বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মাম্পি

ভারত টিভির রিপোর্টার - ম্যাডাম আপনার পরিচালিত "মাম্পি" সিনেমাটা স্পেনের আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে একাধিক পুরস্কার জিতে নিয়েছে। শ্রেষ্ঠ পরিচালিকার জন্য আপনাকে আমরা ভারত টিভির তরফ থেকে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন.. 

 

পরিচালিকা নন্দনা দাস সেন- থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। হ্যাঁ বলুন; কি প্রশ্ন আছে আপনার?

 

রিপোর্টার- আপনারই লিখিত এই সাধারণ মেয়ের গল্পে একটা সুন্দর উত্তরণের বার্তা আছে। এই গল্পটা আপনার মাথায় কিভাবে এল ম্যাডাম? আমাদের দর্শকদের যদি একটু বলেন..

 

নন্দনা- এই মাম্পির মতো অতি সাধারণ দেখতে শ্যামবর্ণ কালো মেয়ে আমাদের চারপাশে অনেক ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদের পাত্রপক্ষ  বারবার রিফিউজ করছে। এই মেয়েটিও সেরকম।  দুশ্চরিত্র পিতার কন্যা হওয়ার জন্য৷ অথবা তার কুরূপা বদনামের জন্য; সে বার বার পাত্রপক্ষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। সেই অপমান ভুলতে  বিবাহিত অপ্রেমিকের কাছে নিজের প্রেমের প্রকাশ চাইছে।

 

রিপোর্টার - ফিল্মের শুরুতে, কলেজ পড়ুয়া মাম্পি ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। আর ফ্লাশব্যাকে দক্ষতার সাথে গল্প বলে যান লেখিকা।

 কয়েকবার স্কুলে ফেল করে এখন কলেজে জুনিয়র মেয়েদের সাথে পড়তে বাধ্য হয় মাম্পি। শরীরে মনে অন্য সহপাঠীদের থেকে এগিয়ে সে নিজের অজান্তেই প্রেমে পড়ে এক পুরুষের। পরে প্রকাশ পায় পুরুষটি বিবাহিত।তবু্ও প্রেম ঘন হয়। দীঘার হোটেলে কুশলের  শয্যাসঙ্গী হবার ঘনিষ্ট মুহুর্তে মাম্পি ছিটকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করে শৈশব কৈশোর জুড়ে পোড়াতে থাকা স্মৃতির স্বপ্নদৃশ্য। মন ক্যামেরা সব ধরে রাখে।। যেখানে সে দেখতে পায় শৈশবে তাকে একা ফেলে রেখে তার মায়ের হিল খটখটিয়ে চলে যাওয়া পরপুরুষ  প্রেমিকের কাছে।  ছোট্ট মাম্পি তার মায়ের ছেড়ে যাওয়া কাপড়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ে ভেজা চোখে। 

ম্যডাম,আপনি  কি চাইল্ড সাইকোলজিতে মেয়েটির মায়ের প্রতি অবচেতনে ঘৃণাটুকু দেখাতে চেয়েছেন? যদিও এই কারণেই আবার  অবিবাহিত মাম্পি নিজের সতীত্ব সুরক্ষিত রাখতে পারছে। মনে মনে মায়ের সাথে মেয়ের এই লড়াই ফের রিলেট করতে পারা-সেটা কি স্বাভাবিক না অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ?

 

নন্দনা- কিছুটা মানসিক চাপ তো বটেই। তবে পুরোপুরি সাইকিক নয়। অনেক বছর পরে বিবাহিত সুখী দাম্পত্যে থাকা মাম্পি তার মা বিদিশা দেবীকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রশ্ন করেছে- মা, তুমি কি তোমার জামাইবাবুর বন্ধু পরমেশকাকুকে ভালোবাসতে? নাহলে হরিদ্বারের ধর্মশালায় দু'জনে এক স্নানঘরে একসাথে ঢুকেছিলে কেন?  দিদা আমাকে কোলে নিয়ে ধর্মশালার চাতালে ঘুরছিল কেন? অন্যদের থেকে তোমাদের পাহারা দিতে? জানি বাবা বেড়াতে যায়নি সেবার।

মেয়ের ঘরে আশ্রিতা  বিধবা বৃদ্ধা বিদিশা দেবী কোনো  স্বীকারোক্তি দেয় না  মাম্পির কাছে। ছেলে বাপ্পা আর তার বউ মানসীর সাথে বিদিশাদেবীর বনাবনি হয়না কোনোদিন। 

কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ থেকে  রাগত স্বরে মেয়েকে বলেন তোর অতোটুকু বয়সে তো এসব মনে থাকার কথা নয়? তখন তো তোর ভাই জন্মায়নি। কতো ছোটো ছিলি তুই! কে বলেছে? তোর পিসিরা? 

মাম্পি অস্ফুটে বলে, কেউ বলেনি মা। তোমার আমাকে একা ফেলে রেখে পেনসিল হিল খটখটিয়ে পরমেশ কাকুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসা, তোমার ছেড়ে যাওয়া কাপড়ে মুখ চেপে কাঁদতাম। ওই কাপড়ে মিশে থাকা তোমার শরীরী গন্ধে একসময় আমার চোখের জল শুকিয়ে যেত। এইসব আমি ভুলিনি কোনোদিন। ঘুমের মধ্যে অনেকদিন পর্য্যন্ত  এইসব অবহেলার  স্মৃতি-দৃশ্য দেখে চমকে জেগে উঠতাম। সেই জুতোটাও উনি তোমাকে কিনে দিয়েছিলেন বলে; বাবার সাথে তোমার বাকবিতন্ডাও আজ স্পষ্ট কানে বাজে। যদিও জানি বাবার  বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা বা না ফিরে বাঈজী বাড়ি থেকে যাওয়াটা নিয়ে তুমি ঝগড়া শুরু করলেই  শুধুমাত্র দাদুর  সমর্থন পেতে।

 ঠামু কিন্তু রেগে বলতো, ছেলেরা একটু বারমুখো হয় কিন্তু বাড়ির বউ স্নো পাউডার মেখে আঁচল লুটিয়ে উড়ু উড়ু হয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরলে ফিরলে, স্বামীকে আঁচলে বাঁধতে পারে? স্বাভাবিক নিয়মেই ফিল্মে এগুলো এসেছে।

 

রিপোর্টার-নারীদের দ্বন্দ্বটাও  এখানে দেখিয়েছেন?

 

নন্দনা-  ফিল্মে সেযুগের  সমাজব্যবস্থায় নারীদের অবস্হান; মাম্পিকে মেয়েদের পরাধীনতার প্রতিবাদ হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছি। মা-মেয়ের লড়াইটা ঠিক মূখ্য বিষয় নয়। সমঝোতা করতে করতে  জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মেয়ে মায়ের বন্ধু হয়েছে। মাকে কিছুটা নীরব সমর্থন জানাচ্ছে।

 

রিপোর্টার - তাই কি অবিবাহিতা মাম্পি তার প্রেমিক বিবাহিত, একথা জানবার পরেও সবটুকু মেনে নিয়েছিল?

 

নন্দনা- ধনী ব্যবসায়ী  পিতার নিকষ কালো কন্যা হয়েও পাত্রী হিসাবে অচল মাম্পি শৈশবে মায়ের অবহেলা ভুলতে দ্রুত নিজের করে কাউকে জীবনে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। ভালোবাসার কাঙালপনা থাকলেও সুতীব্র নীতিবোধ তাকে শেষ পর্য্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য করে।

 আর সে শেষ পর্য্যন্ত  বিবাহিত পুরুষের হাতে নিজেকে  সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়া  থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখে।

 

রিপোর্টার - মায়ের  অনৈতিকত কাজের জন্য নিজের মানসিক তীব্র দহনকেও মাম্পি তার সুরক্ষার  প্রতিফলন হিসাবে দেখছে। আবার ভাই বাপ্পা তার নিজ পিতার সন্তান কিনা সে প্রশ্নও তুলে দিয়েছে,মায়ের সন্মুখে। একদিকে নিজের অনৈতিক পিতার কাজকর্মের বিরুদ্ধে মাকে নীরব সমর্থন অপরদিকে তাঁকেই আবার পুরোপুরি সন্দেহ করাটা  কি মাম্পিকে সাইকিক পেশেন্ট হিসাবে দেখায় না?

 

নন্দনা- দেখবেন ফিল্মের একটা দৃশ্যে মাম্পি তার মাকে বলছে- আমাদের পারস্পারিক বিশ্বাস আর আনুগত্য যেমন মানুষ-ভেদে বদলে যায় ঠিক তেমন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর পরিস্থতির চাপেও বদলে যেতে পারে। এখানে মাম্পির নিজের ভিতর মাকে নিয়ে মানসিক দ্বন্দ্ব আর সেই দ্বন্দ্ব-ই তার জীবনে পরকীয়ার প্রবল প্রতিবাদ হিসাবে কাজ করেছে। আমাদের বিশ্বাস আর আনুগত্য পরিবেশ আর পরিস্থিতির উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। 

 

রিপোর্টার - ম্যডাম দাসসেন আপনিও নিজেও কি এই ব্যপারে একমত? নাকি এটা শুধুই ফিল্মের স্টান্ট বা  পাবলিসিটির জন্য একটা চোখা ডায়লগ?  গল্পের লেখিকা বা পরিচালিকা হিসাবে আপনার নিজের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কতোটুকু?

 

নন্দনা-  দেখুন মাম্পি তার প্রথাগত বিবাহের  সুখী দাম্পত্যের মাঝামাঝি এবং বিধবা বিদিশাদেবীর শেষ বয়সে;খুব ক্যজুয়ালি এই প্রসঙ্গ তুলেছে। মাম্পি বা তার মায়ের গল্পকথার সূত্রে এবং ওদের জীবনের  পারিপার্শ্বিক শান্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অতীতস্মৃতি হিসাবে ছবিতে এই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।  মাম্পি  শিশুবেলায় যে চোখে তার মাকে; সন্তানকে অবহেলা করে প্রেমিকের কাছে যেতে দেখেছে আজ পরিণত বয়সে এসে কিন্তু সেসবের সোচ্চার প্রতিবাদ করছে না। যতোটুকু আগে তার মায়ের মুখেই শুনেছে তার সাথে নিজের শিশুবেলায় দেখা স্মৃতিটাকে মিলিয়ে নিতে চাইছে। তাই শুধু কৌতুহলের বশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে-

মা; পরমেশ কাকু তো অবিবাহিত ছিলেন? তিনি তো কলকাতায় রহিস মুসলিম বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। যাকে কাকু মাইজী ডাকতেন তিনি ইউ পির গোঁড়া ব্রাহ্মণ ম হিলা হলেও হলেও তাঁর স্বামী মৃত শাহনাজ মুসলমান ছিলেন তাই তো? তা পরমেশ কাকু এখন কোথায় থাকেন? নিঃসন্তান মাইজী তো ওনাকে প্রচুর গহনা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো তো তোমাকে দিতেও এসেছিলেন না শেষবারের মতো? আমি তখন বোধহয় ক্লাস ফাইভ তাই না?

বিদিশা দেবী যখন জানান; হ্যাঁ। ওগুলো দিয়েই উনি মধ্যপ্রদেশে  ভাইয়ের সংসারে চলে গিয়েছিলেন। না খোঁজ, না খবর। জামাইবাবুর অফিসে কাজ করতেন উনি। কিন্তু জামাইবাবুও মারা গিয়েছেন তখন,তাই এর পরের খবর  আর কিছু জানা নেই আমার।

এতোদিন পরে মাম্পি তার মাকে  ধিক্কার জানিয়েছে ওই গহনাগুলো নেবার জন্য। আবার মায়ের দাম্পত্য অ-সুখের জন্য মাকে ক্ষমাও করে দিয়েছে মনে মনে। নিজে এক নারী হয়ে অন্য নারীকে বোঝার চেষ্টা, নিজেকে ভাঙাগড়া অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে এই মাম্পি চরিত্রটিকে।

এর পরেও  মাম্পি তার মাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছে একজায়গায়, তোমার ভুল পথে হাঁটা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে হেঁটে নিজের উত্তরণ ঘটাতে পারলাম আর তুমি পারলে না মা? 

এখন চুপিচুপি কানে কানে আমাকে বলছো; "কেউ যেন না জানতে পারে আজ বলে যাচ্ছি তোকে, যদিও; বাপ্পা আমারই ছেলে কিন্তু ও তোর নিজের ভাই নয়!"

 

রিপোর্টার- অসাধারণ একটা গল্প।  নারীদের জীবনের অনেক টানাপোড়েন দেখিয়েছেন আপনার ছবিতে। তাই এতো জয়টীকা এনে দিয়েছে "মাম্পি"।

অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। তবে যদি কিছু মনে না করেন একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

 

নন্দনা- হ্যাঁ  হ্যাঁ বলুন না। নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।

 

রিপোর্টার -না মানে এই মাম্পি  সিনেমাটা ভারতে রিলিজের সময় একটা গুঞ্জন উঠেছিল, এই চলচিত্রটি মুক্তি পাবার দিনে আপনার মা;বিমলা দেবী সুইসাইড করেন। বিষয়টা কি একেবারেই  কাকতালীয়? 

 

নন্দনা- প্লিইইজ! আপনার ইন্টারভিউতো শেষ। আপনি এবার আসতে পারেন।

 

রিপোর্টার- সরি। ডোন্ট মাইন্ড ম্যডাম। আসলে এটা পাবলিক ডিম্যান্ড। আপনার মতো স্বনামধন্য মানুষের এটা অটোবায়োগ্রাফি কিনা জনগণ সেটা জানতে চায়।

 

নন্দনা- প্লিজ,ক্লোজড দিস চ্যাপ্টার এন্ড গুড নাইট।

 

ভারত টিভির দুঁদে জার্নালিস্ট  জহরলাল বাঁড়ুজ্জেকে কোনো  সুযোগ না দিয়েই  উঠে চলে যান নন্দনা দাস সেন।

 

পরদিন সংবাদপত্রে  "মাম্পি"- র পরিচালিকা নন্দনা দাসসেন সহ অভিনেতারা প্রভূত প্রশংসা পান।  জনপ্রিয় সংবাদপত্র "জনবার্তা" হেডলাইনে ছাপেঃ- 

"মাম্পি"- নারীর উত্তরণের গল্প না আত্মজীবনীর চিত্ররূপ?

 

**********সমাপ্ত**********

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু