বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কিছুতে কেন যে মন লাগে না

কিছুতে কেন যে মন লাগে না
ছোট গল্প

"বলছি , এই যে আপনাকেই বলছি শুনছেন !"

জোরে চেঁচালো সাঁওলি কিন্তু না বারান্দায় বসা সে মানুষ ফিরেও তাকালো না এদিকে।

দূর বাবা , কাঁহাতক আর চেঁচানো যায় ! আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর চোখেও পড়ছে না। আর মোদ্দা কথা খুব জোরে বৃষ্টি এলো বলে।পা চালিয়ে ওই বাস স্ট্যান্ড অবধি যেতে যেতে সে জানে যে একেবারে ভিজে যাবে সে ।সামনে এই একটাই বাড়ি !

অসহায় হয়ে আশেপাশে তাকালো সে। না এবার বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করে দিয়েছে। নাঃ এবার রাস্তা পার হয়ে ওই গাছের নিচেই দাঁড়াতে হবে ! ভাবতে ভাবতে সবে সরতে যাবে ঠিক সে সময় লোহার গেট খোলার আওয়াজ হলো যেন .. কে যেন ডাকলো তাকে !

একটু চমকে পেছন ফিরে দেখলো একজন মাঝ বয়সী মহিলা হাত নেড়ে তাকেই ডাকছে। এগিয়ে গেলো সাঁওলি আর কিছু বলার আগেই মহিলা বলে উঠলেন, "আপনি ভিজে যাবেন , এখানে আর কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই , ভেতরে এসে দাঁড়ান।"

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো সাঁওলি গেটের ভেতরে পা রাখলো। দুধারে সারি সারি গাছ সুন্দর করে সাজানো আর তার মাঝদিয়ে নুড়ি পাথর বেছানো একটা সরু পথ। ওই ভদ্র মহিলাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সাঁওলি একটু একটু করে। এ সব ওর এত চেনা কেন লাগছে .. সেই ওর আঁকা ড্রয়িং খাতার বাইরে বেরিয়ে এরা কি করে সব এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো করে।

আরো এগিয়ে গেলো সাঁওলি , ওই নুড়ি পথটা এবার শেষ হয়েছে যেখানে সেখানে একটা ছোট্ট জলাশয় বানানো , ওতে শালুক ফুল ফুটে আছে , মন বলছে গেলেই ওখানে ও অনেক ছোট ছোট রঙিন মাছ আর রঙ বেরঙের পাথর দেখতে পাবে। কিন্তু কি ভেবে হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ চলে গেলো তার। পুরো কালো হয়ে যাওয়া আকাশে এবার আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। আর একটু একটু করে পিছিয়ে ঠিক গাড়ি বারান্দার নীচে যেই দাঁড়ালো সে , আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো তখনই।

"এই আঁকাটা দেখেছিস নীল , তাকা একবার , এই গেট পেরিয়ে যেই পা রাখবে কেউ সে একদম স্বপ্নে ডুবে যাবে জানিস , সে নিজের মনেই এগিয়ে যাবে ভেতরে , আরো ভেতরে আর এই দেখ পথ যেখানে শেষ হবে ঠিক সেখানেই মাটির নীচে বেশ বড় একটা চৌবাচ্ছা বানাবো বুঝলি ! পদ্ম ফুটে থাকবে আর হলুদ লাল সাদা ছোট ছোট মাছ লুকোচুরি খেলবে ওদের পাতার ফাঁকে ফাঁকে। নীল তুই চুপ করে থাকিস না , আরো আছে , পাতা উল্টে দেখ। ওই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলায় সারি সারি তিনটে ঘর হবে বুঝলি। একটা তোর , একটা আমার আরেকটা লম্বা হল ঘর ,আমি নিজের হাতে সাজাবো তাকে। দেওয়াল জুড়ে বসার ব্যবস্থা আর এলোমেলো কিছু বাটিকের জামা পরানো কুশন .. দেওয়ালে নানান ভাবে সাজানো শুধু বই , বই আর বই। দেশ বিদেশে ঘুরবো আমরা আর শুধু কিনে আনবো সব থেকে কমদামের কিছু জিনিস।সমুদ্রের ধারে ধারে ঝিনুক কুড়িয়ে আনবো , আনবো কাশ্মীরের ওই পাহাড়ী গাছের নিচের থেকে একরাশ নানান রকমের ফল , পাতা আরো অনেক কিছু। এবার পাতা ওল্টাতে পারিস ! দেখ এটা কি ! বল তো এটা কি !"

এগিয়ে আসে নীল ," সত্যি বল না সাঁওলি কি এটা ! একটা কিছু আঁকা কিন্তু তুই ঢেকে দিয়েছিস আঠা দিয়ে ! কি এটা ! কি আছে এর ভেতরে বলবি আমায় ! "

হেসে সরে গেলো সাঁওলি , একটু একটু লজ্জা করছে যেন ! "ধ্যাৎ ! ওটা ওভাবেই থাক ! এখন না , সেই পরে বলবো !”

"কবে , কবে বলবি সাঁওলি !"

"আমাকে কথা দে .. আমি না বলা অবধি কোনদিন খুলে দেখবি না তুই”

“কোনদিন তোকে না বলে কিছু কি আমি করেছি !

“না তাও !"

"এই নে , তোকে ছুঁয়ে কথা দিলাম .."

কিন্তু এ কি দেখছে সে এখন ..সে তো নীল নয় ,অন্য কারো সাথে ছাদনা তলায় দাঁড়িয়ে ! পুরোহিত মন্ত্র বলছে , আর পাশে বসা কেউ তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন নীল কোথায় ! এ কে

“তোমাকে কতবার বলবো সাঁওলি , ওই ছেলেটার সাথে মেশা আমার একদম পছন্দ নয়। আর কতবার বোঝাবো তোমাকে , কেন বুঝতে চাও না তুমি "

"কিন্তু বাবাই আমি ভালোবাসি ওকে। আমি ওকে ছাড়া কাউকে পারবো না জীবন সাথী করতে।"

তারপর হাসপাতালের সেই ঘর .. বাবাই বিছানায় !

চিন্তিত মুখে সবাই বাইরে ! মা , দি , কাকাই সব এমন ভাবে ওকে দেখছে যেন ওর জন্যই এই অবস্থা।

আর তারপরে সেই সন্ধ্যে বেলা। বাবাই কি যেন বারবার বলতে চাইছে অথচ বলতে পারছে না। ওর নামটা বিড়বিড় করে বলেছিল দু তিনবার না কি আরো বেশী হয়তো !

সিস্টার বাইরে এসে একটু জোরে চেঁচিয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাবাই ঘোলা চোখে তাকিয়ে শুধু একটাই কথা বলেছিল "তোর যা ভালো লাগে তাই করিস তুই ! আমি আর বাধা দেবো না রে !"

সেই শেষ কথা।

বিয়েটা তারপর সেই বাবাইএর পছন্দের জায়গায় হলো কিছু মাস পরেই।সব স্বপ্ন , আঁকা লেখা খাতার মাঝেই বন্ধ থেকে গেলো। রোহিতকে বিয়ে করে অন্য দেশে চলে গেলো সে তারপরে ।

আর কোনদিন কোন খবর পায় নি নীলের। চেষ্টাও করে নি। কি বলতো ওকে সেটাই ভেবে পায় নি আসলে !কে যেন সামনে এসে দাঁড়ালো , একেবারে সামনে ! সাঁওলি ঠিক দেখছে তো ! না বোধহয় !

নীল তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে !

“কেমন আছো সাঁওলি ! সেই যে না বলে চলে গেছিলে আমি একা একা সেই খাতার পাতায় আঁকা দেখে দেখে সব সাজিয়েছি এ বাড়িতে ! জানো অনেক বার ইচ্ছে হয়েছে তোমাদের বাড়ি থেকে তোমার খবর নিয়ে আসি । কিন্তু সবার কাছে আগেই জেনে গেছিলাম তুমি ডাক্তারের জীবন সাথী হয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে গেছো কবেই । তাই আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি ! "

অস্ফুটে বলতে গেলো সাঁওলি আর তোমার বৌ কোথায় সে ! কেমন আছো তুমি!

কিন্তু একটাও প্রশ্ন করার আগেই একজন কেউ হাতে ট্রে তে চা নিয়ে এসে পৌঁছে গেলো। টেবিলে ট্রে রেখে মিষ্টি হেসে বললো সে , "ভিজে গেছেন তো একটু চা খেয়ে নিন ভালো লাগবে ।"

হাসতে গিয়েও কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেলো সে। কেমন যেন অবাঞ্ছিত লাগলো নিজেকে এদের মাঝে। চোখে একরাশ উপচে পড়া জলকে চোখেই থামিয়ে চা খেয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো সে।ভদ্রমহিলা ভেতরে যাবার আগে মিষ্টি হেসে ওকে আবার আসার কথা বলে ভেতরে গেলো।উঠে দাঁড়ালো সাঁওলি এবার যাবার জন্য। কিন্তু নীল ওকে দাঁড়াতে বলে দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।ফিরে এলো হাতে একটা বড় খাতা নিয়ে .. আস্তে আস্তে তার মলাট খুলে ধরলো ওর সামনে .. এ কি ! এ কাদের নাম লেখা .. নীল সাঁওলি !

গোটা গোটা অক্ষরে , এ তো ওর নিজের হাতের লেখা ! নিতে গেলো খাতাটা সে হাতে ।বাধা দিলো নীল , "একটা পাতা আজও ঢাকা আছে যে ! বলবে কি আছে ওতে ! তুমি তো বলেছিলে তুমি বলবে ! আমি হাত দিই নি তাই !”

বুঝলো সাঁওলি আজ এতবছর পরে হয়তো তুই সম্বোধনটা হারিয়ে গেছে ওই জীবনের আঁকে বাঁকে। এখন একটা ভদ্রস্থ তুমি তে আটকে রয়েছে জীবন।

খাতাটা নিলো না আর সে। শুধু ওই আঠা দিয়ে মোড়া ওই এত বছরের সযত্নে ঢাকা পর্দা এক লহমায় টেনে ছিঁড়ে দিলো সে। ফিরে আর তাকালো না সেদিকে। ঘর পেরিয়ে , বারান্দা পেরিয়ে চলে এলো নুড়ি পাথর দিয়ে সাজানো তার অনেক বছর আগের আঁকা সেই পথে।

একটু একটু করে এগিয়ে গেট খুলে বাইরে .. একেবারে সোজা বাইরে !মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো যে ! সামনে হাত বাড়িয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে উঠে বসলো সে। বিদেশ থেকে ফিরে রোহিত আজকাল সবসময় ওর ভুল ধরায় ব্যস্ত। কাল রাতে নেশার ঘোরে ওকে গায়ে হাত তুলতে এসেছিল। যাবার কোথাও জায়গা নেই আর। চাকরি অনেক পেয়েছিল কিন্তু কোনদিন সে ভাবে ভাবেনি নিজেকে নিয়ে ..আর বিদেশে গিয়ে নীলু আর নীলা জীবনে আসার পরে আর কিছু ভাবার অবকাশ তেমন করে পায় নি যে।

বৃষ্টিটা আরো জোরে এলো। জানলার কাঁচ খুলে একটু জল হাতে নিতে বড্ড ইচ্ছে করলো কেন কে জানে ..

নীল তখন খাতার ছেঁড়া পর্দার আড়ালে রাখা দুটো ছোট ছেলে মেয়েকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে .. নীলু আর নীলা খেলছে একটা বাগানে সাঁওলি আর নীলের সামনে প্রজাপতির সাথে ..আর বড় বড় চোখের জলের বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তাদের ওপরে ..একজন ফিরে যাচ্ছে তার আঁকার খাতা ফেলে .. আরেকজন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের মাঝ মধ্যিখানে ..জীবন কাগজের নৌকায় ভেসে এগিয়ে যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে .. আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে .. জানিনে , জানিনে , কিছুতে কেন যে মন লাগে না ..

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু