বাজলো খুশির ঘণ্টা
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে একটা ছোট্ট ভাতঘুম দিয়ে উঠে প্রতিদিনের অভ্যাসমত আজও বারান্দায় এসে বসেন অংশুমানবাবু। বাড়ির সাবেক আমলের ঘড়িটা ঢংঢং করে স্বশব্দে ঘোষণা করে চারটে বাজে। অদূরে খেলার মাঠে বাচ্চাগুলো রঙিন প্রজাপতির মত কেউ বল,কেউ টেনিস রাকেট নিয়ে খেলাধুলো করছে। ওদের দেখে অংশুমানবাবুর মনে হয় বড়দিন আর ইংরেজি বর্ষবরণের রেশ এখনো সেভাবে কেটে উঠেনি ওদের। অবশ্য এইতো আনন্দ করার বয়স।আর একটু পরে দিনের আলো এবার নিভতে শুরু করলেই যে যার বাড়ি ফিরে যাবে।আস্তে আস্তে জ্বলে উঠবে নিয়ন আলোর সারি। কুয়াশার আস্তিনের ঘেরাটোপে একহাত দূরের জিনিসও অদৃশ্য হবে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। তবে শুধুই কি প্রকৃতির? মানুষের জীবনেও কি একটা সময় এমন অন্ধকার এসে ভিড় করেনা।এই যেমন ওনার ক্ষেত্রেই।
এককালে কত রঙিন ছিল জীবন।
টাকাপয়সার অভাব থাকলেও একসাথে সকলে মিলে হইচই করে সব ভুলে একসাথে বাঁচা যেত। কত টুকরো টুকরো সুমধুর স্মৃতির পসরা মনে এসে ভিড় করে আজ। ওপার বাংলা থেকে ঘরছাড়া হয়ে দক্ষিণ কলকাতার বাঘাযতীন এলাকার উদ্বাস্তু কলোনিতে এসে ওঠা তখনকার ছোট্ট অংশুর। বাবা এদেশে এসে ধর্মতলায় একটা অফিসে কেরানীর চাকরি জুটিয়েছিলেন। মা,বাবা আর অংশুরা পাঁচ ভাইবোন।সব মিলিয়ে সাতজনের পেট চলত বাবার স্বল্প ওই রোজগারে। হারিকেনের আলোয় মাদুর বিছিয়ে একসাথে চলত পড়াশুনো। কেউ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে তার কপালে ওমনি তালপাতার পাখার ডাটির প্রহার চলত উত্তমমধ্যম। আবার এমন শীতকালে পরীক্ষা মিটে যাবার পর ছুটির দিনে সবাই মিলে একসাথে কখনো চিড়িয়াখানায় আবার কখনো বা ময়দানে পিকনিক করতে যাওয়া হত। ডান্ডি বা পাম কেকের কাগজের প্যাকেট ছাড়িয়ে নিজের কথা একটুও না ভেবে মা যখন ওদের ভাইবোনদের হাতে ছোট্ট ছোট্ট টুকরোগুলো সযত্নে তুলে দিতেন কি অদ্ভুত সুন্দর,মায়াময় লাগত মায়ের লক্ষ্মী প্রতিমার মত ঢলঢলে মুখখানা।এলো খোঁপা থেকে নারকেল তেলের এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ পেত অংশু।কোথায় যে হারিয়ে গেল সোনাঝরা দিনগুলো। আস্তে আস্তে বড় হয়ে চাকরি বাকরি পাবার পর যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকল। বোনের বিয়ের বছর পাঁচেক পর বাবাও মারা গেলেন।বাবার পিছু পিছু মাও চলে গেলেন তার বছর দুয়েক পর।অংশু তখন আকাশবাণীতে কর্মরত। কত কর্মব্যস্ততার জীবন। সদ্য বিয়ে করেছেন কত দায়দায়িত্ববোধ।বাড়িতে স্ত্রী অমিতা,দুই যমজ সন্তান। ছেলে রুবেল আর মেয়ে রাকা। ওদের বড় করা নিয়ে কত ভাবনা। একটু বেশি রোজগারের আশায় চাকরির পর টিউশন সেরে তারপর বাড়ি ফিরতেন অংশু। অনেক খেটেখুটে সোনারপুর এলাকায় তিনকাঠা জমি কিনে নিজের বাড়িও করেছিলেন। অবশ্য সংসারের দিকটা পুরোটাই সামলাতেন স্ত্রী অমিতা।কোনো বাজে খরচ করতেন না অংশু।
নেশার মধ্যে একটাই ছিল সেটা হল মাছ ধরা। আর সেই মাছ ধরার সঙ্গী ছিল পুরনো পাড়ার বন্ধু নীরেন ওরফে নীরু। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিপ ফেলে বসে থাকতেন দুই বন্ধু মিলে ছুটির দিনে। এমন কত দিন আছে কতক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো মাছ পড়েনি। তবুও ফেরার পথে কত আনন্দ করে রাস্তার দোকান থেকে চা, সিঙ্গাড়া বা কচুরি, জিলিপি খেতে খেতে কতদূর রাস্তা হেঁটেছেন দুজনে একসাথে।এরপর হটাৎ বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে। নীরেন একটা ভালো চাকরির অফার পেয়ে চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যে। সময়ের কাঁটা বেয়ে পার হতে হতে অংশুমানের জীবন এখন শান্ত নদীর মত। মেয়ে রাকার বিয়ে হয়ে গেছে দিল্লিতে। আর ছেলে রুবেল কাজের সুত্রে ব্যাঙ্গালোর। ওদের হাবেভাবে বোঝা যায় ওরা আর কলকাতায় ফিরতে আগ্রহী নয় বরং আরো দূরে দেশের সীমানা পেরিয়ে যেতে পারে যদি সেটাই ওদের ইচ্ছা। অমিতাও সারাদিনের কাজশেষে কোনোদিন স্থানীয় লাইব্রেরী যাওয়া বা আশ্রমের পুজোপাঠ নিয়ে আছে। অংশুর জীবন খালি একরাশ শূন্যতা। শীতে যেমন পাতা ঝরে চারদিকটা ধুলিধূসর ঠিক তেমন। যদি বন্ধু নীরেনকে খুঁজে পাওয়া যেত খুব ভালো হত। হটাৎ এসব ভাবতে ভাবতে মনের দুর্ভাবনার কালো মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের রুপোলি রেখার মতো উঁকি দেয় একটা মুখ।
আচ্ছা ওবেলা বাজার যাবার পথে রিকশা থেকে নামার সময় হোঁচট খেয়ে যখন উনি পড়ে যাচ্ছিলেন সেইসময় যে ছেলেটি ওনাকে কায়দামত ধরে ফেলে তার মুখটা অবিকল ওনার বন্ধু নীরেনের মত দেখতে ছিলনা! না কোনো ভুল হচ্ছেনা ওনার। স্মৃতিপটে আরো একবার ঝালিয়ে নেন মুখটা। তবে ন নীরেন কি করে এখানে আসবে? বাঘাযতীনেই তো ওদের নিজেদের বাড়ি ছিল। তবুও একবার খোঁজ নিয়ে দেখবেন কি? কি যেন বলেছিল ছেলেটা রেললাইন টপকে ওইপারে ওদের বাড়ি, নাম নীলাদ্রি বসু।বেশ পরোপকারী ছেলেটা। আজকাল অনেকেই যখন বিপদ দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় সেখানে কেমন সুন্দর এগিয়ে এলো। বাজার শেষে আবার ওনাকে রিকশায় তুলে দিয়ে তবে বাড়ি ফিরল। ছেলেটিকে একদিন নিজের বাড়ি আসার জন্য বলেছেন অংশু, সেইসাথে নিজের কার্ডও দিয়েছেন। ওই নীলাদ্রিই কি তবে নীরেনের ছেলে?পায়ের ব্যথাটা না থাকলে আজই গিয়ে খোঁজ নিতেন। একটু কমলে একদিন গিয়ে ঠিক খোঁজ নিয়ে আসবেন।
এটা ওটা ভাবনার পাখা ভালোই পাল মেলেছিল এমনসময় কলিংবেল বেজে উঠতেই অংশু শুনতে পান উদাত্ত কণ্ঠ,"খুঁজে দিতে না পারলে আড়ি/আমার ব্যোমকেশ বক্সীর থুড়ি অংশুর বাড়ি?";আরে এতো নীরেনের কন্ঠস্বর। বহুবছর পর হলেও এই গলা কি ভোলা যায়? সাথে সাথে ভেসে আসে অংশুর গিন্নী অমিতার গলা,"কই গো দেখবে এসো কে এসছে?সত্যি নীরেন ঠাকুরপো কতদিন পর দেখা হল আবার।"কোনমতে পায়ে ব্যথা নিয়ে হলেও ড্রইংরুমে ছোটেন অংশু। দেখা হয় দুই বন্ধুর।জড়িয়ে ধরেন দুজন দুজনকে বুকের মাঝে। ওদের চোখে তখন খুশির জলের বন্যা বইছে। শুরু হয় কথার ফুলঝুরি।
__"কিরে তুই আবার কবে সোনারপুরে ঘাঁটি গেড়ে বসলি? ও দেশ থেকে কবে এলি? তোদের বাঘাযতীনের বাড়ির কি খবর?",অংশু একের পর এক বলেই চলেন।
মৃদু হেসে নীরেন বলেন,"দেশে ফিরেছি বছর খানেক। পুরনো আমলের বাড়ি। সারাই করার অনেক ধকল।ভাইরা তাই সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ওই পুরনো বাড়িটা প্রোমোটারকে দিয়ে যে যার সুবিধামত জায়গায় ফ্ল্যাট নিয়ে নেবার। তাই শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে এদিকেই চলে এলাম। তাছাড়া তোর সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাও মাথাতে ঘুরছিল প্রতিনিয়ত। জানতাম ঠিক দেখা হবেই। আজ নীলাদ্রি ওবেলা বাড়ি ফিরে পুরো ঘটনা খুলে কার্ডটা দেখাতেই ভাবলাম এই অংশু তুই ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। তখনই ঠিক করলাম সন্ধেবেলা তোর বাড়ি এসে হানা দিয়ে চমকে দেব একেবারে।"
__"একদম প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করেছিস।চল আসছে রবিবার কোথাও গিয়ে মাছ ধরে আসি আগের মত। যদিও সেই অভ্যেস আর নেই তবু ইচ্ছেটা তো আগের মতই আছে";অংশু বলেন।
ততক্ষণে গরম গরম চা, সিঙ্গাড়া, জিলিপি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছেন অমিতা। ওদের দুজনের কাণ্ড দেখে বলেন,"সত্যি তোমরা পার বটে দুজনে। এতদিন পর দেখা হল দুই বন্ধুর ওমনি মাছ ধরতে ছুটবে। বরং চলো দুই পরিবার মিলে একসাথে পিকনিক করা যাক। ঠান্ডাটা একটু কমুক, মাছ ধরা নিশ্চয় হবে। "
__"দারুণ বলেছেন বৌদি। ট্রামলাইন, ময়দান,ভিক্টোরিয়া,ঘোড়ার গাড়ি আরো কত কিছু আছে আমার এই চেনা শহরে। নতুন করে এই শহরটা ঘুরে দেখা যাবে একবার।"অমিতার কথায় সায় নীরেনবাবু বলেন।
__"সে তো বটেই।তবে আয় দুই প্রাণসখা মিলে আপাতত এই শীতসন্ধ্যায় চা আর বাকি খাবারগুলোর সদগতি করি।",অংশুমান বলেন গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে।
দুজন প্রবীণ মানুষকে এভাবে ছেলেমানুষী করতে দেখে নীলাদ্রি সেটা বন্দী করে মুঠোফোনের ক্যামেরায়।সত্যি এবারের নতুন বছরের প্রাক্কাল জমে গেছে দুই বন্ধুর দুজন দুজনকে ফিরে বাবার আনন্দে। হোকনা বেলাশেষ। জীবনের ঘণ্টায় খুশির জিঙ্গেল বেল বাজিয়ে নতুন ছন্দে আরো একবার শুরু করলে ক্ষতি কি!
