বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

নির্জন প্রেমিকা



বাড়ির কাছেই এত সুন্দর দ্রষ্টব্য স্থান আছে কল্লোল জানতেনই না। অথচ বর্ধমান বেশ নামকরা শহর, জেলা সদর। ইতিহাসের পাতায় অনেকবার নাম তুলেছে সে অনেক হিন্দু মুসলমান শাসকের হাত ধরে। প্রবীররা বেশ কয়েক পুরুষ ধরে বর্ধমানের বাসিন্দা। কল্লোলের থেকে সে বয়সে অনেকটাই ছোট। একদম নিজের দাদার মত ভক্তি শ্রদ্ধা করে কল্লোলকে। আসলে জয়েন করার পরে কল্লোলের আন্ডারেই পোস্টিং হয় তার। কাজ শেখার পাশাপাশি একটা ভালো সম্পর্কও তৈরি হয় তাদের মধ্যে। সেই প্রবীরের বিয়ে হলো গত বৈশাখে। অফিসের সবাই আসলেও কল্লোল আসতে পারেননি। এক সপ্তাহ আগেই তার প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের একটা অপারেশন হয়। কাজেই কলকাতা থেকে বর্ধমান জার্নির ধকল তিনি নিতে সাহস পাননি। প্রবীরের খুবই মন খারাপ। দাদার পিছনে লেগে থেকে থেকে এই মাসে রাজী করিয়েছে তাদের বাড়ি আসবার জন্য। সামনের বছর কল্লোলের রিটায়ারমেন্ট, পরে আর কবে সময় হবে। এসব ভেবে টেবে কল্লোল হাজির হন বর্ধমানে। সস্ত্রীক আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মনিকা শেষমুহূর্তে আসতে পারলো না।


প্রপার বর্ধমান থেকে পাঁচ কিলোমিটার মত ভেতরে প্রবীরদের বাড়ি। শহর বলা চলে না, বরং বেশ সবুজ মফস্বল এক টুকরো। নিজেদের পুকুর সহ বিরাট জমি জুড়ে নতুন পুরোনো মিলিয়ে তিনটে বাড়িতে প্রবীরের বাবা কাকারা তিন ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন। একান্নবর্তী না হলেও বেশ বড় আর জমজমাট পরিবার। সকলের সাথে সকলের বেশ ভালো সম্পর্ক।


দুপুরের ভুরিভোজ সেরে কল্লোল দেখলেন এখন শুলেই ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপর আঁইঢাই, বদহজম এসব জ্বালাবেই জ্বালাবে। তাই প্রবীরকে নিয়ে লোকাল দ্রষ্টব্যগুলো দেখে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সেইমত বেরিয়ে ঘোরাঘুরি শেষ হলো প্রায় দু'ঘন্টায়। কার্জন গেটে এসে প্রবীর বলে, চলুন দাদা, এই বি সি রোড গেছে রাজবাড়ি পর্যন্ত। তার উত্তর ফটকের থেকে কিছুটা এগোলেই আলমগঞ্জ, সেখানে একটা সমাধি আছে। ইন্টারেস্টিং। দেখবেন চলুন।


পুরোনো ইটে গাঁথা সমাধিটাতে বেশ অযত্নের ছাপ। আকারে একটু বেশিই বড়, তা বাদে দেখে বিশেষ কিছু মনে হলো না। তাই কল্লোল জিজ্ঞাসা করলেন, ইন্টারেস্টিং কেন হে?


ইতিহাসের ছাত্র প্রবীর। বললো, এটা শের আফগানের সমাধি দাদা। তাঁর আসল নাম আলি কুলি খাঁ।


শের আফগান! আফগানিস্তানের নাকি? এখানে সমাধি কেন?


না না, দাদা। ইনি পারস্যের। আকবরের খুব প্রিয় পাত্র ছিলেন। দুর্ধর্ষ শক্তিমান ছিলেন। শের নাম কেন হয়েছে আন্দাজ পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। তবে বাঘ মারার জন্য কিন্তু ইনি বিখ্যাত নন্। এনার একজন স্ত্রী ছিলেন মেহেরুন্নিসা। ইনি কে বলুন তো?


মেহেরুন্নিসা? আকবর... আকবর! দাঁড়াও, দাঁড়াও ইনিই কি জাহাঙ্গীরের ওয়াইফ....


হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। বেগম নূরজাহান।


ইন্টারেস্টিং তো! সত্যিই ইন্টারেস্টিং। কত কি জানি না দেখো। এই বাংলার বধূ একদিন দিল্লীর মসনদ কাঁপিয়েছেন, ভাবা যায়। অবশ্য শের আফগান তো বলছো পারস্যের?


হ্যাঁ। সেই অর্থে বাংলার বধূ নাও বলা যেতে পারে ঐ ডাকসাইটে সুন্দরীকে। হা হা করে হেসে বলে প্রবীর। তারপর অদ্ভুত ভাবে চোখ নাচিয়ে বলে, শের আফগান কিন্তু আমাদেরও আত্মীয় হতে পারতেন। হতে হতেও হলেন না। সেটাও ইন্টারেস্টিং ঘটনা দাদা। চলুন রাতে শুনবেন।


প্রবীরদের বাড়িটা অপেক্ষাকৃত নতুন। বরং ছোট কাকার বাড়িটা বেশ পুরোনো। ওটাই প্রবীরের ঠাকুর্দার বাবার তৈরি আদি বাড়ি। পছন্দ হলো বেশ কল্লোলের। অনেকটা সময় ধরে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। পুরোনো সিঁড়ি, বারমহল, অন্দরমহল, কবুতর চত্বর - সেসব ছাড়াও পুরোনো জিনিসপত্রও আছে অনেক। আর প্রবীর গল্প বলে বেশ গুছিয়ে, তাই শুনতেও ভালো লাগছিল। দোতলা বাড়ি কিন্তু এখনকার প্রায় চারতলার হাইটে। ছাদে উঠেও দেখা গেল একটা ঘর আছে একপাশে। ভেজানো দরজা ঠেলে প্রবীরের সাথে সেই ঘরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল সামনের দেওয়ালে। পিঠের উপর শিরদাঁড়ায় কেমন একটা শিরশিরে ভাব অনুভব করলেন কল্লোল।


এনার কারনেই শের আফগান আমাদের আত্মীয় হতে চলেছিলেন, জানেন? দরজার সোজাসুজি দেওয়ালে বেশ বড় মাপের একটা তেলরঙের ছবি। সুন্দর মজবুত ফ্রেমে বাঁধানো হলেও ভেতরের ছবিটা বহু পুরোনো বোঝাই যাচ্ছে। খুব সুন্দরী না হলেও প্রাণবন্ত এক মহিলা। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ মুখ। ছবির ভেতর থেকে চোখদুটো যেন কল্লোলের দিকেই চেয়ে আছে। বড্ড জীবন্ত আর.... ভীষন চেনা আদল!


আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বোন সম্ভবতঃ। এইসব হিসেব, বাবা বলতে পারবেন। প্রবীর জানলা খুলতে খুলতে বলে- ১৬০৫ সাল নাগাদ শের আফগান এই বাংলার জায়গিরদার হয়ে যখন এলেন তখন আমার ঐ ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন জমিদার। ফলে শের আফগানের নজরে পড়তেই হলো। ভালোই নাকি দহরম মহরম ছিল। তবে সেই জমিদারের মহলের থেকেও এলাকায় বেশি পরিচিতি ছিল এই জমিদার কন্যার। দেখুন, কি ব্যক্তিত্ব মহিলার!


খোলা জানলা দিয়ে আসা হাওয়াতে ছবিটা নড়ে উঠতেই কল্লোলের মনে হলো যেন মহিলা একটু হাসলেন। হাসিটাও অবিকল.... 


ইনি ঘোড়ায় চড়ে খাজনা আদায় করতেন, জানেন দাদা? সেই আমলে! ভাবা যায়? গরীব প্রজাদের দেখভাল করতেন আবার পাজি হলে নিজেই সাজা দিতেন। ভাবুন, সেই সময়ে বাঙ্গালী এক মহিলার দাপট। পর্দানসীন তো ছিলেনই না, উল্টে জমিদারীর ভালোমন্দ সব ব্যাপারে মতামত দিতেন। জমিদার বাবাও আস্কারা দিতেন মেয়েকে। ভালোও বাসতেন খুব। সেই মেয়েই আবার কাব্যচর্চাও করতেন, জানেন তো। ওনার লেখা অনেক পুঁথি ছিল নাকি। সব পুড়িয়ে দেয় ঐ মেহেরুন্নিসা।


মেহেরুন্নিসা? সেকি! কেন?


কারণ তার স্বামী শের আফগান তখন এই বাঙালিনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। দুজনের লুকিয়ে দেখাসাক্ষাৎও চলতো নাকি। শের আফগান অবশ্য বিয়ে করতেই চেয়েছিলেন, কিন্তু এই জমিদারকন্যা তার বাবার সুনাম নষ্ট করতে চাননি। আবার অন্য কাউকে বিয়েও করেননি। এক বিধর্মীকে স্রেফ ভালোবেসে একাই কাটিয়ে দিলেন সমস্ত জীবন।


একাই?


হ্যাঁ, কুতুবুদ্দীন খাঁর হাতে শের আফগান মারা যেতেই তিনি নিজেকে অন্তরীণ করে ফেলেন। তবুও মেহেরুন্নিসার রোষ থেকে বাঁচেননি। উনিও না, সেই জমিদার পরিবারও না। দিল্লী যাওয়ার আগে একরাতে আগুন ধরিয়ে দেয় মেহেরুন্নিসার লোকজন ঐ জমিদার বাড়িতে। সবাই প্রাণে বাঁচলেও জিনিসপত্র প্রায় কিছুই বাঁচাতে পারেননি। যা কিছু বেঁচে বর্তে ছিল, তার মধ্যে অনেক ছবি ছিল। এই ছবিটা তার একটা। প্রথমদিকে কাকাদের এই বাড়ির বাইরের ঘরেই টাঙানো থাকতো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার হলো, প্রায়ই ছবিটা দেওয়াল থেকে পড়ে যেত, কাঁচ ফ্রেম সব ভেঙে যেত। বিশেষ করে বাইরের লোক বাড়িতে এলেই। সত্যি মিথ্যে জানি না। আমার সবটাই শোনা কথা। বংশের একমাত্র  দুর্ধর্ষ মহিলার ছবি, তাও আবার সাম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রায় সতীন। তাই কেউ প্রাণে ধরে ফেলতেও পারত না। শেষে এই ঘরে একলা ওনাকে রাখা হলো। আমি বরাবর এখানেই দেখছি। আর কখনও পড়ে ভেঙে যেতেও দেখিনি। মনে হয় একলা থাকতেই পছন্দ করেন এই মহিলা। বলেই হা হা করে হেসে উঠলো প্রবীর।


জানলা দিয়ে আসা একটা দমকা হাওয়ায় প্রবীরের হাসি উড়িয়ে নিলো। সেই সঙ্গে কি একটা দীর্ঘশ্বাসও উড়লো? ভীষণ চেনা একজনের শ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনলেন কি কল্লোল! নাকি মনের ভুল তার! এত মিল! এত মিল কি করে হয়!


ট্রেন ছাড়বার ঠিক আগেই প্রবীর জানলার বাইরে থেকে কল্লোলকে বললো, খুব ভালো লাগলো দাদা আপনি আসলেন, থাকলেন!


আরে ভালো তো লাগলো আমার বেশি। চমৎকার তোমার বাড়ি, বাড়ির মানুষজন। খাওয়া দাওয়ার কথা তো মনে থাকবে চিরকাল। নেহাত বয়স হয়ে গেছে তাই! তোমার মত বয়সে এলে হয়ত এক হপ্তার আগে নড়তামই না স্রেফ ঐ খাওয়া দাওয়ার লোভে। তাছাড়া কত কি দেখলাম বলো তো? জানলামও। ও হ্যাঁ, ঐ ছবির মহিলার নাম যেন কি? তোমার কাকার ছাদের ঘরের ছবিতে...


হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি দাদা। ওনার নাম মঞ্জুলিকা।


ট্রেনের ভোঁ এর সাথে সাথে কল্লোলের বিস্মিত মুখের অভিব্যক্তি কি প্রবীর খেয়াল করলো? প্রবীর চাকরিতে ঢুকে থেকে মঞ্জুলাদির কথা অনেক শুনেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু দেখেনি কখনও। দেখলে বুঝতো কল্লোল কেন সেই ছবি দেখার পর থেকে ঘোরের মধ্যে আছেন!


মঞ্জুলিকা... মঞ্জুলা.... মঞ্জুলাদি! তুমিই, হ্যাঁ তুমিই তো সে-ই! সেই কবে থেকেই একা রয়ে গেলে! কবে থেকেই তোমার প্রেমকে দূরে সরিয়ে রেখেও নিখাদ ভালোবাসাটুকু দিয়ে গেলে চুপচাপ! একলা নির্জনে নিজের সাথেই কাটিয়ে দিলে জীবনটা! সেই তখনও, আবার এই এখনও? প্রবীর জানতেও পারলো না, শের আফগানের ভালোবাসার মঞ্জুলিকা আবার ফিরে এসেছিলেন বোধহয় কল্লোলের ভালোবাসার মঞ্জুলাদি হয়ে। কলিগ এবং বয়সে একটু বড় মঞ্জুলাদির সাথে কল্লোল একসময়ে গভীর ভালোলাগার এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। অথচ সেই সম্পর্ককে কোন প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি কেউই। কল্লোলের পক্ষে সম্ভবও ছিল না, আর সেইজন্যই হয়ত মঞ্জুলাদির কোন দাবীও ছিল না। শুধু নিঃশব্দে নির্ভর করে গিয়েছেন কল্লোলের উপর। তারপর তো চুপচাপ একদিন নিঃশব্দে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন। অসময়েই বলতে গেলে। আজ অনেকদিন পর কল্লোলের চোখে দু'ফোঁটা জল চলে এলো সেই মঞ্জুলাদির জন্য। নাকি মঞ্জুলিকার জন্য! 


*****

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু