছ থেকে বাবা একটা বিশ্ৰী গলায় আমাদের উদ্দেশ্যে বলে এখানে কি করছিস ? বাঁচতে চাইলে ঘরে যা।তারপর আপন মনেই ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলে যদিও তোরা কেউ বাঁচবি না। পরক্ষনে কর্কশ গলায় চিৎকার করে ওঠে যা ঘরে যা। আমরা ভীষণ ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে দরজায় পিঠ লাগিয়ে ভাবতে থাকি, এ কে এতো আমার বাবা নয়।

আমাদের ভাবনার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু যে আমাদের সঙ্গে ঘটতে চলেছে সেটা বুঝলাম ওই দিন রাতে।

                     ------চলবে------

কপিরাইট রিজার্ভ@সৌগত@মুখোপাধ্যায়#২০২২



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু