বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সুতোর টান

আধফোঁটা গোলাপটা হাতে ধরে বসন্ত তাকিয়ে থাকে রূপার দিকে, মুখে স্মিত হাসি। রূপার দু'চোখে রাজ্যের বিস্ময়! বসন্তর বাড়িয়ে থাকা হাতের গোলাপটাও হেসে ওঠে ওর বোকামো দেখে! বসন্ত মৃদু হেসে ফিসফিসিয়ে 'নাও' বলতেই ঘোর কাটে রূপার। লাল হয়ে ওঠে দুই গাল, তারপর তড়বড় করে বসন্তর হাত থেকে গোলাপটা নিতেই হাতে কাঁটা বেঁধে! উফ্ করে বেশ জোরেই কঁকিয়ে ওঠে রূপা! ঘুম ভেঙে যায়। ডান হাতের আঙুলের ডগাটা চোখের সামনে আনতেই দেখে দু ফোঁটা রক্ত জমেছে।


একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপা বাথরুমের দিকে যায়। ফিরে এসে বিছানায় বসন্তর প্রায় অচেতন শরীরটার দিকে এক ঝলক চেয়ে দেখে। আগে ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসত। সেখানেই পানাহার। এখন সেটা অন্যদিনেও হচ্ছে। বারন করলে, কান্নাকাটি করলে রাগে জিনিসপত্র ছুড়ত, গালমন্দ করত। এখন সেসবের সাথে চড় চাপটাও নির্দ্বিধায়! কাল ছুঁড়ে ফেলা শিশির ভাঙা কাঁচ কুড়োতে গিয়ে আঙুলের ডগাটা কেটেছে রূপার। তবু তার স্বপ্নে বসন্ত আগের মতই উতলা প্রেমিক। গতকাল নাকি গোলাপ দিবস ছিল। এক বছরের রুপাইকে নিয়ে দিনভর সংসার সামলাতে সামলাতে বোকা মেয়েটা মনে মনে ভাবছিল, বসন্ত কি জানে আজ গোলাপ ফুল দিতে হয় ভালোবেসে?


সন্ধ্যার বিষন্ন আঁধারটা রূপার চিরকালের অপছন্দ। ধূপধুনো দিয়ে আর শাঁখ বাজিয়ে সেই বিষন্নতা জোর করে সরিয়ে দিতে চায় রোজ। সংসারের ভালো কোরো মা, রুপাইএর বাবার সুমতি দাও- দুটো পেলব হাতের আকুল প্রার্থনা রোজ ঠোক্কর খায় পাথরের মূর্তিতে। বিজলি বাতির চকচকে আলোতে ঘরের দেওয়ালে ছায়া পড়ে পুরোনো দিনের খাটের বাজুর। রূপার আদরে যত্নে সেই খাট ঝকঝকে। তকতকে বিছানায় বসন্ত বাতাসের নিবিড় আলিঙ্গনের স্বপ্ন জড়ানো থাকে। তবু বসন্ত বাড়ি ফেরে টালমাটাল পায়ে। রূপার মুখ মেঘ জমে, বুকে ঝড়। তবু মনে মনে খড়খড়ে পা দুটোকেই তোয়াজ করে। লাল লাল চোখদুটোর দিকে মিনতি ভরা দৃষ্টি হানে। তারপর কোনদিন ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির উত্তাপ, কোনদিন মাঝ সমুদ্রের ঝড়, কোনদিন বা গহীন অরন্যের আদিমতায় ছেয়ে যায় রূপার সংসার। অবুঝ রুপাইকে বুকে জড়িয়ে সে আশ্রয় খোঁজে পালিশ করা খাটের এক কোনে রাখা তার স্বপ্নডিঙিতে। অসহায় ঘুম নামে দু'চোখে এক সময়। তারপর আসে তার স্বপ্ন, নিজস্ব স্বপ্ন, সব পেয়েছির স্বপ্ন।


গুরু গম্ভীর মানুষটা সকালে একটু লজ্জা পায় হয়ত। নাকি রূপার মনের ভুল! চায়ে তাকে প্রথম চুমুকটা দিতে দেখে রূপা লোভাতুর দৃষ্টিতে। গোপনে। আহ্! একটা পরিতৃপ্তির নিঃশব্দ উচ্চারন রূপাকে চনমনে করে তোলে। আর নিশ্চয়ই ভুল করবে না, কালকের মত, কিম্বা গত রবিবারের মত- খুন্তি আর কড়াইটা ফিসফিস করে গল্প করে। ডালটা ফোড়ন দেয় রূপা। ঝাঁঝটা যাতে ঘরে না যায় খেয়াল রাখে প্রানপনে। তবু ও ঘরে ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠে রুপাই। আঁচলে হাত মুছে ছুট্টে যায় সে। এই তো সোনা, আমি আছি, বাবা আছে, কাঁদে না কাঁদে না- নরম গলায় নরম শিশুটির কোমল বুকেও আশার দোলা দুলিয়ে দেয় রূপা। বাবা আছে, বাবা আছে! এক টুকরো মেঘে ভাসা স্বপ্ন ছোট্ট বুকেও হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে।


রবিবারের শেষ বিকেলে লগ্নভ্রষ্ট এক ঘুম নামে রূপার দুই চোখে। বিছানায় পাশাপাশি সে আর ছোট্ট রুপাই। কিনারায় কোঁচকানো চাদরে ঘামের গন্ধ মেখে বসে থাকা উতলা বসন্ত। জানলার বাইরে তখন হাতছানি, হাতছানি! এদিকে সংসার, তেল, নুন, সাবান, কেরোসিন, ওদিকে হাতছানি, হাতছানি। ইয়ার দোস্ত, নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দুশ্চিন্তা, মালিকের গালাগাল সব ভুলবার হাতছানি। বসন্ত পিছু ফেরে। বিছানা থেকে নামতে যেতেই নরম স্পর্শ! আদো স্বরে ডাক - বা বা!


গুরু গম্ভীর মানুষটার চোখে অবাক দৃষ্টি। বুকের ভেতরে তিরতির জল। দু'হাতে আচেনা ব্যকুলতা জড়ো হয়। ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরে তার কর্কশ হাতে। তখনি সুগন্ধি একটা স্বপ্ন গুটি গুটি পায়ে রূপার আঁখি তারায় কাঁপন তোলে। সেদিকে তাকিয়ে রুপাইকে আলতো হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে বাইরে আসে বসন্ত। রূপার স্বপ্নভেলা ভেসে যায়, ভেসে যায়। ঐ তো, দূরে ডাঙা দেখা যাচ্ছে।

****

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু