এমন বন্ধু আর কে আছে
গত কয়েকদিন ধরে চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছে সুভাষবাবু ও তাঁর গিন্নি অন্তরা দেবীর। তাঁদের একমাত্র ছেলের বউ নীলাশা নয় মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। ডাক্তার এই মে মাসের প্রথমেই ডেট দিয়েছেন। এদিকে গত এক বছর ধরে করোনা ভাইরাসের কারণে দেশ জুড়ে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি। কবে যে সব ঠিক হবে কেউ জানে না। ছেলে সমীরণ কর্পোরেট জগতে কাজের সূত্রে আমেরিকা গিয়েছিল। সেও ওখানে আটকা পরে গেছে। দুবেলা ভিডিও কল করা ছাড়া সমীরণের এখন কোনো উপায় নেই।
খুব স্বাভাবিক কারণে নীলাশার মাঝে মাঝে চিন্তায় শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে বর এই সময়ে বাইরে প্লাস নিজের বাবা মাও আসতে পারছে না। যদিও নীলাশার শ্বশুর শাশুড়ি যথেষ্ঠ শক্তসামর্থ্য এবং ওর যত্নেরও কোনো ত্রুটি রাখছেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিন দিন চারপাশের পরিবেশ ও পরিস্তিতি যা ভয়াবহ হয়ে উঠছে, তাতে চিন্তা বিন্দুমাত্র কমছে না।
এক মাস আগে তাও ব্লাড টেস্ট, আল্ট্রা সাউন্ড, ডাক্তার দেখানো এসব ঠিকঠাক চলছিল, মুশকিল হল গত একমাস ধরে এ পাড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায়। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াও সমস্যা আবার বাড়ির গাড়ির ড্রাইভারও আসতে চাইছে না। ফোন কল করে ঠিকঠাকভাবে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
চিন্তায় টিভি বন্ধ করে অন্তরা দেবী সুভাষ বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, "কি গো যা অবস্থা চারিদিকে, এবারতো সত্যি চিন্তা লাগছে, আবার ছেলেটাকেও কিছু বলতে পারবো না। ও বেচারি ওখানে বসে চিন্তা করবে।"
সুভাষবাবুরা থাকেন অন্নপূর্ণা আবাসনে। আবাসনের লোকজন অবশ্য খুব সাহায্য করে। এই আবাসনে একটি ছোকরা ডাক্তার বাবুও আছে। নামকরা হাসপাতালের
ডাক্তার কিন্তু তাও তাঁকে ইদানিং কেউ পাত্তা দেয় না। এইতো মাস তিনেক আগেই জনতার কাছে কি মারটাই না খেয়েছিল। এই আবাসনে এ বি পি আনন্দ ও বাকিসব নিউজ চ্যানেল চলে এসেছিল। ওই ডাক্তারের চিকিৎসাতেই এই আবাসনের একজন বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল।
অন্তরা দেবী এরমধ্যে একদিন সুভাষ বাবুকে বলেছিলেন, --"হ্যাঁ গো বলছি এই সময় হটাৎ করে কোনদিন কি হয় না হয়, তুমি একবার ঐ কি যেন নাম ছেলেটার.... মনে পড়েছে....অনির্বান...ওকে বলে রেখো না একটু।"
-- "তুমি খেপেছ, ওই মানুষ মারার ডাক্তারকে বলবো আমি আমার বৌমার ডেলিভারির ব্যাপারে।"
-- "আরে মানুষ মারার ডাক্তার বলছো কেন? কোনো ডাক্তার ইচ্ছা করে কোনো রুগীকে মারে। ওই হারাধনবাবুতো এমনিতেই অনেক দিন ধরে কিডনির জটিল অসুখে ভুগছিলেন, তাছাড়া নব্বই বছর বয়স...।"
-- "থাক তুমি আর এসব বলে আমায় ভুল বুঝিও না। আমি নিজে আবাসনের বাকিদের সাথে গিয়ে ঝামেলা করে এসেছি, আবার আমিই যাব ওই লোভী বদমাইশ ডাক্তারের কাছে।"
-- "তাহলে যা ভালো বোঝ তাই করো।"
----------------------------
সবে ছেলের সাথে ফোনে কথা সেরে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন অন্তরা দেবী। সুভাষবাবু তখনও খবরে মগ্ন। হটাৎ নীলাশার চিৎকারে দুজনেই কাজ ফেলে ছুটে যান। বাথরুম থেকে ঘরে আসতে গিয়ে পা স্লিপ করে পরে গেছে নীলাশা। অসহ্য পেটে যন্ত্রণা নিয়ে মাটিতে বসে কাতরাচ্ছে।
তড়িঘড়ি ডাক্তারকে ফোন করেন সুভাষবাবু। কিন্তু কিছুতেই ফোনে পান না। কোনো উপায় না পেয়ে এই আবাসনের কয়েকজনের সাহায্য চাইতে বের হন সুভাষবাবু। সবাই যে যার ঘরে। একমাত্র ওই ডাক্তারবাবুটি ফিরছিলেন রুগী দেখে। বিভ্রান্ত সুভাধবাবুকে দেখে উনিই প্রশ্ন করেন, "কি আঙ্কেল, কিছু হয়েছে?"
হাজার বিরক্তি স্বত্ত্বেও আর কারুর সহযোগিতা না পেয়ে বাধ্য হয়ে সবটা খুলে বলেন সুভাষবাবু। তারপর ওই ডাক্তারই নিজের গাড়িতে ড্রাইভ করে নিজের হসপিটালে নিয়ে এসে তড়িঘড়ি অপারেশন করেন নীলাশার।
--"আপনারা দাদু ঠাকুমা হয়ে গেছেন মি এন্ড মিসেস মিত্র।" একগাল হেসে নার্স তোয়ালের মধ্যে করে সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়েকে দেখিয়ে নিয়ে যায়। নার্সটি বলেন,--"আপনাদের বৌমারতো জল ভেঙে গিয়েছিল। আর একটু দেরি হলে হয়তো বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেত।"
নার্সদের মুখেই সুভাষবাবু জানতে পারেন তিনদিন টানা ডিউটির পর বাড়ি ফিরছিলেন ওই ছোকরা ডাক্তার নীলাদ্রি।
-- "আপনারা এখন দেখা করতে যেতে পারেন বৌমা ও নাতনির সাথে। তারপর আমার সাথে ফিরে চলুন। কাল সকালে আবার আমি যখন আসবো আপনাদের নিয়ে আসবো না হয়।"
হাত জোড় করে কেঁদে ফেলেন সুভাষবাবু। বলেন, --"তুমি আমার ছেলের বয়সি হবে। সেদিন ওই বৃদ্ধ মারা যাওয়ায় কিছু না বুঝে খুব অন্যায় করেছিলাম। আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা। সত্যি তুমি আজ না থাকলে কি যে হত।
তোমরা মানুষরূপী ভগবান।"
অন্তরা দেবী বলেন, --"তোমায়তো আগেই বলেছিলাম। এমন বন্ধু আর কে আছে। ডাক্তাররা সবসময়ই উদার মানবিকতার মানুষ হন।
আমাদের নাতনির নামটা তুমিই দিও বাবা।"
--"ঠিক আছে আন্টি আমি কাল ভেবে বলবো। আমার কিন্তু খাওয়া ডিউ রইলো। আমার মা এখানে থাকেনা। তাই আন্টির কাছেই কব্জি ডুবিয়ে খাবো।"
আনন্দে চোখে জল এসে যায় অন্তরা দেবীর।