বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

হামি

__"পুপসি শোনো একদম দৌড়াদৌড়ি করবেনা খাওয়ার সময়।চিকেন দিয়ে ভাত মেখে দিয়েছি চুপচাপ বসে লক্ষ্মীসোনার মত খেয়ে নাও।বড্ড দুষ্টু হয়েছ তুমি!"শোনা যায় রেশমির গলা।থালাতে ভাত মেখে নিয়ে মেয়ে পুপসির পিছন পিছন প্রতিদিন এই ঘর ওই ঘর দৌড়াতে হয় রেশমি মানে সাত বছরের ছোট্ট পুপসির মাকে।ছোট্ট পুপসি ওরফে আদৃতা ভাত খাওয়া নিয়ে বড্ড বেশী বায়না করে।এটা খাবনা ওটা খাবনা এই নিয়ে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয় রেশমিকে।শাক,সবজি,ফল  একদম খেতে চায়না পুপসি। ওর নজর শুধু ওই চিপস,ফাস্ট ফুড আর চকোলেটের দিকে।সপ্তাহে একটা মাত্র রবিবার ছুটির দিনেও রেহাই নেই রেশমির।সকালে বাজার করে এনে রান্নাবান্না সারতে বড্ড দেরী হয়ে গেল।তার উপর কদিন হল বাড়ির কাজের লোক মতির মা ডুব মেরেছে কিছু না বলে কয়ে।সব দিক থেকে নাজেহাল অবস্থা ওর।


অন্যদিকে অর্পণ মানে রেশমির স্বামী চুপচাপ ঘরের বিছানায় বসে ল্যাপটপ কোলে অফিসের কাজ করছে আর মাঝেমধ্যেই চা,কফির হুকুম করছে ওকে।সামনেই নাকি কোন জার্মান প্রজেক্টের বড় দায়িত্ত্ব ওর কাঁধের উপর।তাই নাওয়া খাওয়ার সময় নেই।পুপসির মুখে ভাতের গ্রাস তুলে দিতে দিতে রেশমি মনে মনে ভাবে অর্পণ বড় বদলে গেছে আজকাল।ছুটির দিনেও আজকাল ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে নিজের মত থাকে।এইত সেদিন কত যত্ন করে ইলিশ ভাপা রাঁধল ও ভেবেছিল অর্পণ অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে একসাথে ডিনার করবে। ছোট্ট পুপসিও বায়না ধরেছিল বাবা বাড়ি ফিরলে একসাথে খাবে বলে। কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে অর্পণ জানিয়ে দিল ও কন্টিনেন্টাল খেয়ে এসছে বাড়িতে খাবেনা।কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ল পুপসি। রেশমিরও সেদিন আর খেতে ইচ্ছা করেনি।চুপচাপ বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছিল।অর্পণের যা হাবভাব তাতে এই বাড়িতে বড় দমবন্ধ লাগে রেশমির।একাকিত্ব যেন হাঁ করে গিলতে আসে ওকে।ঘড়ির টিকটিক কাঁটার আওয়াজ তাড়া করে বেড়ায় রেশমিকে।শুধু পুপসির  মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনা।সপ্তাহের অন্যদিনে পুলকার এসে পুপসিকে বড় রাস্তার নামিয়ে দেবার পর ওকে বাড়িতে এনে স্নান করানো খাওয়া দাওয়া করাতে অনেক সময় কাটে রেশমির।তারপর ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজে খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় রেশমি।অলস দুপুরে কখনও ও তাকিয়ে থাকে ওদের আবাসনের লাল কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ফুলের দিকে। আকাশ আলো করে ফুটে আছে ওরা।কখনো বা আনমনে ও চেয়ে থাকে উড়ন্ত কোন ঘুড়ির দিকে কানে যায় কর্নেটো আইসক্রিমওয়ালার হাঁক।সারাদিনের মধ্যে রেশমির নিজের জন্যে সময় বলতে ওইটুকুই।


আসলে ওদের এই "মধু_মঞ্জরী" আবাসনটা অনেক বড়।তিনটে ফেজে প্রায় সত্তর জন পরিবারের বসবাস।পুপসি ঘুম থেকে উঠতেই শুরু হয় ওর প্রজেক্ট  হোমওয়র্ক নিয়ে আরেক প্রস্থ ছোটাছুটি।বাচ্চা নিজে ছোটো হলে কি হবে ওর স্কুল ব্যাগের ওজন বেশ ভারী।ভাতের দলা মেখে পুপসির গালে দিতে দিতে এসব কথা ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল রেশমি।হুশ হয় অর্পণের চিৎকারে।রেশমি গিয়ে দেখে ওর অন্যমনস্কতার সুযোগে পুপসি সোজা ছুটে গিয়ে ওর বাবার পিঠে চেপে বসেছে।এদিকে ওর লাফালাফিতে কফির কাপ উল্টে বিছানায় পড়ে গেছে। সেই নিয়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে চেঁচামেচি শুরু করেছে অর্পণ,"কি হোপলেসের কাজকর্ম কর রেশমি!ওইটুকু একটা বাচ্চাকে সামলে রাখতে পারনা সারাদিন কর কি?সত্যি কি করে যে মা হলে তুমি?"


এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে রেশমির।বেশ ঝাঁজিয়ে উঠে বলে শোনো অর্পণ মা হওয়াতে আমার একার কোন ভূমিকা ছিলনা নিশ্চয় সেটা তুমি ভালমত জান।আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম বলে

পুপসি এসছিল আমাদের মাঝে।আর শুধু ওইটুকু সাত বছরের একটা মেয়েকে  সামলাবার কথা কি বলছ বিগত নয় বছর ধরে তো তোমার সব বেয়াদপি সামলে আসছি।একা হাতে বাজার করা,রান্না করা,স্কুলে পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ে যাওয়া সব। দুটো টাকা রোজগার করে আনলেই সব দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায়না অর্পণ সেটা বোধয় তুমি ভুলে গেছ। আমার কথা ছাড়ো নিজের মেয়েটার  দিকে তাকিয়ে দেখ একবার ওইটুকু মেয়ে নিজের বাবাকে কাছে পেতে চায় আর তুমি সামান্য কফি পড়ে গেছে বলে সেই নিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলেছ?ছি ভাবতেও ঘেন্না হয় আমার একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম তোমাকে।কিন্তু আর নয় অনেক সহ্য করেছি।দিস ইজ টু মাচ আমি ডিভোর্স চাই সেই সাথে পুপসির কাস্টডি চাই আমার।ও আমার সাথে থাকবে।আমার কাছে মানুষ হবে",এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাফাতে থাকে রেশমি ওর জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি এখন অর্পণের উপর ঘোরাফেরা করছে।


চোখ দুটো এবার জ্বলে ওঠে অর্পণেরও ব্যঙ্গ করে বিশ্রী ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে,"তা ম্যাডাম ডিভোর্স কেসে তোমার হয়ে কে লড়বে শুনি?তোমার বাবা থুড়ি আই মিন আমার  শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু ওই বুড়ো উকিল কি যেন নাম ওই বিজন বসু?" রেশমি কেটে কেটে উচ্চারণ করে হ্যাঁ যা ভেবেছ,"একদম ঠিক তাই। আমি বিজন কাকুকেই ডাকব।"আর দেরি করেনা অর্পণ।পায়ে স্যান্ডাল গলিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় সঙ্গে বলে যায়,"আচ্ছা ম্যায় ভি দেখ লেতা হু!আমিও কি করতে পারি।"এদিকে যাকে নিয়ে এত কাণ্ড সেই পুপসি তখন মা বাবার যুদ্ধং দেহি চেহারা দেখে এক ঘরের কোণে সেধিয়ে গেছে।সেদিকে লক্ষ্য না করে রেশমি ফোন করে উকিল তথা বিজন বসুকে,"হ্যাল্লো কাকু আমি রেশমি বলছি তুমি কি একটু আমার ফ্ল্যাটে আসবে?পরিস্থিতি আমার হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আজকে যা হল সেটাতো জাস্ট ভাবতে পারছি না।"বিজনবাবু  ঠান্ডা মাথায় ধীরে ধীরে উত্তর দেন,"আমি আসছি রে মা। একটু মন শক্ত কর তুই।ভেঙে পড়িসনা। তোর এই বিজনকাকু থাকতে চিন্তা কি?"


খানিকক্ষণের মধ্যেই চলে আসেন উনি। ওনাকে দেখে রেশমির কথার বাঁধ ভাঙে হুড়মুড়িয়ে। সব কথা যখন শেষ হয় খেয়াল হয় পুপসি আশপাশে কোথাও নেই।সোফায় যেখানে বসে ওরা কথা বলছিল সেখানে পড়ে আছে ওর আঁকার খাতা।একটা ছবি এঁকেছে পুপসি তার নীচে লেখা মাম্মাম,বাবা আর মাঝখানে আমি।টুগেদার ফরএভার। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি।অর্পণকে ফোন করে ডাকে রেশমি।কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও কোথাও পাওয়া যায় না পুপসিকে। বাধ্য হয়ে সবটা জানিয়ে ফোনে ডাকা হয় অর্পণকে।ওর কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে রেশমি।ওকে স্বান্তনা দেবার ভাষা হারিয়ে যায় অর্পণেরও সত্যি যে আজ কি হচ্ছে।সমস্ত আশা ছেড়ে যখন পুলিশে মিসিং ডাইরি করা হবে বলে ঠিক করা হচ্ছে এমন সময় পুপসি কোলে নিয়ে ঘরে ঢোকেন মিস রিনিতা সান্যাল।উনি পেশায় একজন মনোবিদ।ওই একই "মধুমঞ্জরী" আবাসনে ফেজ থ্রিতে থাকেন উনি।পুপসি জড়সড় হয়ে বসে আছে ওনার কোলে।রিনিতা এবার বলেন,"পুপসির মা বাবা হিসাবে আপনাদের কিছু কথা বলছি আজ।কিছু মনে করবেন না।বিকেলে আমি যখন ছাদে আমার টবগুলোতে জল দিতে যাই তখন দেখি জলের ট্যাংকের পিছনে ছোট্ট হাত দুটো প্রাণপণে নিজেকে লোকাবার চেষ্টা করছে কাছে গিয়ে দেখি ও আপনাদের মেয়ে।আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যে কথাটা জানতে পেরেছি ওর থেকে সেটা হল আপনাদের ঝগড়া দেখে আদৃতা ভীষণ ভয় পেয়েছে। আর ও চায় ওর মাম্মাম আর বাবার সাথে একসাথে থাকতে। এটা কখনোই চায় না আলাদা হয়ে বিশেষ কারোর সাথে দিন কাটাতে।ও ভালো থাকবে না।"ওনার কথাগুলো যখন শেষ হয় রেশমির নরম গাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।অর্পণ মাথা নীচু করে বসে আছে সারা ঘর জুড়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।


এতক্ষণে বোঝা যায় ছবিটার মধ্যে দিয়ে পুপসি ঠিক কি বলতে চেয়েছিল ওর মা বাবা দুজনকে।রিনিতা আবারো বলেন ,"আসলে কি বলুন তো অর্পণবাবু গুড পেরেন্টিংয়ের নামে গাদাগাদা টাকা খরচ করে নামী স্কুলে ভর্তি করে বা দামী খেলনা দিয়ে নয় বরঞ্চ ওকে একটা দামী শৈশব দিতে হবে।সেটাই পুপসির জন্যে সেরা উপহার। নিজেদের ইগো,মান অভিমানের প্রভাব ওইটুকু ছোট্ট শিশুর উপর পড়তে দেবেন না এটা আমার অনুরোধ।"বিজনবাবুও নীরবতা ভেঙে এবার বলেন," হ্যাঁ মিস রিনিতা আমিও একমত আপনার সাথে সহমত।আসলে শৈশবে বড়দের এই ঝগড়া শিশুদের মনে অনেক অজানা আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়।আমিও বলব এসব ছোটখাট অভিমান,সেন্টিমেন্ট,দাম্পত্য কলহ ছেড়ে পুপসির জন্যে ভালোভাবে বাঁচ তোরা দুজনে।চলুন মিস রিনিতা আমরা এবার যাই।আর পুপসি সোনা ভাব করে নাও দেখি তোমার মাম্মাম আর বাবার সাথে।"পুপসিকে কোলে নিয়ে ওর একেএকে ওর গালে স্নেহচুম্বন এঁকে দেন বিজনবাবু আর রিনিতা। তারপর ওকে টাটা করে বেরিয়ে যান ওনারা।


রাত্রে অর্পণের উদ্যোগে ছোটো ছোটো অ্যারোমা মোমবাতি দিয়ে অনেকদিন পর সেজে ওঠে বাড়ির ডাইনিং টেবিল। আর পুপসি খুব খুশি আজ ওর মাম্মাম আর বাবার মধ্যে ভাব হয়ে গেছে।আবার ওরা একসাথে থাকবে।রাতে খেয়ে উঠে মা বাবার মাঝখানে বসে হোম থিয়েটারে মুভি দেখতে বসে পুপসি।তারপর দুজনকে জড়িয়ে  মিষ্টি করে মা আর আর বাবার দুগালে এঁকে দেয় হামি।ওদের সামনে চলা হোম থিয়েটারে তখন সাম্প্রতিক কালের জনপ্রিয় বাংলা ছবির দৃশ্যতে পর্দা জুড়ে চলছে "ঝগড়া ঝাটি রাগ/মারামারি ভাগ/সেরে যাবে সব পাগলামি/শুধু তিনটে চারটে সাতটা আটটা হামি।।।"

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু