জিনিয়াস
জিনিয়াস
**********
রাত ঢের হয়েছে, বিশাখা শুয়ে শুয়ে মোবাইলটা নিয়ে স্ক্রল করছিল আনমনে। আসলে ও অনির্বাণের ফোনের অপেক্ষা করছিল, অনির্বাণকে অফিস থেকে কয়েকদিনের জন্য পুণেতে পাঠিয়েছে। ও উইপ্রোতে আছে, ইউ কে র স্লট করে তাই রাত হয়, দিনের বেলা খানিক ঘুমায় তাছাড়া বিশাখারও তখন অফিস থাকে। পাশে শোয়া মিঠির মাথাটা বালিশ থেকে কেমন হেলে পড়েছে। মেয়েকে ঠিক করে শুইয়ে দিতে না দিতে ফোন, অনি ভেবে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখে জয়িতা ফোন করছে । জয়িতা আর বিশাখার মধ্যে ছোট থেকেই ভাব, এক স্কুল, একই কলেজে একই বিষয়। শুধু গ্রাজুয়েশনের পরপরই বিশাখা ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেলো তাই মাস্টার্স আর করা হয় নি, জয়িতা মাস্টার্স করে একটা সরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে কেমিস্ট্রির শিক্ষিকা।
"তুই অন আছিস দেখে ফোন করলাম, এখন তো we are in the same boat, sister, " জয়িতা হি হি করে হাসতে হাসতে বলে। জয়িতার বর অর্পণ একটা নামকরা ওষুধ কোম্পানির রিজিওনাল মার্কেটিং ম্যানেজার, প্রায়ই ট্যুরে থাকে। জয়িতা শ্বশুর শাশুড়ী আর খুদে ছেলেকে নিয়ে একাই থাকে। জয়িতার সাথে কথা বলতে চিরকালই ভালো লাগে, নিজের হারিয়ে যাওয়া কৈশোর যেন ফিরে আসে, তরুণী বেলা, প্রথম কলেজ জীবন সবকিছু যেন ছুঁয়ে যায়। জয়িতা মেয়েটা বড্ড ভালো, তাদের সময়ের স্কুল শিক্ষিকা মানেই কেমন যেন গোমড়া মুখো, সেরকম একেবারেই নয়। খুব হাসিখুশী স্বভাবের, রঙ্গরসপটু , সে-তুলনায় বিশাখা খানিক অন্তর্মুখী। স্বভাবের এই বৈপরীত্যই হয়তো ওদের বন্ধুত্বের চাবিকাঠি।
একথা সেকথা বকবক করে জয়িতা বললো " আরে একটা দারুণ খবর আছে। আমাদের সেই মোমপরী এখন ECOSOC ( ইকোনমিক এন্ড সোস্যাল কাউন্সিল অফ ইউ এন ও) তে বিশাল ঘ্যাম পজিশনে আছে। পুরো ল্যাটিন আমেরিকার CSW ( সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অফ ওম্যান) সামলায়। এই বয়েসেই এতোটা উন্নতি করেছে, অবশ্য ও যে বিশাল রেসের ঘোড়া সে তো আমরা জানতামই, তাই না? " বিশাখা বুঝতে না পেরে বলে " কে উন্নতি করেছে রে? কার কথা বলছিস? "
জয়িতার গলায় সামান্য উত্তেজনার ছোঁয়া " জানিসই তো আমার বড় নন্দাই ওয়াশিংটনে আছেন, ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসীতে ছোটখাটো এডিসি । ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসীর একটা পার্টিতে ইনভাইটেড হয়ে এসেছিল মোমপরী। এমনিতে তো ও নিউ ইয়র্কে থাকে কিন্তু কোনো কাজে ওয়াশিংটনে এসেছিল তাই পার্টিতে এসেছিল। তখনই আমার ননদের সাথে নিজে এসে আলাপ করে, কিভাবে যেন বুঝেছিল দিদিভাই বাঙালি।
দিদিভাই তো বুঝতেই পারে নি যে ও বাঙালি, ওর যা চেহারা আর সবুজ চোখ তাতে ওকে দেখে আমার ননদ ভেবেছিল স্প্যানিশ বা পূর্ব ইউরোপীয় হবে, টাইটেলটাও আবার আইরিশ 'মিসেস ও হারা'। তবে আমার ননদ খোঁজ নিয়ে জেনেছে বার দুয়েক বিয়ে করলেও ও এখন ডিভোর্সি। দিদিভাইকে ওই বললো যে ও কলকাতার মেয়ে তবে কলেজ লাইফ থেকেই কলকাতা ছাড়া, টুয়েলভ কোন স্কুল থেকে , কোন ইয়ারে করেছে বলায় দিদিভাই আমার কথা বলেছিল, ও চিনতে পেরেছে। আমার ফোন নম্বর নিয়েছে, বলেছে শিগগিরই আমায় ফোন করবে। "
জয়িতার কথার স্রোতে ভাসলেও বিশাখার ধীরেধীরে মনে পড়ছিলো তাদের জাজেস কোর্টের পাশের সরকারি স্কুলে দু বছরের ইলেভেন টুয়েলভ পড়ার কথা। বাড়ির কাছাকাছি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর তারা দুজন ঠিক করেছিলেন জীবনে কিছু করতে হলে ভালো স্কুল থেকে ইলেভেন টুয়েলভ করতে হবে, সেইমতো দুজনে অ্যাডমিশন নিয়েছিলেন ওই সরকারি গার্লস স্কুলে, ছিয়াত্তর নম্বর বাসে করে দুজনে স্কুলে যেতেন। স্কুল থেকে দেওয়া জ্যালজ্যালে বেগুনি পাড়ের সাদা খোলের তাঁতের শাড়ি, পি টির দিন সাদা ডিভাইডিং স্কার্ট, সেই প্রথম আর শেষ ডিভাইডিং স্কার্ট পরা। টিফিন পাওয়া যেতো নামমাত্র মূল্যে স্কুল ক্যান্টিন থেকে তাই খালি টিফিনবাক্স নিয়ে যেতেন। ক্যান্টিন চালাতেন এক প্রায় বৃদ্ধা মহিলা যাকে তারা মাসী বলে ডাকতেন।
ওই স্কুলেই তাদের দেখা হয়েছিল তানিশার সাথে, তাদের সময়ে এইরকম নাম বাঙালি মেয়েদের মধ্যে খুবই কম দেখা যেত । তাদের মতো সায়েন্স নিয়ে পড়তো না কিন্তু ম্যাথম্যাটিকস ছিল ওর ইলেকটিভ সাবজেক্ট। কাজেই বাংলা ইংরেজি আর ম্যাথ তিনটি ক্লাসে ওর দেখা পেতেন। অস্বাভাবিক সুন্দরী আর লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট সাত আট ইঞ্চির মেয়েটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মেয়েটির সারা শরীরে কোনো গয়না না থাকলেও নাকে একটা বড় হিরের নাকছাবি আর কপালে চিলতে সিঁদুর। তারা যখন সতেরোয়ও গঠনে প্রায় বালিকার শরীর তখন ওর শরীরে পূর্ণ যুবতীর বিভা । লম্বা হবার কারণে তাদের ইউনিফর্মের শাড়িটি ওর গোড়ালির উপরে। এই মেয়েটিকে নিয়ে সহপাঠিনী আর শিক্ষিকাদের ভিতরে
কানাঘুঁষা শুরু হয়েছিল।
জানা গেল তানিশা গতবছর পার্কস্ট্রিটের একটা নামকরা ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল থেকে আই সি এস সি তে কলকাতার মধ্যে
প্রথম হয়েছিল। এতো ভালোভাবে পাস করেও এক বছর পরে তাদের বাংলা মিডিয়ম স্কুলে কেন পড়তে
এসেছে সেটিও এক প্রহেলিকা ! ওইরকম লম্বা, সাদা ধপধপে মসৃণ ত্বক, অসম্ভব কাটাকাটা মুখ চোখ, দেখে একদমই মনে হয় না যে ও বাঙালি ! কানাঘুঁষা চলে যে সরকার টাইটেল হলেও ও বাঙালি নয়, বিশাল একটা বিদেশি গাড়ি চড়ে স্কুলে আসে। পিছনের সিটে থাকেন একজন শ্যামলা রঙের, মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক। তিনি আগে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরেন, তারপরে নামে ও। ভদ্রলোক হাত নাড়েন, ও তার দিকে ফিরেও তাকায় না, গটগট করে স্কুলে ঢুকে যায়। জানা গেল তানিশা এক নামকরা স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলের বউ যাদের সারা ভারতে চেন অফ সোনার দোকান আছে।
আগে ওর রূপ আর রেজাল্ট জেনে তারা ভেবেছিলেন মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব দাম্ভিক প্রকৃতির হবে কিন্তু দেখা গেলো একেবারেই তা নয়। নিজে থেকে কারুর সাথে ভাব করে না কিন্তু কেউ কথা বলতে আসলে মন খুলে কথা বলে। দুর্দান্ত রূপসী ও অসম্ভব মেধাবী মেয়েটিকে নিয়ে পুরো স্কুলেরই কৌতূহল ছিল, সেটি আরও বাড়লো ইলেভেনের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার পর। ইকনমিক্সের টিচার মনীষা দি পরীক্ষার পরে টিচার্স রুমে হৈ হৈ করে জানিয়েছিলেন যে এইরকম পরীক্ষার উত্তরপত্র তিনি তার পুরো শিক্ষিকা জীবনে দেখেন নি। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন তিনি নিজেও এমনটা লিখতে পারবেন না। তার জানাশোনায় যারা ইকনমিক্সের শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন তারাও কেউ লিখতে পারবেন কি না সন্দেহ! এইরকম উত্তরপত্র স্কুলের অর্কাইভে সংরক্ষণ করা উচিত, ভবিষ্যতের ছাত্রীদের জন্য।
মনীষা দি আধবুড়ি, ভীষণ নাকউঁচু টাইপের মহিলা, তার মুখে এতো প্রশংসা শুনে অন্য টিচারাও নড়েচড়ে বসলেন। টিচার্স রুমে তানিশাকে ডেকে পাঠিয়ে খোঁজখবর করা হলো। তানিশা উত্তরে বলেছিল যে ও কোনো টিউশন মাস্টারের কাছে পড়ে না। "এইরকম নোট কোথায় পেলে?" এই প্রশ্নে সামান্য হেসে জানালো ও নিজের নোট নিজেই তৈরি করে। দিদিমণিদের কৌতুহল যায় না, তারা আরও জিজ্ঞাসাবাদ করায় ও বলেছিল " আমার কাছে প্রচুর ইকনমিক্সের বিদেশি বই আছে, আমি বাইরে থেকে বই আর জার্নাল আনাই। " দিদিমণিদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস শুরু হয়েছিল, বাংলার টিচার চিত্রা দি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলেন " ও তো কোটিপতি বাড়ির বউ, টাকার ভাবনা তো ওর নেই তাই এইসব অদ্ভুত বিলাস। ক্লাস ইলেভেনের মেয়ে বিদেশি জার্নাল থেকে কোট করলে এক্সামিনর বেড়ে পাকা বলে ওর নম্বর যদি না কেটেছে তাহলে আমার নামই পাল্টে দিও। " মনীষা দি কিন্তু বারবারই মাথা নেড়ে বলেছিলেন "নাগো, কি সুন্দর আর প্রাঞ্জল করে উত্তর লিখেছে যে পড়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। মুক্তোর মতো হাতের লেখা আর জ্ঞান দেখানো নয় বরং জ্ঞানের নির্যাসটুকু দিয়ে উত্তর লিখেছে। এ মেয়ে সাধারণ মেয়ে নয়। "
ছাত্রীদের মধ্যেও উত্তেজনা ছড়ায়, ওদের ক্লাসের কুহু ওকে জিজ্ঞেস করেছিল ক্লাস ইলেভেনেই বিদেশি বই লাগবে এমন ধারণা ওর কিভাবে হলো? উত্তরে তানিশা বলেছিল ওর অনেক আগে থেকেই মানে এগারো বারো বছর থেকেই নানা বিষয়ের বই পড়ার নেশা তৈরি হয়েছে। প্রথমে বাড়িতে যেসব গল্পের বই ছিল তা শেষ করে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই আনতো। সেখানে গল্পের বই ছাড়াও আরও অনেক বিষয়ের বইও ছিল, সেসব পড়েই ওর ইকনমিক্সের উপর আগ্রহ জন্মেছিল, তারপরে বিদেশ থেকে বই আনিয়ে পড়তে লাগলো। ক্লাসের মেয়েরা জিজ্ঞেস করেছিল " তুই যে এতো বাইরের বই পড়িস, তোর বাবা মা আপত্তি করেন না? " উত্তরে ম্লান হেসে রূপসী মেয়েটি বলে " আমার তো মা নেই, সকালে বাবা আর মাসি অফিসে বেরিয়ে যায় ফিরতে ফিরতে রাত সাতটা আটটা হয়ে যায়। আমি তো দুপুর সাড়ে তিনটেয় ফিরে আসতাম তারপর সময় কাটাতে বই পড়া শুরু করেছিলাম। "
দেখা গেলো মেয়েটা শুধু ইকনমিক্সেই নয়, ইলেকটিভ ম্যাথেও তুখোড়। ওর কম্বিনেশনটাও অদ্ভুত, ইকনমিক্স ম্যাথ লজিক আর ফোর্থ সাবজেক্ট সংস্কৃত। প্রতিটি সাবজেক্টে ছাঁকা নম্বর ওঠে। স্পষ্টবাদী কিন্তু নম্র, ভয়ংকর একগুঁয়ে, পি টি ক্লাসে কিছুতেই পি টি বা গেম খেলতে চাইতো না। তাদের সময়েও মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে কিছু ট্যাবু ছিল, বিশাখারা বলতেন শরীর খারাপ হয়েছে। সেখানে তানিশা গেম টিচারের চোখের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বলে দিতো " আমার পিরিয়ড হয়েছে, এই সময়ে ডাক্তার খেলাধুলা করতে মানা করেছে। গেম টিচার শুক্লা দি হয়তো বলে বসতেন " গত সপ্তাহেও তো একই কথা বললে। " তানিশা কিন্তু ভাঙতো না, অম্লানবদনে বলতো " ওটাই তো প্রব্লেম, আমার পিরিয়ড ভয়ংকর ইরেগুলার, একই সপ্তাহে হয়তো দুবার হয়ে যায়। ডাক্তার স্ট্রিক্টলি মানা করেছেন। " বলেই গটগট করে লাইব্রেরিতে চলে যেতো।
রূপেগুণে বহ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল মেয়েটিকে নিয়ে মেয়েদের কৌতুহলের শেষ ছিল না। কুহু ওর হাতির দাঁতের মতো গায়ের রঙ আর মোমের মতো মসৃণ স্কিনের জন্য ওর নাম দিয়েছিল ' মোমপরী '। ক্লাসের কোনো মেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল " যে ভদ্রলোক তোকে স্কুলে পৌঁছে দিতে আসেন, উনি কে হন তোর? " তানিশা কিছু একটা করছিল, অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয় " কে পিন্টুদা? ও আমার বর হয়। " বিশাখার খুব অবাক হয়েছিল, ভদ্রলোকের বয়েস বত্রিশ তেত্রিশের কম হবে না, মাঝারি হাইট, পেটে একটা নেয়াপাতি ভুঁড়ি, মাথার চুল এখনি পাতলা হতে শুরু করেছে। ওদের গলার স্বরে অবাক হবার ভাবটা চাপা থাকে নি, তানিশা কিন্তু মাথা নেড়ে বলেছিল " ওরকম বলিস না, পিন্টুদার জন্যেই আবার পড়াশোনা করার সুযোগ পেলাম নইলে বাবা আর তার স্ত্রী তো কম চেষ্টা চালায় নি পড়া বন্ধই করে দেবার। "
তানিশা অস্বাভাবিক খোলাখুলি কথা বলে তাই ওর জীবনের আঠেরো বছরের গল্পও তারা জেনে ফেলেছিলেন। তানিশার দাদু সরকারি চাকরি নিয়ে কাশ্মীরে ছিলেন, সেখানে অনেক কম বয়েসী এক কাশ্মীরি মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে ফিরে আসেন।
তাদের একটি মেয়েও হয়, মেয়ের যখন বয়েস বছর দুয়েক তখন তার স্ত্রী তাদের ফেলে চলে যান। পাহাড়ি সুন্দরীর সমতল এবং বিধর্মী স্বামী দুটোই বোধহয় সহ্য হচ্ছিল না। দাদু আর বিয়ে করেন নি, ওনার বিধবা দিদি বাচ্চাটাকে মানুষ করেছিলেন। দাদু আর বিয়ে না করার কারণ তিনি তখন সমস্ত মেয়েদের এমনকি তার আত্মজাকেও ঘোর অবিশ্বাস আর ঘেন্না করতে শুরু করেছেন। মায়ের দোষে বাচ্চা মেয়েটির সাথে অস্বাভাবিক রূঢ় আচরণ করতেন। মেয়েকে দেখতেও হুবুহু মায়ের মতো কিন্তু দেখা গেল মেয়ে অস্বাভাবিক মেধাবিনীও বটে।
মেয়ের যখন ষোলো তখন দাদুকে মারণ রোগে ধরলো, তিনি ক্লাস টেনে পড়া মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন ত্রিশ বছরের তানিশার বাবার সাথে। মেয়ের কান্নাকাটি ওজর আপত্তিতে কর্ণপাতও করলেন না। মেয়ের বিয়ের পরে অবশ্য তিনি বেশিদিন বাঁচেনও নি কিন্তু মারা যাবার আগে জামাইকে ডেকে তানিশার দিদিমার কীর্তিকলাপ সব বলে পরামর্শ দিয়ে যান " ওই মায়ের রক্তই তো এরও শরীরে, সজাগ থেকো নইলে আমার মতো দশা তোমারও হবে। " জামাই শ্বশুরের কথাকে ধ্রুব সত্য ধরে নিয়ে তানিশার মায়ের উপর কড়া নজর রাখতে লাগলেন , পুরোপুরি গৃহবন্দী দশা। মেয়েটির প্রাইভেটে মাধ্যমিক দেবার ইচ্ছাতে কর্ণপাতও করলেন না। বিয়ের এক বছরের মধ্যে তানিশা জন্মালো, একে মেয়ে তায় আবারও সেই একই রকম দেখতে হওয়ায় তানিশার বাবা বেজায় চটলেন কিন্তু মেয়ের জন্মের পরেই তার চাকরি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি এবং এক নিকট আত্মীয় মারা যাওয়ায় তার পুরো সম্পত্তির মালিকানা লাভ করায় মেয়েকে সৌভাগ্যদাত্রী বলে ভেবেছিলেন।
তানিশার দিদিমা পড়াশোনা করেছিলেন কি না বা কেমন ছাত্রী ছিলেন তা না জানা গেলেও তানিশার মা নাকি পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন। নিজের পড়াশোনা না হওয়ায় তার সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন শিশু কন্যার উপরে। বয়েসে অনেক বড়, অসম্ভব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, কর্কশ স্বামীর সাথে তার মানসিক সংযোগ ছিলো না। ওর বাবাও বেয়াড়া কুকুর আর বেয়াড়া স্ত্রীকে টিট করার জন্যে একই পন্থা নিয়েছিলেন। ওর বাবার স্ত্রীর কাছ থেকে একটিই মাত্র চাওয়ার ছিল সেটি হলো বাঙালিদের মতো দেখতে একটি পুত্রসন্তান। তাই যখন তানিশার নয় আর ও মায়ের ছাব্বিশ তখন আবার ওর মা গর্ভবতী হলেন। ওর বাবা কৃষক হয়ে বীজ তো ছড়িয়েছিলেন কিন্তু তার আর কোনো যত্ন নেন নি। গর্ভাবস্থায় ওর মাকে কোনো ডাক্তার দেখান নি বা কোনো টেস্টও হয় নি। তাই প্রসব বেদনার সাথেসাথে এক্লামশিয়া দেখা দিলো। জ্ঞান হারাবার আগে তিনি মেয়েকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন " আমি হয়তো তোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তুই কিন্তু কোনো অবস্থাতেই পড়াশোনা ছাড়িস না। বাঁচালে ওই পড়াশোনাই তোকে বাঁচাবে, আমার অবস্থা দেখ, আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে আজ আমার এই অবস্থা! পড়াশোনা করে তুই যদি জীবনে কিছু হতে পারিস তবেই বুঝবো যে আমি তোকে সঠিক পথ দেখিয়েছি। " এরপরে মা জ্ঞান হারিয়েছিলেন, এতো খিঁচুনি হয়েছিল যে বেডের ঘষায় হাতেপায়ে ঘা হয়ে গেছিল, শরীরটা বেঁকেচুরে এক একবার অর্ধ চন্দ্রাকৃতির হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে একটি মৃত পুত্রের জন্মের সাথে সাথে তারও প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়৷
মায়ের জন্য তানি ছাড়া কেউ শোক করে নি, বাবা তার দিকের আত্মীয়দের কাছে বলেছিলেন " ডাইনি মাগী নিজে মরবি মর, ছেলেটাকে পর্যন্ত খেয়ে গেলো। কটা রঙ দেখে ঘরে তুলেছিলাম কিন্তু রাক্ষুসি আমার ছেলেকে খেয়ে তবে মরলো। ওর বাপ ঠিকই বলেছিল নিজের মেয়ের সম্বন্ধে, এরা হলো বিষকন্যা ।" বাবা মা মারা যাবার তিন মাসের মধ্যে অণিমা মাসীকে বিয়ে করে ঘরে তুললেন । ছোট্ট তানিশা পাঠ্য এবং অপাঠ্য বইএর দুনিয়ায় নিজের আশ্রয় খুঁজেছিল।
পরের দিন আর্টসের দেবযানী ওদেরকে বলেছিল " ওই বদের ধাড়ি মেয়েটা কাল তোদেরকে বোকা পেয়ে খুব ঢপ দিচ্ছিল দেখলাম। আমি ওদের পাড়ায় থাকি, সব জানি ওর ব্যাপারে। সাধে ওর বাবা ওকে পড়া ছাড়িয়ে ঘরে আটকে রেখেছিল ! ষোলো বছরের মেয়ের ব্যাগ থেকে যদি কন্ট্রাসেপটিভ পিল বের হয় তাহলে সব বাপই এটা করবে। তার উপর মেয়ের তো গুণের সীমা নেই, ভাবতে পারিস স্কুলে পড়া মেয়ে মদ খায়, সিগারেট খায়! জয়িতার বিশ্বাস হয় নি, দেবযানীকে জিজ্ঞেস করেছিল " তুই কি করে জানলি? তোকে ও ভাগ দেবে বলে গলা জড়িয়ে সাধাসাধি করেছিল বুঝি?" রাগ করে উঠে উঠে যেতে যেতে দেবযানী বলেছিল " ইচ্ছে হলে বিশ্বাস নাই করতে পারিস কিন্তু শুধুশুধু মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? অণিমা কাকিমাই আমার মাকে বলেছে, পুরো পাড়া ওই মেয়ের গুণ কীর্তি জানে! "
পরের দিন জয়িতাই জিজ্ঞেস করেছিল, ও অল্প হেসে বলেছিল " দেবযানী বলেছে তো? মিথ্যে বলে নি, সত্যিই রাত জেগে যখন পড়ি তখন ঘুম আর ক্লান্তি কাটাবার জন্য আমি একটু আধটু খাই ওইসব। " জয়িতা বলেছিল " আর তোর ব্যাগ থেকে যেটা পাওয়া গেছে বলে ও বললো? " কেমন একটা ক্লিষ্ট হাসি হেসে তানিশা বলেছিল " এই পৃথিবীতে মা ছাড়া কেউ এমনি এমনি কিছু দেয় না রে! আমি বাবাকে বলেছিলাম আমায় প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতে। বাবা আর অণিমা মাসি দুজনে রোজগার করে, ডাক্তার বলে দিয়েছে ওদের কোনো বাচ্চাকাচ্ছা হবে না। বাবা তার মামাবাড়ির সব সম্পত্তির মালিক হয়েছে তবু প্রতি মাসে
আমাকে কিছু টাকা দিতে চাইলো না। বই না পড়ে আমি থাকতে পারি না, ভয়ানক নেশা হয়ে গেছে মা চলে যাবার পর। প্রথমে স্কুল ক্যান্টিন থেকে টিফিন করার জন্য যে সামান্য পয়সা দিতো তা জমিয়ে কাছের লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছিলাম কিন্তু ওখানকার কালেকশন ভালো না তাই দূরের বড় লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ নিয়েছিলাম।
ওইখানেই বান্টির সাথে আলাপ, ওরো বইএর নেশা তবে আমাদের রুচি ভিন্ন।
বান্টি লা মার্টসে পড়তো, গুজরাটি ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। ওই বাইরে থেকে বই এনে দিতো, নেশার জিনিসও সাপ্লাই ওই দিয়েছে, এমনি এমনি তো কেউ কিছু করে না তাই ওর কিছু ইচ্ছে আমায়ও পূরণ করতে হয়েছে। মাঝখানে মাসীর অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন হলো বলে অফিস যায় নি, বাড়িতে আমি যখন থাকতাম না ও আমার জিনিসপত্র ঘাঁটতো, বাবাকে সব দেখিয়েছিল। বাবা আমাকে প্যান্টের বেল্ট খুলে প্রচন্ড মেরেছিলেন তারপরে আমায় ঘরে আটকে রেখেছিলেন।
দুজনে অফিস যখন যেতেন তখনও দরজা আর টেলিফোনে তালা দিয়ে যেতেন । আমি জানলা দিয়ে লোক ডাকতাম দরজা খোলার জন্যে কিন্তু মাসি সারা পাড়ায় নানা কুৎসা রটিয়ে রেখেছিল তাই কেউ সাহায্য করতে আসেও নি। পিন্টুদার বন্ধু আমাদের পাড়ায় থাকে, পিন্টুদা একদিন বন্ধুর কাছে এসেছিল তখন আমি ওকে ডেকেছিলাম। ওই আমায় উদ্ধার করে, ঘুষ দিয়ে কর্পোরেশন থেকে আঠেরো বছর হয়ে গেছে বলে বার্থ সার্টিফিকেট বার করে, তালাওয়ালা ডেকে তালা খুলে আমায় কয়েদ থেকে বের করে। আমি চলে যাওয়াতে সবচেয়ে খুশি বাবাই হয়েছিল কারণ বিয়ে দেবার খরচা লাগলো না।
ওদের বাড়িতেও নানা আপত্তি হয়েছিল, আমি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছি আর ওরা সোনার বেণে। তার উপর ভয়ংকর কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবার, আমার উপরে হাজার নিয়ম চাপাতে চেষ্টা করেছিল। নাকের হাওয়া-বাতাসে নাকি স্বামীর আয়ুক্ষয় হয় তাই এই ঢাউস নাকছাবি পরিয়ে দিয়েছে। আমি অবশ্য স্ট্রেইট বলে দিয়েছি নাকছাবি আর কপালে একটু সিঁদুর ছাড়া আর কিছু পারবো না। শাঁখাপলা নোয়াছাড়া ন্যাড়া হাত দেখে ওরা খুব বিরক্ত কিন্তু কি করবো হাতে কিছু পরে থাকলে আমার খুব অস্বস্তি হয়। বাড়িতে শাড়ি পরেও থাকতে পারবো না জানিয়ে দিয়েছি। তবু আমি পিন্টুদার কাছে খুব কৃতজ্ঞ কারণ ওর জন্যেই আবার পড়াশোনা শুরু করতে পেরেছি নইলে আমারও মায়ের মতো অবস্থাই হতো। "
এরমধ্যে বিশাখার কাছে একদিন তানির ফোন এলো। বিশাখার মনে আছে জয়িতা বলেছিল যে তানি ওর নম্বর নিয়েছে, ফোন করবে বলেছে কিন্তু সত্যি সত্যি যে ফোন আসবে এমনটা ভাবেন নি। কতো বছর আগে মাত্র দুবছর পড়েছিলেন তাও একসাথে নয়, বন্ধুও ছিলেন না। তানির ওইরকম রূপ আর মেধা না থাকলে তিনি তো কবেই ওকে ভুলে যেতেন যেমন অন্যদের গিয়েছেন। বিশাখারা তো এ্যাভারেজই হয়, তাকে কিকরে মনে রাখলো তানি! একথা সেকথার পরে জিজ্ঞেসও করেছিলেন। তানি একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিয়েছিল " জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি আবার অনেক কিছুই পেলাম না। সবচেয়ে বেশি যা পেয়েছি তাহলো জাজমেন্ট, খুব কম মানুষের চোখেই আমার প্রতি এমপ্যাথি দেখেছি তাই তাদের আমি কখনোই ভুলি না। "
বিশাখাকে ও বলেছিল মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ওর উপলব্ধি হয়েছে ধনী বা গরীব দেশের অধিকাংশ মেয়েদের জীবনের মান ভালো না। পদে পদে অসম্মান, অবমাননা, লাঞ্চনা তাদের নিত্য সঙ্গী।
আর ল্যাটিন আমেরিকার মেয়েদের সাথে এশিয়ান মেয়েদের প্রচুর মিল। আরও বলেছিল " জীবন আমায় যা দিয়েছে তার জন্য রিগ্রেট করি না কিন্তু একটা সাধ আছে। তোদের মতো আমারও যদি একটা সন্তান থাকতো। তিন তিনবার বিয়ে করলাম, পিন্টুদার সময় নাহয় আমার পাঠ্যাবস্থা ছিল, পিন্টুদার ছিল অসম্ভব ইনফিরিয়টি কমপ্লেক্স, ও আমাকে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে কিছুতেই যেতে দিতে চায় নি , বউ বেশি পড়াশোনা করলে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে তাই রাগে অন্ধ হয়ে ওইরকম একটা কাজ করে বসেছিল কিন্তু তারপরের দুটো! প্রথমটা ডিভোর্সি ছিল, আগের পক্ষের দুটো বাচ্চা ছিল তাই আর বাচ্চা চাইলো না কিছুতেই। যতই আমি বলি না কেন বাচ্চার ভরণপোষণের ভার আমার একার কিন্তু বিশ্বাস করলো না। হয়তো বুঝেই গিয়েছিল যে বিয়েটা টিঁকবে না। আর ও'হারার ধ্যানজ্ঞান ছিল তার ফ্যামিলিকে আমেরিকায় নিয়ে আসা। আমার কথা কেউ ভাবেই নি তবে একটা অনাথ আর্জেন্টাইন পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েকে অ্যাডপ্ট করতে চাইছি। একটা বাচ্চা ছাড়া আমার আর এখন কোনো কামনাই নেই। "
সেদিন রাতে জয়িতাকে ফোন করে বিশাখা বলেছিল " বড় কষ্ট লাগে রে, সম্মান বড় চাকরিই তো জীবনের সব নয়। আমরা কাজ করতে বাইরে যাই, জানি ফিরে আসবো যেখানে সেখানে আছে একটি কোমল নয়ন পুরুষ , একটি তনয় বা তনয়া যাদের আমরা ধরে রাখি ভালোবাসা দিয়ে । আপন সুখের গোপন স্বর্গ আমাদের আছে কিন্তু তানির কথা ভাব, বহু হাত বহু মুখ ঘুরে ঘুরে এতোটুকু প্রেম কোথাও পায় নি। নিজের বাবা পর্যন্ত ওর ইচ্ছা ওর আশা আকাঙ্ক্ষার দিকে ফিরেও তাকাই নি। কতখানি নিরাশা ব্যথা বেদনায় ও কষ্ট পাচ্ছে বলেই না একটা বাচ্চাকে নিজের করে পেতে চাইছে ! "
জয়িতা বলে " আজ তুই ওকে অবোধ বালিকা, কিই বা চেয়েছিল? একটু পড়াশোনাই তো করতে চেয়েছিল বা নিজের ঈশ্বর দত্ত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল বলে কাঁদুনি গাইছিস, লাস্ট যেদিন ওকে আমরা দেখেছিলাম সেদিন কিন্তু আমরা সবাই ওকে ঘেন্নাই করেছিলাম।" বিশাখার মনে পড়ে যায় তানিশাকে শেষ দেখার দিনের ঘটনা। তাদের উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ দিনে ছিল ম্যাথ, দেখা গেল তানিশা আসে নি। অবাক হয়েছিল সবাই, এক ঘন্টা পরে মেয়ে এসে হাজির, মাথার চুল খোলা আর ভিজে চুল দিয়ে জল চুইয়ে পরছে। স্কুলের ইউনিফর্মের শাড়িটাকে তারা যেমন স্কুলে প্লীট দিয়ে পরতেন তেমনটি নয়, কোনো রকমে গায়ে জড়ানো। ইনভিজিলেটর ঢুকতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না, ওর কান্নাভেজা গলা শুনে শেষ পর্যন্ত দিলেন। কেন এতো দেরি সে প্রশ্ন করায় ও মাথা নীচু করে উত্তর দিয়েছিল " আমার স্বামী হঠাৎ সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। " ঝড়ের বেগে অঙ্ক করছিল, টিফিনের সময় একা একা দূরে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। সেকেন্ড হাফে অন্য একজন ইনভিজিলেটর ওকে জিজ্ঞাসা করেন যে ওর স্বামীর কি হয়েছে? ওর উত্তর শুনে সেদিন সেই শিক্ষিকা আর ছাত্রীর দল হতবাক হয়ে গেছিল। দিদিমণির প্রশ্নের উত্তরে ও অঙ্ক কষতে কষতে পুরো ক্লাসকে রুদ্ধশ্বাস করে দিয়ে বলেছিল " হি হ্যাঙ্গড হিমসেল্ফ। "৷
****