সত্যি হলেও গল্প
সত্যি হলেও গল্প
বুম বোস
(১)
"জয় জয় জয় জয়, হেএএএএএএ।" প্রেয়ারটা শেষ হওয়া মাত্রই ছেলেপিলে সব আলোর বেগ সহযোগে, ব্রাউনীয় গতির চরম নিদর্শন প্রদর্শন করে, ক্লাসের দিকে ধাবিত হলো। আর এই তীব্র ছুটোছুটির মাঝে গোটা কয়েক ধাক্কাধাক্কি, বার পাঁচেক ল্যাঙ মারামারি আর বেশ কিছু নতুন শেখা গালাগালির প্রয়োগ তো প্রায় রোজকার ঘটনা। তবে তরমুজ পাড়া হাই ইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী দের এরুপ ছোটাছুটির কারণ একটা রয়েছে বটে। কারণটি হলেন ওদের জীবনবিজ্ঞান শিক্ষক অর্ণব স্যার। এই রাগি, ববদমেজাজি মানুষটির ভয়ে ছাত্রছাত্রীরা একে বারে গুটিপোকার মত শিটিয়ে থাকে । জীবনবিজ্ঞান পড়ানোর ফাঁকে ছাত্রছাত্রীদের ভৌগোলিক মানচিত্র একেবারে ওলটপালট করে দিতে সিদ্ধহস্ত এই মহামানব। যদিও আবার স্যার পড়ান খুব ভালো। এ বিষয়টি অস্বীকার করার মত ক্ষমতা কারুর নেই। আর এইসব কারণেই ওনাকে সবাই একটু সমঝেই চলে। তার ওপর আজ আবার প্রথম ক্লাসটাই ওনার,তাই তো উনি আসার আগেই সবাই বইখাতা খুলে লক্ষ্মী ছেলেমেয়েদের মত পড়তে বসে গেছে। সত্যি, বেতের আঘাত মানুষ কে দিয়ে কি কি যে করায়, তার হিসাব নাই। যাইহোক ক্লাস শুরুর ঘন্টাটা পড়ার পরই সবাই একেবারে তটস্থ হয়ে অপেক্ষা করছে স্যারের জন্য, আর ঠিক তখনি টুয়েলভের একটা দাদা ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলল,' অর্ণব স্যার আজ আসেননি, ওনার শরীর খারাপ। তোরা মজা কর। ' ব্যাস, কথাটি শোনামাত্রই সবার মধ্যে এমন এক অপরিসীম ফুর্তির সঞ্চার হলো, যে দেখে মনে হলো সদ্য সব কটা নিউটনের চতুর্থ সূত্রটি আবিষ্কার করে, পাবলিশও করে ফেলেছে। তো এই অনাবিল আনন্দের মাঝেই ঋদ্ধি একটা মস্ত আড়মোড়া ভেঙে বলল,' যাক বাবা, আজ আর এই ফালতু জাইলেম ফ্লোয়েমের ছাতার মাথা নিয়ে ঝিক ঝিক করতে হবে না। '
' যা বলেছিস ভাই। স্যার ক্লাসে ঢুকলেই কেমন যেন একটা আতঙ্কের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যাই।' ইমন বললো।
দেবা জীবনবিজ্ঞান বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল,' থাক আর, কাব্যি করিস না। একদিন অর্ণব স্যারের ক্লাস অফ যাওয়া ইস লাইক গোল্ড ডাস্ট। সো এই অফ পিরিয়ডটা খুলে এনজয় কর।'
' ধুর আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না।' অমিত জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঋদ্ধি ওর কথা শুনে হেসে বলল, 'তাতো লাগবেই না, আঁখি স্কুলে আসেনি যে আজ। সবই বুঝি ভাই, মা আমায় রোজ লাঞ্চে ভাত দেয়, ঘাস না।'
'ধুর সেটা না।' অমিতের নাক লাল হয়ে গেলো। (এই ফাঁকে বলে রাখি অমিতের গায়ের রঙ শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুরর মতই উজ্জ্বল আর চকচকে।) যাই হোক অমিতের কথা শুনে ইমন বলল,' আরে লুকিয়ে কি লাভ বলতো? তুই কি ভাবিস আমরা কিছু বুঝি না?
' কিন্তু কি করি বলতো, কিছুতেই বলতে পারছি না।' অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
'আব আয়া উট পাহাড় কে নিচে। ' ইমন বেঞ্চে একটা চাপড় মারলো।
'কেনো বলতে পারছিস না? প্রবলেমটা কোথায়?' ঋদ্ধি জিগ্যেস করলো।
' ভয় লাগে রে,যদি ভুল বোঝে আমায়?'
' ধুর পাগলা, এত্ত ভয় পেলে চলে,স্মার্টলি গিয়ে যাস্ট বলে দে। মাউন্টেন ডিউ এর অ্যাড টা দেখিসনি, ডর কে আগে জিত হে রে পাগলা।' ঋদ্ধি হাতটা অবিকল এস আর কের মত দুদিকে ছড়িয়ে বলল।
'হ্যাঁ তা তোর অঙ্কে এত ভয় কেন একটু বলবি?' দেবা ফেচকিয়ে বলল।
'উস ডরকে আগে হাম যা নহি সকতে, ইসি লিয়ে।' ঋদ্ধি চোখ টিপলো। দেবা ওর মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল,'সত্যি ভাই!! তোর মত বাচাল গোটা পৃথিবীতে আর একটাও নেই। ' ঋদ্ধি জামার কলারটা তুলে বলল,' থ্যাংকস ফর দ্যি কমপ্লিমেন্ট। '
অমিত এবার ঠিক কবি সুকান্তর স্টাইলে বসে জিগ্যেস করলো, 'ওকে কি করে বলি বলতো ভাই?'
ঋদ্ধি অমিতের কাঁধে হাত রেখে গেয়ে উঠলো, 'ভালোবাসা নীল খামেদের ভেলা।'
'মানে?' অমিত ওর কথার কোনো তল পেলনা।
'মানে আবার কি!! একটা সুন্দর করে চিঠি লিখে ফেল। তারপর সেটা ওকে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।' ঋদ্ধি নিজের না গজানো গোফে তা দিয়ে বলল।
' ভাই নিচে তোর নামটা লিখিস কিন্তু, নাহলে আবার ঋদ্ধির সানাই বেজে যাবে।' ইমনের কথায় সবাই হোহো করে হেসে উঠলো।
(২)
'সবাই কাল ড্যাফোডিলস এর কোয়েশ্চন অ্যানসার গুলো পড়ে আসবি, লিখতে দেবো।' বলেই স্যার ক্লাস থেকে প্রস্থান করলেন। আর সাথে সাথেই টিফিনের ঘন্টাটাও পড়লো।আঁখি খাতা বই সব ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে টিফিন বক্সটা বার করলো। রিয়া পাশে বসে চুল ঠিক করছিল, ওর দিকে একগাল পরোটা এগিয়ে দিয়ে বলল,' এই অমিত ছেলেটা কেমন রে?'
' আমি কি করে জানবো?' রিয়া পরোটার গালটা মুখে পুরে দিয়ে, চেবাতে চেবাতে বলল।
' না তোরা একসাথে টিউশন পড়িসতো তাই জিগ্যেস করলাম।'
'হ্যাঁ পড়ি, বাট ওর সাথে আমার সাথে আমার সেরম আলাপ নেই। কিন্তু কেসটা কি বলতো? পছন্দ নাকি তোর?'
'আরে না রে। কদিন ধরে দেখছি, আমার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকে। আমার কেমন যেন লাগে। তাই তোকে বললাম।'
'দেখ তোকে হয়তো মনে ধরেছে ওর।'
'ধুর, তোর খালি একই কথা, ছাড়।'
' আমি কউনসা ধরে আছি যে ছাড়বো!! যাইহোক আমি বাথরুম যাচ্ছি,তুই যাবি?'
'না, তুই যা।' রিয়া হেসে চলে গেল। আঁখি আবার নিজের পরোটা আলুর তরকারিতে মনোনিবেশ করলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঠিক যখন মুখ ধুতে যাবে বলে উঠেছে, অমনি পেছন থেকে,'আঁখি' বলে একটি ডাকে ঘুরে তাকালো ও। দেখলো অমিত হাতে একটা খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
'কি হয়েছে?' আঁখি জিগ্যেস করলো।
' না কাল তুই আসিসনি তো তাই অর্ণব স্যারের ন-ন-নোটস গুলো এনেছি। টুকে নে,স্যার পড়া না করলে তো খুব বকে তাই আর কি।' ক্যালানের মত হাসলো অমিত।
' আমি তো রিয়ার থেকে নিয়ে নিয়েছি রে। '
'ওহ!! নিয়ে নিয়েছিস? আমি ভাবলাম....... আচ্ছা ঠিক আছে রে। ' অমিত নিজের বেঞ্চের দিকে পা বাড়ালো।
'ওই শোন।' ডাকলো আঁখি।
'হুম?'
আঁখি হেসে বলল,' থ্যাংস। '
অমিত হাসলো । এ হাসি সাধারণ নয়, এ হাসি অদ্ভুত এক ভালোলাগার ফসল। বলে বোঝানো যাবে না এই মুগ্ধতা। তা না যাক!
সব কি বলে বোঝানো যায়?
( ৩)
'স্যার আসবো?' টিচার্স রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, ভয়ে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলল অমিত। পেছনে ইমন, ঋদ্ধিরাও দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।' দরজার একদম সামনেই অরুণ স্যার, তাপশ স্যার আর অর্ণব স্যার বসেন। ইমনের গলা শুনে চোখ তুলে তাকালেন উনি। তারপর বাজখাঁই গলায় বললেন,' একজন এসো।'
অমিত হাতের খাতাটা নিয়ে এগিয়ে গেল স্যারের দিকে। তারপির খাতাটা স্যারের হাতে দিয়ে বলল,' এই উত্তর গুলোই তো বইতে আছে, আপনি তাও এক করে দিয়েছেন। মানে কি ভুল হয়েছে যদি একটু বলেন?'
স্যার এবার অমিতের পিঠে হালকা চাপড় মেরে বললেন,'এটুকু লিখলে কিছুই পাবে না খোকন। ইলাবোরেটই করোনি কেউ। সব কি শুধু টেক্সট বই পড়ে হয়? একটু এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দাও।'
' না মানে, স্যার?'
'আহ , যাও এখন। ' স্যার ধমক দিলেন। অমিত খাতাটা নিয়েই দে ছুট। বাইরে আসতেই ওকে সবাই ঘিরে বলল,' কি বললেন স্যার? '
অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,' এটুকু লিখলে হবে না, ইলাবোরেট করতে হবে, আর আর আর শুধু টেক্সট বই ফলো করলে হবে না।'
' নাও, বোঝো ঠেলা!! একেই এই ঢপের সাবজেক্ট, টেক্সট বইটাই পড়তে ইচ্ছে করে না, আবার নাকি রেফারেন্স। ধুর ধুর, ভাল্লাগেনা।' ইমন কাঁদো কাঁদো সুরে বলল।
' ছাড় এখন বাদ দে এসব। শুভেন্দু স্যারের অংক ক্লাস আছে, আমাদের আগে যদি উনি ক্লাসে ঢুকে যান, তাহলে খবর আছে।' ঋদ্ধি বলল।
অমিত বলল,' আমার অফিসে একটু কাজ আছে, তোরা ক্লাসে যা আমি দু মিনিটে আসছি।'
' ঠিক আছে, তুই জলদি কাজ সেরে আয়।' বলেই ওরা তিনতলার দিকে দৌড় দিল। অমিত চট করে অফিসে গিয়ে ওর স্কলারশিপটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েই সোজা হাঁটা দিল স্কুলের দক্ষিণ দিকে। ওদিকে আরেকটা সিঁড়ি রয়েছে, ওটা দিয়েই উঠে যাবে ও। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। টুয়েলভ কমার্সের ক্লাসের পাশ দিয়ে তিনতলা গামি সিঁড়িটা বেয়ে উঠতে শুরু করলো ও। একটা টার্ন নেওয়ার পরই ও দেখলো আঁখি গোড়ালি তে হাত দিয়ে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে সিঁড়িতে বসে। অমিত ছুট্টে ওর কাছে গিয়ে বলল, ' কি হয়েছে?? কাঁদছিস কেন?'
' পা টা মুচকে গেছে।'
'এ মা, কি করে!!' বলেই অমিত ওর পা থেকে যুতোটা খুলে গোড়ালিতে নিজের হাতটা ঘষতে শুরু করলো। তারপর গোড়ালিটা ধরে এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগলো হালকা করে। আঁখি অবাক হয়ে দেখছিল অমিত কে। খুব আপন মনে হচ্ছিল সামনের বোকাসোকা ছেলেটাকে। যে চোখ দুটো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর গোড়ালির দিকে, যে হাত দুটো শুধুই ওর ব্যথা নিরাময়ে ব্যস্ত, তারা অমন কেন?
কেমন? সেটা শুধু আঁখিরাই বোঝে, শুধু আঁখিরা।
' কি রে হাঁটতে পারবি এবার? নে আমার হাতটা ধর।' অমিত ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল আঁখির দিকে।
' হুম।' বলেই আঁখি আলতো করে ধরলো অমিতের হাতটা। তারপর আসতে আসতে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ধীর পায়ে, বেয়ারা সিঁড়ি, ফাঁকা করিডোর, হলুদ দুপুর পেরিয়ে ওরা মিলিয়ে গেল ক্লাসের দিকে।
( ৪)
ছুটির ঘন্টা পড়ার সাথে সাথেই সবাই হুরমুর করে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে স্কুলের মাঠে এসে জটলা করলো। দেবা সাইকেলের লকটা খুলতে খুলতে জিগ্যেস করলো, 'কি রে লিখলি চিঠিটা? ' অমিত মাথা নেড়ে বলল,'নাহ।'
'কেন?'
' খুব ভয় করছে রে। '
' ধুর, সেদিন যেভাবে তোর হাত ধরে ক্লাসে ঢুকলো, দেখে মনে হল অর্ধেক কাজ হয়েই গেছে, যাস্ট বলাটাই যা বাকি।'
'বাজে বকিস না দেবা। ওর লেগেছিল বলেই......।
' এই যে খোকনরা। ' অমিত কথাটা শেষ করার আগেই অর্ণব স্যারের ট্রেডমার্ক ডাক শুনে থমকে গেল । ঋদ্ধি পেছন ফিরে বলল, ' আমাদের ডাকছেন স্যার?'
' তা না তো কী, তোমাদেরই ডাকছি। শোনো এদিকে।' ওরা স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। স্যার ফুলহাতা জামার হাতাটা গুটিয়ে ঘড়িটা দেখলেন, তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন,'শোনো হে খোকাগন, আমার শরীরটা কদিন একদম ভালো যাচ্ছে না। তাই স্কুল থেকে আজ ছুটি নিলুম সাত দিনের জন্য। কিন্তু তোমাদের তো আবার সামনে টেস্ট, তাই নোটস গুলো আমি দিয়ে দিতে চাই। তোমরা এই কজন আমার বাড়ি চলো। তোমাদের আমি একটা খাতা দেব, জেরক্স করে ফেরত দিয়ে যাবে। আর খাতাটা যদি ছিঁড়েছে বা হারিয়েছে তাহলে প্রত্যেকের চামড়া আমি গুটিয়ে দেব,এই বলে রাখলুম।' স্যার রীতিমত গর্জে উঠলেন।
'আ-আ-আপনার বাড়ি?' ঋদ্ধি কোনোমতে বলল।
স্যার বললেন,' হ্যাঁ আমার বাড়ি।'
'কিন্তু আমরা তো আপনার বাড়ি চিনিনা স্যার।'
'সেটা আমি জানি, তোমরা আমার সাথেই যাবে।' বলেই স্যার স্কুল থেকে বেরিয়ে তরমুজতলা অটো স্ট্যান্ড এর দিকে হাঁটা দিলেন। অমিত,ঋদ্ধি, ইমনরাও পিছু নিল স্যারের। মিনিট দেড়েক হাঁটার পর ওরা অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেল। স্যার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অটোওয়ালার উদ্দেশ্যে বললেন,' কোনটা যাবে?'
'এই তো স্যার, আমারটাই যাবে, বসে পড়ুন। ' শোনা মাত্রই ওরা চটপট অটোয় উঠে পড়লো। অমিত, দেবা আর ইমন বসলো পেছনে, স্যার আর ঋদ্ধি সামনে। অটো চলতে শুরু করলো। ফুরফুরে স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে বেশ কিছুক্ষণ চলল এই অটো সওয়ারি। ঠিক জোড়া পুকুরের সামনেটা গিয়েই থেমে গেল অটোটা। স্যার বললেন,'চলো নেমে পড়ো। ' স্যারের কথামতই ওরা অটো থেকে নেমে পড়লো। এই জায়গাটার নাম অনেক বার শুনেছে ওরা,তবে আসা হয়নি কখনো। ওরা ভাবতো নিশ্চয়ই পর পর দুখানা পুকুর আছে বলেই জায়গাটার অমন নাম। কিন্তু অটো থেকে নেমে একটার বেশি দুটো পুকুর ওরা দূর দূর তাক দেখতে পেলনা। ঋদ্ধির ইচ্ছে হল ব্যাপারটা স্যারকে জিগ্যেস করার,কিন্তু সাহসে কোলালো না। স্যার অটোর ভাড়া টাড়া মিটিয়ে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন পুকুর লাগোয়া গলিটা ধরে। ঋদ্ধিরাও স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা সরু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এক তলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন স্যার। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন,'এসো, ভেতরে এসো। এটাই আমার বাড়ি।' ওরা একে একে গেট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। স্যার ওদের বারান্দায় যুতো খুলে ভেতরে আসতে বললেন। ওরা স্যারের নির্দেশ যথাযথ পালন করলো। অতঃপর ওরা স্যারের বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলো। বাড়িটা যে খুব একটা বড়ো তা কিন্তু নয়। ওই খান তিনেক ঘর, বারান্দা,রান্নাঘর, বাথরুম আর বাড়ির সামনে ছোট একটি উঠোন, এই হলো স্যারের বাড়ির বর্ণনা। স্যার বাড়ি ঢুকতেই চেঁচিয়ে বললেন,' কই গো, খেতে দাও, পেটে একেবারে ছুঁচোয় ডন মারছে।' রান্না ঘর থেকে 'যাই' বলে আরেকটি মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এল তৎক্ষণাৎ। ঋদ্ধি ইমনের কানে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলো,'স্যারেরও বউ আছে? কিন্তু কেন! মানে কি করে?' সত্যি ওদের অবাক হওয়ারই কথা। এরম একটা রাগি, বদমেজাজি লোকের যে বউ থাকতে পারে সেটা ওরা কোনো দিন ভাবেইনি।
' ও মা, এরা তোমার স্টুডেন্ট নাকি?' স্যারে স্ত্রী ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
'হ্যাঁ গো। ওদের কিছু নোটস দেওয়ার ছিল,তাই বাড়িতে নিয়ে এলাম। কাল থেকে তো আমার স্কুল যাওয়া হবে না।
' তা ভালোই করেছো। ' স্যারের স্ত্রী হাসলেন। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন,' তোদের সবার নাম কি রে?'
ঋদ্ধি হালকা হেসে বলল,' আমার নাম ঋদ্ধি সেন ম্যাম।'
'ওমা ম্যাম কি রে! দিদি বল। তোরা সব আমার ভাইয়ের বয়সী। '
'আচ্ছা তবে দিদিই বলবো। ' ঋদ্ধি আবার হাসলো।
'আর তোদের নাম?' ইমন, দেবা,অমিত একে একে নিজেদের নাম বলল। স্যারের এবার সবাই কে স্যারের ঘরে গিয়ে বসতে বললেন। ওরা ধীর পায়ে স্যারের ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরে ঢুকতেই ওরা দেখলো সারা দেওয়াল জুরে শুধু সৌরভ সচীন দ্রাবিড় দের পোস্টার। দেওয়াল আলমারি গুলো সবকটা বিভিন্ন রকম গল্পের বইয়ে ঠাঁসা। খাটের পাশে একটা তার ছেঁড়া গিটারও রাখা আছে, দেখলো ওরা। এই সব কিছু ওদের অবাক হওয়ার পরিমানটা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল।
'কি দেখছো হাঁ করে?' স্যারের ডাকে সম্বিত ফিরলো ওদের।
' না মানে, স্যার আপনি গিটার বাজাতেন?' ইমন প্রশ্ন করলো। স্যার সামনের চেয়ারটা টেনে বসলেন। তারপর বললেন,' ওই কলেজে থাকতে একটু আদটু।' ঋদ্ধি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনি স্যারের স্ত্রী অর্থাৎ ওদের সবার দিদি এসে প্রত্যেকের হাতে একটা করে মিষ্টির প্লেট ধরিয়ে দিলেন।
'ভালো করে, শান্তি করে খা বুঝলি। আরো লাগলে ডাকবি,আমি পাশের ঘরে আছি। ' বলেই দিদি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অমিত একটা রসগোল্লা মুখে পুরে স্যারের দিকে তাকালো। স্যারের পরণে এখন একটি ফতুয়া আর পাজামা। স্কুলের সেই রাগি,বদমেজাজি লোকটার সাথে এনার যেন কোনো মিলই নেই।
'তোমরা খেয়ে নাও, তারপর আমি তোমাদের খাতাটা দিচ্ছি।' স্যার বললেন।
'আচ্ছা স্যার আপনি এত গল্পের বই পড়েন নাকি?' ঋদ্ধি আবার স্যার কে জিগ্যেস করলো। স্যার হেসে পালটা প্রশ্ন করলেন,' কেন আমি পড়তে পারিনা?'
'না মানে, আমরা ভাবতাম আপনি শুধুই পড়াশোনা করেন। হাসেন না, সব সময় রেগে থাকেন। ' ঋদ্ধির এরুপ বোকা বোকা কথায় স্যার ও হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর চোখ বুজে বললেন,' তোদের দেখে আমার নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। আমিও ঠিক তোদের মতই ছিলাম। তোদের মতই প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি। এখনো আছি, তবে স্কুলে নয়। সত্যি স্কুলে আমার ইমেজটা বড্ড কাটখোট্টা রকমের। ' স্যার এত বছরে এই প্রথম ওদের সাথে তুই করে কথা বললেন। যাইহোক স্যারের কথা শুনে ইমন জিগ্যেস করলো,'কেন?'
স্যার হেসে বললেন,' আসলে ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি স্যার মানেই গম্ভীর, রাগি, বদমেজাজি একটা মানুষ। তারপর নিজে যখন স্কুলের চাকরিটা পেলাম তখন নিজেকেও ওইরকম একটি রাগি, গম্ভীর, বদমেজাজি শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নিযুক্ত করলাম। আসলে ভয় পেতাম জানিস, যদি স্টুডেন্টরা না মানে। কিন্তু বিগত দশ বছরের নিপুণ অভিনয় আমাকে এই গম্ভীর, বদমেজাজি, রাগি টিচারের ইমেজটা উপহার দিয়েছে। ' স্যার হাসলেন,তারপর আরো বললেন,' এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয় যে কেন তখন অত ভয় পেয়েছিলাম। আর ভয় পেয়েছিলাম বলেই আজ অবধি আমার কোনো স্টুডেন্ট আমায় ঠিক করে চিনতে পারেনি। তাদের প্রত্যেকের কাছে আমি সারা জীবম একজন রাগি, বদমেজাজি, মারধোর করতে ভালোবাসা টিচার হয়েই রয়ে গেলাম। ' একটানা বলে থামলেন স্যার। তারপর আবার বললেন,' এই ভয় জিনিস টা মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু জানিস। সব কাজ গোলমাল করে দেয় নিমেষে। অনেকে বলে যে "আমি ভয় পাই না" খুব মিথ্যে বলে। ভয় সবাই পায়, শুধু কেউ কেউ সেটাকে ওভারকাম করতে পারে, কেউ কেউ পারে না। এটাই তফাৎ। ' স্যার নিচে রাখা জলের বোতলটা হাতে নিয়ে একটু জল খেলেন। তারপর ঋদ্ধির দিকে তাকিয়ে বললেন,' এই যে আমাদের ঋদ্ধিকেই দেখ। সব সাবজেক্ট এ ভালো নাম্বার পায়, কিন্তু অঙ্কে প্রত্যেক বার কম পায়। কারণ ও অঙ্কটাকে ভয় পায়। ও যদি অন্য সাবজেক্ট গুলির মত অঙ্ককেও সমান গুরুত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে অভ্যাস করে তাহলে ও অঙ্কতেও ভালো নাম্বার পাবে। ' স্যারের কথা শুনে ঋদ্ধি পুরো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। স্যার ওর সম্মন্ধে এতটা খোঁজখবর রাখেন! ভাবাই যায় না।
স্যার এবার একটা জম্পেশ হাই তুলে বললেন, 'যাইহোক, অনেক জ্ঞান দিলাম তোদের। তোরা ভালো করে পড়াশোনা কর। সামনে টেস্ট তারপর মাধ্যমিক। ভালো রেসাল্ট করতেই হবে কিন্তু। কি করবি তো?' ওরা সবাই একসাথে বলল, ' হ্যাঁ করবো।'
'যাক, আমার চারজন স্টুডেন্ট অন্তত জানলো যে সবাই আমায় যতটা খারাপ লোক ভাবে ততটা খারাপ আমি নই। ' হালকা মেজাজে বলা স্যারের এই কথা গুলোতে কোথাও যেন একটা একটা চাপা দুঃখ, একটা অভিমান লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু কার ওপর স্যারের এই অভিমান? নিজের ওপর, নাকি বছর বছর ধরে যাদের পড়িয়ে এসেছেন সেই ছাত্রছাত্রীদের ওপর? এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় স্বয়ং স্যারের কাছেও নেই।
কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। বিকেল ফুরিয়ে এখন সন্ধে নামার পালা। এবার না বেরলে বাড়ি ফিরতে অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে। তাই ওরা আর কোনো কথা না বলে প্লেটে অবশিষ্ট মিষ্টান্নের ওপর মনোনিবেশ করলো।
ওদের খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ হওয়ার পর, স্যার টেবিল থেকে একটা খাতা নিয়ে ওদের হাতে দিয়ে বললেন,' এটা জেরক্স করে কাল পরশু নাগাদ আমার বাড়িতে দিয়ে যাস।' ওরা সবাই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো।
'আর হ্যাঁ, খাতাটা যদি সুস্থ সবল ফেরত না পাই,তবে কিন্তু পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে নেব, এই বলে রাখলুম।' কথাটি বলে স্যার নিজেই হেসে ফেললেন। ঋদ্ধি,ইমন,দেবা,অমিতরাও পালটা হেসে সেদিনের মত বিদায় নিল স্যারের কাছ থেকে।
(৪)
স্যারের বাড়িতে কাটানো সেই বিকেলটি ওদের জীবনে কি এমন পরিবর্তন এনেছে তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু বলতে পারি যে ভয়কে এখন আর ওরা তেমন ভয় পায়না। ওরা বুঝেছে যে ভয় একটা অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং ওরা ভয় কে কন্ট্রোল করবে, ভয় ওদের নয়।
ঋদ্ধি এখন আর ভয় পেয়ে অঙ্ককে দূরে সরিয়ে রাখে না। রোজ সকালে দু ঘন্টা বিকেলে দুঘন্টা বসে অঙ্ক করে। ভুল হলে আবার করে,কিন্তু হার মানে না কিছুতেই।
অমিতও আজ নিজের সমস্ত ভয় দীমা নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে একটা পাতা চারেকের চিঠি লিখেই ফেলেছে। তারপর নিজের হাতে বানানো নীল খামটাতে ভরে নিয়ে এসেছে স্কুলে। মনের সব এলোমেলো কথা গুলো আঁখিকে জানানোর সময় এসে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই টিফিনের ঘন্টা পরবে, আর তখনই.......
' অমিত পড়া শুনছিস না কেন?' পিউ ম্যামের ধমকে সম্বিত ফিরলো ওর।
' বল আমি এক্ষুণি কি পড়ালাম?'
' ভূগোল। ' অমিতের উত্তরে ক্লাসের সবাই হ্যা হ্যা হেসে উঠলো। ম্যামও মৃদু হেসে বললেন,'দাঁড়িয়ে থাক।' বলেই ম্যাম আবার পড়ানোয় মন দিলেন। ম্যামের ক্লাসটা শেষ
হতেই টিফিনের ঘন্টা পড়ে গেল। দেবা,ঋদ্ধি, ইমন সবাই খোঁচাল অমিত কে,' কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা চিঠিটা দিয়ে আয়।'
' ম্যাম সবার সামনে আমায় অমন করে বলল, ও কি ভাবলো তো!!!'
'ধ্যার, তুই যাবি না ক্যালাবো?' দেবার ঘুসি পাকালো।
'যাবো?' ঋদ্ধি, দেবা,ইমন সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো,'যাআআআআআআআ।' অমিত সাথে সাথে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বার করে লাফিয়ে বেঞ্চ থেকে বেরলো। তারপর ছুটে একেবারে আঁখির সামনে গিয়ে বলল,' একটু শুনবি?'
'হ্যাঁ বল।' অমিত নীল খামে মোড়া চিঠিটা আঁখির হাতে দিয়ে বলল,' এটা তোর জন্য, পড়ে দেখিস একটু। ' চিঠি টা আঁখির হাতে দেওয়া মাত্রই ওপারের বেঞ্চ থেকে দেবা, ঋদ্ধি, ইমনরা, 'ইয়েএএএএএএএ' বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আঁখি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অমিতের দিকে। ওদিকে সব নাচতে শুরু করে দিয়েছে। এক অদ্ভুত আনন্দে আজ মাতোয়ারা সবাই। হবে নাই বা কেন!! এ যে শিকল ভাঙার আনন্দ, এ যে ভয় কে জয় করার আনন্দ।
আসলে পৃথিবীতে সব কিছুই আপেক্ষিক, ধ্রুবক তো শুদুমাত্র স্মৃতিরা। আজ থেকে বছর দশেক পর এই বন্ধুত্ব,প্রেম, আনন্দ, ভালোলাগা গুলি থাকবে কিনা জানা নেই কারুর। তবে স্যারের বাড়িতে কাটানো ওই বিকেলটা, আনন্দময় এই টিফিনের সময় টুকু প্রত্যেকের স্মৃতিতে রয়ে যাবে আজীবন।
********
এ মা, আঁখি চিঠিটার কি উত্তর দিয়েছিল বলা হলনা আপনাদের। আচ্ছা সেটুকু নয় না বলাই থাক। হয়তো ওদের দুজনের মাঝে প্রেম এসেছিল,কিংবা আসেনি। কিন্তু এটা নিছক প্রেমের গল্প নয়, এটা তো সেই ভয় কে গো হারা হারিয়ে দেওয়ার গল্প,যে ভয়ের ভয়ে কত অঙ্ক না করাই রয়ে যায়, কত প্রেম না বলাই রয়ে যায়। তাই না?
