বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অমূল্য (একটি লোকগাঁথা )

 

অমূল্য  (একটি লোকগাঁথা )

 

সঞ্জয় দত্ত

 

 

 

 

আজ যে গল্প বলছি তা বহু প্রাচীন এক লোকগাথা হয়তো অনেকে এটা কোনসময় শুনেছেন বা পড়েছেন, এখন হয়তো ভুলে গেছেন l প্রতিনিহতঃ জীবন চলার পথে এই গল্পটা আজও নানাভাবে শিক্ষণীয় ।

এক ছোট খামারে বাস করত দরিদ্র এক তরুণ কৃষক দম্পতি । দিনরাত দুজনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কোনরকমে দু মুঠো অন্ন জুটলেও ছিল না তাদের কোনও সচ্ছলতা বা দুর্দিনের জন্য কোন সঞ্চয়। দিনের শেষে প্রতিদিন রাতে তাদের একটাই চিন্তা আগামীকাল কি হবে? তাদের সন্তান জন্মালে কেমন করে এই সামান্য রোজকারে তাকে পালন পোষণ করবে?

 

একরাতে হতাশ স্বামী তার স্ত্রীকে বললে, "আমি ঠিক করেছি এখান থেকে অনেক দূরে গিয়ে কাজের সন্ধান করবো, এখনও আমি  জোয়ান আছি পরিশ্রম করতে পারি, বিদেশে গিয়ে অনেক অর্থ রোজকার করে নিয়ে এলে আমাদের কষ্ট অনেকটা দূর হবে। তবে তা করতে কতদিন লাগবে জানি না। "

শুনে স্ত্রী বললে, "আমিও যাবো তোমার সাথে,"

" তুমিও  গেলে আমাদের এই খামারের কি হবে? তাছাড়া পথে কি দুর্ভোগ আছে তও জানি না।  না না আমি একাই যাব, তোমাকে পথের বিপদের  সঙ্গে জড়াব না। কথা দিচ্ছি ভাল রোজকার করেই ফিরে আসবো।"

স্ত্রী কাঁদো কাঁদো মুখে বলে "তুমি চলে গেলে জমিতে কে হাল দেবে? কে চাষ করবে? ফসল না হলে খাবোই বা কি? তুমি কেমন আছ? কোথায় আছো? জানবোই বা কেমন করে?"

স্বামী - "আমার গ্রামের বন্ধু আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমাদের জমিতে চাষ করবে ও ফসলের অর্ধেক দেবে তোমাকে তাই দিয়ে তোমার কোনরকমে চলে যাবে। কতদিনে ফিরবো আর কত দূরে যেতে হবে জানি না। তুমি শুধু আমার অপেক্ষা করে থেকো, আমি ঠিকই ফিরে আসবো তোমার কাছে অনেক রোজকার করে ।"

স্ত্রী তার স্বামীর হাত ধরে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, "ওগো আমি সারা জীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব ।"

 

 

পরের দিন সকালে একটা পোঁটলায় কিছুদিনের শুকনো খাবার নিয়ে তরুণ কৃষক পথে নামলো। বেশ কিছুদিন কাজের জন্য অনেক চেষ্টা করেও কাজ সে কিছুতেই জোগাড় করতে পারলো না। এদিকে পথ চলতে চলতে সে নিজের গ্রামের থেকে অনেক দূরে চলে এসে পড়েছে, সঙ্গের খাবার প্রায় শেষ, অর্থও অতি সামান্য অবশিষ্ট। ঘরে ফিরতে গেলে এখন তাকে না খেয়েই বেশ কিছুদিন হাঁটতে হবে। ক্লান্ত শরীরে একটা গাছতলায় বসে সে বিশ্রাম করছে সেই সময় সেখান দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এক বুড়ো যাচ্ছিল। অচেনা কৃষককে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, "তোমাকে তো বাপু এদিকের বলে মনে হচ্ছে না l কোথা থেকে আসছো? কোথায় যাবে? পথ হারিয়ে ফেলেছো নাকি?"

তরুণ কৃষক বলে, সে গরিব কৃষক, দরিদ্রতা দূর করতে সে রোজকারের আশায় কাজের সন্ধানে বেড়িয়েছে। অনেকদিন অনেক ঘুরে কাজ না পেয়ে এখন তার কাছে না আছে খাবার বা খাবার কেনার টাকা । এঅবস্থায় বাড়ী ফিরতে গেলেও তাকে না খেয়ে অনেকদিন হাঁটতে হবে। এখন গাছতলায় বসে ভাবছে কি করবে?

 

সব শুনে বুড়ো বললো আমি তোমাকে কাজ, মাইনে, খাওয়া ও থাকার জায়গা দিতে পারি l শুধু শর্ত হল প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত তোমাকে আমার ক্ষেতে কাজ করতে হবে, আমি যেমন ভাবে বলব ঠিক সেভাবে ।

তরুণ কৃষকের কাছে সে সময় রাজী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। বুড়োর ঘোড়ার পিছন পিছন সে হাঁটতে থাকে তার খামারের দিকে।

 

বুড়োর কাছে তরুণ কৃষক কাজ করতে করতে অনেক কিছু নতুন শিখলো চাষের ব্যাপারে। অল্প সময়ে অধিক ফসল, একই জমিতে সারা বছর ভিন্ন রকমের ফসল ফলানো, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করা, আরো চাষের অনেক নতুন পদ্ধতি যা তার আগে জানাই ছিল না l তার গ্রামেও কাউকে করতে দেখে নি । নতুন জ্ঞানের উৎসাহে সে অবিরাম কাজ করে যেতে লাগলো আর তার মাইনের টাকা প্রতি মাসে বুড়োর কাছে জমিয়ে রাখতে লাগলে, যাতে সে যখন বাড়ি ফিরবে তখন সব টাকা একসঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে ।

 

দেখতে দেখতে প্রায় ২০ বছর একনাগাড়ে কাজ করার পর একদিন তরুণ কৃষক বৃদ্ধকে বললে সে বাড়ি যেতে চায়। বৃদ্ধ বললে, "বেশ খুব ভাল কথা, এখন তুমি ঠিক কর বাড়ি যাবার সময় তোমার এতো বছরের জমানো মাইনের টাকা নেবে না আমার তিনটে অমূল্য উপদেশ? টাকা নিলে অবশ্য আর উপদেশ পাবে না।"

 

তরুণ কৃষক পড়লো মহা চিন্তায়, দুদিন অনেক ভেবে সে  ঠিক করল এতদিনে সে চাষের সম্বন্ধে যা শিখেছে সেই জ্ঞান দিয়ে নিজের ক্ষেতেই  অনেক বেশী শস্য ফলাতে পারবে, বরং অভিজ্ঞ বৃদ্ধের তিনটে উপদেশ হয়তো তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে । তাই সে বৃদ্ধকে বললে, "আমার মাইনে চাই না বরং আপনার তিনটে উপদেশ আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে  চাই।"

 

বৃদ্ধ বললো বেশ আমার প্রথম উপদেশ জীবনে সাফল্যের কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই, সংক্ষিপ্তের পথ মরীচিকা ও বিপদে ভর্তি। দ্বিতীয় কৌতূহল থাকা ভালো কিন্তু অহেতুক কৌতুহল অত্যন্ত মারাত্মক, তা সহজে পতনের ডেকে আনতে পারে। তৃতীয়, জীবনে রাগে বা দুঃখে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি সবসময় ভুল হয় l তাই ক্রোধ, ঘৃণা বা দুঃখী অবস্থায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কখনোই নেবে না । জীবনে গুরুত্তপুর্ন সবসময় সিদ্ধান্ত ধীর স্থির হয়ে ভেবে চিন্তে নেবে।

 

 

 

 

বিশ বছর পর খামারে কাজ করতে করতে বৃদ্ধ তরুণ কৃষকের মধ্যে এক পরম বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বিদায় নেবার সময় দুজনেরই মন ভারাক্রান্ত বৃদ্ধ তরুণ কৃষকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, "তোমাকে বিদায় জানাতে মোটেই ইচ্ছে করছে না, কিন্তু এতদিন পরে তোমার বাড়ি ফেরার আনন্দে আমিও আনন্দিত, আমি ঈশ্বরের কাছে সর্ব্বদা তোমার মঙ্গোল কামনা করবো তুমিও এই বুড়োকে ভুলে যেও না যেন,"

"আপনার কাছে এতো শিখেছি, পেয়েছি এত ভালোবাসা, কি করে আপনার কথা প্রতিদিন আমার মনে পড়বে না?"

 বৃদ্ধ দুচোখের জল মুছতে মুছতে বলে, "বন্ধু, আমার উপদেশ গুলো সবসময় মনে রাখবে," তারপর ভিতর থেকে দুটো সুন্দর কাপড়ে বাঁধা পোটলা এনে বলে,  "এই পোঁটলার সব খাবার তোমার পথে খাবার জন্য আর এই অন্য পোঁটলাটা নিজের বাড়ি পোঁছে  খাবার সময়ই খুলবে তার আগে একদম নয় আর এই খাবার বাড়ির সকলের সঙ্গে ভাগ করে খাবে"

 

তরুণ কৃষক সম্মতি জানিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বৃদ্ধের কাছে বিদায় নিল পথ চলতে চলতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, ক্লান্ত তরুণ কৃষক পথের  পাশে একটা ঝর্ণার কাছে বসে বৃদ্ধের দেওয়া পথের খাবারের পোঁটলাটা খোলে খাবারের সঙ্গে রয়েছে একটা ভাজ করা কাগজ তাতে লেখা, 'বন্ধু পথ চলার উপদেশ - পথে সব সময় নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকে বেশি করে সজাগ রাখবে, হৃদয় দিয়ে অনুভব আর বুদ্ধি দিয়ে বিচার করবে, অন্ধের মতো কাউকে বিশ্বাস করবে না'

তরুণ কৃষক আগে একদমই লেখা পড়া জানতো না বৃদ্ধ কাজের শেষে তাকে প্রতিদিন একটু একটু করে কিছু লেখা পড়াও শিখিয়েছে মনে মনে সে বৃদ্ধকে বলে আপনার কাছে অনেক শিখেছি আপনার উপদেশ সবসময় মনে রাখব

 

কিছুক্ষন বিশ্রামের পর তরুণ কৃষক আবার পথে নামলো কিছুদূর যাওয়ার পর গাধার পিঠে এক মোটা সোটা লোকের সঙ্গে দেখা দেখে মনে হয় লোকটা বুঝি পথে কারুর জন্য অপেক্ষা করছে অচেনা লোকটি নিজে থেকে তরুণ কৃষকের সঙ্গে পরিচয় করে গপ্পো জুড়ে দিল খানিক কথাবাত্রার  পর সে জিজ্ঞেস করলো তরুণ কৃষকে সে কোথা থেকে আসছে? কোথায় যাবে?

বাড়ি ফেরার আনন্দে মশগুল তরুণ কৃষক কিছু না ভেবেই বলে ফেলে বিশ বছর খামারের কাজের পরে সে তার নিজের গ্রামে নিজের পরিবারের কাছে ফিরছে

কৃষকের কাছে সব শুনে সেই  লোকটা বলে ওহো আমি চিনি তোমার গ্রাম সেতো এই লম্বা পথে - দিন লেগে যাবে আমি বরং একটা সহজ আর সংক্ষিপ্ত পথ দেখিয়ে দিচ্ছি সেটা ওই বনের মধ্যে দিয়ে অবশ্য গেছে প্রথমে খানিকটা জঙ্গলের পরেই রাস্তা বেশ ফাঁকা সুন্দর ওই পথে  তুমি দু দিনেই আরামে নিজের গ্রামে পৌঁছে যাবে তরুণ কৃষক প্রথমে খুশি হয়ে লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই পথ ধরে, কিন্তু কিছু পা চলতেই  দেখে জঙ্গল ক্রমশঃ আরো গভীর হচ্ছে বড় বড় গাছের ছায়ায় দিনের আলো সেখানে একেবারে নাম মাত্র জনপ্রাণহীন পথে তার গা ছমছম করতে থাকে কে জানে কোন জংলী জানোয়ার কোথা থেকে এসে  তাকে আক্রমণ করে দাঁড়িয়ে সে এক মূহুর্ত্ত কি করবে চিন্তা করতেই  হঠাৎ বৃদ্ধের উপদেশ তার মনে পরে গেল বৃদ্ধ বলেছিল  জীবনে সংক্ষিপ্ত পথের  অর্থ মরীচিকা   বিপদ,  নিজের বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করবে, অন্ধের মতো কাউকে বিশ্বাস করবে না তৎক্ষনাৎ সে ভাবে পথের নির্দেশ দেওয়া লোকটাকে তো সে চেনেই না, তাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করে অজানা পথে পাড়ি দেওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়  সংক্ষেপের সেই পথ পরিত্যাগ করে উল্টো দিকে দৌড় লাগায় যত শিগগিরি নিজের চেনা পথে দিনের আলো থাকতে থাকতে ফেরা যায়  তার নিজের জানা লম্বা পথে পৌঁছতে তবে তার শান্তি  হল

 

এদিকে দিনের আলো ক্রমে নিভে আসছে রাতবিরেতে পথে একা হাঁটা মোটেই নিরাপদ নয় তাছাড়া সকাল থেকে হেঁটে সে অত্যন্ত ক্লান্ত  সেই রাতে কাছেই একটা সরাইখানা দেখে সে সেখানে আস্তানা নেয় কোন রকমে পোঁটলা খুলে রাতের খাওয়া সেরে সে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে

 

মাঝ  রাতে সরাইখানার  বাইরে প্রচন্ড চিৎকার, চেঁচামিচি, মানুষের দৌড়াদৌড়ির, আর্তনাদের আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে যায় প্রথমে সে ভাবলো বুঝি ভূমিকম্প, পরমুহূর্ত্তে তার কৌতূহলী মন বললো একবার সরাইখানার বাইরে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে কি হচ্ছে পর মুহূর্তে বৃদ্ধের উপদেশ মনে পড়ে গেল, সে তার অহেতুক কৌতূহলকে দমন করে ঘরের দরজা না খুলে ঘাপটি মেরে বিছানায় শুয়ে থাকলো

 

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তরুণ কৃষক জানতে পারলো একদল মাতাল সরাইখানার বাইরে চেঁচিয়ে ঝগড়া করছিলো আসলে ওরা এলাকার গুন্ডা কোন কারণে সরাইখানাতে ঢুকতে পারে না কৌতূহল বসত যারাই সরাইখানার বাইরে বেরিয়েছে ব্যাপারটা দেখতে ওরা  তাদের আক্রমণ করে  জনাকয়েক পথিক আহত, তার মধ্যে দুজন ছুরিকাঘাতে মারা গেছে

ঠিক সরাইখানা ছাড়ার সময় আতঙ্কিত, পরনে ছেঁড়া জামা কাপড়, পথ ক্লান্তিতে বিদ্ধস্ত একজন পথিক সেই সরাইখানায় পৌঁছোয় আগেরদিন বিকেলে তার সর্বস্য লুঠ হয়ে গেছে তরুণ কৃষক তাকে জিজ্ঞেস করে  কেমন করে হল এমনটা?

সে বললে আগের দিন তার সঙ্গে গাধায় চড়া এক মোটা লোকের পথে দেখা হয় ভারী মধুর স্বভাবের লোকটি যেচে তার সঙ্গে আলাপ করে পথ নির্দেশিকায় জঙ্গলের সরল সংক্ষিপ্ত  পথ দেখিয়ে দেয় তাকে ওই পথে কিছুদূর যাবার পরে, নির্জন জঙ্গলের মধ্যে কয়েকজন কুখ্যাত ডাকাত যে ওৎ পেতে ছিল তা সে জানত না ডাকাতদের আচমকা আক্রমণে সহজেই পরাস্ত হয়, ওরা ওর সর্বস্য কেড়ে নিয়ে ওকে মেরেই ফেলতো জঙ্গলের অন্ধকারে সে কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে মনে মনে বৃদ্ধকে তার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে কৃষক পথিকের দুর্দশার জন্য সমবেদনা জানিয়ে তাকে নিজের থেকে কিছু অর্থসাহায্য করে আবার নিজের গ্রামের পথ ধরে

 

তরুণ কৃষক এক নাগাড়ে অবিরাম হেঁটে চলেছে তার গ্রামের উদ্দেশ্যে । সকালে সে হাঁটা শুরু করে দুপুর নাগাদ পথের পাশেই কোথায় বসে সঙ্গের পোঁটলার খাবারে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর গাছতলায় একটু বিশ্রাম করেই আবার হাঁটা শুরু করে। দীর্ঘ ছয় দিন পথচলার পর এক সন্ধ্যায় কৃষক তার নিজের গ্রামের সীমানায় পৌঁছল।  মন তার আনন্দে নেচে উঠলো।

 

কুড়ি বছরে গ্রামের অনেক পরিবর্তন হলেও দূর থেকে তার বাড়িটা সে সহজেই চিনে নিলো। চিরিদিকে সন্ধ্যার আঁধার তখন ঘনিয়ে এসেছে।  অন্ধকারে ঝোপ ঝাড় গাছ সবই ছায়ামূর্তির মতো ঠেকছে। আর একটু কাছে পৌঁছতে সে দেখে পরিষ্কার তার বাড়ির জানলা দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভিতর লম্পের আলোয় এক নারীর ছায়ামূর্তি সে দেখতে পেলো। তার স্ত্রীকে এতবছর পরে তার চিনতে কোনই অসুবিদে হলো না।  মন তার আনন্দে ও উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে গেছে। ওঃ  কতদিন পরে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে। কুড়ি বছর আগেকার অনেক পুরোনো কথাই তার মনে পড়ছিলো, বিদায় নেবার সময় তার স্ত্রী তার দু হাত ধরে বলেছিলো "আমি তোমার পথ চেয়ে সবসময় অপেক্ষা করে থাকবো।"

তার স্ত্রীর ছায়া দিকে তাকিয়ে তার চলার গতি বেড়ে গেল হেঁটে নয় একরকম ক্লান্ত শরীরেও সে প্রায় দৌড়োচ্ছে তার বাড়ির দিকে।  পথে আর এক মূহুর্ত্ত সময় সে নষ্ট করতে চায় না।

 

আচানক হঠাৎ কিছু দেখে তার চলার গতি একেবারে থমকে গেল। প্রথমে সে তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না । চোখ খানিক রগড়ে আবার তাকায়। এতদিন পথ চলার পরে এতবড় মানুষিক ঝাঁকুনির জন্য সে এক্কেবারেই প্রস্তুত ছিল না।  ঘরে ফেরার সমস্ত আনন্দ উত্তেজনা মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। স্ত্রীর প্রতি তার সেখানে জন্ম নিলো রাগ, ঘৃণা প্রতিহিংসার আগুন। সে দেখলো ঘরে হারিকেনের আলোতে তার স্ত্রীর পাশে একজন পুরুষের ছায়ামূর্তি।  স্ত্রী তার মাথায় আদরের  হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

 

কি হয় দেখার জন্য তরুণ কৃষক একটা ঝোঁপের কাছে বসে পড়ল। ঝোলা থেকে বার করলো তার ছুরিটা, রাগে তার সারা শরীর তখন কাঁপছে । ঠিক করলো রাত বাড়ুক সকলে ঘুমিয়ে পড়ুক তখন গিয়ে বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী ও তার প্রেমিককে খুন করে তার প্রতিশোধ নিয়ে ওই বুড়োর কাছে ফিরে যাবে।

তার মনের মধ্যে বিশ বছর আগের নানা চিন্তা ঘোরপাক খেতে থাকে। রাত বাড়ার সঙ্গে তার বৃদ্ধের কথা মনে পরে গেল 'রাগে বা দুঃখে নেওয়া সিদ্ধান্ত সবসময় ভুল হয়'সে ঠিক করল পরদিন সকালে সে তার বাড়ি গিয়ে সমস্ত ঘটনা জানবে, যদি তার স্ত্রী তার অবর্তমানে নতুন জীবন সাথী খুঁজে নিয়ে থাকে, সে  তার স্ত্রীকে  জানাবে সে তাকে ভালোবাসে এবং ফিরে এসেছিলো তার কাছে বরং তার স্ত্রীই  তার অপেক্ষা করে নি। যতই হোক সে তার স্ত্রীকে সে ভালোবাসে প্রতিশোধের জ্বালাতেও ভালোবাসার মানুষকে কি খুনকরা যায়? বরং তার বাড়িটা স্ত্রীকে দিয়ে সে ফিরে যাবে বৃদ্ধের কাছে।

দুশ্চিন্তার মধ্যে ক্লান্ত তরুণ কৃষক ওই ঝোপের কাছেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে সে ধীর পায়ে গিয়ে তার বাড়ির দরজার কড়া নাড়ে ।  অল্পক্ষন দরজা খোলে  এক যুবক, অচেনা একজনকে দেখে সে অবাক, কৃষকও অবাক তাকে দেখে। পিছন থেকে ততক্ষনে তার স্ত্রীও এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ  বছর কেটে গেলেও একে  অপরকে তারা সহজেই চিনতে পারে। স্ত্রী যুবকের দিকে তাকিয়ে বলে " বাছা প্রতিদিন এনারই সুস্বাস্থ ও নিরাপদে ফিরে  আসার কামনা করে আমরা সকাল সন্ধ্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম। পুত্র ইনি তোমার পিতা ।"

স্ত্রীর কথা শুনে কৃষক প্রথমে অপরাধ বোধে কিছুক্ষন নির্বাক। তার বুকের দুশ্চিন্তার ভার এক নিমেষে হাল্কা হয়ে যায়।  পরমুহূর্তে তার পুত্র ও স্ত্রীকে মহা আবেগে জড়িয়ে ধরে। না জেনে ক্রোধে  দুঃখে বশীভূত হয়ে কত আজেবাজে চিন্তা না করেছিল সারা রাত তাই ভেবে তার দুচোখ দিয়ে  জল গড়িয়ে পড়ে।

 

সে রাতে একসঙ্গে খাবার সময় কৃষক বৃদ্ধের দেওয়া খাবারের পোঁটলাটা খোলে।  আর একবার তার হতবাক হবার পালা, এবারে আরও আনন্দের ।  তার বিশ বছরের  সমস্ত উপার্জনের  টাকা বৃদ্ধ সঞ্চিত রেখেছিলো ওই পোটলার মধ্যে, সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি " তোমরা সুখী হও শুধু  মনে রেখ জীবনে টাকার থেকেও ধৈর্য, বুদ্ধি ও জ্ঞান অমূল্য"

 

 

 

*****************************

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু