বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

আমার নিজের সৎ মা



গলা জড়িয়ে মার সাথে শুয়ে আছে ছোট্ট ডোডো। আজ তো শনিবার। কাল রাতে আগেই সব কথা বলে নিয়েছে নিজের মার সাথে। কাল তোমার অফিস , আমার স্কুল কিছুই নেই না মাম্মা। তাই আমি আর তুমি অনেকক্ষণ ঘুমোবো কাল। তুমি আমায় অনেক গল্প শোনাবে আর আমার দিকে পাশ ফিরেই শুধু শোবে।


বাপিকে বলো নিজের মাম্মার কাছে শোবে কাল থেকে। মুখে হাসি চেপে সরে গেলেন রমলা দেবী.... রিনির শাশুরিমা। বুকের মাঝে কেমন যেন একটা হালকা খুশীর হাওয়া ছুঁয়ে চলে গেল এক নিমেষে। ঘর পেরিয়ে বিশাল বারান্দায় এসে নিজের তুলসী মঞ্চের পাশে এসে চুপ করে দাঁড়ালেন। সন্ধ্যে প্রদীপ আর ধূপের ধোঁয়ায় কেমন যেন একটা মোহময় পরিবেশ হয়ে রয়েছে।


কি জানি কেন তাও দু চোখের জল এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল আজ এই শাশুরিমার আঁচলের কোণা কোণা। এত সুখ অপেক্ষায় ছিল তার জন্য ! নিজের ইষ্ট দেবতার চরণে বারবার মনে মনে মাথা ছোঁয়ালেন আজ রোজকার মত আবার। হু হু করে বেরিয়ে আসা জল ভিজিয়ে দিলো তুলসী মঞ্চের পাশ টুকুও আজ।


কিন্তু সব চোখের জল দুঃখের হয় কি ! মনের আশা প্রত্যাশার পথে যখন শুধুই নিরাশা এসে নিজের শক্ত পাঁচিল তুলে দিতে চায় ঠিক সেই সময়ে এক টুকরো আশার রামধনুর ঝিলিক সব দুঃখ দূরও তো করে দেয়। সে তো অহরহ তোমার আমার জীবনেও ঘটে চলেছে তাই নয় কি ! তো আজ রমলা তো দুঃখের কান্নায় ভেসে যাচ্ছে না ... সে তো আজ মুহূর্ত দিন মাস আর বছরে মিশে যাওয়া তার সেই দুঃখের পাহাড়ের নিচে এক সবুজ ঘাসের জমিতে দু পা রেখে নিজের খুশিটুকু আঁচলে বেঁধে নিতে চাইছে। তা একটু কাঁদুক না হয় ! তোমরা কি বলো...!


ডোডোর আধো আধো গলার আওয়াজ ভেসে আসছে কানে আর রিনির টুংটাং হাসির আওয়াজ। এত ভাল বৌ সত্যি পাবেন তা কি জানতেন তিনি ঠিক আজ থেকে দু বছর আগেও। তখন তো কিছু না কিছু নিয়ে এক ভীষণ যন্ত্রণার সম্মুখীন হওয়া রোজ রোজ নিত্য প্রতিমুহূর্ত !


দীপ আর তৃষার বিয়েটা হয়েছিল ঠিক আজ থেকে চার বছর আগে। কলেজে নয় এক অফিসে কাজ করতে করতে আলাপ আর তারপরে ভালোলাগা আর হয়তো ভালবাসাও ! কিন্তু সত্যিই কি ভালোবাসা ছিল ওদের মাঝে .... কে জানে ! রোজ ঝগড়ার কি কারণ থাকতে পারে তা আজও বুঝে উঠতে পারেননি তিনি।


হ্যা স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হওয়াটা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার হয়তো কিন্তু এই বেসামাল ঝগড়ার রাশ কিছুতেই টানা গেল না শেষ পর্যন্ত। পরে শুনলেন দীপ এর কাছে ওকে বিয়ে করার আগেই জেদ ধরেছিল তৃষা বিয়ের পরে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকবে ওরা দুজনে। শুরু হল আরো নানান বিষয়ে মতভেদ। আর শেষে একরাতে ঘোষণা করে দিলো তৃষা সে আলাদা থাকতে চায়। তার জীবনে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। আর এত তাড়াতাড়ি মাতৃত্বের বন্ধনে জড়াতে চায়নি সে নিজেকে... এর সবকিছুর জন্য দীপ দায়ী। তাই ডোডো এখানেই থাক নিজের বাপি আর দাদাই ঠাম্মার কাছে। হ্যা যদি দীপ রাজি থাকে আলাদা থাকার জন্য তবে নয় তৃষা আরেকবার ভেবে দেখবে !


রাজি হয়নি দীপ সে কথায় শুনে বুকটা গর্বে ভরে উঠলেও ভেজা চোখে ওর বাবা আর রমলা পাশে বসিয়ে বলেছিলেন ... কেন রে দীপ একবার বলে দেখতিস আমাদের ! এই সামান্য ব্যাপারে ঝগড়া মীমাংসা করে নিতিস না হয় !


তাছাড়া তোর বাবা আর আমি নিজেরা দুজনেই এখনও তো সবকিছু বেশ করে নিতে পারছি .... অতটা বুড়োও তো হইনি রে দীপ ! রমলার কোলে মাথা রেখে সেই ছোটবেলার দীপ ফিরে এলো আজ বহুদিন পরে। মার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখে বললো .... আচ্ছা মা ! কি দিয়ে তৈরী তুমি বলো তো আমায় ! এই সারা সারাদিন বাড়ির কাজ , রান্না আর ছোট্ট ডোডো কে দেখাশোনা করে হাঁফিয়ে ওঠো না তুমি।


একদিনও তো আরাম পাও নি যেদিন থেকে এই বাড়িটায় এসেছো ... ঠাকুমা পিসি আর আমরা সবাই শুধু তো নিয়েছি তোমার থেকে , কি দিয়েছি বলো তো আজ পর্যন্ত ! বড় সাধ করে সবার অমতে গিয়ে আমার বিয়েটা দিয়েছিলে তুমি তৃষার সাথে। সে কিন্তু শুধু তোমায় নয় এই বাড়িটাকেই কোনদিন নিজের বলে ভেবে উঠতে পারে নি।


রোজ প্রতিনিয়ত ওর তালে তাল মেলাতে মেলাতে আমি কখন যেন নিজের জীবনের সুর তাল টুকুই ভূলে যেতে বসেছিলাম। আর তো আর এই ছোট্ট ডোডোর তোমরা না থাকলে কি হতো আজ ভাবলেই বুকের মাঝে শিরশির করে ওঠে যে। আমাকে পছন্দ করেছিল কেন আর কেনই বা বিয়ে করে এই প্রহসন করে গেল তাই বুঝলাম না আমি যে মা ! আজ দুবছর পরে একটু আমাকে ঘুমোতে দাও মা তোমার কোলে!


ভিজে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে চুপ করে বসে রইলো রমলা বেশ কিছুক্ষণ। ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপ সত্যি বুঝি ! তারপর সেই ডোডো কে বুকে আগলে মানুষ করতে করতে হঠাৎ একদিন দীপ এর ছোট পিসি এই রিনির কথা এসে বললো।


খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে সে। লেখাপড়া শেষ করে ছোটখাটো একটা চাকরি করে। থাকে ওই পিসীর বাড়ির কাছেই। কথায় কথায় সব শুনে রিনির মা বাবা না কি রাজি দীপের সাথে ওর সম্বন্ধে। কিন্তু দীপ তো রাজি নয় আর বিয়েতে। কি করে বোঝায় রমলা তার এই আদরের ননদ কে। তাই ঠিক হলো এবার ডোডোর দু বছরের জন্মদিনে সবার সাথে রিনিও আসবে তার বাবা মার সাথে এই বাড়িতে ! তারপর দেখা যাক কি হয় !


এলো সেই জন্মদিনের সন্ধ্যে ! বেশ কিছু অতিথির সাথে সাথে রিনিও নিজের বাবা মার সাথে এসে পৌঁছলো । হালকা নীল রঙের শাড়িতে বিনা কোন সাজ সজ্জায় রিনিকে বড় মিষ্টি লাগলো রমলার। তৃষার সর্বদা সুসজ্জিত মুখটা মনে পড়ে গেল তখনই । ছোট পিসি এসে আলাপ করিয়ে দিলো সবার সাথে ।


কেক কাটার সময়ে নিজের বাপির কোলে উঠে কেক কাটতে কাটতে হঠাৎ কি জানি কেন খুব জোরে কেঁদে উঠলো ছোট্ট ডোডো। সব ছোট বাচ্চাদের নিজের মার সাথে দেখে কি জানি হয়তো নিজের মার কথা মনে পড়ে গেছিলো তার।


কিন্তু কোনদিন তো কাঁদে না সে এমন করে !সবাই এগিয়ে এলো , ভোলাবার চেষ্টাও করলো কিন্তু বাপির পিঠে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদেই গেল একটানা সে। কি যে হলো রিনির , এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বলে উঠলো , ডোডো সোনা আমার সাথে খেলবে তুমি ! চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ঝাঁপিয়ে চলে এলো ডোডো রিনির কোলে।


তারপর যা যা হলো প্রায় সবটাই স্বপ্ন মনে হয় আজও রমলার ! সেই জন্মদিনের ঠিক তিন মাস পরে বৌ নয় ডোডোর নতুন মা কে বরণ করে আনলো রমলা তার এই ছোট্ট বাড়িতে। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না রিনির এই ভালবাসা ডোডোর প্রতি। সৎ মা এত ভাল হয় ! কে জানে বাপু !


দিন গড়িয়ে মাস আর মাস গড়িয়ে পেরিয়ে গেল বছর । রিনি পাঁচ বছরের হলো যেদিন সেই জন্মদিনে সবাই এসে শুধু প্রশংসাই করে গেল রিনির। আর আড়ালে রমলাকে বলেও গেল এত ভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়।


তাই হবে হয়তো ! বারান্দা পেরিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে দেখা হয়ে গেল দীপের সাথে। মাকে দেখে এক মুখ হেসে এগিয়ে এলো দীপ , জানো মা কাল কি হয়েছে ! বড় বড় চোখ তুলে তাকাল রমলা নিজের ছেলের দিকে। কাল ডোডো কে স্কুলে কেউ না কি বলেছে যে রিনি ওর নিজের মা নয় .... ওর সৎ মা।


বাড়ি এসে কাউকে কিছু বলেনি সে। চুপচাপ নিজের ঘরে বসে রিনির ফটো এঁকেছে। নীচে ছোট্ট ডোডোর ছবি। ওপরে লিখেছে .... আমার নিজের সৎ মা ! স্কুলে যাবার আগে রিনি কে দেখিয়েছে ডোডো। রিনির চোখে জল দেখে মুছিয়ে দিয়ে বলেছে .... পিসি বলেছে সে তো কবেই , যে আমার আসল মা আমায় ছেড়ে চলে গেছে আমি যখন খুব ছোট ছিলাম ! আমি তো তাকে কোনদিন দেখেছি কি না মনে করতে পারি না মা।


আমি তো শুধু জানি তুমি আমার মা। তোমায় জড়িয়ে না শুলে আমার যে ঘুম আসে না কোনদিন। তুমি কেঁদো না মা। আজ রাতে আমি সব গল্প শুনবো তোমার কাছে .... সেই  যেদিন এই ছোট্ট ডোডো কে তুমি আপন করে নিয়েছিলে সেদিনের গল্প। বলবে তো তুমি মা !


চোখের জলে সেদিনের সেই মা মেয়ের গল্প বলতে বলতে আর শুনতে গিয়ে এখানেও রমলা আর দীপ ভেসে গেল চোখের জলে। দরজার বাইরে থেকে শোনা রিনি আর ডোডোর সব কথার মানে পরিষ্কার হয়ে গেল রমলার কাছে। দীপের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল রমলা। পেছন ফিরে দেখলেন শান্ত পায়ে নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে গেল দীপ।


একটু হাসলো রমলা ... খুশির হাসি ...! মনে মনে ভাবলেন নিজের সৎ মার হাতে মাথা রেখে ডোডো বুড়ী এতক্ষনে পৌঁছে গেছে নিজের স্বপ্নের জগতে হয়তো ! মা শুধু মা হয় ! জন্ম না দিলেই বা ! এই স্নেহ এই ভালোবাসা শুধু এক মায়ের আঁচলের নিচেই তো যুগে যুগে সব ডোডোরা পেয়ে এসেছে। সে যে ওর নিজের আঁকা ছবির মা !


ডোডোর নিজের সৎ মা !

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু