গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম
"কাশীরাজের তিন কন্যার একসাথে স্বয়ম্বরসভার আয়োজন করা হয়েছে।
ভারতের পরাক্রমশালী সমস্ত রাজ্যের রাজা বা যুবরাজরা সেই সভায় আমন্ত্রিত। আমি চাই, তোমার ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে কাশীকুমারীদের বিবাহ স্থির হয়।কাশী শক্তিশালী রাজ্য, বৈবাহিক আত্মীয়তা স্থাপিত হলে তা হস্তিনাপুরের পক্ষে মঙ্গলজনক।"
-"আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ সহমত মাতঃ, কিন্তু স্বয়ম্বর সভায় কন্যারা স্বীয় ইচ্ছায় বরমাল্য প্রদান করবে, কিভাবে তাদের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করব, জননী? আমি বলি কি..."
কথা শেষ করার পূর্বেই সপত্নীপুত্র ভীষ্মকে নিরস্ত করেন সত্যবতী।
-"তুমি স্বয়ম্বরের পূর্বেই আমাদের প্রস্তাব বুঝিয়ে বলবে, প্রয়োজনে রাক্ষস বিবাহের ব্যবস্থা করবে।
মোট কথা কাশী কুমারীরা হস্তিনাপুরের বধূ হোক এই আমার ইচ্ছা।"
-"যে আজ্ঞা মাতঃ।"
সত্যবতী কক্ষনিষ্ক্রান্ত হবার পরেও গঙ্গাপুত্র চিন্তাচ্ছন্ন রইলেন।
সেই কোন শৈশব থেকে তিনি পিতার স্নেহে বড় হয়েছেন, স্মৃতিপটে কখনোই মায়ের ছবি ভাসে না। পিতা তাঁকে যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত করার পূর্বেই ধীবররাজ সত্যবতীর প্রেমে পড়েন। ধীবররাজের নিকট বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে গেলে তিনি তাঁর দৌহিত্রের রাজ্যাধিকার দাবী করায় বিষণ্ণ শান্তনু অসম্মত হন। জ্যেষ্ঠ পুত্রের সাথে এরূপ অন্যায়আচরণ তাঁর সাধ্যাতীত।
সত্যবতীকে ভুলতে পারলেন না রাজা, নিরুৎসাহী হয়ে পড়লেন রাজকার্যে।
অমাত্যদের কাছে সব শুনে দেবব্রত ছুটে গিয়েছিলেন সত্যবতীর পিতার কাছে।
প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পিতার রাজ্যের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী হবে সত্যবতীর সন্তান। আমৃত্যু বিবাহ পর্যন্ত করবেন না, যাতে তাঁর সন্তানও রাজ্যের দাবী না করতে পারে!
এমন ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে নিজের সুখ স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে প্রৌঢ় পিতার সুখ ক্রয় করেছিলেন দেবব্রত, তাই তাঁর অপর নাম ভীষ্ম।
সেই থেকে অদ্যাবধি সত্যবতী এবং তাঁর পুত্রদের মঙ্গলকারী কার্যে লিপ্ত রেখেছেন নিজেকে।
কিন্তু আজ বিমাতা যে আদেশ করে গেলেন তা কি আদৌ করা উচিৎ?
ক্ষত্রিয়দের মধ্যে হরণপূর্বক বিবাহ বৈধ, কিন্তু তা কি একজন নারীর পক্ষে অবমাননাকর নয়?
-"না না কুমার, আমি বিচিত্রবীর্যের মত নির্বীর্য পুরুষের সাথে আমার কন্যাদের বিবাহ দিতে প্রস্তুত নই।
আপনি নিজে যদি বিবাহে সম্মত হন তাহলে তবু বিবেচনা করতে পারি!"
-"তা হয়না রাজন, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।"
-"আমাকে ক্ষমা করবেন, আমিও অপারগ।"
কাশীরাজের প্রত্যাখ্যানে জ্বলে উঠলেন ভীষ্ম।
পরদিন স্বয়ম্বরসভায় নিজেই উপস্থিত হলেন।
পরিণত রাজপুত্রের চেহারায় অটল গাম্ভীর্য, কেশে রুপোলী ঝিলিক দেখা দিলেও শরীরের প্রতিটি পেশীতে দর্পিত যৌবনের উদ্ভাস।
কাশীকন্যাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠা অম্বার মুগ্ধ দৃষ্টি পড়ল এই পরিণতবয়স্ক যুবাপুরুষের দিকে। কে এই তরুণকান্তি?
তিনি যে পূর্বেই স্থির করে রেখেছেন প্রেমিক শাল্বরাজকে মাল্যদান করবেন, কিন্তু এই পুরুষকে দর্শন করে তাঁর কুমারী চিত্তে অকস্মাৎ একি চাঞ্চল্য উপস্থিত হল!
অম্বার বিমনা ভাব শাল্বরাজের নজর এড়াল না।
ক্রুদ্ধ শাল্ব উপহাসের সুরে বলে উঠলেন, "যৌবনের উপবনে কে এই রসভঙ্গকারী বৃদ্ধ?"
উপস্থিত রাজন্যবর্গের মুখে চাপা হাসি।
অম্বা দুঃখিত হলেন।
গঙ্গাপুত্রের শরীরের পেশীগুলি সর্পসম ফুঁসে উঠল।
বীর বিক্রমে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে লাফিয়ে নামলেন সভায়।
-"আমি কুরুরাজ শান্তনুর পুত্র মহামতি ভীষ্ম। এই মূহুর্তে কাশী কন্যাদের আমি হরণ করে নিয়ে যাচ্ছি, আমার ভ্রাতা ভবিষ্যত কুরুরাজ বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহের উদ্দেশ্যে।
কারুর ক্ষমতা থাকলে বাধা দিয়ে দেখুক।"
পরাক্রমী কুরুবংশের কথা শুনে ভয়ে বাকী রাজারা অধোবদন হলেও শাল্ব সম্মুখসমরে অগ্রসর
হলেন। তিলোত্তমা সুন্দরী অম্বাকে তিনি কোনমূল্যে হারাতে রাজী নন।
ভীষ্ম ততক্ষণে সভাদ্বারে দণ্ডায়মান রথে নিয়ে গিয়ে তুলছেন কন্যাদের।
অম্বিকা, অম্বালিকা অশ্রুমুখী ভয়চকিতা হলেও অম্বার মুগ্ধদৃষ্টি তেজোদীপ্ত কুমারের দিকে।
পলকে ভীষ্মের হৃদয়েও মৃদু শিহরণ লাগল!
এই নারীর দৃষ্টির মোহমায়ায় তিনি কি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন?
ভীষ্ম শাসন করলেন নিজের চিত্তকে।
এই কন্যা তাঁর ভ্রাতৃবধূ হবেন!
ভীষ্মের কাছে পরাজিত অপমানিত শাল্ব অম্বার দিকে চাইলেন, সে চোখে শাল্বর প্রতি প্রেম মমতা নেই, আছে বীর ভীষ্মর প্রতি প্রশংসা মুগ্ধতা।
রথ চলেছে হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে।
কিছুসময় পরেই অম্বা নিজের মনের কথা জানালেন ভীষ্মকে।
-"আমি আপনার বীরত্বে মুগ্ধ কুমার। আপনার ভ্রাতা নয় আমি আপনাকেই পতি হিসাবে কামনা করি।"
লজ্জারুণ অম্বার কথা শুনে রথের গতি স্তব্ধ করেন গঙ্গাপুত্র।
-"তা হয়না কন্যা, আমি বিবাহ করতে অপারগ।"
-"তাহলে কেন আমাকে নিয়ে এলেন?"
অম্বার নারীহৃদয় প্রার্থিত পুরুষের প্রত্যাখ্যান সইতে পারল না।
-"আমি শাল্বরাজের বাগদত্তা, এই দণ্ডেই ফিরিয়ে দিয়ে আসুন আমাকে।"
ভীষ্ম পলকের জন্য ভাবলেন, তারপর রথের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিলেন শাল্বরাজ্যের দিকে।
-"আমি পরপুরুষ দ্বারা কন্যার পাণিগ্রহণে অসমর্থ।
অম্বা উচ্ছিষ্টা।"
লাঞ্ছিতা অম্বা ভীষ্মকেই দায়ী করলেন, "আজ আপনার জন্য আমার এই অবস্থা। ঘরে বাইরে আমি পরিত্যক্তা।"
ভীষ্মগুরু ভগবান পরশুরামের কাছে প্রতিবিধান চাইলেন কন্যা।
গুরু শিষ্য জড়িয়ে পড়লেন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে।
কেউই হার মানেন না।
প্রমাদ গুণলেন দেবতারা।
সৃষ্টি যে রসাতলে যাবে!
নিরস্ত করলেন দুপক্ষকেই।
অম্বাকে বরপ্রদান করতে চাইলে আহত ফণীনি সমা কন্যা পরজন্মে ভীষ্মর মৃত্যুর কারণ হতে চাইলেন।
ভীষ্ম সব শুনলেন, তবু প্রতিজ্ঞার নিগড়ে বাঁধা মানুষটা একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন না। কন্যার দুর্ভাগ্যের জন্য তিনি দায়ী ঠিকই, কিন্তু এমন বরণীয়া কন্যার প্রেম পেয়েও তা ফিরিয়ে দিয়ে তিনিও কি দুর্ভাগা নন?
চোখের সামনে ক্ষণিকের জন্য দুর্বল হওয়া কন্যার মৃত্যু দেখলেন বিষণ্ণ রাজকুমার, তবু বাধা দিতে পারলেন না।
হায়রে জীবন!
*****
অম্বা কন্যারূপে শিখণ্ডী নামে জন্ম নিলেন দ্রুপদরাজার গৃহে। পিতা সর্বসমক্ষে তাঁর নারীপরিচয় গোপন রাখলেন।
পুত্র পরিচয়ে শিখণ্ডীর বিবাহ দিলেন হিরণ্যবর্মার কন্যা র সঙ্গে।
বিবাহের পরেই তার পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ায় ক্রুদ্ধ হিরণ্যবর্মা পাঞ্চালরাজ্য আক্রমণ করলেন।
গতজন্মের দুর্ভাগ্য এই জন্মেও পিছু ছাড়ল না।
আত্মহননের উদ্দেশ্যে শিখণ্ডী গভীর অরণ্যে পালিয়ে এলেন।
সেখানেও বিপত্তি। দেখা হল এক যক্ষের সাথে।
পূর্বজন্মের অপমান বিস্মৃত হননি কন্যা। ভীষ্মবধের সংকল্প তার হৃদয়ে জাগ্রত।
যক্ষের নিকট পুরুষ হওয়ার বর চাইলেন।
মহামতি ভীষ্মর আরও একটি প্রতিজ্ঞার কথা কন্যা জানেন।
রূপান্তরকামী, নারী এবং দুর্বলের সম্মুখে অস্ত্রপরিহার করার শপথে আবদ্ধ শান্তনুপুত্র।
ভীষ্মও শিখণ্ডীর সব কথা অবগত হয়েছেন। তাকে তিনি ঘৃণা করেন।
পরবর্তীকালে কুরু পাণ্ডব যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ায় বিষণ্ণ পিতামহ স্নেহাস্পদ পান্ডবদের পক্ষ গ্রহণ করলেন না, তিনি যে কুরুরাজসিংহাসনের রক্ষাকর্তা।
অস্ত্র ধরতে বাধ্য হলেন অতিপ্রিয় পৌত্র অর্জুনের বিরুদ্ধে।
হায়! কি ভীষণ প্রতিজ্ঞার নাগপাশে তিনি আবদ্ধ আজীবন।
যুদ্ধের নয়দিন অতিক্রান্ত।সম্মুখ সমরে কোনমতেই পিতামহের সাথে এঁটে উঠতে পারছেন না পাণ্ডবরা।
কৃষ্ণের পরামর্শে গোপনে তাঁরা শত্রুশিবিরে উপস্থিত হলেন। পিতামহের নিকট তাঁকে পরাস্ত করার উপায় জানতে চাইলেন তাঁরা।
মহান মানুষটি হাসছেন মৃদু মৃদু।
নিজের মৃত্যুবাণ তুলে দিলেন প্রিয়পাত্রদের হাতে।
"আমি কোনো রূপান্তরকামী মানুষের সম্মুখে অস্ত্র ধরি না।
শিখণ্ডীকে সামনে রেখে আমাকে ধরাশায়ী কর।
তবে মৃত্যু আমার স্বেচ্ছাধীন।
অবশ্য তাতে তোমাদের জয়লাভে বিঘ্ন ঘটবে না।"
পিতামহকে প্রণাম করে বিষণ্ণ পার্থ কুরুশিবির ত্যাগ করলেন।
যুদ্ধের দশমদিনে শরশয্যা নিলেন ভীষ্ম। পাণ্ডবরা নিষ্কন্টক হলেন।
প্রতিজ্ঞাপূর্ণ হল অম্বা তথা শিখণ্ডীর।
সূর্যের উত্তরায়ণের অপেক্ষায় মৃত্যুকামী মানুষটা কি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে একবারও ভাবলেন অম্বার প্রণয়কামী সেই দৃষ্টির কথা!