বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

( দ‌্য আর্টিস্ট - ২০১১)

মুক্তি : ১৫ মে ২০১১ (কান), ১২ অক্টোবর ২০১১ (ফ্রান্স)

দৈর্ঘ : ১ ঘন্টা ৫৪ মিনিট

রঙ : সাদাকালো

চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : মিশেল হাজানাভিসিয়াস

প্রযোজনা : টমাস ল্যাঙম্যান

অভিনয় : জ্যাঁ ডুজারডি, বেরেনিস বেজো, জন গুডম্যান, জেমস ক্রোমওয়েল, মিসি পাইলে, পেনেলোপি এন মিলার, ম্যালকম ম্যাকডোয়েল, বিৎতসি টুলোক

সঙ্গীত : লুডভিক বার্স

চিত্রগ্রহণ : গুইলাউম স্কিফম্যান

সম্পাদনা : এনে-সোফি বিয়ন, মাইকেল হাজানাভিসিয়াস


কিছু কিছু সিনেমা বয়সের অগ্রযাত্রা এবং পিছু হটতে থাকা প্রতিবন্ধকতার দরুণ আমাকে কাঁদতে বাধ্য করে তুলেছে। তবে এই প্রথম কোনও ছবি দেখে আমার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু নির্গত হলো এবং এটি কোনও অত্যুক্তি নয়।

আর সেটি হলো ২০১১ সালের ফরাসি হাস্যরসাত্মক নাট্য-চলচ্চিত্র "দ‌্য আর্টিস্ট", যেটির পরিচালক মিশেল হাজানাভিসিয়াস ।

এই ফরাসী পরিচালকের দুর্দান্ত বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, গৌরবজনকভাবে মজাদার এবং আকস্মিকভাবে স্নেহময় চলচ্চিত্রটি হলিউডের সাদা-কালো নির্বাক-যুগ সম্পর্কিত। আর, এটির মূল  দ্রষ্টব‌্যই হলো এই যে, ছবিটি পুরোপুরি সাদা-কালো নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণের রীতি মেনে নির্মিত হয়েছে। তবে ছবিটি কি সত‌্যিই নির্বাক ? নাকি প্রায়- নির্বাক ? নাকি পুরোটাই সবাক ? ছবিটিতে কিছু কথ্য শব্দ এবং লুডোভিক বর্সের একটি ক্রমাগত অর্কেস্ট্রাল স্কোরের উপস্থিতি সম্পূর্ণ ছবি জুড়ে বিদ‌্যমান।

পুরো সিনেমাটিতে বুদ্ধিদীপ্ত কমেডির ছাপ সুস্পষ্ট। রোম‌্যান্সের ওভারডোজ বা মাত্রাতিরিক্ততা নেই, বরং, রয়েছে ভীষণরকম অপ্রত‌্যাশিত বাস্তবধর্মী, প্রগাঢ় এবং কামার্ত প্রেমাবেগ। হ‌্যাঁ, এটি সম্পূর্ণরূপেই একটি প্রেমের গল্প; একটি কমনীয় প্রেমের গল্প যেটি বিনোদনের চমৎকার ঝলমলে পোশাকে সুসজ্জিত। অপ্রত‌্যাশিতভাবে এই সিনেমাটি একজন পুরুষের গর্ববোধ এবং তাঁর সংবেদনশীল মননের একটি চূড়ান্ত প্রতিফলক। এমনকি এই ছবিটি  অসতর্কতার সাথে দর্শকের কাছে একটি প্রশ্নও রেখে যায় যে, "চলচ্চিত্রশিল্প কি নীরব থাকা অবস্থায় বেশি খাঁটি ছিল না তা সরব হওয়ার পর বেশি খাঁটি হলো?"

একজন পরিচালকের পরিচালনা কখন সার্থক হয়? যখন তাঁর সৃষ্টি, তাঁর নির্মাণ দেখার পর দর্শকের চোখ জুড়িয়ে যায়। সেই নির্মাণ দেখার পর মনে হয় এটাকে টপকে যাওয়া বেশ কঠিন, যেই দৃষ্টি দর্শকচিত্তে গভীর ভাবে গেঁথে যায়...। এই সিনেমাটা দেখে 'Sunset Blvd"-এর একটা ডায়ালগের কথা মনে পড়তে বাধ‌্য, "We didn't need dialogue. We had faces"। আর এই সিনেমাটি হলো সত‌্যি বলতে, এই ডায়ালগটির আদ‌্যোপান্ত ভাব সম্প্রসারণ।

বর্তমানে নির্বাক চলচ্চিত্র অপেক্ষা সবাক চলচ্চিত্রগুলো একটু বেশিই বিনোদন-পূর্ণ। ১৯২৭ সালের পর থেকে দর্শক যখন ক্রমে ক্রমে সবাক ছবি পেতে আরম্ভ করলো, তখন থেকেই শুরু হলো নির্বাক চলচ্চিত্রের পতন। তখন চ‌্যাপলিন নিজেও আর না পেরে সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণকার্যে হাত দেন এবং এই নির্বাক থেকে সবাকে আসার গল্পকেই পুঁজি করে হাজানাভিসিয়াস এই সিনেমাটির জন্ম দিয়েছেন। যদিও চলচ্চিত্র সবাক এবং নির্বাক, এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত, তবুও পিওর চলচ্চিত্র বলতে কিন্তু "নির্বাক" চলচ্চিত্রকেই বোঝানো হয়, যদিও এখন নির্বাক বলতে কিছু নেই; তা কেবল ইতিহাস। চ‌্যাপলিন মনে করতেন, সিনেমার প্রকৃত স্বাদ একমাত্র নির্বাক চলচ্চিত্রেই পাওয়া সম্ভব। তিনি আরও মনে করতেন যে, সবাক সিনেমায় যে-কোনও একটা দিক, অর্থাৎ, স্টোরিলাইন কিংবা চিত্রনাট‌্য দুর্বল হয়ে গেলে কিংবা খুব একটা জোরালো না হলেও অন‌্যান‌্য ব‌্যাপার যথা পরিচালনা-অভিনয়-সঙ্গীত-সংলাপ বা টেকনিক‌্যাল বিষয়গুলোর মাধ‌্যমে তা ঢেকে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু অন‌্য দিক থেকে নির্বাক চলচ্চিত্রে সমস্তটাই পারফেক্ট হতে হবে। কোনও একটা দিক দুর্বল হয়ে পড়লে দর্শক সেটিকে সেভাবে ধরতে পারবেন না।

২০১১ সালে বেশ কিছু অনবদ‌্য ছবি নির্মিত হয়েছে, যেগুলোর মধ‌্যে উল্লেখযোগ‌্য হলো স্পিলবার্গের "ওয়ার হর্স", স্করসিসের "হুগো" প্রভৃতি। কোনোটিই কোনোটির চেয়ে কম নয়। কিন্তু, এই সকল ছবির ভিড়ের মধ‌্য থেকে যখন কোনও নির্বাক চলচ্চিত্রকে বর্ষসেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, আর তার মধ‌্যে সেটি যদি হয় সাদা-কালো তাহলে হয়তো বহু মানুষই কপালে ভাঁজ ফেলবেন বা ভুরু কুঁচকোবেন। এখনকার পরিচালকরা যেখানে নিত‌্য-নতুন পন্থা অবলম্বন করছেন, প্রত‌্যহ নতুন কোনও কিছু করে দেখাচ্ছেন, সেখানে হাজানাভিসিয়াস দর্শককে নিয়ে গেছেন নয় দশক পেছনে। যখন সবাক চলচ্চিত্র বাজারে খুব একটা জায়গা পায়নি।

থমাস ল্যাংম্যান প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি রচনা, পরিচালনা ও সহ-সম্পাদনা করেছেন মিশেল হাজানাভিসিয়াস এবং এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জঁ দ্যুজার্দাঁ ও বেরেনিস বেজো।১৯২৭ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যকার সময়ে হলিউডের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটিতে একজন বয়স্ক নির্বাক চলচ্চিত্রের তারকা ও একজন উঠতি অভিনেত্রীর মধ্যকার প্রেমের সম্পর্ক চিত্রিত হয়েছে।

সিনেমার পুরো গল্পটি একজন তারকার জন্মের পটভূমিকাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলা একটি বৈচিত্র‌্যময় আলোকরশ্মি।

একজন বয়স্ক এবং প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র-তারকার সঙ্গে তাঁর একজন বিপুল ভক্ত এবং প্রতিভাধর যুবতীর দেখা হওয়ার মধ‌্য দিয়ে ছবি মূল ট্র‌্যাকে নেমে আসে। গল্পটি শুরু হয়েছে ১৯২৭ সালে যখন নির্বাক যুগের বিখ্যাত অভিনেতা জর্জ ভালেন্টিন তার নতুন ছবি আ রাশিয়ান এফেয়ারের প্রিমিয়ারের জন্যে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফারদের মুখোমুখি হয়েছেন, এমন সময় পেপে মিলার নামে এক নারী দূর্ঘটনাক্রমে তার উপর এসে পড়ে। ভ্যালেন্টিন তাকে নিয়ে একটু মজাই করেন। পরদিন ভ্যারাইটি পত্রিকায় শিরোনাম আসে ‘কে এই নারী’ যার সাথে ভ্যালেন্টিনের ঘণিষ্টতা। এরপর পেপে কিনোগ্রাফ স্টুডিওতে এক্সট্রা হিসাবে অডিশন দিতে আসে। এ সময় ভ্যালেন্টিনের সাথে নাচের একটি দৃশ্যায়ন চিত্রায়ণ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে ঘনিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। পেপে সুষ্পষ্টভাবেই ভ্যালেন্টিনের প্রেমে পড়ে। সে ভ্যালেন্টিনের ম্যাকআপ কক্ষে এসে তার কোটকে জড়িয়ে ধরে। ভ্যালেন্টিন তার ঠোঁটের উপর একটি তিল এঁকে দিয়ে বলে, তোমার অভিনেত্রী হিসাবে বিখ্যাত হতে হলে নতুন কিছু লাগবে। যাহোক ধীরে ধীরে প্যাপে তার অবস্থান করে নেয়। দুই বছর পর ১৯২৯ সালে প্রযোজক জিমার ঘোষণা দেয়, সে আর নির্বাক ছবি বানাবে, সবাক ছবি বানাবে। কিন্তু ভ্যালেন্টিন ছবিতে শব্দ সংযোজন ব্যাপারটি মেনে নিতে পারে না। তার মতে, ভক্তরা তাকে দেখতে আসে, তার কণ্ঠ শুনতে আসে না। যাহোক ভ্যালেন্টিন নিজেই একটি ছবি প্রযোজনায় হাত দেয়। অন্যদিকে জিমার তার সবাক ছবি বানা পেপে ও একদল নতুন শিল্পী নিয়ে। একই দিনে দুটো ছবি মুক্তি পায়। পেপে রাতারাতি তারকা হয়ে যায়, আর ভ্যালেন্টিন এর ছবি ফ্লপ হয়, সে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। তার স্ত্রী ডরিস তাকে ছেড়ে চলে যায়। ভ্যালেন্টিনের সাথে রয়ে যায় তার প্রিয় কুকুর আর ড্রাইভার ক্লিফটন। কিন্তু ক্লিফটনকে তিনি চাকরী থেকে বের করে দেন, নিজের সব জিনিস নিলামে বিক্রি করে দেন। এক পর্যায়ে চূড়ান্ত হতাশ ও মাতাল ভ্যালেন্টিন তার ফিল্মে আগুন ধরিয়ে দেন, নাইট্রেট ফিল্মের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় কুকুরটি ছুটে গিয়ে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ভ্যালেন্টিন প্রাণে বেঁচে যায়। পত্রিকায় এ সংবাদ পড়ে পেপে হাসপাতালে আসে। ভ্যালেন্টিনকে তার বাসায় নিয়ে যায়। পেপে যে তাকে ভালবেসেছিলো তা পরিস্কার বোঝা যায়। ভ্যালেন্টিন আবিষ্কার করে তার নিলামের সব জিনিস পেপে কিনে রেখেছে, এমনকি তার পুরনো ড্রাইভারকে সে নিজের ড্রাইভার করে রেখে দিয়েছে। এদিকে পেপে প্রযোজক জিমারকে প্ররোচিত করে ভ্যালেন্টিন ও তাকে নিয়ে একটি ছবি বানানোর। তাদের নিয়ে এবার একটি মিউজিক্যাল বানানো হয়। ছবির শেষ অংশে এসে জিমারের কণ্ঠে সংলাপ শোনা যায় : ‘কাট, যথার্থ। অসাধারণ। আরেকটা শট কি দেয়া যায়।’ ভ্যালেন্টিন তার একমাত্র এবং ছবির শেষ সংলাপ দেয় ‘সানন্দে!’

মূলত একটি রোম‌্যান্টিক-কমেডি হলেও, এর মধ‌্যে লুকিয়ে আছে পুরোনো কিছু কথা এবং নির্বাক বনাম সবাকের মৌন লড়াই। দেখানো হয়েছে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে একজন সুপারস্টারের কী পরিণতি হয় !


ছবিটির প্রতিটি দৃশ‌্যে পরিচালকের সাহসিকতা এবং আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় ! অত‌্যন্ত সাদামাটা কিন্তু সাবলীল স্টোরিলাইন এবং অনবদ‌্য ক‌্যামেরার কাজ এই ছবির প্রাণভ্রমর। খুব সতর্ক হয়ে এই ছবিটির চিত্রায়ণ করা হয়েছে, যাতে এটির প্লট অর্থাৎ ১৯২৭ সালে ক্যামেরার কাজ কেমন হতো, তা তুলে ধরার জন‌্য। তবে মজার বিষয় হলো, এই ছবিটিতে কোনও zoom shot নেই, কারণ সেই সময় এই প্রযুক্তিটির ব‌্যবহার শুরু হয়নি। আর এই ছবির আরেকটি অন‌্যতম বৈশিষ্ট‌্য হলো ছবির আর্ট ডিরেকশনের কাজ। প্রতিটি কস্টিউম মার্জিত এবং সুসজ্জিত হওয়ার ফলে সিকুয়েন্সগুলি সুচারু ভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। মজার ব‌্যাপার হচ্ছে, এই ছবিতে অভিনয়কারী কুকুর-চরিত্র "উগি"-কে অস্কার দেওয়ার জন‌্য বেশ রব উঠেছিলো। "Independent"-এর একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিলো, যদি কোনও চারপেয়ে প্রাণীকে অস্কার দিতে হয়, তাহলে সেটি অবশ‌্যই হবে এই উগি।

সাদা-কালো ফ্রেম। নির্বাক ছায়াছবি। মন কেমন করা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। ইতিহাস!

প্রাণপণে ফিরে আসার লড়াই চালাচ্ছেন এক নির্বাক-যুগের তারকা, প্রেমে-অপ্রেমে। সবাক ছবির দাপটে যিনি হারিয়ে যাওয়ার পথে। ইতিহাস! 

সেই ইতিহাসকেই কুর্নিশ জানাল এ কালের হলিউড। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা-সহ পাঁচটি অস্কার পেল মিশেল হ্যাজানভিসাসের ‘দ্য আর্টিস্ট।’ ১৯২৯ সালে শেষ বার নির্বাক ছবি ‘উইংস’ পুরস্কৃত হয়েছিল অস্কারের আসরে। তার পর ‘দ্য আর্টিস্ট’। সাদা-কালো, নির্বাক ছবিটি হয়তো ফেলে আসা সময়কে লেখা মিশেলের প্রেমপত্রই।


( অভ্র )

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু