বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অন্তর্দ্বন্দ্ব


অফিস থেকে বেরিয়ে সোনালী খেয়াল করল মাথাটা ভীষন ধরেছে। আসলে কালকের সমস্ত প্রেজেন্টেশনের কাজ গুছিয়ে বেরোতে গিয়েই দেরিটা হল। সোনালীর বস যদিও অনেক আগেই বলেছিলেন চলে যেতে কিন্তু সোনালী যায়নি। আসলে এই কাজের জায়গায় মেয়ে বলে এক্সট্রা অ্যাডভান্টেজ নেওয়াটা তার মোটেই পছন্দ নয়। এখন এক কাপ চা হলে মন্দ হত না, কিন্তু ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেছে। অগত্যা অফিসের সামনের দোকান থেকেই সোনালী চা খেল। বাড়ি গিয়ে তো আর এখন তার ভাগ্যে চা জুটবে না উল্টে তাকেই অনিমেষ এর জন্য চা জলখাবার বানিয়ে দিতে হবে। চা শেষ হতে না হতেই একটা বাস পেয়ে গেল। যদিও বাস ফাঁকা নয় কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না বলে ভিড় বাসেই উঠে পড়ে সোনালী। 


বাড়ি ফিরতেই যথারীতি চোখে পড়ে, অনিমেষ হাত পা ছড়িয়ে সোফার উপর মোবাইল নিয়ে বসে পাবজি খেলছে। অফিসের জামাটা পর্যন্ত এখনো ছাড়া হয়নি। ঘরদোর যথারীতি প্রচন্ড অগোছালো। শাশুড়ি বসে টিভি দেখছেন মুখখানা বাংলার পাঁচ করে। সোনালী বুঝতে পারল এক্ষুনি তার দেরি করে ফেরা নিয়ে বাক্যবাণ শুরু হবে। ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল, দিন দিন তোমার ফেরার সময় পিছিয়ে যাচ্ছে বৌমা। আচ্ছা মেয়েটার কথা ভেবে তো অন্তত একটু আগে বাড়ি ফিরতে পারো। 

মেয়েটার কথা বলতেই মিষ্টুর দিকে চোখ গেল সোনালীর।টেবিলে বসে মন দিয়ে পড়ছে। সে ছোট হলেও মায়ের কষ্ট বোঝে তাই ঠাম্মিকে থামিয়ে দিয়ে সে বলে উঠলো, আমি সব হোমওয়ার্ক করে রাখছি মাম্মাম তুমি সব কাজ সেরে এসো তোমাকে একবার দেখিয়ে নেবো। 

আবার শুরু করলেন শাশুড়ি, ছেলেটাও তো সেই কখন অফিস থেকে ফিরে বসে আছে একটু চা করে দেবে বলে। এবার সোনালী ধৈর্য্য রাখতে পারল না। বললো, আচ্ছা মা আপনার ছেলেতো আজ অনেকক্ষণ ফিরেছে মনে হয়। ও তো পারতো আজ একটু চা বানিয়ে খেতে বা আমাকে খাওয়াতে।

-- বাহ কি দিনকাল এলো। তুমি বাড়ির বউ কাজ করে অফিস থেকে বাড়ি ফিরবে রাত করে আর তোমার স্বামী খেটেখুটে এসে রোজগার করে সারাদিনের পরিশ্রমের পর চা খাবার সব বানাবে , মেয়েকে পড়াবে। সত্যি ভগবান আমায় এবার তুলে নাও।

-- রোজতো বলিনি মা বানাতে। এক আধদিন একটু বদল হলে ক্ষতি কি? আমিও তো সারাদিন খেটেখুটে রোজগার করে আসি তারপরেওতো আমাকে যা যা করার করতে হয়... রাতের খাবার বানানো, মেয়েকে পড়ানো সবটাই আমি সামলাই। আর আপনার ছেলে হয় মোবাইল নিয়ে বসে গেম খেলে নয় ভিডিও দেখে আর ফেসবুক করে।


--এই হচ্ছে তোমাদের এখনকার দিনের মেয়েদের সমস্যা বৌমা। আগেকার দিনেই ঠিক ছিল। মেয়েরা ঘরের কাজ করবে, ছেলেরা বাইরের কাজ করবে। আর এখন তোমরা সব চাকরি করে ধরাকে সরা জ্ঞান করো। ইনকামের নাম করে বাইরে যাচ্ছ আর ভাবছ খুব স্বাধীন হয়ে গেছো। আরে আমার বাবু কি কম রোজগার করে যে তোমাকেও বেরোতে হবে কাজে? 

-- না আপনার ছেলে কম রোজগার করেনা বটে তবে আমি এত পড়াশোনা করেছি শুধু আপনার ছেলেকে বিয়ে করার জন্য নয় , নিজের আর্থিক স্বাধীনতার জন্য। আর তাছাড়া আমিও তো সংসারের জন্য অনেক খরচা করি। ছেলেমেয়ের বই-খাতার খরচা, টিফিন, ওষুধ এসবের খরচাতো আমিও দিই। তাছাড়া আমার নিজের প্রয়োজনেও আপনার ছেলের কাছে হাত পাততে ইচ্ছা করে না।

-- ছাড়ো বৌমা....তোমার সাথে আমি কথায় পারবো না। আমারতো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে... আমরাও ছেলেপুলে মানুষ করেছি, সংসার করেছি...তোমার মতো করে আমি ভাবতে পারবো না। আজ যদি তোমার মায়ের মত ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে বেরিয়ে চাকরি করতাম  তাহলে তোমার মতই আমার ছেলেটিও হত।

-- দয়া করে আমার মাকে তুলে প্লিজ কোনো কথা বলবেন না। আমার মা যেমন চাকরিও করতো, সংসারের কাজও সামলাতো আর আমার বাবাও ছুটির দিনে সংসারের নানা টুকটাক কাজকর্ম করতো। আপনি সারাদিন বাড়িতে থেকে আপনার ছেলেকে কি রকম মানুষ করেছেন সে তো দেখতেই পাচ্ছি মা। কোনো একদিন আপনিও বুঝতে পারবেন। 

রাগে ফেটে পড়ে সোনালী।

--প্লিজ মা, তুমি এবার থামো। আবার তুমি ওর সঙ্গে কথা বলছো। তুমি পারবে না ওর সাথে। বিরক্ত হয়ে কথাগুলো মাকে বলে অনিমেষ।

-- অনিমেষ তুমি বড় বড় জ্ঞান না দিয়ে একদিন যাও তো আমি যে কাজগুলো করি করে দেখাও। অফিস করে এসে একটু সংসারের কাজ করো, মেয়েকে পড়াও, তবে বুঝবো তোমার এসব বলা সাজে।

-- ধ্যুর, রোজ এই ঝগড়া ভালো লাগে না। তোমাকে চা দিতে হবে না...ছেড়ে দাও...আমি পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসছি।

-- বাবা যাসনি, আমি তোকে চা করে দিচ্ছি। অনিমেষের মা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে যান।

বিরক্তিতে সোনালীর নিজেরও আর চা খাওয়ার এনার্জি থাকেনা। হাতমুখ ধুয়ে এসে রাতের রান্না চাপিয়ে মেয়ের কাছে এসে বসে সে। মেয়ের পড়া দেখে রাতে যথারীতি মনের মধ্যে হাজারো অশান্তি নিয়ে আর শারীরিক ক্লান্তি নিয়ে ঘুমোতে যায়।

পরদিন সকালে উঠতেই অনিমেষ বলে, সোনালী আজ আমার কিছু বন্ধু আসবে.... রাতে একটু ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। সোনালী চটজলদি উত্তর দেয়, প্লিজ তুমি দোকান থেকে খাবার আনিয়ে নিও, কারণ আমার আজ অফিসে প্রেজেন্টেশন আছে আমার ফিরতে রাত হবে প্লাস মেয়ের পরের দিন থেকে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে তাই অফিস থেকে ফিরে যেটুকু সময় থাকবে সেটুকু ওকে দেখতে হবে।


--উফ্ আবার সেই শুরু হয়ে গেল। বৌমা তুমি এমনিতেতো রাত করেই ফেরো। একদিন একটু ওর বন্ধুরা আসবে বলছে, তুমি আজ একটু আগে আসতে পারবে না!

-- দুদিন আগেই আমার অফিসের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিল মা, আশা করি ভুলে যাননি। আপনার ছেলেকে সেদিন বলেছিলাম ফিরতে তাড়াতাড়ি সে ফিরতে পেরেছিল কি?


-- তুমি কি তার প্রতিশোধ নিতে আজকে তাড়াতাড়ি ফিরবে না!

-- ছেড়ে দাও মা আমি বন্ধুদের সাথে বাইরে খেয়ে আসবো আজকে আমার ফিরতে রাত হবে। 

-- মা, আপনার ছেলেকে বলে দিন, আমার অফিসেও কাজের প্রচণ্ড চাপ যাচ্ছে। আপনার ছেলের যেমন কাজের চাপ যাচ্ছে কিন্তু সে বাড়িতে ঢুকে কিছুই বুঝতে পারে না কারণ তার যা যা প্রয়োজন তাকে সব মুখের সামনে ধরা হয়। আমাকে কিন্তু কেউ হাতের সামনে কোনো দিন কোনো জিনিস এগিয়ে দেয় না।

-- কি মুশকিল তুমি একটা মেয়ে সেটা মাথায় রাখো।

-- এখানেইতো আমার সাথে আপনার মতের অমিল মা। সাম্য সবার জন্য ... এটা যদি এযুগে এসে বুঝেও না বোঝেন তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আপনি কোথায় মা হিসাবে ছেলেকে শাসন করবেন, ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেবেন তা নয় আপনি সমানে তাকে মাথায় তুলে যাচ্ছেন। তাহলে বলি শুনুন আমিও কিন্তু বিয়ের আগে বাড়িতে সেরকম কিছু কাজ করতাম না কিন্তু এখন সবইতো করি। মানছি আপনার ছেলেও কোনদিন বাড়ির কাজ করেনি ... তাবলে করবেও না! ভবিষ্যতে ধরুন আপনি রইলেন না, আমিও রইলাম না তাহলে কি ও উপবাসে থাকবে? বেসিক কাজকর্মগুলোতো সবারই জানা উচিত। ঘরের দুটো কাজ করলে কি আপনার ছেলের জাত চলে যাবে?

-- বৌমা তোমার কিন্তু মুখের লাগাম ছেড়ে যাচ্ছে। 

--আমার আর ভাল লাগছে না....আমি চললুম। সশব্দে দরজা বন্ধ করে অফিস বেরিয়ে যায় অনিমেষ। শাশুড়িও রাগে গজ গজ করতে করতে ঠাকুর ঘরের দিকে চলে যান।

রাতে আর সেদিন বাড়ি ফেরে না সোনালী। ভাইকে মেয়ের স্কুল থেকে নিতে পাঠিয়ে নিজেও অফিস ফেরত পথে বাপের বাড়ি  চলে আসে।


আজ দিন দশেক হয়ে গেল সোনালী বাপের বাড়িতে। বাড়ির খবর সেরকম ভাবে নেয়া হয় না। আসলে এখানে সে দিব্যি আছে। শাশুড়ি একদিন ফোন করে সোনালীর বাবাকে যথেষ্ট অপমান করেছিলেন ওর হুট করে এখানে চলে আসা নিয়ে। তারপর থেকে আর ফোন করে না সোনালী। অনিমেষ মাঝে মাঝে দায় সারা ফোন করে শুধু মেয়ের খবর নিতে। 

হটাৎ একদিন শাশুড়ি সোনালীর ফোনে ফোন করেন। বলেন, বাড়ি আসছো কবে? শাশুড়ির গলা শুনে সোনালীর ভালো ঠেকে না। সেদিনই অফিস থেকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। ফিরে দেখে তিনি খুবই অসুস্থ। আশ্চর্য্য হয় অনিমেষ সব কিছু জানা সত্ত্বেও কোনো ডাক্তার দেখায়নি শুনে। উল্টে ছেলের জন্য খাটতে খাটতে মায়ের অবস্থা আরো খারাপ। 

আজ অনিমেষের মাই সোনালীকে বলেন, তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমিই ভুল শিক্ষা দিয়েছি ওকে। 

সোনালীর আজ কিছুটা হলেও মনে স্বস্তি হয়। 

আসলে আমাদের এই সমাজে নারী পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে আমরা গলা ফাটিয়ে মরলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই নারীদের সমান অধিকারের লড়াইয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াই। পারস্পরিক বোঝাপড়ার সেই অন্তর্দ্বন্দ্বে জয়লাভ করলে হয়তো ছেলেদের আস্তে আস্তে বোঝানো যাবে যে মেয়েরা তাদের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। সেই প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দে সোনালীর মন আনন্দে ভরে ওঠে। আর দুদিন পরেই দোল। বসন্ত উৎসবের আনন্দের সাথে এই আনন্দও মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। 


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু