বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ছোট বৌ

ছোট বৌ

এক হাতে ভাতের ডেকচির ঢাকনা অন্য হাতে মেয়েকে সরাতে গিয়ে দেওয়ালের কোনের পেরেকের খোঁচায় পায়ের বুড়ো আঙুলের অনেকটা কেটে যাওয়ায় চোখের জল অজান্তেই বেরিয়ে গেলো আর অসহ্য কষ্টে মেয়েকে কোলে নিয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো রুমকি।

হারুর মা বাজার নিয়ে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলো "কি সব্বনাশ হলো গো , এ যে রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘর"বাড়িতে এ সময় বিশেষ কেউ থাকে না।

বড় জা বড়লোক বাড়ির মেয়ে।বিয়ের পরে এক ঘর বোঝাই জিনিস পৌঁছে তার মা আগেই বলে গেছিলেন শশীবালাকে "আমার মেয়ে জেদ করলো তাই না হলে রাজা উজিরের বাড়িতে এ মেয়ের যাওয়া কেউ আটকাতে পারতো না "সে গল্প অনেক বড়। কারণ প্রতিমাসেই সুদূর বেনারস থেকে এসে নানান রকমের জিনিস উপহারে দিয়ে মেয়ের হাত পা আঙুল মা বিচক্ষণ ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যান , যে ভুলিয়ে তার গরুর মত বেচারী মেয়েকে দিয়ে এরা কাজ তো করিয়ে নিচ্ছে না। যেহেতু এটা প্রেমের বিয়ে তাই উভয় পক্ষই চুপ থাকে ।

রুমকি ছোট ছেলের বৌ। তার বাবা মায়ের পয়সা বাড়ি গাড়ি বড় জায়ের কাছে নস্যিতুল্য, সে কথা বাড়ির ইঁট কাঠ পাথরও জানে। সকাল বিকেল শশীবালা পাখি পড়ার মতো ওকে শোনায়।পাছে এই মেয়ে ওই বড় বৌয়ের অনুকরণ করে। তাহলে তো এই গোটা সংসারের দায়িত্ব ওই হারুর মা আর ওনার নিজের ওপরই এসে পড়বে।

রুমকি আর প্রবালের বিয়েটা এক কথায় হয়ে গেছিলো। প্রবালের বাবার খুব ছোটবেলার বন্ধুর মেয়ে এই রুমকি। যদিও পরে চাকরির জন্য সব বন্ধুরাই এদেশে ওদেশে ছড়িয়ে যায় কিন্তু কি করে যেন এদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ভালো চাকরি পেয়ে প্রবালের বাবা অন্য শহরে চলে গেছিলো কিন্তু রুমকির বাবা নিজের অসুস্থ বাবা মাকে ছেড়ে যায় নি কোথাও। পুরোনো পাড়াতে আটা চালের দোকান ছিল আগেই রুমকির দাদুর। সেটাই সামলে নিয়েছিল বাবা চলে যাওয়ার পরে।হারুর মার গলার আওয়াজ পেয়ে শশীবালা এসে পৌঁছলেন।কোলে বড় বৌয়ের তিন বছরের মেয়ে।দূর থেকেই রক্ত দেখে একেবারে চেঁচিয়ে উঠলেন"কি ক্ষতি করলে গো। কি সব্বনাশী মেয়ে আনলো গো তোমার শ্বশুর , আর মেয়ে পেলো না এ ত্রিভুবনে"

হারুর মা উঠে এগিয়ে এলো "কেমন মা গো তুমি দুই ছেলের ! রক্তে ভেসে যাচ্ছে বৌমণির পা আর তোমার এখনও শাপ শাপান্ত করা যাচ্ছে না ! আমরা মুখ্যু সুখ্যু মানুষ হলেও এত কঠিন নয় গো আমাদের মনটা। আর ওই নবাব নন্দিনী পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে কই তাকে তো ডাকো না একবারও।পেন্নাম ঠুকি তোমায় " বলে গজগজ করতে করতে রুমকির কোল থেকে ছোঁ মেরে ছোট্ট রিয়াকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

আর ঠিক সে সময়েই দরজায় কে যেন আওয়াজ করলো।ভয়ে সাদা হয়ে গেল রুমকির মুখ। আর তাড়াতাড়ি ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে রক্ত মুছে উঁকি মেরে দেখতে লাগলো কে এলো ! তেত্রিশ কোটি দেবতাকে সেই সকাল থেকেই তো ডেকে চলেছে সে কিন্তু তার প্রার্থনা অগ্রাহ্য করে সদানন্দ ঘোষাল দু'হাতে প্রায় পাঁচ দশটা ব্যাগ নিয়ে চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় পা রাখলো।

সদানন্দ ঘোষাল রুমকির বাবা।নিত্যানন্দ বাবু এ সময়ে বারান্দায় বসেই খবরের কাগজ পড়েন।আজও তার ব্যতিক্রম ছিল না।বন্ধুকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন আর একমুখ হেসে বললেন " আরে এসব কি করেছো ! পুরো বাজার উঠিয়ে এনেছো তো !"

বিনীত হাসি হাসলো সদানন্দ। মেয়ের বিয়ে এ বাড়িতে দেওয়ার তেমন ইচ্ছে তার ছিল না কিন্তু বন্ধুর জোড়াজুড়িতেই দিতে হয়েছিল।জানেন সব তার ফুলের মতো মেয়েটা সকাল থেকে রাত উদয়াস্ত খাটার পরেও ভালো করে হয়তো খেতেও পায় না। এক একবার ইচ্ছে হয় বলতে বন্ধুকে কিন্তু রুমকির মা বাধা দেয় " না গো ওদের বাড়ির ব্যাপার। তুমি কিছু বলতে যেও না। কি থেকে কি হয়ে যায়। আর তোমার জামাই তো ভালো , ব্যাংকের চাকরি।কদিন পরেই হয়তো বদলি হয়ে চলে যাবে"

মুখ কাঁচুমাচু করে বন্ধুর পাশে রাখা চেয়ার টেনে বসে পড়লো খুব আস্তে। আর টেবিলের পাশে ব্যাগ গুলো রেখে বললো " আরে না না নতুন বছর পড়ে এত দিন হয়ে গেলো।ওর মা কবে থেকে বলছে যাও গিয়ে দিয়ে এসো , আমিই সময় পাচ্ছিলাম না আসলে "!

হাতে যে মোটেই টাকা ছিল না তা কি করে বলবেন তিনি।জলের গ্লাস নিয়ে হারুর মা এলো। বড় আশা করে চেয়েছিলেন এই বুঝি রুমকি আসবে।ছোটবেলায় বড্ড ন্যাওটা ছিল। স্কুল ছুটি থাকলেই দোকানে গিয়ে কোলে বসে থাকতো। সবাই কত আদর করতো আর বলতো " ও সদা'দা এত জড়িও না। পরের বাড়ি যাবে যখন থাকবে কি করে !"হঠাৎ এসে প্রণাম করলো কে যেন।অন্যমনস্ক দেখলেন প্রবাল দাঁড়িয়ে। ভারী ভালো ছেলে। "ভালো আছেন বাবা ! " হাসলো প্রবাল।"খুব ভালো দিনে এসেছেন , আজই হাতে ট্রান্সফার অর্ডার পেলাম।সামনের মাসেই চলে যেতে হবে দিল্লী। হাতে সময় বড় কম। তাই আজ এসেছেন যখন রুমকিকে কিছুদিনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে যান। কতদিন হলো ও যাই নি আপনাদের কাছে"

হাঁ হাঁ করে তেড়ে এলো শশীবালা।"বাড়ি ঢুকেই বৌয়ের সুখ সুবিধের কথা ভাবতে বসেছো। আর আপনি কেমন মানুষ মশাই ! নিশ্চয়ই ওর কাছে কান্নাকাটি করেছেন , আপনাদের খুরে খুরে প্রণাম "বলেই চলে গেল শশীবালা জায়গা ছেড়ে। এই ছোট বৌকে যদি নিয়ে যায় কি হবে এ সংসারের ভাবতে ভাবতে ঠোকর খেলো ঘরের চৌকাঠে আর পড়লো ধড়াম করে।মাথায় লেগে দরজার কোণা রক্ত বেরিয়ে এলো।আর মাগো বলে পড়ে যেতে যেতে দেখলো রক্তাক্ত পা নিয়ে রুমকি এসে ধরে ফেলেছে তাকে।

এক ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেন শশীবালা , না পেরে বললেন "যাও বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে নাও , তোমার বর তো আলাদা সংসার পাতার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

একটাও কথা না বলে ধীরে ধীরে এনে খাটে শুইয়ে দিলো রুমকি। আর পাখা চালিয়ে হারুর মাকে ওখানে বসিয়ে গরম দুধে হলুদ মিশিয়ে এনে দিলো হরির মার হাতে।"মাসী তুমি খাইয়ে দাও আমি ডাক্তারকে ফোন করে আসছি"ততক্ষণে সবাই জড়ো হয়েছে এ ঘরে।

অবাক শশীবালা ,এ কোন রুমকি ! তিনি যাকে চিনতেন সে তো নয়। বাড়িতে এত জন মানুষ থাকতেও নিজের পায়ের ব্যথা অগ্রাহ্য করে এ তো তার সেবাতেই ব্যস্ত।আর বড় বৌ যাকে সারাক্ষণ পারলে তুলোর বাক্সে রেখেছেন সে শুনে বলেছে "যত ঢং তোমার মায়ের , লেগেছে না ছাই ! ওই বলে সেবা নেওয়ার বাহানা। আমি কিন্তু পারবো না কিছু করতে "চেঁচিয়ে বলার সময় হয়তো ভুলেই গেছিলো যে দুটো ঘরেরই দরজা খোলা আর কে জানে হয়তো তাকে শুনিয়ে বলার জন্যই।

ডাক্তার এলেন , ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে যাবার সময় বলে গেলেন "ভাগ্য করে ছেলের বৌ পেয়েছেন , আমাকে তো রীতিমত বকুনি দিয়ে ডেকে পাঠালো।বলেছিলাম এখন ঘুমোতে দাও , বিকেলে যাবো। তা বলে কি না নিজের মার হলেও এটাই বলতেন তো !"

আমি আর দেরি করিনি। আসলে আজ অপারেশন করে ফিরতেই তো দেরী হলো। সবে চান করে খেতে বসেছিলাম। তা সে মা লক্ষী কই।আমিও তো অনেকদিন তার হাতের চা খাই নি "

সলজ্জ ভাবে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো রুমকি "ক্ষমা করবেন কাকু। মার মাথা দিয়ে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে আসলে তাই খুব ভয় পেয়েছিলাম।"

দেখতে গিয়েই পায়ের দিকে চোখ পড়লো। সাদা ব্যান্ডেজের পট্টি ছাপিয়ে রক্ত ফুটে উঠেছে"এটা কি করে হলো "ডাক্তার কাকু বলার সাথেই হরির মা সব বলে দিলো।

বড্ড লজ্জা লাগলো শশীবালার ।সত্যি একবারের জন্য জানতে চান নি অত কেটে রক্ত বেরোনোর পরে তুমি কেমন আছো।ওষুধ ইনজেকশন রুমকিরও হলো।

সদানন্দ বাবু এবার ঘরে এলেন প্রবালের সাথে।"তুমি যাও ঘুরে এসো কটা দিন। একেবারে আটকে পড়েছো এ সংসারে এসে"

শশীবালার পাশে বসা রুমকি এক মুহূর্তে কেমন করে যেন বড় হয়ে গেলো। এ সংসারে যেদিন থেকে সে এসেছে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে শুধু।মা আর বাবার শিক্ষা এটাই তো ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়া। আর প্রবাল সেও তো বড্ড ভালোবাসে ওকে। শশীবালার বলা কথা কোনদিন গায়ে মাখে নি ও।

আজ হঠাৎ মনে হলো ,নাঃ , এই সংসারটা তার নিজের। এই অবস্থায় এদের ছেড়ে সে কোথায় যাবে। হরির মা একা পারবে এই ওষুধ খাওয়াতে , রান্না করতে !

দিদিভাই তো কোনদিন কিছু করেনি আর এখনও করবে না।তাই দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো"ও বাবা এবারও আমার যাওয়া হবে না গো। মার এমন অবস্থায় ছেড়ে কি করে যাই তুমি বলো। আর জানো বাবা প্রবালের ট্রান্সফার হয়ে গেছে অন্য শহরে। সামনের মাসে আমাদের চলে যেতে হবে।তার আগে আসবো আমি তোমাদের সাথে দেখা করতে , মাকে বুঝিয়ে বলে দিও"

মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বাইরে বেরিয়ে গেলেন সদানন্দ বাবু। মনটা খারাপ তবু একটু খুশীও আজ।তারা স্বামী স্ত্রী মিলে ঠিকই মানুষ করেছেন মেয়েকে।

রাতে সবাইকে খাইয়ে শাশুড়ি মায়ের মাথার পাশে এসে বসলো রুমকি। "ঘুমিয়ে পড়ো। আমি তোমার পাশেই আছি"

ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন শশীবালা "এই মাকে ক্ষমা করে দিস পারলে আর মাঝে মাঝে চলে আসিস তোরা এই সংসারেও "

বড্ড কষ্ট হলো বুকের মাঝে কেন শশীবালার আজ।

খুব কান্না পেলো।আর অবাক হয়ে দেখলো এতদিনের জমাট বাঁধা কিছু ব্যথা কিছু ভয় অঝোরে বেরিয়ে আসছে বন্ধ চোখের পাতা ভেদ করে।এ সংসার তার বড় শখের ছিল , আজও আছে। বড় ছেলে যেদিন নিজের চেয়ে বয়েসে বড় বড়লোক বাবার এক মাত্র মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিল সেদিন কিন্তু শশীবালা বাধা দেন নি।বরং ওর বাবাকে বুঝিয়েছিলেন "আহা ওদের জীবন ওদের মতো বাঁচতে দাও। কিন্তু দিনে দিনে বড় বৌয়ের বড্ড খারাপ ব্যবহারেও মুখ খোলেন নি কোনদিন সংসার ভেঙে যাবে বলে।এক ঢাল চুল নিয়ে লক্ষী ঠাকুরের মত দেখতে মেয়েটাকে নিজের হাতে এ বাড়িতে এনেছিলেন কিন্তু ততদিনে বড্ড ভয়ে আড়ষ্ট ছিলেন তিনি।তাই শুরু থেকেই নিরীহ মেয়েটাকে নানান ফন্দি করে শুধু অত্যাচার করেছেন। আর বোকা মেয়েটা মুখ বুজে সহ্য করেছে। আজও পড়ে না গেলে তার শিক্ষা হতো না হয়তো।রাত বাড়লো। চোখ খুলে জল চাইলেন খুব আস্তে।

জল খাওয়াতে খাওয়াতে খুব ধীরে শশীবালার কানে কানে সেই বোকা মেয়েটাই বলে উঠলো"ও মা , মা , বাবাকে আমি রাজি করিয়ে নিয়েছি , তুমি আর বাবা আমাদের সাথেই থাকবে। যাবে তো মা এই এত বড় বাড়ি ছেড়ে দু'টো ঘরের সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটে। আমিও তো যেতে চাইছিলাম না কিন্তু ওখানে আমি না গেলে তোমার ছেলের খাওয়ার বড় কষ্ট হবে সেটা তুমিই বলেছো তাই ভেবে দেখলাম যাবো কিন্তু তোমাদের ছেড়ে না !"

কাঁদছেন না শশীবালা। এবার তো তার খুব খুশী হবার কথা।কিন্তু অনুতাপে ভরা মনটা ভেতর ভেতর পুড়ে যাচ্ছে কি ভীষণ জ্বালায় আর বলছে শুধু "আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয় তাই না !"রুমকিও পায়ের ব্যথা ভুলে আজ বড্ড খুশী।

পেরেছে এক মায়ের মন জয় করতে সে জন্য নয় .. এক বৃদ্ধ বাবা মাকে তাদের শেষ বয়েসে স্বস্তির ছায়াটুকু দিতে পেরেছে বলে..

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু