বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

আমি কাঁটাতারেই সুখী

"ব্রজগোপী খেলে হোরি,হোরি রে,

খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে!

পিরীতি ফাগ মাখা গোরীর অঙ্গে,

হোরি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে!"


__প্রতিবারের মত এবারও দোলপূর্ণিমার দিন সকাল সকাল দিদি তিস্তার মিষ্টি গলা শুনে ঘুম ভাঙ্গলো ছোটবোন তোর্সার।বিছানায় উঠে বসে চোখ খুলতেই ও দেখে ততক্ষণে ওর দিদির স্নান সারা শেষ।কাঁচা হলুদ রঙের মিষ্টি একটা জামদানি শাড়ি পরে ভিজে এলো চুলে সারা ঘরে ধুনোর আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে তিস্তা। একটা মিষ্টি গন্ধ ছেয়ে আছে চারদিকে।ওমনি একছুটে গিয়ে দিদিকে জড়িয়ে তোর্সা বলে,"শুভ দোলযাত্রা দিভাই।কিন্তু সকাল সকাল তুই এমন সেজেছিস মনে হচ্ছে যেন অভিসারে যাবি কেষ্টঠাকুরের সঙ্গে।বল নারে একবার লক্ষ্মীটি তার নামটা,আমি নিজে গিয়ে তাকে বরবেশে সাজিয়ে আনবো তোর কাছে। তোর তো লজ্জা খুব বেশি।মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলে উঠতে পারিসনা।আমার আবার ওসবের বালাই নেই।" ওমনি ছোটবোনের কান ধরে তিস্তা বলে,"খুব পাকু হয়েছিস রে বোনু তুই!ভুলে যাস কেনো আমি তোর বড়দিদি,আমার সাথে ইয়ার্কি?"


কপট অভিমান দেখিয়ে তোর্সা এবার বলে,"দিদি না আরো কিছু!তুই আমার সবথেকে ভালো বন্ধু আমার দোসর।মাত্র আট মিনিটের বড় তুই আমার থেকে।আসলে এই পৃথিবীতে আসার সময় ভগবান আমার আগে তোকে পাঠিয়েছিল নইলে আমার এই পৃথিবীতে থাকতে ভীষণ একা লাগবে সেইজন্য।"


ছোটবোন তোর্সার কথায় হেসে ফেলে তিস্তা বলে,"সত্যি এখনও তুই ছেলেমানুষ রয়ে গেলি বোনু।আচ্ছা তোর সেই বন্ধুপ্রবর বিতানের খবর কি?আজ সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ির হোলিপার্টিতে সেই তো প্রধান অতিথি তাইনা?",দিদির মুখে বিতানের কথা উঠতেই একরাশ ভালোলাগা জড়িয়ে ধরে তোর্সাকে।সত্যি সেই কলেজ জীবন থেকে তোর্সা আর বিতান দুজন একসাথে পথ হাঁটছে।যদিও দুই বোনের বিষয় ছিল ভাষাতত্ত্ব আর বিতান ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।এই শহরেরই এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত ওরা। আলাদা বিভাগ হলেও কলেজ সোশালে একটা জায়গায় মিলে গেছিল বিতান আর তোর্সার ভালোলাগার প্রধান জায়গা গান। পড়াশুনোর ফাঁকে একসাথে গান লেখা,সুর দেওয়া চলত। আর দিদি তিস্তা চুপচাপ থাকত ওদের মাঝে।আসলে দুজনে যমজ বোন,চেহারায় অসম্ভব মিল হলে কি হবে স্বভাবে দুজনের প্রচুর অমিল।


তিস্তা শান্ত নদীর মত যার দু কুলে গড়ে উঠে জনবসতি আর তোর্সা খরস্রোতা পাহাড়ি ঝর্ণা,সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় হড়কাবানের মত। উচ্চমাধ্যমিকের পর একটা পথ দুর্ঘটনায় মা,বাবা একসাথে গত হবার পর তিস্তাই তো সংসারের সবকিছু ধরে রেখেছে একাহাতে।তাই ছোটবোনের সাথে বিতানের সম্পর্কের ব্যাপারটা তিস্তার অজানা কিছু নয়। যাইহোক সেসব এলোমেলো পালকি পালকি ভাবনা ছেড়ে তোর্সা বলে ,"হ্যাঁ রে দিভাই আজ সকালেই দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা ওর।আমি কাল রাতে ফোন চার্জে দিয়ে ঘুমাতে গেছিলাম।কি জানি বিমান থেকে নেমে ফোন করেছিল কিনা ও আমাকে...";এই বলে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা টেনে সুইচ অন করতেই মিসডকল অ্যালার্ট ঢোকে।ওমনি তিস্তা চোখ নাচিয়ে বলে,"সত্যি তুই পারিস বটে বোনু।তোকে না পেয়ে শেষমেশ আমাকেই ফোন করেছিল বেচারা বিতান। বললো কানপুর থেকে ঠিক সময়েই কলকাতা এসে পৌঁছেছে ও। আরো জানালো বিকেলে ঠিক সময়ে আসবে ও আমাদের বাড়ি।নে যা স্নান করে আয় এবার। তারপর তো আবার তোর ওই এন.জি.ও তে যাবি।যা ঝটপট ঘুরে আয় তুই।বাড়িতে অনেক কাজ বাকি আছে।বিকেল হতেই অতিথিরা সব আসবেন, বিতানের মা বাবাও আসবেন আজ।ওদের সামনে কিন্তু লক্ষ্মী হয়ে থাকিস তুই।"


__"কিন্তু বিতান তো এতকিছু বলেনি আমাকে!";তোর্সা বলে দিদির কথার উত্তরে।বোনের চুলগুলো কোঁকড়া চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে তিস্তা বলে,"যা ভুলো মন তোর,নিশ্চয় বিতান বলেছিল তোকে।হয়ত ভুলে গেছিস তুই।নে যা,এত না ভেবে এবার ঝটপট স্নান সেরে ফেল পাগলি একটা।"


স্নানঘরে ঢুকে একটা মিঠেকড়া আমেজ ঘিরে ধরে তোর্সাকে।তবে কি আজ দোলের দিন বিতান ওর মা বাবার সামনে তোর্সার রঙে ওর জীবনটা রাঙানোর কথা বলবে?একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় সারা শরীর জুড়ে ওর।সুন্দর করে স্নান সেরে সারা শরীরে সুগন্ধি ছড়িয়ে নতুন ময়ূরকণ্ঠী কুর্তিটা পড়ে ও।আজ ইচ্ছে করেই জিনস, টপ পরলনা ওনারা আবার কি ভাবেন সেই ভাবনাচিন্তা থেকে।আয়নার সামনে নিজেকে আজ পুরো অন্যরকম লাগছে খেজুরে বিনুনিতে।সত্যি সেজেগুজে থাকলেও ওকেও খুব একটা খারাপ লাগেনা। কিন্তু তোর্সার এসব আবার বিশেষ পোষায় না,নেহাত আজ দিভাই বলল তাই। স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও আজ একবার না গেলেই নয় এন.জি.ওতে।বাচ্চাগুলো অপেক্ষা করবে ওর জন্য,।রং,পিচকিরি নিয়ে যাবে ও কথা দিয়েছে ওদের।সেইমত বেরিয়ে পড়ে তোর্সা।বিতান আসার আগেই ফিরে আসতে হবে ওকে বাড়িতে।আজ ওকে এই নতুন রূপে দেখে একদম চমকে যাবে নিশ্চয় ও উফফ ভাবলেও বুকের রক্ত চলকে উঠছে ছলাৎ ছল।ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথ ধরে তোর্সা। আজ সারাদিন মনের মধ্যে শতেক রঙের দোলা লেগেছে বারেবারে বিতানের কথা মনে পড়লেই।যাইহোক রাস্তাঘাট ফাঁকাই আছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে এসে পৌঁছায় তোর্সা। দুই একবার কলিংবেল বাজিয়ে উত্তর মেলেনা কোনো।মনেমনে ও ভাবে তাহলে কি দিভাই কোথাও বেরোলো?কিন্তু ওকে তো কোনো কিছু জানায়নি।আর বিতানেরও তো এতক্ষণে এসে যাবার কথা।কই ও তো কিছু বলেনি।একটা অজানা চিন্তা গ্রাস করে তোর্সাকে।কিছু হলনা তো দিদির একা বাড়িতে দোলের দিন?একবার কি বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে দেখবে ও যদি জানলা দিয়ে কিছু দেখা যায়?যন্ত্রের মত সেদিকে পা বাড়ায় তোর্সা। কিন্তু একি দেখছে ও, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা ও।



ওর দিদি তিস্তা আর বিতান বিছানায় আদিম রিপুর চরম খেলায় মেতেছে।হালকা সুরের মূর্ছনা বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে।কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আসছে বুনো হাঁস,হাঁসির মত শীৎকারের শব্দ দুটো শরীর খেলা করে বেড়াচ্ছে পাগলের মত। অস্ফুটে তোর্সার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,"না এটা কিছুতেই...যে রঙের খেলায় আজ আমার জীবন রঙিন হবার কথা ছিল সেই মানুষটার জন্যই আজ দুনিয়া বড় ফ্যাকাশে লাগছে এখন।"


ঝটপট নিজেকে সামলে শাড়ির আঁচল ঠিক করে কাঁপা কাঁপা গলায় তিস্তা বলে ,"বোনু তুই কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস? কলিংবেল বাজাবি তো?"


কাটা কাটা কণ্ঠে তোর্সা দিদিকে বলে,"অনেকবার বাজিয়েছিলাম রে দিভাই। খেয়াল করিসনি তোরা।যাক ভালোই হল।এতদিন সামনে থেকে যা দেখতে পাইনি পিছন থেকে এসে সেটা দেখে নিলাম।তবে তুই স্পষ্ট বলতে পারতিস তোদের সম্পর্কের কথা।একই মায়ের গর্ভে জন্ম আমাদের, একসাথে বড় হয়ে ওঠা।তোর জন্য আমি এটুকু করতে পারতাম না এতটাও ছোট মন নয় আমার। আসলে তুই তো সারা জীবন করেই গেছিস মুখ ফুটে কিছু কোনোদিন চাসনি আমার থেকে।তাই আগে বললে নিজের সবথেকে ভালোবাসার মানুষটাকে তোর হাতেই তুলে দিতাম রে দিদিভাই।"


ওদের দুই বোনের কথার মাঝে বিতান নিজের গলাটা একটু ঝেড়ে  বলে ওঠে,"তুই একবার ভিতরে আয় তোর্সা। আসলে আমি আর তিস্তা দুজন মিলে আগে থেকে তোকে বলতেই চেয়েছিলাম।কিন্তু তুই যা ছটফটে পাগলি স্বভাবের তাতে ঠিক কিভাবে রিএক্ট করবি আমাদের সঙ্গে শুধু এই ভেবে এতদিন কিছু বলে উঠতে পারিনি।আসলে তোকে আমি ভালোবেসেছিলাম শুধু একজন ভালো বন্ধু হিসেবে। আর তোর দিদি তিস্তাকে জায়গা দিয়েছি আমার মনে। আমার মা,বাবারও তোর দিদিকে খুব পছন্দ,ওদেরও সায় আছে এই সম্পর্কে। আজ সন্ধেবেলা ওরা আসছেন বিয়ের পাকা কথা বলতে।কিছু খারাপ মনে করিসনা তোর ছটফটে, খামখেয়ালী স্বভাব আমাদের বাড়ির চিন্তাধারার সঙ্গে একেবারেই খাপ খায়না। বরং তোর দিদি তিস্তা একদম উপযুক্ত মানাইসই বউ। আজ সবটা জানালাম তোকে। এবার তো জানলি সবটা।অন্তত বন্ধুত্বটা রাখ আমার এটাই আবদার।"


বিতানের কথাগুলো শুনতে শুনতে  দু কোণ বেয়ে গরম বাষ্প ঝরে পরলেও তোর্সা স্পষ্টভাবেই বলে,"জানাসনি রে বিতান।বল পরিস্থিতির চাপে জেনে গেছি আমি অজান্তেই।তবে তোদের কারো উপর আমার কোনো রাগ নেই রে।তোরা দুজনেই আমার ভীষণ প্রিয়। তাই আমার জীবনের সবটুকু রং তোদের দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস তোরা।বন্ধুত্ব তার সাথেই রাখা যায় যে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে জানে।"



কথা বলা শেষ করে পিছন ফেরে তোর্সা।তিস্তা বলে,"কিন্তু বোনু তুই কোথায় যাবি এভাবে?একটিবার শোন আমার কথা।"


__"তোদের জন্য আমার সময় ঘড়ির কাঁটা এখানেই থেমে গেল দিভাই। এতদিন অনেক ভেবেছিস।তবে আর চিন্তা করিস না তুই। নিজের নতুন জীবন শুরু কর।এত বড় পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও রংহীন ক্যানভাসের মত হলেও একটা ঘর ঠিক জুটে যাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে। এখন আপাতত ওই বাচ্চাগুলোর নির্মল হৃদয়ের কাছে গিয়ে মুঠো ভরে কিছুটা অক্সিজেন নেব নতুন করে বাঁচার জন্য ।সুখী পরিসমাপ্তি, লালচে গোলাপ দিয়ে তো সব গল্পের উপসংহার টানা যায়না তাইনা?কিছু গল্প শেষ হয় গোলাপের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে। আমি সেই কাঁটাতার নিয়েই সুখী থাকতে চাই। আর চলি রে..."কথাগুলো শেষ স্কুটিটা নিয়ে অদৃশ্য হয় তোর্সা।


তিলোত্তমা মহানগরীর রাস্তায় তখন রঙিন নিয়ন আলো জ্বলে উঠছে একেএকে।রংহীন,বিবর্ণ হৃদয়ে এগিয়ে চলে তোর্সা।অদূরে কোনো চায়ের দোকান থেকে এফ.এমে ভেসে আসে,"শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি/তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি/তাই মুখ লুকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে/বসন্তের এই স্মৃতিচারণ/প্রেমে পড়া বারণ,কারণে অকারণ/মনে পড়লেও আজকে তোমায় মনে করা বারণ।।।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু