পোদ্দারের পোদ্দারি
এই তুই মনিষা না?
হ্যা। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম নাতো।
আরে আমি স্বপ্নারে। স্বপ্না পোদ্দার। এতো জলদি ভুলে গেলি স্কুলের বন্ধুকে?
ওবাবা! তুই! কেমন আছিস? ভুলিনিরে। আসলে এতোদিন পর দেখাতো। অনেক বদলে গেছিস তুই। তাই একটু...
বুঝেছি। আর বাহানা বানাতে হবে না। এতোক্ষণ ধরে তোর আড়চোখে দেখাগুলো কিন্তু খেয়াল করছিলাম আমি। দেখেও না চেনার ভান করছিলিস যে বেশ বুঝতে পারছিলাম। সেই যে তমালদাকে দেখেও না দেখার ভান করতিস কলেজে মাঝে মাঝে যেরকম, সেরকম।
হেসে ওঠে দু'জনেই একসাথে।
তোর এখনো ওসব কথা মনে আছে স্বপ্না? সেই দিনগুলোর সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেইরে। মন থেকে মুছে ফেলেছি সব। এতো ব্যস্ততায় সময় কাটে, যে ওসব মনে করারও সুযোগ পাই না একেবারে। তোকে সত্যিই চিনতে পারিনিরে। রাগ করিসনা প্লিজ। আজ আসি? একটু তাড়া আছে।
ঠিক আছে যা। তবে তোর ফোন নম্বরটাতো দিয়ে যা।
আচ্ছা লিখে নে। 033......
আরে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটাদে। যোগাযোগ থাকবে অন্তত।
ওটা বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিরে। আর নম্বরটাও মুখস্থ নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে। নো ইস্যু। এতেই চলবে। এই তোর মনে আছে, তোর বিয়ের সময় কি মজা হয়েছিল তোর শশুর বাড়ী গিয়ে? এই তিমিরদা কেমন আছেন রে? আর বাকিরা সবাই? একদিন আয় না আমার বাড়ি। এখান থেকেতো কাছেই। এই মাসটাই থাকবো। তারপর ফিরে যাবো আবার দিল্লিতে। আচ্ছা তুই কি তোর ওই শ্বশুর বাড়িতেই থাকিস এখনো?
হ্যা রে। তোর তিমিরদাও ভালোই আছেন। তবে খুব ব্যস্ত থাকেন আজকাল। আজ আসি, বাই।
সবই ঠিক বললো, তবু কেমন আনমনা ভাবে। কেমন শান্ত হয়ে গেছে মনিষা। কী প্রাণোচ্ছ্বল ছিল আগে। কী ভালো গান করতো। ওর গলায় "ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি" গানটা আজও কানে বাজে। দেখা হয়ে কেন জানি না মনটা ভারী হয়ে গেল উল্টো।
বাড়িটা ভাড়া দিয়ে পাকাপাকি ভাবে চলে যাবো এবার দিল্লি। গোছগাছ, শেষ সময়ে সবার সঙ্গে একবার দেখা করার মতো বিভিন্ন কাজ কর্মের দরুন কদিন বেশ ব্যস্ততায় কেটে গেল। ফোনটা আর করা হয়ে উঠেনি মনিষাকে। একদিন দুপুর বেলা টিভিতে গান শুনতে শুনতে ওর কথা মনে পড়লো আবার। ভাবলাম ফোনটা করেই নেই। কিভাবে শুরু করবো ভাবতে ভাবতে , পার্টিতে ডাকার বাহানায় ফোনটা করেই নিলাম। আমার ফোন পেয়ে ওতো খুব খুশি। বলেই ফেললো," ভাবতেই পারিনি তুই ফোন করবি। সবাই ভুলে গেছে আমায়। তার মধ্যে দূরে থেকেও তুই যে প্রাধান্য দিয়ে ফোন করে কথা বলবি আমার সঙ্গে, সত্যি রে ভাবতেই পারিনি একদম।"
টুকটাক কথা হতে হতে ওর অভিমান কিছুটা কমলে, কিছুটা স্বাভাবিক হলে বললাম জানিস এখনো নজরুল গীতি শুনলেই তোর কথা মনে পড়ে।
তাই? হাহাহা
আর গান কেমন চলছে তোর?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "ওসব এখন পুরোদমে ভুলে গেছিরে, বললাম না? এতোদিন জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। শ্বশুর শাশুড়ি ননদ দেওর সবার দেখাশোনা রান্নাবান্না ঘরকন্নার মাঝে গান নিয়ে ভাবার সময় কই। তাছাড়া যা দুরন্ত ছেলে ছিল আমার। এখন আর কেউ নেই। শ্বশুর শাশুড়ি গত হয়েছেন বেশ কবছর। ননদের বিয়ে হয়ে ও এখন কেনাডায় সেটেল। দেওর থাকে আমেরিকা। বিয়ে করে বৌ নিয়েই গেছে একেবারে। সবাই নিজের জীবনে ব্যস্ত। ছেলে পড়ছে হোস্টেলে থেকে। এখন নিরবিচ্ছিন্ন অবসর। ওই দূর থেকে কর্তব্য গুলো করা ছাড়া আর তেমন কাজ নেই আমার। ছাদে একটা বাগান করেছি ওই নিয়ে আর এতবড় বাড়ি দেখে রাখতেই কেটে যায় আমার।"
বাঃ তবেতো এবার গানটা নিয়েও আবার চর্চা করতে পারিস।
না রে তা আর হবার নয়।
কেনো?
ধুর, এখন সেসব একদম ভুলে গেছি। গাইতে গেলেই কেবল মনে হয় যেন বেসুরো গাইছি।
ও কিছু না। কয়েকদিন হারমোনিয়াম নিয়ে অভ্যাস করলেই দেখবি সব মনে পড়ে গেছে। চাইলে কোনো গানের স্কুলের সঙ্গেওতো যোগাযোগ করতে পারিস।
পারি... আসলে কি জানিস, এতো বছর ঘরের মধ্যে থেকে থেকে না বেরোনোর অভ্যেসটাই চলে গেছে। তাছাড়া এখন মনে হয় আমি বোধহয় লোকের সঙ্গে কথাই বলতে পারিনা ভালো করে। আজকাল সবাই দেখেছিস কেমন ফটফট করে ইংরেজিতে কথা বলে? তার উপর কেমন সব ড্রেস পরে আসে? আমারতো ভাই শাড়ি ছাড়া কিছু পরার জো' নেই। তায় আবার মনে হয় কথা বললেই ভুলভাল কিছু বলে ফেলবো না তো? আমার অস্বস্তিবোধ দেখে, তোর তিমির দাও বলেছে, "মনিষা তুমি যেভাবে আছো তেমনি থাকো। বাইরের জগতের সঙ্গে অযথা মানানসই হবার দরকার নেই তোমার।" এ কি কথা!
নারে ও ঠিকই বলেছে। এসব কারণেই হয়তো দুরত্ব বেড়ে গেছে আমাদের মধ্যে অনেক। তোর তিমির দার পাশে আমি আজ বড্ড বেমানান যেন।
হুম বুঝলাম। আচ্ছা শোন যে জন্য ফোন করা তোকে। আগামী রোববার বিকেলে আমার বাড়ি তোদের নিমন্ত্রণ রইলো। জমিয়ে গল্পো করবো দুই বান্ধবীতে আর বরেরা। খাওয়া দাওয়া সেরে একবারে ফিরবি তোরা।
তোর তিমিরদার সঙ্গে একবার কথা বলে নিয়ে জানাই তোকে? সেদিন তো থার্টি ফার্স্ট নাইট, যদি ওর কোথাও কোনো কাজ থেকে থাকে!
না না। কোনো বাহানা চলবে না। তোদের আসতে হবে অবশ্যই। বলিস যে আমি তিমির দাকে আলাদা করে নেমন্তন্ন করেছি। না এলে কিন্তু শালির মনে দুঃখ দেওয়া হবে। হাহাহা। এবার রাখি বন্ধু আসিস।
সেদিন রবিবারে আরো কিছু বিশেষ বন্ধুদের আসার কথা আড়াল করে গেছিলাম ওর কাছে, পাছে আসতে মানা করে দেয়। ওরা আসতে অপরিচিত সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওদের। পার্টি চলছে ঘরে। আরো বান্ধবীরাও এসেছিল। সবাইতো এতোদিন পর ওকে দেখে খুব খুশি। মনিষা, শান্ত শিষ্ট মিষ্টি হাসি হাসি মুখ, যার কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকতো তৈরি।
স্মৃতির পেটারা থেকে একেকটা গল্প একেক বান্ধবীর মুখ থেকে বেড় হতে থাকলো আর হাসির ফোয়ারা ছুটতে লাগলো। হাসতে হাসতে ধীরে ধীরে একটু একটু করে কাটতে থাকলো ওর জড়তা। এবার সুস্মিতা, লতিকা, পাপিয়া কুমকুম সবাই চেপে ধরলো ওকে একটা গান করার জন্য। মনিষা কিছুতেই হারমোনিয়ামে বসবে না। বর্ণালী ততক্ষনে হারমোনিয়াম টেনে ওকে উৎসর্গ করে গান ধরেছে "ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি"। গলা মেলাচ্ছে বাকী বান্ধবীদের অনেকেই। সবার সঙ্গে সুর মেলাতে শুরু করলো মনিষাও। তারপর আরো কিছু সমবেত গানের সুরে সুর মিলিয়ে তারপর ও একক শুরু করলো "আমার নয়নে নয়ন রাখি পান করিতে চাও কোন অমিও..." গানটা।
সুরের মূর্ছনায় মুহূর্তের মধ্যে ঘরের ভেতরে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। উল্টোদিক থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিমিরদা তখন ওর দিকে যেনো আবিষ্কার করছে ওকে। গানটা শেষ হতেই তিমির দাও গান ধরলো " আবার ভালোবাসার সাধ জাগে..."। গাইতে গাইতে মনিষার পাশে দাঁড়িয়ে হাতে তুলে দিলো পাশের ফুলদানি থেকে একটা লাল গোলাপ। সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো হ্যাপি অ্যানিভার্সারি অফ ফর্স্ট মিটিং অফ মনিষা এন্ড তিমিরদা ... ওরাও একসাথে বলে উঠল, থ্যাঙ্কস এভরিবডি, এন্ড থ্রি চিয়ার্স ফর আওয়ার স্বপনা পোদ্দারস পোদ্দারি।
হেসে উঠলো সবাই একসাথে। স্বপ্নার বাড়িতে বছর শেষের রাত যেতে যেতে, নতুন বছরের সঙ্গে এনে দিলো সবার চোখে যেনো নতুন নতুন একেকটা স্বপ্ন।
