বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মেয়ের মতো

রাতের দিকে ঝড় বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ফলে বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।  পাতলা উলের একখানা ছাদর  গায়ে  জড়িয়ে  খুকখুক করে কেশে  উঠল লাইলা। গা'টা জ্বরজ্বর করছে ক’দিন থেকে।  সজল গায়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে বলল, “গা তো বেশ গরম। কতবার বলেছি  হারু ডাক্তারের ডিস্পেন্সারী থেকে একটু ওষুধ আনতে, কিন্তু কে কার কথা শোনে? বলে কিনা, “ওষুধ লাগবে নাগো, এমনিই সেরে যাবে।” চাদরে মুখ ঢেকে লাইলা বলল, “এত সকালে উঠে কোথায় যাবে? ঘরে চাল বাড়ন্ত, মুদির দোকানে ঢের বাকী, বলেছে টাকা না দিলে আর ধার  দেবে না।“ সজল কোন কথা না বলে, চুপচাপ দরজা খুলে এসে দাওয়ায় বসল। বাইরেটা চেয়ে দেখল, গাছগুলো বৃষ্টির জল পেয়ে বেশ চকচক করছে, তাতে সূর্যের আলো পড়ে যেন হীরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পা পা করে উঠোনে এসে দেখল ঘরের পেছনের লাউয়ের মাচাটা ঝড়ে পড়ে গেছে।  উঠোনে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠল, “কৈগো ঘুম ভাঙল? দেখে যাও তোমার লাউয়ের মাচাটা পড়ে গেছে?” ঘুম জড়ানো কন্ঠে লাইলা বাইরে এসে দাওয়ায় বসল। ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে চেয়ে বলল, “ছাগল দুটো ছেড়ে দাও, বাইরে পাতাপুতি খেয়ে আসুক।“ লাইলা আবার কেশে উঠল, তারপর বলল, “আজ আর বাইরে গিয়ে কাজ নেই, তুমি বরং মাচাটায় নতুন খুঁটি দিয়ে ঠিক করে দাও।“  সজল বলে উঠল,  “ঘরে বসে থাকলে সংসার চলবে?  জানোই তো এই টোটো চালিয়েই উনুনে হাঁড়ি চড়ে।“   লাইলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর সংসার! দুটো মানুষ বৈ তিনটে তো নয়, ও একটা কিছু ফুটিয়ে নিলেই হল, তুমি বরং আজ বের হইও না। একটু বেলা হলে হারু ডাক্তারের কাছে থেকে ওষুধ নিয়ে এসো।“ 

সজল বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, “এখনকার অসুখ বিসুখকে  অবহেলা করলে হবে না। কীসে থেকে কী হয়! তুমিও আমার সঙ্গে চল, দেখিয়ে ওষুধ আনা ভালো।“ 

সজল এক মুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে ঢকঢক করে জল খেল, জলের গ্লাসটা দাওয়ায় রেখে, “শোন আমি একটু বের হচ্ছি, ফিরে এসে ওষুধ আনতে যাব, তুমি পারলে মাচাটা বেঁধে দিও, আমি একটু স্টেশন চত্বরটা দেখেই ফিরে আসছি।“ বলেই টোটো নিয়ে বেরিয়ে গেল সজল।  

 

লাইলা রান্নাঘরের এঁটো বাসনগুলো কল পাড়ে রেখে, ঘরদোর ঝাড় দিয়ে এসে দাঁড়াল লাউয়ের মাচাটার কাছে। একটা লাউয়ের ডগা হাতে তুলে নিয়ে দেখল অনেক কলি এসেছে।  লাইলার মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, “ইস খুঁটিটা পচে গেছে, পাল্টাতে হবে।“ বলেই ঘরে গিয়ে দা নিয়ে এসে একটা জিয়ালার ডাল কেটে পুঁতে দিল। মাচাটা তুলে তাতে বেঁধে দিয়ে, বলল, “বেশ আর পড়বে না।“ এমন সময় পাড়ার স্কুল শিক্ষক সবুর আলি বাড়িতে ছুটে এসে, “লাইলা ও লাইলা, এই ভোরবেলায় ছাগল না ছাড়লেই কী চলছিল না? কত সাধের আম গাছটা তোমার ছাগলে মাথা মুড়িয়ে খেয়ে এল, যত সব ছোটলোকের জাত পাড়ায় এসে জুটেছে।“ গালি দিয়ে তিনি চলে গেলেন বটে। কিন্তু লাইলার রাগ গিয়ে পড়ল ছাগলটার উপরে। লাইলা একটা ডাল তুলে ছাগলকে দু’বাড়ি মেরে বলল, “তোর জন্যই সাতসকালে ছোটলোক শুনতে হল, গরীব মানুষকে ছোটলোক বলতে পারলে অনেকেরই গায়ের জ্বালা মেটে।” ছাগলটাকে খুঁটিতে বেঁধে, খ্যানখেনে গলায়, “এই সংসার থেকে কবে যে মুক্তি পাব, আল্লাহ জানে!”  থালা বাসন ধুয়ে তুলে দিয়ে ঝাঁটা দিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিতে শুরু করল লাইলা।

 

 “লাইলা ভাবি তোমার ঘরে একটু গমের আটা হবে গো?” বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, পাশের বাড়ির নাসরীন। তোমার দেওর এখন একটু হাসপাতালে যাবে, আটাও ফুরিয়ে গেছে, বেলা হলে তোমাকে দোকান থেকে এনে দিয়ে দেব আটা। থাকলে এক বাটি দাও দেখি ভাবি।“  ঝাঁটাখানা ঘরের চালায় রেখে কলের জলে হাত ধুয়ে, আঁচলে মুছে, “আটা যা আছে নিয়ে যা, আবার রেশন দিলেই আটা পাওয়া যাবে।“  বলেই ঘরে ঢুকে এক বাটি আটা দিয়ে বলল, “এ আটা ফেরৎ দিতে হবে না, নিয়ে যা।“   

 

সজল আপন মনে  টোটো নিয়ে এগিয়ে চলেছে। মন্দিরের বাঁকটা পেরোতে গিয়েই দেখল মন্দিরের চাতালে বসে  একটা অল্প বয়সী মেয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে।  গাড়ি থামিয়ে সজল লক্ষ করল, আশেপাশে জনপ্রানী নেই। গুটিগুটি পায়ে কাছে গিয়ে ডেকে উঠল, “ও মেয়ে কী হল তোমার?” মেয়েটির বয়স কত আর হবে? দশ কী বারো। যন্ত্রণায় আছাড়ি পিছাড়ি করছে। মুখটা কেমন বিকৃত হয়ে গেছে। ঝড় জলের রাতে এখানে কার সঙ্গে এল? নাকি একা একাই এসেছে। “তোমার সঙ্গে কেউ আছে নাকি ও মেয়ে...?” হাতের ইশারাই মেয়েটি বলল, “আর সহ্য করতে পারছি না।“ একটু ইতস্তত করে সজল পাঁজাকোলা করে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে টোটোতে শুইয়ে দিয়ে স্টার্ট দিল। 

 

“ও নার্সদিদি আমার টোটোতে একটা মেয়ে যন্ত্রণায় আছাড়ি পিছাড়ি করছে। একটু দেখুন না।“ নার্সদিদি সঙ্গে সঙ্গে এসে মেয়েটিকে ভালো করে দেখে বলল, “কে হয় আপনার? একে তো ভর্তি করতে হবে?” 

“না মানে কে হয় বলতে...!”  ভেবলিয়ে সজল দাঁড়িয়ে রইল। 

“রোগীর নাম ঠিকানা বলুন?” সজল ভাবছে আমি তো চিনিই না, কি করে নাম ঠিকানা বলব। ফ্যালফ্যাল করে নার্স দিদির দিকে চেয়ে রইল সজল। নার্সদিদি বলে উঠল, “কী হল রোগীর নাম বলুন?”   সজল সাত পাঁচ না ভেবেই বলে ফেলল, “হ্যাঁ নাম মানে সায়রা, ওর নাম সায়রা।” খচখচ করে লিখলেন, আপনার নাম ঠিকানা বলুন,” “আমার নাম সজল সর্দার, বাড়ি বকুলতলা।“ লেখার পরে নার্সদিদি বললেন, “আপনার কে হয়?” সজল থতমত খেয়ে, “আমার কে হয় মানে...?”   নার্সদিদি ফিক করে হেসে ফেললেন, “তারপরে বললেন, “হ্যাঁ মেয়েটি আপনার মেয়ে তো?” আগপিছু না ভেবে, সজল বলে উঠল, “হুম।“  

 

কাগজের ফর্মালিটি সেরে নিয়ে, “ওকে ভর্তি করে নিলাম, ডাক্তার এসে আগে দেখুন পেশেন্টকে তারপর জানা যাবে কি হয়েছে। আর হ্যাঁ কোথাও যাবেন না আপনি। ঐ বেঞ্চে গিয়ে বসুন। ডাকলেই আসবেন।“    

 

সজল পাশের একটা খালি বেঞ্চে গিয়ে বসল। তাঁর মাথায় তখন হাজার বাতির লাইট জ্বলছে। মনে মনে ভাবল,  “মেয়েটি যেই হোক ফেলে দিয়ে তো চলে যাওয়া যায় না। ডাক্তার দেখে ওষুধ দিলে নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবে। তখন জানা যাবে ওর নাম ঠিকানা।“ আজকে আর স্টেশন যাওয়া হবে না, এখানে কতক্ষণ লাগবে কী জানি। এমন সময় মাইকে ঘোষণা হল, “সায়রার বাড়ির লোক কোথায় আছেন? কাউন্টারে একবার দেখা করুণ।“  

সজল ছুটে কাউন্টারে গিয়ে, “আমিই সায়রার লোক, বলুন কী বলছেন?” কাউন্টার থেকে নার্সদিদি বলে উঠলেন, “সায়রার অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করাতে হবে। রক্ত লাগতে পারে, যোগাড় রাখুন।“ সজল যেন আকাশ থেকে পড়ল, বলল, “রক্ত?” একটু সরে এসে, মনে মনে ভাবতে লাগল, “কী ঝামেলা দেখ দেখি। লাইলা বারণ করেছিল আজ বের হতে। না এলেই ভালো হত, অথচ...পালিয়ে গেলেও তো হয়। কী প্রয়োজন  পরের ঝামেলা ঘাড়ে নিয়ে। কার না কার মেয়ে তাঁর ঠিক ঠিকানা নেই। ভাবতে ভাবতে হাসপাতালের একবারে বাইরের সিঁড়িতে পা দিয়েছে সজল, সামনেই গেটের কাছে টোটো দাঁড়িয়ে আছে, চলেই যাই, যা হবার হবে। টোটোতে বসে স্টার্ট দিতেই মাইকে আবার ঘোষণা হল, “সায়রার  বাড়ির লোক কোথায়, তাড়াতাড়ি আসুন।“ ঘোষণা কানে বাজতেই দাঁড়িয়ে গেল সজল। গাড়ি রেখে দৌড়ে গেল কাউন্টারে। “নার্সদিদি আমি সায়রার লোক বলুন কী প্রয়োজন?” আমি বললাম তো রক্ত লাগতে পারে, রক্ত এনেছেন?” সজল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, “না মানে, আমি দিলে হবে না দিদি?” আবার নার্সদিদি হেসে উঠলেন, বললেন, হবে না কেন, গ্রুপ মিলে গেলেই হবে। কী গ্রুপ আপনার রক্তের? জানেন?”  সজলের হঠাৎ মনে পড়ে গেল, একদিন স্থানীয় ক্লাবে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করিয়েছিল। সেদিন ওরা বলেছিল  (B ), সেটাই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বলল,  “(B ) নার্সদিদি।“ 

নার্সদিদি বলে উঠল, “ঠিক আছে আমার সঙ্গে আসুন।“  

 

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। টোটো নিয়ে বাড়ি ঢুকল সজল। সজলকে ঢুকতে দেখে লাইলা বলে উঠল, “কীগো এই আসছি বলে গেলে, অথচ  বিকেল হল ফিরতে? কিছু খেয়েছ নাকি...? মুখটা শুকনো কেন?”  

 

সজল কোন কথা না বলে গাড়িখানা চালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে, “নাগো কিছু খাওয়া হয়নি, শরীরটাও দুর্বল ঠেকছে।“ লাইলা যেন আকাশ থেকে পড়ল, বলল, “সেকী? কিছু না খেয়ে এতক্ষণ আছো?  শরীর দুর্বল তো হবেই।  যাও চান করে এসে, আগে খেয়ে নাও।“ 

 

ভাত খেতে খেতে সজল বলে উঠল, “লাইলা আজ একটা কান্ড ঘটে গেছে। ভাবছি এখন কী করবো?”  লাইলা উদগ্রীব হয়ে বলে উঠল, “কান্ড মানে? কোন ঝামেলা হয়েছে? কোথায়, কার সঙ্গে?” বলেই পাশে এসে বসল। 

“নাগো সে সব না। আসলে একটা অচেনা মেয়ে...!” 

লাইলা সব শুনে বলল, “তা এখন কোথায় সে মেয়ে? হাসপাতালেই? ওর বাবা-মাকে খবর দাওনি?”    

মুখের ভাতটা গিলে নিয়ে,  “খবর দেব কী, কেউ থাকলে তো? ওর নাকি কেউ নেই। মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে বুঝলে লাইলা? কাছে এনে রাখবে? যতদিন খোঁজ না হয়!”  

স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে লাইলা হারিয়ে গেল অতীতে। লাইলার কোলের এক রত্তি  মেয়ে। সকালে দৌড়ে স্কুলে গেল। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে এসেই, “মা আমার পেটে খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি কী মরে যাব মা?” লাইলা বুকে জড়িয়ে নিয়ে সেদিন ছয় বছরের মেয়েকে আশ্বাস দিয়েছিল, “বালাইষাট মরবি কেন? তোকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। একদম ভাবিস না।“ কিন্তু সেই মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই কষ বেয়ে নালা ঝরে জিভ বেরিয়ে গিয়েছিল। বাঁচাতে পারেনি লাইলা তাদের একমাত্র মেয়েকে। আল্লাহ পাক তবে কী সেই মেয়েকে আজ ফিরিয়ে দিল?  আজ বেঁচে থাকলে আমাদের সায়রার বয়সও বারো বছর হত।  

“কী ভাবছো লাইলা? কিছু বল?“ বলেই লাইলার গায়ে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিল সজল। 

“সবই তো বুঝলাম, এই নিয়ে পরে যদি থানা পুলিশ হয়? আমরা গরীব মানুষ, সবাই আবার কথায় কথায় ছোটলোক বলে সম্বোধন করে। পারবে  তখন সব সামলাতে?”  

“একটা কথা খুব মনে হচ্ছে জান? হাসপাতালের কাগজে আমার মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছি, নামও লিখে দিয়েছি সায়রা। আসলে আমাদের সেই ছোট্ট সায়রার কথা খুব মনে পড়ছিল...!”   

“তাহলে এক কাজ কর, আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।  চল গিয়ে নিয়ে আসি মেয়েটাকে, তোমার টোটো বের কর...!”    

“সে না হয় বুঝলাম কিন্তু সম্পর্ক? লোকে কী বলবে?”  

“শোন তোমাকে অতশত ভাবতে হবে না, কত সম্পর্ক আছে পৃথিবীতে। এও না হয় নামহীন সম্পর্কে  ‘মেয়ের মতো’  বড় হবে।“ সজল আর এক মুহূর্ত দেরি না করে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ল...!

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু