শুক্তো
..."শোনো, ভাত আর ডাল করে গেলাম, একটু শুক্তো রান্না করা আছে ফ্রিজে। খাওয়ার সময় মাইক্রোওভেনে চার মিনিট গরম করে নিও। মাছে নুন হলুদ মাখানো আছে, একটু ভেজে নিও।" কথাগুলো বলে সোহিনী ল্যাপটপ ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল।
তখনো আবীর বিছানায় বসে আছে চায়ের কাপ নিয়ে। সে একটু দেরীতেই ঘুম থেকে ওঠে। সোহিনীর সকালেই অফিস থাকে। তাই এইসময় বেশি কথা হয়না ওদের। অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হতে হতেই টুকটাক কথা বলে সোহিনী। কিন্তু কালকের পর আর সেভাবে সকালে কথাও হয়নি। কাল ঝগড়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে। সেটা জানে আবীর। শুরুটা ওই করেছিল। আসলে দুটো টিকিট কেটেছিল "পুষ্পা" সিনেমাটা দেখতে যাবে বলে। এমনিতেই শুক্রবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে সোহিনী। তাই ভেবেছিল আজ সিনেমা দেখে ডিনার করেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু একে তো দেরী করে ফিরলো, তারপর এসেই বসলো গাদাখানেক কাজ নিয়ে। কিছুতেই যেতে পারবেনা জানিয়ে দিল সোহিনী। ওদিকে স্যাম আর ওর গার্লফ্রেন্ড ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই একটু বিরক্ত হয়েছিল আবীর। নিজের পড়াশোনার কাজের ফাঁকে ক্লান্ত হয়ে সে চাইছিল একটু বাইরে যেতে তাই একপ্রকার জোর করেই যেতে বলেছিল সোহিনীকে। বোঝেনি সোহিনী'র পক্ষে যাওয়াটা অসম্ভব ছিল। শেষে নিজেও যাওয়ার প্ল্যান ক্যান্সেল করলো। তারপর কথায় কথায় ঝগড়া কখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বোঝেনি আবীর। অভিযোগ অভিমান পেরিয়ে অবশেষে আঘাত হয়ে ঝরে পরেছে আবীর। বাড়িতেই রাখা হুইস্কিটা শেষ করেছিল একাই। একাকীত্ব আর ডিপ্রেশন ওকে একটু একটু করে গ্রাস করছিল অনেকদিন থেকেই। আজ শুধু আগ্নেয়গিরিটা ফেটে পরলো যেন।
...."ইটস নট ওয়ার্কিং এনি মোর, আই নিড আ ব্রেক সোহিনী।"
হুইস্কির গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলেছিল আবীর। ওপ্রান্ত থেকে উত্তর আসেনি কোনো। কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল শুধু সোহিনী। আর অপেক্ষা না করেই বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পরেছিল আবীর। হয়তো উত্তরটা শোনার জন্য তৈরি ছিলনা। কিন্তু এভাবে শেষ হবে চায়নি আবীর নিজেও, তবু মনের মধ্যে একটা পাহাড় প্রমাণ অভিমান আর অভিযোগ জমে আছে বুঝতে পারলো। আবীর অপেক্ষা করেনি সোহিনীর জন্য। রাতে বেডরুমে ফিরেছিল কিনা তাও জানেনা আবীর। হয়তো ড্রইংরুমেই রাত কেটেছিল সোহিনীর।
বাইরে অফিসের পুলকার অপেক্ষা করছিল সোহিনীর জন্য। সোহিনীর আজ একটু দেরিই হয়েছে। ড্রাইভার বারবার ফোন করে তাড়া দিচ্ছিল।
-"মেকয়াপ করাটাও কিন্তু একটা আর্ট, তাইনা সোহিনী, কত ক্ষত ঢেকে যায়।" পুলকারে সোহিনীর স্টপেজের আগে মিসেস ভানুশালী ওঠেন। জন্মসূত্রে উনিও কলকাতার বাসিন্দা, বিয়ের পরে মুম্বাইয়ে আসেন। সোহিনীকে বিশেষ স্নেহ করেন। আজকেও ফোনের স্ক্রিনেই চোখ রেখেই কথাগুলো বললেন। সোহিনী চুপ থাকল। ও জানে মিসেস ভানুশালী কি বলতে চাইছেন।
-"ক্লান্ত লাগে জানেন খুব। মনে হয় ট্রান্সফার নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই।"
-"দূর থেকেই তো এখানে এসেছিলে সোহিনী। তাছাড়া নিজের থেকে পালিয়ে যাওয়াটা কি সহজ? আমি তো এত বছরেও পারিনি। ভালোবাসার সম্পর্ক অনেকটা ভালো ওয়াইনের মত। একটু সময় দিতে হয়। সোয়ার্ল করে ফ্লেভার পার্টিকেল গুলো মিশিয়ে দিতে হয় বাতাসে। তারপর একটু একটু করে যত্ন নিয়ে আত্মস্থ করতে হয়। আমি যেটা পারিনি সেটা তুমিও করোনা সোহিনী। ভালোবেসে ক্ষত বিক্ষত হলে প্রতিঘাত হয়ে ফিরিয়ে দিওনা।"
মিসেস ভানুশালীর কথাগুলো অবাক করে সোহিনীকে। পরের স্টপেজে গাড়ি থামলে ওদের আলোচনাও বন্ধ হয়ে যায়। বাকিটা পথ সোহিনী ল্যাপটপ খুলে বসে। কালকের কিছু কাজ ছিল।
প্রায় দু'বছর হলো ওরা একসাথে আছে। বিয়ে করেনি। একটা লিভ-ইনে আছে দু'জনেই। হঠাৎ করেই একদিন সোহিনী চলে আসে আবীরের ফ্ল্যাটে, তারপর চলে যাওয়ার কথা মনে হয়নি কারোই। সব সম্পর্কের আড়ালে নাম বা কারণ থাকেনা বোধহয়। একসাথে থাকার জন্য বাকি সব অপ্রয়োজনীয়, তাই কিছু সম্পর্ক শুধুই হাতে হাত রেখে থেকে যেতে চায়.....
----------------------------------------------------
ওরা দুজনেই থাকতো কলকাতায়, পড়াশোনার সূত্রে একসময় সুদূর মুম্বাইয়ে পাড়ি দিয়েছিল। তাই ওদের দুজনের আলাপ পর্বটা আগে জেনে নিতে হবে, নাহলে বাকি গল্পে খেই হারাবে পাঠক।
সোহিনী তখন সবে কলেজে উঠেছে। আবীর ওদের পাড়ায় থাকতো। বরাবর ফার্স্ট হওয়া পাড়ার আইকন ছেলে ছিল আবীর। মাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। অথচ সোহিনী ঠিক তার উল্টো। পড়াশোনায় ভালো হলেও ফার্স্ট সেকেন্ডের গন্ডিতে আটকা থাকেনি কোনোদিন। সোহিনীর ছিল গানের প্রতি অগাধ প্রেম। পাড়ার যেকোনো অনুষ্ঠানে সে সবার আগে। আবীরকে স্কুল যাওয়া, আর সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়া ছাড়া দেখা যেতোনা পাড়ায় বিশেষ। সেই সেই আবীর কীভাবে যে সোহিনীর প্রেমে পড়লো তা আজও অজানা। উচ্চমাধ্যমিকের পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলো আবীর। সোহিনীর তখন মাধ্যমিক দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে মায়ের বকুনির চোটে আবীরের কাছে যেতো ইংরেজিতে অসুবিধা হলে। অবশ্য সোহিনী যেতো আবীরের মা'য়ের সাথে গল্প করতে। আর আবীর একমনে ওর নোটস বানিয়ে রাখতো। তারপর দু'বছর পরে সোহিনীও এলো প্রেসিডেন্সিতে। তবে ওর সাবজেক্ট কমার্স। ততক্ষণে আবীর থার্ড ইয়ার। তার সাথেই প্রিপারেশন নিচ্ছে ইউ পি এস সি এক্সামের। গ্র্যাজুয়েশনে খুব ভালো পার্সেন্টেজ নিয়ে পাশ করলো আবীর।
সেদিন বিকেলের কথা খুব মনে পরে আবীরের। ভাগ্যিস কলেজে গেছিল ও। কলেজের সামনে একটা বাইরের পার্টি এসে ঝামেলা করেছিল সেদিন। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আ্যক্টিভ মেম্বার সোহিনী। ঝামেলার থেকেই শুরু হয় হাতাহাতি। আহত হয় সোহিনী। আবীর সেদিন কলেজের প্রফেসরের কাছে এসেছিল এক্সট্রা কোচিং নিতে। ওকে ওই অবস্থায় দেখে অটো ডেকে সোজা নার্সিংহোমে। সেদিন ওই ঝামেলার থেকে বের না করে আনলে সোহিনীর ক্ষতি হতো ভীষণ। কয়েকজন কলেজ স্টুডেন্ট মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল। পুলিশের এসে পৌঁছাতে সময় লাগে অনেকটা। আবীর, সোহিনীকে নিয়ে সোজা নার্সিংহোমে এলো, বাড়িতে খবর দিল। ট্রিটমেন্ট করিয়ে আবার বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
তারপরই কেমন যেন সব পালটে গেলো। রোজ একবার হলেও সোহিনীর খোঁজ নেওয়া চাই। মেয়েটা যখন প্রাণ খুলে হাসতো মনে হতো যেন রামধনু উঠেছে আকাশে, হাজারটা প্রজাপতি উড়ে যেতো। এভাবেই একদিন একটা বৃষ্টি ভেজা বিকেলে সোহিনীদের বাড়িতে ছাদে ওকে ভিজতে দেখে নিজেকে আটকাতে পারেনি আবীর। সোহিনীও নিজেকে আটকায়নি, দুজন মিলে ভিজেছিল সেদিন। সব আগল পেড়িয়ে জাপটে ধরে ভিজেছিল সোহিনী। ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছিল দুজনের মধ্যে। তারপর আরও দুটো বছর পেরিয়ে গেলো।
সোহিনী মাস্টার্স করে চাকরি পেলো একটা প্রাইভেট ব্যাংকে। আবীর তখন পি এইচ ডি করছে। রিসার্চের কাজে মুম্বাই এসেছে। সোহিনী নিজের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। দুই বাড়িতেই ওদের সম্পর্কটা জানে। বিয়ে নিয়ে তাড়া দেয়নি কেউ। তবু যেদিন সোহিনীকে ছেড়ে মুম্বাইয়ে আসছে মনটা হূ হূ করে উঠেছিল।
মুম্বাইয়ে এসে আবীর নিজের কাছে ব্যস্ত হয়ে পরেছিল। মাস দুই পরে একদিন বাড়ি ফিরে দেখে দরজার সামনে অপেক্ষা করছে সোহিনী। সেইদিনটার কথা আজও মনে আছে ওর। সেদিনও বাইরে বৃষ্টি পরছিল খুব।
...."মাই গড, সোহিনী তুমি এখানে...আমাকে জানালে আমি এয়ারপোর্টে যেতাম।" আবীর যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত ন'টা।
...."তাহলে সারপ্রাইজ হতোনা ডিয়ার। আমি বিকেল থেকে বসে আছি। প্লিজ দরজা খোল। হিসু পেয়েছে খুব।" সোহিনী ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল। এভাবে কলকাতা থেকে মুম্বাই চলে আসবে ভাবেনি আবীর।
...."খেয়েছো কিছু?"
...."হ্যাঁ, বিস্কিটের প্যাকেট ছিল একটা।"
...."আমি তো রান্না করিনা, বাই তো চলে গেছে।বাজারও করা হয়নি। বাড়িতে কিছু নেই তেমন। তুমি একটু বোসো। আমি অর্ডার করি কিছু।" সোহিনী'র হঠাৎ আগমনে আবীর বেশ নাজেহাল হয়েছে।
..."হ্যাঁ, আমার জন্য চিকেন মাঞ্চুরিয়ান আর রুমালি রুটি অর্ডার করো।" বাথরুম থেকেই চিৎকার করে সোহিনী।
ব্যস, তারপর সোহিনী জানালো, সে এখানেই ট্রান্সফার অর্ডার পেয়ে গেছে। এখানেই থাকবে।
অবাক হয়নি আবীর। সোহিনী'র পক্ষে এই পাগলামি অসম্ভব কিছুই নয়। তবু সে বলেছিল আলাদা একটা রুম খুঁজে দেওয়ার কথা। রাজি হয়নি সোহিনী। একসাথেই থাকতে শুরু করে ওরা তারপর। বেশ কিছুদিন সব নিজের জায়গায় ছিল। সোহিনীর চাকরি, আবীরের রিসার্চ....সবকিছু। কিন্তু একটু একটু করে হিসেব বদলাতে লাগল। রিসার্চটা কিছুতেই শেষ হতে চাইছিল না। ইন্টারনাল পলিটিক্স বাধা হচ্ছিল বারবার। ফলে মেয়াদ দীর্ঘ হচ্ছিল ওর ধৈর্য্য'র। মুম্বাইয়ে যা খরচ সামালাতে পারছিলনা আবীর। স্টাইপেনের টাকায় আর হচ্ছিল না। তার উপর পড়াশোনার খরচ, অথচ রোজগার নেই তেমন। তাই খরচ বেড়ে গেছিল অনেকটাই। যদিও সোহিনী অনেকটা কন্ট্রিবিউট করছিল, তাও ভেতরে ভেতরে কী যেন একটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো আবীর'কে। হয়তো সোহিনী'র সাফল্য....
-----------------------------------
আবীরের মনে পরল আরও একদিনের সেই সন্ধ্যেবেলাটা.....
কলিং বেলের আওয়াজে উঠে দরজা খুললো আবীর।
...."কী ব্যাপার আজ এত তাড়াতাড়ি?" প্লে স্টেশনে গেম খেলছিল, তাই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই খেলতে বসে গেলো। লক্ষ্য করেনি সোহিনীর হাতে অনেকগুলো প্যাকেট।
....."সারপ্রাইজ আবীর। দেখো তোমার ফেবারিট রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার এনেছি। আর সাথে শ্যাম্পেন। আজ সারারাত পার্টি করবো আমরা, শুধু আমি আর তুমি......"
...."হটাৎ আমাদের কথা মনে পরলো? কী ব্যাপার? বস বুঝি নতুন প্রজেক্ট দেয়নি কোনো?" এতটা কঠিন কথাগুলো কেমন নিজের কানেই বাজছিল আবীরের।
...."আরে বাবা আমার প্রমোশন হয়েছে। কাল থেকে আমি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। অনেকদিন থেকেই তোমাকে বলবো ভাবছি। কিন্তু কনফার্মেশন লেটারটা আজ পেলাম। তাই ভাবলাম সারপ্রাইজ দেবো। কী গো খুশি নও তুমি।"
….."হু। খুশি তো। কিন্তু সোহিনী আমি ডায়েটে আছি। রান্নার মাসি ডালিয়া আর চিকেন করে গেছে, তুমি খেয়ে নাও, আমি খাবো না।" মূহুর্তে সোহিনীর মুখের হাসিটা নিভে গেলো। তবু আবীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
...."আরে বাবা তোমাকে আগে থেকে বললে সারপ্রাইজ দিতাম কেমন করে?"
....."সোহিনী আমরা ছোট বাচ্চা নই যে সারপ্রাইজ দেখলে লাফিয়ে উঠবো। এত বড়ো নিউজ আর সেটা আজ জানতে পারছি আমি। কাম অন গ্রো আপ।" কথাগুলো বলেই উঠে পরেছিল আবীর।
ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল সেদিন সোহিনী। ফ্রিজে তুলে রেখেছিলো খাবার। না খেয়েই শুয়ে পরেছিল রাতে। সেদিন রাতটা সোফাতেই ঘুমিয়েছিল আবীর। টেবিলের ওপর রাখা শ্যাম্পেনটা জুড়িয়ে গেছিল ওদের সম্পর্কের মতো।
-----------------------------------
নাহ! কিছুই ভালো লাগছিল না। ফোন করলো স্যামিকে। এখানে এসে ওর সাথে পরিচয় হয়েছে। ফ্রি লান্সার হিসেবে কাজ কর্ম করে। বিয়ে করেনি, অজস্র গার্লফ্রেন্ড। নয় বাড়িতে থাকে নাহলে বনে বাদারের ছবি তুলে বেড়ায়, বোহেমিয়ান জীবন যাপন ওর, তবু বন্ধুত্বটা অনেকদিনের। ফোন করে দেখে নিল বাড়িতে আছে কিনা। হূট করে বেড়িয়ে পরাই ওর স্বভাব। আবীর যে আসছে সেটা জানিয়ে দিলো।
..."কী রে, বৌ'য়ের সাথে ঝগড়া করেছিস?" বাড়ি ঢুকে চাবিটা টেবিলের ওপর রাখতেই প্রশ্নটা ধেয়ে এলো।
...."তুই জানলি কী করে?"
..."আজ ডিওতে স্নান না করে এসেছিস, মানে বাড়িতে যেমন বসে ছিলিস তেমনই চলে এসেছিস, অন্যদিন তো পুরো ডিওতে স্নান করে ফুলবাবু সেজে আসিস।"
..."ভাই একটা বিয়ার দে, মাথার ঠিক নেই একদম।" ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো আবীর।
...."নিয়ে নে ফ্রিজে আছে" স্যামি তখন ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলে ওকে সব কথা বললো আবীর।
...."আসলে দোষটা তোর নয়, আমরা তো পুরুষ, মেনে নিতে পারিনা এক নারীর আধিপত্য, তার স্বাধীনতা"
.…"এটা কী বলছিস স্যামি, আমার আর সোহিনীর কেমিস্ট্রিটা একদম আলাদা। তুই জানিস তো সব..." আবীর ডিফেন্ড করলো নিজেকে।
...."তাই কী আ্যবি? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখ। রোজ রেডি হয়ে যখন অফিসে যায় মেয়েটা এগিয়ে দিস জলের বোতল কিম্বা লাঞ্চবক্স? কাছে ডেকে বলিস আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।"
...."সারারাত কাজ করে সকালে ঘুমিয়ে পরি, জানিস তো তুই।" আরও একটা বিয়ারের বোতলে চুমুক দিলো আবীর।
..."না রে, এটা আমাদের মেল ইগো। আমরা তো এটা শিখেই বড়ো হয়েছি যে সংসারটা আমাদের অধীনে। স্ত্রীর যত্ন রাখার দায়িত্ব আমার, সংসারের খরচের দায়িত্ব আমার....খুব লিবারেল হলে বড়ো জোর উদার হয়ে বলতে পারি আমি আমার বৌ'কে চাকরি করার পারমিশন দিয়েছি। কিন্তু মেনে নিতে পারিনা আমার বৌ ফিনান্স সামলাবে আর আমি ঘরের দায়িত্ব নেবো? কী তাইতো? দাবার গুটি উলটো চালে পরলেই সংসার নামক সঙ টার দাঁত, নখ বেরিয়ে পরে। সোহিনী একবারও তোকে এই নিয়ে বলেছে যে পড়াশোনা ছেড়ে চাকরি খুঁজতে যা।"
...."আমি তো চেষ্টা করছি বল। একটু সময় লাগছে, তাছাড়া সোহিনী বরাবর সাপোর্ট করেছে। আমি অধৈর্য্য হয়ে পরলেও আমার পাশে থেকেছে।"
...."আর তুই কী করলি? কাঁটার মুকুট পড়ার শাস্তি দিলি ওকে। প্রতিদিন তোর মেল ইগোর সাথে ঠান্ডাযুদ্ধে নামে যে মেয়েটা তাকে আরও দূরে সরিয়ে দিলি।"
সত্যি যদি চলে যায়, কাল খুব আঘাত করেছি ওকে।
...."বাড়ি ফিরে যা আবীর। ওর ফেরার সময় হলো। একটা সরি, বিশ্বাস কর তোকে ছোট করে দেবেনা। হাঁটুমুড়ে প্রেম নিবেদন করার চেয়েও বুকে টেনে সরি বলা অনেক সহজ রে।"
নাহ! আর সময় নষ্ট করেনি আবীর। বাড়ি ফিরে এসেছিল সন্ধ্যের মধ্যেই। এসে দেখলো সোহিনীও ফিরেছে।
বেডরুমে এসে দেখলো সোহিনী খাটের ওপরে লাল রঙের সুটকেস চাপিয়ে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। খাট জুড়ে অবিন্যস্ত জামাকাপড়। আবীরের মনে হলো পৃথিবীটা দুলে উঠল। সারাটাদিন ঠিক এই ভয়টাই তো পাচ্ছিল। নাহ! কিছুতেই যেতে দেবেনা এভাবে ওকে। নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবে ওকে।
খাটের সামনে এসে মাটিতেই বসে পরলো আবীর। সবুজ রঙের একটা স্কার্ট পরে আছে সোহিনী। ওর কোলে মাথা রেখে ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো আবীর।
...."এভাবে কোথাও যেতে পারোনা তুমি। সরি সোহিনী। আসলে সত্যি বোধহয় সম্পর্কের মাঝে আমার ইগো চলে এসেছিল। আমি সব ঠিক করে নেবো দেখো। সব নতুন করে ফিরিয়ে দেবো তোমাকে।"
..."ইউ নিডেড আ ব্রেক.....কঠিন হয়ে আছে সোহিনী। হাত দুটো অসম্ভব ঠান্ডা।
আই নিড ইউ....
..."উই নিডেড আ ব্রেক....ভোঁদুরাম, আমরা দু'জনেই কাল গোয়া যাচ্ছি। দুপুরের ফ্লাইটে। আমি তোমাকে এত সহজে ছাড়বো না, বুঝলে। ঝগড়াঝাটি খুনসুটিতেই হোক আমাদের একটা ঘর। বিয়ে করবে আমায়?" আবীর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সোহিনী ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
....."শোনো না, একদিন তোমার সাথেই একটা মধ্যবিত্ত সংসার করবো। তুমি বাজার করবে ব্যাগ ঝুলিয়ে, আমি ফর্দ মিলিয়ে জিনিস আনতে বললেও ভুলে যাবে, সেদিন আমি রাগ করবো, আর আমি তরকারিতে নুন দিতে ভুলে গেলি নাহয় তুমি রাগ করো। একদিন খুব ঝগড়া করবো। মনের সব কথা উজাড় করে বলতে পারার মতো ঝগড়া, মন খারাপ করা ঝগড়া, কিন্তু তারপর কান্নাকাটি ঝগড়াঝাটি করার পরে তোমাকে নিয়ে একটা প্রেমের গল্প লিখবো বুঝলে। তুমি আমার পাশে শুয়ে যখন ঘুমাবে, তোমার গায়ে চাদরটা তুলে দিয়ে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে শেষ করবো সেই গল্প লেখা। তোমার ফেবারিট জোকার কী বলেছে জানো তো। ম্যাডনেস ইজ লাইক গ্র্যাভিটি। তাই তো পাগলের মতো তোমার প্রেমে পরে যাই বারবার, প্রতিবার।"
বাইরে তখন বৃষ্টি। মুম্বাইয়ে বর্ষা নেমেছে। আবীরের চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে সোহিনীর কোল। ওর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সোহিনী।
...."খিদে পেয়েছে, আছে কিছু রান্না।" অনেকক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে সোহিনী।
...."দুপুরে স্যামির বাড়িতে খেয়েছি, সব রান্নাই আছে।"
..."রাতে শুক্তো খেতে হবে? সোহিনী নাক কুচকায়।"
...."আমাদের সম্পর্কটাও তো শুক্তোর মতো সোহিনী, উচ্ছের তেতোটা আছে, তবু রাঁধুনির গুনে গরমভাতে মেখে খেতে বেশ লাগে। সঠিক মাপে কাটা আলু, কাঁচাকলা আর বড়িটা যেন রোজকার মধ্যবিত্তের সাধারণ সামগ্রী। রান্নাটা নামানোর আগে একটু দুধ দিয়ে দিলেই মাখোমাখো হয়ে অসাধারণ হয়ে যায়। আবীর এবার উঠে এসে বসেছে খাটে।
..."অনেকদিন কবিতা শুনিনি কোনো। আজ একটা কবিতা শোনাবে।" আবীরের বুকের কাছে এসে ঘন হয়ে বসলো সোহিনী।
-----------------------------------
যদি কবিতায় তোকে চাই, তুই শব্দ হয়ে আসিস,
যদি হঠাৎ প্রেমে পড়ি তুই অনেক ভালোবাসিস।
স্বপ্ন ভাঙার স্বপ নিয়ে বুক জুড়ে তুই থাকিস,
আমি সব হারিয়ে নি:স্ব যখন তুই হাত বাড়িয়ে ডাকিস।
রাত নেমেছে চুপি চুপি আলতো প্রেমের ঘরে....
উষ্ণ ছোঁয়ায় ঘুম হয়ে যা আমার দু চোখ জুড়ে।"
-----------------------------------
আবীরের বুকে মাথা রেখে সোহিনী বসে থাকলো অনেকক্ষণ....ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ন'টা...
...."চলো খেয়ে নিই। টুকটাক কাজ আছে। বাকি গোছানো কাল করবো। আমি সাতদিনের ছুটি নিয়েছি। আগে হানিমুন তারপর বিয়ে.... আবীরের ঠোঁটের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে বললো সোহিনী।
-সমাপ্ত