অ-সময়
ধারাবাহিক গল্প: অ-সময়
প্রথম পর্ব
রোজকার মতো মিলি দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সামনের রাস্তার ওপারে থাকা অশ্বত্থ গাছটার থেকে পাখীদের কিচিরমিচির নিরন্তর ভেসে আসছে। স্বচ্ছ নীল আকাশটা নীচের দিক থেকে ধীরে ধীরে লাল হতে শুরু করেছে। এই মনোরম পরিবেষটাকে উপভোগ করতে ওর ভীষণ ভালো লাগে। দাদু বলতেন, “দিদিভাই! সকালে উঠে সূর্যের প্রথম ছটা গায়ে লাগালে অনেক রোগ দূরীভূত হয়।“ কথাটা মনে হতেই ওর কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। সকালের সুন্দর পরিবেষটা যেন একটা বিষণ্ণতার চাদরে ঢাকা পড়ে গেল। বারান্দায় চটি জোড়া খুলে, মিলি ধীর পায়ে নেমে পড়ল। শিশির ভেজা ঘাসের গালিচার উপরে খালী পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। স্নিগ্ধ আলোক রশ্মি ছড়াতে ছড়াতে সূর্য ততোক্ষণে দিগন্তের উপর উঠে এসেছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আকাশে একটা উজ্জ্বল লাল থালা সদ্য বিবাহিত নারীর কপালের সিঁদুরের মতো দেখতে লাগছিল। কিছুক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে পর চোখটা ঝলসে গেল বলে ও নীচে ঘাসের দিকে তাকাল। টমি ওর পায়ের কাছে বসে ওর দিকে তাকিয়ে ল্যাজ নাড়াচ্ছিল। নুয়ে পড়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে একটু আদর করে দিলো। টমি বিগলিত হয়ে “কিঁউ কিঁউ” করে উঠল। একটা লম্বা ছায়া টমির উপর পড়তেই মিলি ঘুরে তাকাল। কেও একজন সূর্যটাকে ঢেকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা শিলিউটের ধার ঘেঁষে আলোর ছটাগুলো যেন ছলকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মুখটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মিলি “কে?” বলে জিজ্ঞেস করার আগেই শুনতে পেল সেই আদুরে ডাক।
“দিদিভাই!”
মিলি চমকে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত মাথা থেকে পা অবধি নেমে গেল।
“দাদু, তুমি!”
মিলি ছুটে গেল তাঁকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু, ওর হাত দুটো যেন হাওয়ার মধ্যে দিয়ে পার হয়ে গেল। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিলো; নাহলে পড়েই যেত। টমি তারস্বরে চ্যাঁচাতে থাকল। পেছন ফিরে দেখতে পেল, দাদু টমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। টমিও কিছুক্ষণ পরে চিৎকার থামিয়ে ল্যাজ নাড়াতে শুরু করল। মিলির গায়ে লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। দাদু টমিকে আদর করতে করতে ওর দিকে ফিরে তাকালেন। এবার ওঁকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মিলি একবার চার পাশে নজর বুলিয়ে আবার দাদুর দিকে চাইল। উনি তো আগের মতোই আছেন; সেই চোখমুখের আদল, পরিষ্কার করে কামানো দাড়ি গোঁফ, ঠোঁটের দু পাশে সব সময় লেগে থাকা এক চিলতে হাসি। তবে কি দাদুকে আবেগের চোটে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ও ভুল দিশায় এগিয়ে গিয়েছিল! এবার আর ছুটে না গিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে দাদুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। ডান হাতটা মাটিতে গিয়ে ঠেকল। অবাক বিস্ময়ে এবার দাদুর মুখের দিকে তাকাল।
হাসতে হাসতে দাদু বললেন, “আমাকে তুই আর ছুঁতে পারবি না দিদিভাই।“
মিলির কপালে আরও কিছু ভাঁজ পড়ল।
“তার মানে?”
“তার মানে, আমি এই মুহূর্তে তোর সামনে থাকলেও বাস্তবিক আমার এখন কোন অস্তিত্ব নেই।“
মিলি কিছুই বুঝতে পারছিল না। মনে পড়ে গেল, সেদিনকার কথা, যেদিন দাদু হটাত করে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।
ঘুম থেকে উঠেই দাদুকে ঘরের মধ্যে অস্থির ভাবে পায়চারী করতে দেখেছিল মিলি। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলছিলেন না। মা তাঁকে জোর করে জল খাবার খাইয়ে দিয়েছিলেন। খেয়ে পরই উনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলেছিলেন, “ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না।“
মিলি এই সব কথার কোন মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওরা কারা, দাদু?”
জবাব দেননি উনি। শুধু নিস্পলক তাকিয়ে ছিলেন একবার। তার পরেই বেরিয়ে গেছিলেন। আর ফেরা হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেলের শেষে সন্ধ্যা নেমেছিল; কিন্তু দাদু আর ফিরলেন না। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। মানুষটা যেন উবে গিয়েছিল হটাত করে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গেলেও তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। একদিন মিলির বাবা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন, তার পর মাও সেই একই পথে পাড়ি জমালেন। মিলির তখন সবে বিয়ে হয়েছে। অসিতের সঙ্গে ঘর করা হল মাত্র তিন বছরের জন্য। তার মধ্যে রুচিকার জন্ম। অসিত পথ দুর্ঘটনায় মারা গেল। মিলির জীবনটা হাহাকার করে উঠেছিল। এক মাত্র মেয়েকে সম্বল করে বেঁচে থাকার জন্য কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসরের চাকরিটা তখনই নিল। তারপর পি এইচ ডি, আর রিসার্চের মধ্যে ডুব দিল। রুচিকা ততো দিনে বড় হয়ে গেছে। কলেজে পড়তে পড়তে এক বিদেশী যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে ফেলল। মিলি বাধা দেয়নি। তোমার জীবন; তুমি কী ভাবে কাটাবে, তা তুমি নিজেই ঠিক করো। এখন রুচিকা স্বামীর সঙ্গে সংসার পেতেছে। কখনও কখনও ওর কাছে আসে। মিলি নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। রুচিকার সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা বলতে সুযোগ পায় না। এখন রুচিকাও আর বিশেষ আসে না। এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। নিজের গবেষণার কাজ এগিয়ে চলেছে ।
তবে, এত দিন পরে দাদুর দেখা পাবে; এটা সম্পূর্ণ রূপে কল্পনাতীত। অবাক বিস্ময়ে ও তখনও ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে, দাদুই মুখ খুললেন, “ভয় পেলি নাকি রে!”
মিলি শুধু বলল, “ভয় না, দাদু! আমি শুধু হিশেবটা মেলানোর চেষ্টা করছি।“
দাদু এবার বলতে শুরু করলেন, “শোন দিদিভাই! আমি যে সময় এখান থেকে হারিয়ে যাই, তার বেশ কিছুদিন আগের থেকে একটা বিচিত্র রকমের বার্তা আমার টেলিপোর্টেশন যন্ত্রের মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছতে থাকে। সেটাকে অনুধাবন করতে গিয়ে বুঝতে পারি, বহু আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত এক আকাশ গঙ্গার মধ্যে থেকে কোন এক জীবন্ত গ্রহের বাসী আমার টেলিপোর্টেশন যন্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে এসে অবতীর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু, আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, তখন পর্যন্ত কেও ওদেরকে দেখতে পায়নি। ওরা কোনোরকমে আমার যন্ত্রে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে, কিন্তু ওদের বার্তা আমি বুঝতে পারছি না। তাদের বার্তাটাকে ডিকোড করার চেষ্টা করতে থাকলাম। অনেক কষ্টে তাদের বার্তা বুঝতে পারলাম। তারা এখান থেকে ফিরতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওদের অবস্থিতি জানতে লেগে পড়লাম। বেশ কয়েকবার বার্তা আদানপ্রদান করার পর যখন ওদের অবস্থান জানতে পারলাম, তখন আমার মাথায় বজ্রাঘাত হওয়ার জোগাড়। ওরা আমাদের ঘর থেকে কিছু দূরে থাকা একটা পরিত্যক্ত হানাবাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে। সেখানে সচরাচর কেও যাওয়া আসা করে না।
সেদিন ওখানে পৌঁছে ওদের খোঁজ করছি; হটাত মনে হল, কেও আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিচ্ছে। চার পাশটা ঝোপঝাড় আর আগাছায় ভর্তি। যে কোন জন্তু জানোয়ার তার মধ্যে সেঁধিয়ে থাকতে পারে। ভাঙ্গা চোরা ইটের দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকলাম, কারণ গেটটা মর্চে ধরে একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। গেটে ঝোলানো তালাটাকে ঝোপের মধ্যে খোঁজাও সম্ভব হচ্ছে না। দেওয়াল থেকে লাফ দিয়ে ভেতরে গিয়ে পড়তেই মাথার মধ্যে এক প্রকার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিঁর ক্রমাগত ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সেই আওয়াজ ও যন্ত্রণা, দুটোই সয়ে আসতে লাগল। তখন চার পাশটাতে তাকিয়ে কোন দিকে এগোব, ঠিক করতে থাকলাম। ঠিক সেই সময় বাড়িটার সদর দরজাটা খুলে গেল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কে খুলল। কাওকে দেখতে পেলাম না। তখনই কারুর নির্দেশে সেই খোলা দরজাটার দিকে এগোতে লাগলাম। কাঁটা ঝোপের মধ্যে দিয়ে কোনোরকমে ঘরটার বারান্দার নিচে গিয়ে পৌঁছলাম। পুরনো কালের বাড়ি। অনেক উঁচু বারান্দা। সামনের সিঁড়ির ধাপগুলোও বেশিরভাগ জায়গায় ভেঙ্গে পড়েছে। তলা থেকে বারান্দার উপরে হাত রেখে নিজেকে তোলার চেষ্টা করলাম। মনে হল, কেও যেন আমাকে তুলে সেটার উপর পৌঁছিয়ে দিলো। এবার কিছুটা যন্ত্রচালিতের মতো খোলা দরজাটার ভেতর ঢুকে পড়লাম।
ক্রমশ।
