বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

উল্টোচক্র



জলন্ত কাঠ গুলো নিভে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে গেল। একসময় অরুনাভকে পুরোপুরি দেখা গেল। শীতকাল, ঠান্ডাটাও জম্পেশ পড়েছে ক'দিন ধরে। রিসিভিং সেকশনের দু'জন স্টাফ তাড়াতাড়ি চাদর আর কম্বলে মুড়ে অরুনাভকে নিয়ে গেল সোজা ইমার্জেন্সিতে। সেখানে ইনওয়ার্ড-রুমে আগেই রেডি করে রাখা ছিল সমস্ত মেশিনপত্র। ডাক্তার আর তিনজন নার্স মিলে পরীক্ষা শুরু করলেন। নাহ্, তেমন কিছু নয়। হার্ট ফেইল কেস। সুতরাং আই সি ইউতেও রাখার প্রয়োজন নেই। জেনারেল বেডে দিয়ে রিসেপশনে খবর দেওয়া হলো এনাউন্সমেন্টের জন্য। জ্ঞান ফিরতে আধঘন্টা মত লাগবে। 


প্রবীর আর ঝুমা দুজনেই এসেছে। অরুনাভ ধীরে ধীরে উঠে বসেছেন বিছানায়। বুকের বাঁদিকে হাত বোলাচ্ছেন। প্রবীরের মুখের দিকে খানিকক্ষন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। প্রবীরও ছলছলে চোখে দেখছে বাবাকে। মিনিটখানেক পর ধাতস্থ হতে অরুনাভবাবু ফ্যাসফ্যাসে গলাতে বললেন, প্রবীর? সঙ্গে বৌমা? 


হ্যাঁ বাবা, চিনতে পারলে তবে! প্রায় কেঁদেই ফেলে প্রবীর। চলো, হাঁটতে পারছো তো? বাড়ি যেতে যেতেই পুরো ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছেন, তেমন চিন্তার কিছু নেই।

-------


চেনা ঘর, চেনা বিছানা, চেনা ছেলে বৌমা আর নাতনি সুমিকে নিয়ে অরুনাভ বেশ ভালোই আছেন। ধীরে ধীরে শরীরে বল বাড়ছে। এখন বাজার দোকানপাট সব তিনিই সামলাতে শুরু করেছেন। আর বিকেলের আড্ডাটাও দিব্যি জমছে। অরুনাভর আগে এসে গেছেন পদ্মলোচনদা, মাইতিদা আর বিমলেশ। বছর চার পাঁচ যেতেই একে একে শ্যামলেন্দু, রায়দা, পুলিনদা আর অলকেশ হাজির হয়েছে। তবে আড্ডা, চা আর হাঁটাহাটি শেষ করে বাড়ি ফিরলে ঘরটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে অরুনাভর। 


প্রবীরের চুলগুলো সব কালো হয়ে গেছে। ঝুমারও অনেকটা মেদ ঝরে তন্বী হয়ে উঠেছে। সুমি কলেজ থেকে স্কুলে এন্ট্রি পেয়ে গেছে। এখনও কি তার ফেরার সময় হয়নি? মাঝেমাঝে স্বপ্নে মুখটা ভেসে ওঠে, তবে ঠিক পরিস্কার নয়। প্রবীর বোধহয় জেনেছে ভালোই। সেদিনই মিটমিট করে হেসে হেসে বলছিল, কি! আর তো কয়েকটা মাসের অপেক্ষা বাবা! মনে পড়েছে কিছু?

------


সকাল থেকেই সেদিন সাজ সাজ রব বাড়িতে। সুমি স্কুলে যেতেই প্রবীর আর ঝুমা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। বাবাকে বলে গেল, কখন ফিরবো সে তো জানি না, আজ ঘরেই থেকো। সেইমত অরুনাভ আর বেরোননি। মনটাও ছটফট করেছে সারাদিন।


ওরা দুজনে এম্বুলেন্সে করে মায়াকে নিয়ে ফিরলো সন্ধ্যা নাগাদ। ততক্ষনে অরুনাভর স্মৃতিতে পরিস্কার ধরা পড়েছে মায়ার ছোট খাটো ফর্সা চেহারাটা। ডাক্তার বলেছেন মাস কয়েক প্যারালিসিস কন্ডিশনটা থাকবে বাবা, চিন্তা কোরো না- প্রবীর বলে। আয়া রাখছি রাতের, দিনের বেলা তো ঝুমা আর আমি আছিই। 


পারবি তো বাবু, এত খরচ? জিনিসপত্রের দাম কমলেও তোর তো মাইনে কমেছে বেশ! আমার পেনশনটাও!


আরে কয়েক দিনের ব্যাপার তো। হয়ে যাবে। তাছাড়া উপায় তো নেই। এই সময় এটুকু তো করতেই হবে বাবা।


তা বটে! মনে মনে খুশি হন অরুনাভ। মায়া এসে গেছে, সুতরাং তার সুখের দিন এলো। এখন ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক খাবেন, মনে পড়ছে শীতকালে পিঠে ভাজার গন্ধ, ঠাকুরঘরে সন্ধ্যায় শাঁখ বাজানোর শব্দ আর রাতের বিছানায় মায়া এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলে ঠুনঠুন্ চুড়ির শব্দ! আর বছর খানেক পরেই নিশ্চয় সিনেমা দেখতে যেতে পারবেন, বেড়াবেন দুজনে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাবেন।

----- 


বুঝলে, মনটা কেমন যেন আনচান করছে ক'দিন ধরে! রাতের খাওয়ার পর পান খাওয়া ধরেছেন দুজনেই। পান সেজে মুখে পুরতে পুরতে বলে ওঠে মায়া। প্রবীররা নেই, গেছে ওর শ্বশুরবাড়িতে। ঝুমার বাবা, মানে প্রবীরের শ্বশুরমশাই এসেছেন গতকাল। বেশ অল্পই বয়স ভদ্রলোকের, শরীর স্বাস্থ্যও ভালো। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে জয়েনিং লেটারও এসেছে, হয়ত কাল পরশু অফিসে জয়েন করে যেতে পারবেন। এমন আবির্ভাবের দিনে কাছের মানুষজনকে তো পাশে থাকতেই হয়। তাই ওরা তিনজনেই গেছে। 


মায়া এখন পুরো দস্তুর ঘরসংসার সামলাতে পারছে। বরং ঝুমাই সংসারে ওর অধিকারটুকু চলে যাওয়ার আশংকায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কখনও কখনও। শাশুড়ি বৌতে খটামটি লেগে যায় বেশ। যাক্ গে! অরুনাভ ভাবেন, আর বছর দশ বারো হয়ত থাকবে ঝুমা এ বাড়িতে। তারপর ওর বাবা মা দিনক্ষন দেখে পিতৃগৃহে নিয়ে যাবেন। সব মেয়েকেই একদিন অবিবাহিত জীবনে ফিরতে হয় বাপের বাড়ি। কিন্তু এ সংসারে আরেকজন কারুর যেন আসার কথা! অরুনাভর মনটাও ক'দিন ধরেই উশখুশ করছিল। মায়ার কথাতে তাই বেশ চমকালেন। তাহলে কি ঘটনাটা সত্যিই ঘটবে!

----


বাবা, মুর্শিদাবাদ থেকে ছোটকুর খবর এসেছে- বলে প্রবীর। পরশু ডেট দিয়েছে। আমি কাল যাচ্ছি। একাই যাচ্ছি বুঝলে! চারদিন ছুটি নিয়েছি। পরিস্থিতি কেমন তা তো জানি না, তেমন হলে ছুটি বাড়াবো। চিন্তা কোরো না। মাকে সামলে রেখো।


আর সামলে রেখো! তিনদিন ধরে কেঁদেই চলেছে মায়া। মনে পড়েছে অরুনাভরও। এ তো আনন্দের কথা! তাদের ছোটছেলে আসবে, বয়সে প্রবীরের চেয়ে আট বছরের ছোট। মায়াও আনন্দেই কাঁদছে,  তাই বলে রান্নাবান্না ফেলে কাঁদতে বসলে হবে? দিনরাত ঠাকুরঘরে পড়ে আছে, ওদিকে ঝুমা ছোট্ট দুরন্ত সুমিকে নিয়ে একা একা নাজেহাল হচ্ছে। সুমি এখন ছয় বছরের, বড় ছটফটে নাতনিটা। অরুনাভ গুটি গুটি পায়ে ওদের ঘরে ঢোকেন। সুমিকে খাওয়াচ্ছিল ঝুমা। অরুনাভ বললেন, ছোটকু ফিরলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে বৌমা। ক'দিন একটু সামলে নাও, কেমন? মুখ কালো করে ঘাড় নাড়ে ঝুমা। মনে মনে ভাবে, ছোট ছেলেকে নিয়েই তো আদিখ্যেতা শুরু করবে, জানি না যেন! মেয়েটা যে কবে একটু শান্ত হবে, আর পারা যাচ্ছে না!


বাস এক্সিডেন্ট কেস বাবা। মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে এসেই বাবার ঘরে ঢুকেছে প্রবীর, পাখার তলায় বসে হাঁপাতে থাকে। কী ভীড় হসপিটালে, জানো? রিসিভিং সেকশনে কেউ ছেলে মেয়েকে পাচ্ছে, তো কেউ বাবা মাকে! ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি লেগে গেছে একেবারে! বাপ্ রে! ওদিকে ছোটকুকে নিয়ে মায়া সোজা ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। ঠাকুরের প্রসাদ মুখে দিয়ে, স্নানটান করে তবে ঘরে আসবে সে। আজ মায়া নিজেই সব রান্না করেছে। বেচারা ঝুমার একটু ফুরসত মিলেছে। প্রবীরকে বলতে হবে দিন কয়েক বাইরে ঘুরে আসতে ওদের নিয়ে। এখন ছোটকু আছে যখন চিন্তার কিছু নেই। মায়ার বাতের ব্যাথাটাও সেরে উঠেছে প্রায়। অরুনাভর সুগার আর প্রেশার তো গত মাসেই নর্মাল এসেছে রিপোর্টে। ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছেন ডাক্তার।

-------


বাড়ি শুদ্ধ সকলের খুব মন খারাপ। থেকে থেকে মেয়েটার চিল চিৎকার কান্না আর কখনও কখনও আও উও শব্দ করে হাত পা ছুড়ে খেলাধূলাতে ঘর ভরে থাকত। গাইনোকলজিস্ট পরশু দেখেছেন ওদের মা মেয়েকে। ডেট দিয়েছেন সামনের সপ্তাহে। সুতরাং দিন তিনেকের মধ্যেই হসপিটালে ভর্তি হয়ে যাবে ঝুমা আর সুমি। প্রথম দু'দিন প্রবীর হয়ত দেখতে পাবে মেয়েটাকে। তারপরেই রিফর্মরুমে নিয়ে যাবে দুজনকেই। ঝুমার ছুটি পেতে পেতে হয়ত আরো দিন দুয়েক। ততদিনে সুমি ভ্রূণ হয়ে অন্তর্লীন হয়ে যাবে ঝুমার গর্ভে। আরো নয় দশ মাসের মধ্যে ঝুমা ফিরে পাবে তার মাতৃপূর্বত্ব। ততদিনে স্মৃতিও ফিকে হয়ে যাবে সবার। কি আর করা, এই তো জীবনের নিয়ম। একবার ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন যখন একে একে সবাইকেই হারাতে হবে সময় এলে। নাতনির স্মৃতি মুছবে, তারপর ছেলেরাও ছোট হতে থাকবে। চাকরি থেকে পড়াশুনার জগতে ঢুকবে, এক সময় কৈশোর ছেড়ে বাল্যে পৌছবে। একসময় মায়ার গর্ভে অন্তর্লীন হবে ছেলেরাও। 


অরুনাভ চাকরি করছেন এখন। আশা করা যায় শিগগিরই অরুনাভ আর মায়ার জন্মদাতারা ফিরবেন। তারা সংসারের দায়ভার নিতে শুরু করলে ধীরে ধীরে যৌবন গিয়ে কৈশোর শৈশব ফিরে পাবেন অরুনাভ মায়া। এক সময় কালের নিয়মে তারাও মাতৃ জঠরে অন্তর্লীন হবেন। মেনে তো নিতেই হবে! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কালো হয়ে আসা চুলগুলো দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেলেন অরুনাভ।

*********

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু