বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

দি-পু-দা-র দি

মধ্যবিত্ত বাঙালি, যারা কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই ঘুরতে বেরোয়, একা, দোকা বা দল বেঁধে, তখন তাদের গন্তব্য দি-পু-দা, এর মধ্যেই সীমিত থাকে, প্রায় নব্বই শতাংশ।
আমরা অবশ্য দুটো উপলক্ষ্য পালন করতে দিঘা যাবার প্ল্যান করি। আমাদের মেয়ে, অনেক দিন পরে তার কর্মস্থল ফিজি থেকে, ছুটি নিয়ে, জামাই সহ উপস্থিত হয়েছে। দশই আগস্ট। আমরা বেরিয়ে পড়েছি ১২-ই আগস্ট। বেচারারা বাড়ি এসে, জেট ল্যাগিং কাটানোরও পুরো সময়টা পায় নি। আসলে আমাদের তো অঢেল সময়, কিন্তু ওদের সময় সবটাই খুবই হিসেবের। তাই,"ওঠ ছুড়ি তোর বিয়া"-র মতই আমাদের প্রোগ্রাম শিডিউল।
অবশ্য দিঘার এই ভ্রমণের সারা ব্যবস্থা, আমার গিন্নী মানে মেয়ের মা'ই করেছে। গাড়ি আর ড্রাইভার আমাদের। হোটেল বুকও তিনিই করেছেন। সবচেয়ে বড় উপলক্ষ্য সকলের জন্য ছিল, আমাদের পোষ্যটির জন্মদিন পালন - যা সে সি-বিচে, এই প্রথম করবে। ইন ফ্যাক্ট মেয়েও এসেছে সেই পোষ্যের খাতিরেই। প্রতি বছরের জন্মদিনে, তার এমনই ভ্রমণ যাত্রা উপহার হিসেবে থাকে। পোষ্যের মা হল আমার মেয়ে, আর আমার উনি হলেন তার ঠাকুমা, ন্যানি ইংরাজী কায়দায়।
এরই মধ্যে একদিন, মেয়ে জামাই আসার পূর্বে, শ্যালিকার বাড়ি, টালিগঞ্জ যাওয়া হয়েছিল। সেখানে জাস্ট কথায় কথায়, আমরা বন্ডের(পোষ্য) জন্মদিন পালন উপলক্ষে দিঘা যাচ্ছি শুনে, শ্যালিকাও যাবার জন্য লাফিয়ে ওঠে। যাব কি যাবনা এই ভাবনার অবসান দু-একটি মিনিটে পজিটিভলি চার্জড হয়ে গেল। আমরা চার এক থেকে মুহুর্তের মধ্যে ছয় হয়ে গেলাম। দুটো গাড়ি দু জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করে। আর রাস্তায় বন্ডের দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে,বারোই আগস্ট,সক্কাল সক্কাল আমরাও বেরিয়ে পড়ি নিজেদের অল্টো-২০১২মডেলের গাড়ি নিয়ে বরানগর থেকে। তখন সকাল সাড়ে সাতটা মত হবে। বণ্ডের জন্য তো বটেই, আমাদের জন্যও এই ট্রিপটার খুব দরকার ছিল। ঘড়ি ধরা নিয়মে, ঘুম-খাওয়া আর যার যার মোবাইল বা ল্যাপটপ জীবনে, একটু বাতাসের দরকার ছিল। দিঘার আহবান আর সমুদ্রের বাতাস, সেই একঘেঁয়েমি অনেকটা দূর করবে, এই ছিল অভীপ্সা।
দুটো গাড়ি - একটি বরানগর থেকে নিউ দিঘা, আরেকটি কুঁদঘাট, পূর্ব পুটিয়ারি থেকে নিউ দিঘা। মোটামুটি একই সময়ে যাত্রা করে, আমাদের কোলাঘাটে একত্র হবার কথা, ড্রাইভাররা ফোনে ফোনে ঠিক করে নেয়। প্রথমে ডানকুনি বা সাঁতরাগাছি, তারপর ধূলাগড় এগুলোও ছিল কনসিডারেশনের লিস্টে। এই ডানকুনি থেকেই একটি রাস্তা গেছে ঐতিহাসিক সিঙ্গুরে। পশ্চিম বাংলার ভারী  শিল্প বনাম রাজনীতির মাইলেজ নেবার কুরুক্ষেত্র। বাংলাকে ভালোবেসে, পারসী দাদা এসেছিল তাঁর সবটুকু সদিচ্ছা আর অর্থ নিয়ে। স্থানীয় রাজনীতির পারস্পরিক লড়াইয়ে, এত বড় করে, বাঙালিরা রাজা প্রজা সকলে মিলে, নিজেদেরই বিরুদ্ধে, নিজেরাই বড় বাঁশ দেবে- পারসী বাবা এমনটা ভাবেন নি। কারখানা বসিয়েও, সব ফেলে রেখে গুজরাট চলে গেলেন। আমরা নিজ নিজ দল আর দলদাসেরা নিজ নিজ পিঠ চাপড়াইলাম। আর যারা কারখানার জন্য জমি দিয়েছিল, চাকরি স্বরূপ সংস্থানের আশ্বাস পেয়েছিল, তারা সব হারিয়ে কপাল চাপড়াইলো। এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ - তবু রঙ্গে ভরা। 
সুবিধামত খাবার জায়গা না পাওয়ায়, আমাদের যাত্রাপথে এগিয়েই যেতে হচ্ছিল প্রতিবার। কারণ প্ল্যানে, মেনু হিসেবে,কচুরি রাখা ছিল। কচুরির সন্ধানে আমরা শেষ বাজি রাখি, কোলাঘাটে। যারা ভূগোল নিয়ে গুলিয়ে থাকেন, ছোটবেলা থেকে, তাদের জন্য জানাই, এই সব জায়গাগুলি, ইনক্লুডিং দিঘা, সবটাই পশ্চিম বাংলার পূব পাড় ঘেঁষে। তার মধ্যে কলকাতা ছাড়া, হাওড়া এবং পূর্ব মেদিনীপুর আমাদের রাস্তায় আসবে। কোলাঘাট পূর্ব মেদিনীপুরে। কোলাঘাটের নাম শোনেনি, এমন বঙ্গ সন্তান দুর্লভ। সত্তরের দশকে, স্ব: জ্যোতি বাবুর সময় লোডশেডিং খ্যাত বাঙলার দুটি তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের মাঝে মাঝেই 'সাট ডাউন' হত - ব্যান্ডেল আর কোলাঘাট। দ্বিতীয় কারণ রূপনারায়ন নদের ওপরে ব্রিজটি। খুব সুন্দর। আর তৃতীয় কারণ হল জিভে জল আনা, ইলিশ মাছ। কোলাঘাটে ইলিশের সময়, গ্রাহক আর মাছের পাইকিরি ব্যবসায়ীদের খুব ভিড় থাকে। আমরা যে সময়ে কোলাঘাট পার হব,তখন দেড় সকাল। তবে কোলাঘাট বাজারে ঢুঁ মারলে কি দু-দশ পিস চোখে পড়তো না? কিন্তু উপায় কি?  কলকাতা থেকে কোলাঘাট, বাগনান হয়ে, রাস্তা মোটামুটি দক্ষিণ-পূর্ব। কোলাঘাট আমরা সাড়ে ন'টার কিছুটা পরেই, দশটা ছুঁই ছুঁই, তখন ঢুকি। রূপনারায়ন ব্রিজ পার হয়ে আমরা, মেইন রোড (যেটা ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৬) ছেড়ে, সার্ভিস রোডে গাড়ি ঢোকাই। আমাদের গন্তব্য আনন্দ রেস্টোরেন্ট।

গাড়ি পার্কিং করিয়ে, কাঁচের দরজা ঠেলে, ভিতরে গিয়ে চক্ষু দুটি কপালে উঠে যাবার জোগাড়। অবশ্য, বাইরে গাড়ির জমজমাট দেখে আন্দাজ হচ্ছিল, যে ভিড় হবে। কিন্তু গাড়ি রাখার জায়গার অনুপাতে, রেস্টোরেন্টের খাবার জায়গার রেশিয়ো কম। তাই প্রায় প্রত্যেকটি চেয়ারের পিছনে হাত লাগিয়ে লাইনে অপেক্ষমান বুভুক্ষু ট্যুরিস্টের দল। আসলে ১২-তারিখ শণিবার( সেকেন্ড স্যাটারডে), মাঝে সোমবার একটা  ক্যাজুয়াল খরচ করলে, চারদিনের লম্বা ছুটি। তাই কলকাতা চলেছে সমুদ্র দর্শনে। আমাদের হোটেল বুক করা আছে, তাই চিন্তা নেই মাথা গোঁজার। কিন্তু এরই ভিতরে, এমন অনেক যাত্রী আছেন, যারা সেদিনই সকালে,বসকে রাজী করিয়ে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে - কিছু তো ম্যানেজ হয়েই যাবে এই রকম মনোভাব নিয়ে। আনন্দ রেস্টোরেন্টের সামনে অনেক বাইকার দেখলাম, সব রকম বডি সেফটি অ্যাপেন্ডেজের সাথে। তাতে মেয়েরাও আছেন। বিবাহিত বা কুমারী - পোষাক আর বাইকের ড্রেস পড়া অবস্থায়,চেনা মুস্কিল বঙ্গ ললনা হিসেবে। এদের বর্তমান রূপ দেখতে পেলে, কবি জীবনানন্দ লিখতেন না,"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতি দূর ..." অথবা কবিগুরু তার দুই বিঘা জমির কবিতার সেই লাইনই হয়ত বদলে দিতেন, "বুক-ভরা-মধু, বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে... মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে"।
যাই হোক, অনেকক্ষণ পারমুটেশান, কম্বিনেশান করেও, আমাদের টেবিল পেতে, চেয়ারে বসতে ঘন্টা খানেক তো লাগবেই দেখে, আমরা আনন্দ রেস্টোরেন্ট দেখে নিরানন্দ হয়ে, নতুন আশায় বুক বেঁধে (যার ভিতরে তখন বঙ্গের মধুর চেয়ে,ক্ষুধার ধার বেশি ছিল), গাড়িগুলিকে পার্কিং লট থেকে বের করে, আবার জাতীয় সড়কে এনে ফেলা হল। সকলের চোখ রাস্তার দুপাশে স্ক্যানিং করতে থাকে- যদি একটা খাবার জায়গা চোখে পড়ে, এই দুরাশায়। বেশ কয়েক কিলোমিটার ধরে, স্ক্যানারে কিছু ধরা পড়লো না, তারপরে হঠাৎ করেই, হোটেল লাবণ্য এবং রেস্টোরেন্ট স্বয়ম্ভু মহাদেবের মত রাস্তার বাঁ- দিকে, আমাদের সামনে জেগে উঠলো। সামনে একটা দুটো গাড়ি। বেশ ছিমছাম সুন্দর রেস্টোরেন্ট। কচুরির খোঁজ করতে, জানা গেল কচুরি হবে না, তবে গরম গরম লুচি আর আলুর তরকারি হবে। আর চা-তো অবশ্যই হবে। কচুরি থেকে লুচিতে মনটাকে সরাতে, একটু দ্বিধা ছিল - কিন্তু উপায় কি?  নিউ দিঘায় আমাদের চেক ইন টাইম এগারোটায়। সেটা তো ফেইল করেছি, কিন্তু আরো বেশি দেরী করা সম্ভব এবং উচিত, কোনটাই নয়। অগত্যা সকলের জন্য ঢালাও লুচির অর্ডার দেওয়া হল।
আমরা যারা ঘোর ঈশ্বর বিশ্বাসী, আর যারা বক ধার্মিক, তারা সকলেই একটা কথা মানে, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। এক্ষেত্রেও, তার অনুপম উদাহরণ, আমরা চাক্ষুষ অর্জন করলাম। বললে পেত্যয় যাবেন না,অমন বড় আকারের, স্বাদু,  তৈল বা ডালডা বিহীন, লুচি এ বঙ্গে ইহার পূর্বে ভক্ষণ করি নাই। তরকারিও তদ্রুপ স্বাদু। একটি প্লেটে চারখানা অমন বোমা বোমা লুচি, নিমেষে উদরস্থ হল। সকলেরই। চা খেয়ে বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে, বিল মিটিয়ে,আমরা যখন রেস্টোরেন্টের বাইরে এলাম, তখন এক ঘন্টা প্রায় হয়ে এসেছে। আমার পোষ্যের সাথে শ্যালিকার পোষ্যটিও এই ভ্রমণের সঙ্গী। তাদের সৎকার আর জলপান করানো হল, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া বয়েলড চিকেন দিয়ে।
স্বল্পাহার পশ্চাত, নিজ নিজ হাওয়া গাড়িতে অধিষ্ঠিত হয়ে, আমাদের যাত্রা আবার শুরু হল। কোলাঘাট থেকে দিঘার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।আমরা এ পর্যন্ত কেবল ষাট কিলোমিটারই যাত্রা সম্পন্ন করেছি, যা সমগ্র যাত্রাপথের মাত্র এক তৃতীয়াংশ। আসলে পেট উতলা হলে, মন উতলা আর হাত-পা ততটাই বেতালা হয়ে পড়ে। ভরপেট খেয়ে, এবার আমাদের দৌড় শুরু হল সময়ের বিপক্ষে। লাবণ্য যেখানে ছিল, সে জায়গাটির নাম হোগলবেড়িয়া, পোস্টাপিস: রামতারাখাট, পূর্ব মেদিনীপুর। যদি কেউ এ লেখা পড়ে, দিঘা যাবার প্ল্যান করেন, কলকাতা থেকে গাড়িতে, তারা এখানে ব্রেকফাস্ট করে দেখতে পারেন। ঠকবেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা, শরীর খারাপ হবে না রাস্তায়, অম্বল নামক বস্তুটির সাথে।
হলদিয়ার মোড়, কাঁথির মোড় সব পেরিয়ে, আমাদের রাস্তা ধীরে ধীরে নর্থ-সাউথ হয়ে যাচ্ছিল, যতই দিঘার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কাঁথি পেরোনর পরে, মাটির চেহারা আর গাছপালাও একটু করে বদলে যেতে থাকে। পূর্ব মেদিনীপুর খুবই সবুজ আর শান্ত আমার গ্রামখানি টাইপের। 
নিউ দীঘা টাচ করতে আমাদের দুপুর একটা বেজে গেল। ডালটিন হোটেলের সামনে, পার্কিং-এ গাড়ি রেখে যখন পোষ্য নিয়ে নামলাম তখন দিঘার সমুদ্রে ভাঁটা খেলছে। নিউ দিঘাতে, যে ক'টি পেট ফ্রেন্ডলি হোটেল আছে, ডালটিন তাদের মধ্যে বিশেষ একটি। হোটেলের কর্মীরা, রিসেপশন ডেস্কের লোকেরা, লিফট বয়, মায় দারোয়ান পর্যন্ত সকলেই হাসি মুখ, সফট স্পোকেন। হোটেলের এ্যামবিয়েন্স ভাল লাগবে। পজিটিভ ভাইব আছে নি:সন্দেহে।  কাপল ওয়াইজ আমাদের রুম ডিস্ট্রিবিউট করা হল - ৪০৫,৪০৬,৪০৭। ড্রাইভারদের জন্যও এসি রুম। আমরা ছিলাম ৪০৬ নম্বরে।
এই ভ্রমণ কাহিনীর একদম শেষ পর্বে, আমি যাবতীয় খরচের একটা হিসেব সকলের জন্য দিয়ে দেব।
আপাতত: আমরা চললাম ফ্রেশ হয়ে, লাঞ্চে যাবার জন্য। তারপরে এক ঘন্টা রেস্ট নিয়ে, দিঘা ভ্রমণ শুরু হবে ওল্ড দিঘার বিচ আর সমুদ্র দিয়ে।
(চলবে)...

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু