জাস্টিস
#কৃদন্তী_ঘটক
#জাস্টিসJustice
========
দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নগরীর নিজস্ব শয়নাগারে প্রবেশ করলেন।উদ্দেশ্য একটাই সামান্য বিশ্রাম গ্রহণ করা ।শয্যা গ্রহণ করে তিনি নিদ্রা মগ্ন হবেন ভাবলেন ।গবাক্ষ দিয়ে মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে এবং তার দেহ সুশীতল করে দিচ্ছে ।এই অবস্থায় নিদ্রা আসাটাই স্বাভাবিক ।কাছে কেউ নেই .স্ত্রীসত্যভামা ও রুক্মিণী দুজনেই গৃহ কর্মে ব্যাপৃত ,দাস দাসীরাও কাজে ব্যাস্ত ।কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের চোখে কিছুতেই নিদ্রা আসছে না .তিনি গভীর চিন্তা মগ্ন ।
বেশ কিছুদিন হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির রাজ্ চক্রবর্তী হয়েছেন ।পিতামহ ভীষ্ম কদিন আগেই স্বর্গারোহন করেছেন ।এসব ভাবতে ভাবতে শ্রীকৃষ্ণের মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো ।তার মন অতীতে ফিরে গেলো ।পান্ডব মাতা কুন্তী তাঁর নিকট আত্মীয়া ।বিবাহের পর কিছুদিন রানীর ভূমিকায় থাকলেও তাঁর জীবন বড়ো বেদনাময় ।অকালে পান্ডু রাজার প্রয়াণ মহারানী কুন্তীকে অথৈ সাগরে ফেলে দিলো ।তাঁর পাঁচ পুত্রকে নিয়ে তিনি কম কষ্ট করেন নি ।কৌরবেরা ছোট থেকেই পঞ্চ পাণ্ডবের প্রতি সৌহার্দ দেখায় নি ।ভীমকে বিষ খাওয়ানো ,বারণাবত কান্ড ,বনবাস কত ঘটনা ।এর মধ্যেই পঞ্চ পান্ডব দ্রুপদ কন্যা দ্রৌপদী কে বিবাহ করলো ।দ্রৌপদী শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী ও সখি ।দ্রুপদরাজের বড় আদরের কন্যা এই যাজ্ঞসেনী ।
যাজ্ঞসেনী জীবনে কি পেলো ? অর্জুনকে ভালোবেসেছিলো কিন্তু বিবাহ করতে হয়েছে পঞ্চ পাণ্ডবকে । তাও মেনে নিয়েছিল ।রাজবধূ ,পাটরানী হয়েও বারবার রাজ্য ছেড়ে সে পঞ্চ পাণ্ডবের সঙ্গে বনবাসী হয়েছে ।জীবনে সে কি পেয়েছে ? দিনের পর দিন বনবাস ......পাটরানী হওয়ার পর ও তার ভাগ্য পরিবর্তন হলো না ।শকুনির চক্রান্তে প্রকাশ্য রাজসভায় গুরুজনদের সামনে কৌরবরা তাকে লাঞ্ছনা করতে দ্বিধা করেনি ।সম্মানহানি ,শ্লীলতাহানি সব করেছে কৌরবরা ।আশ্চর্য ঘটনা সেখানে সমস্ত গুরুজনরাই ছিলেন কেবল মাত্র দর্শক ।এমনকি গান্ধার রাজকন্যা গান্ধারী যিনি কৌরব মাতা তিনিও অদ্ভুতভাবে নীরব থেকে কুলবধূর লাঞ্ছনা দেখলেন ।কেউ প্রতিবাদ করলেন না ।যতই শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করতে থাকলেন ততই তাঁর মন ব্যাথাতুর হতে লাগলো ।
অবশেষে এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ । যুদ্ধে সমগ্র ভারতবর্ষের বড় বড় রাজার মৃত্যু , অসংখ্য লোকক্ষয় । চারিদিকে কেবলমাত্র পুত্র শোকাতুরা মায়েদের আর্তক্রন্দন আর স্বামীহারা স্ত্রীদের বিলাপ । তারপ্রিয় যাজ্ঞসেনী পঞ্চপুত্র হারিয়ে পাগলিনী প্রায় । ভগিনী সুভদ্রাও পুত্রহারা ।শ্রীকৃষ্ণ ভাবলেন তিনি তো শুধুমাত্র চেয়েছিলেন পাণ্ডবরা যেন justice পায় । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পাণ্ডবরা রাজ্য ,রাজসিংহাসন পেয়েছে । কিন্তু justice কি পেয়েছে ? কেউ কি justice পেয়েছে ? অর্জুন ,ধর্মরাজ ,যাজ্ঞসেনী ,মহাবীর কর্ণ ,পিতামহ ভীষ্ম এমন কি তিনি নিজেও কি justice পেয়েছেন ? এই justice পাওয়ার জন্য তাকেও কি কম মূল্য দিতে হয়েছে ? কৌরবমাতা গান্ধারী তাঁকে ভয়ানক অভিশাপ দিয়ে বসলেন যে অচিরেই পারিবারিক কলহে তাঁর প্রিয় যদুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবে । শ্রীকৃষ্ণ ও কালের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন । অনাগত দিন আসন্নপ্রায় । শ্রীকৃষ্ণ আর চিন্তা করতে পারছেন না । মন ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছে ।
হটাৎ মনে হলো কদিনের জন্য তিনি সত্যভামা ও রুক্মিনীকে নিয়ে স্থান পরিবর্তন করে একটু ভ্রমণ করে আসলে বোধহয় মন শান্ত হবে । কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তাটাকে বাতিল করলেন । তাদের দুজনের পারস্পরিক সম্পর্ক খুব স্বাস্থকর নয় । বরং তিনি একলাই যাবেন । কিন্তু কোথায় ? হটাৎ তাঁর প্রানাধিকা রাই বিনোদিনীর কথা মনে পড়লো । কতদিন তাঁকে দেখেন নি । রাধিকাও আজ বয়সের ভারে আক্রান্ত হয়েছে মনে হয় । কেমন দেখতে লাগে আজকাল কে জানে । তার মন আকুলি বিকুলি করতে লাগলো রাইকে দেখার জন্য । দুচারদিনের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে ।
বেরিয়েও পড়লেন । সেই বৃন্দাবন । শৈশব কৈশোরের বৃন্দাবন বেশিরভাগ বৃন্দাবনবাসী আজ পরলোকগত । চেনা জানার মধ্যে কাউকে কাউকে পেলেন । কিন্তু রাইকে সংবাদ পাঠাতে হবে যে তিনি এসেছেন । কেবলমাত্র রাইকে দেখার জন্যই তিনি এসেছেন ।
ললিতা ,বিশাখা , চন্দ্রাবলী সকলেই বিবাহ করে পর গৃহবাসী । কাউকেই পেলেন না সংবাদ পাঠানোর জন্য । দুঃখিত ও ভারাক্রান্ত মনে তিনি বনের দিকে পা বাড়ালেন , যেখানে শৈশবে বাঁশি বাজাতেন । একটি গাছের নিচে বসে তাঁর প্রিয় বাঁশি হাতে নিয়ে বাজাতে শুরু করলেন । বংশীর সুললিত ধ্বনি ধীরে ধীরে দিক থেকে দিগন্তরে ছড়িয়ে পড়লো । রাধিকা গৃহকর্মে ব্যাপৃত ছিলেন । হটাৎ চেনা বংশীধ্বনি তাঁর মনকে উতলা করে তুললো । রাধিকা জানেন এই ধ্বনি আর কারুর নয় ,তার প্রাণাধিক প্রিয় শ্রীকৃষ্ণের মুরলীধবনি । পাগলিনীর মতো ছুটতে ছুটতে সেই বনে এসে পৌঁছালেন রাই । সামনে বংশীবাদনরত শ্রীকৃষ্ণ । রাই দৌড়ে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাঁধের উপর মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজলেন । শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়ে চললেন । সময় সময়ের মতো এগিয়ে চলে । সূর্য পশ্চিম দিগচক্রবালে অস্তমিত প্রায় ।
অবশেষে সন্ধ্যা হয়ে এলো .শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার কাছে শেষ বারের মতো বিদায় চাইলেন । দুজনেই জানেন আর তাদের কোনোদিন দেখা হবে না । দুজন দুই পথে এগিয়ে চলেন । শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নগরীতে ফিরে এলেন । আজ তিনি পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন হবেন । অনাগত ভবিষ্যত তিনি জানেন । কিন্তু এই নিয়ে তিনি আর ভাববেন না । আগামী নিয়ে ভেবে লাভ নেই ।জীবনের রঙ্গমঞ্চে তিনি কেবলমাত্র কুশীলব .......,.......
