বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অন্তরঙ্গ

তখন ১৯৯৭ সাল। উত্তর-পূর্ব গুজরাটের একটি ছোটো অঞ্চল ভাদোদরা। ভাদোদরায় একটি রাজবাড়ি ছিল। শোনা যায় তখন থেকে প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো সেই রাজবাড়ি। কিন্তু সেখানে কেউ থাকে না, একটি সরকারি সম্পত্তি রূপেই পড়ে ছিল সেটা।

একদিন সেখানে একজন লোক আসেন। লোক বলা ভুল, যুবকই বলা চলে তাঁকে। বয়স সাতাশ বছর, পেশায় তিনি একজন লেখক। তখনকার দৈনন্দিন পত্রপত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকদিনের শখ ছিল যে তিনি সেই রাজবাড়িকে নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু রাজবাড়ি সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকায় তিনি বিরত ছিলেন। তারপর একদিন তিনি নিজেই স্থির করলেন, রাজবাড়িতে যাবেন বলে। তাই তা সফল করার উদ্দেশ্যেই তিনি সরকারি অনুমতিপত্র নিয়ে রাজবাড়িতে গেলেন। অনুমতিপত্রে দিন তিনেক মতো থাকার অনুমতি ছিল। তাই তিন দিনের মধ্যেই তাঁকে সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করে ফেলতে হবে -এই ভেবে প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করে দিলেন। রাজবাড়িটা আয়তনে প্রায় দশ হাজার বর্গফুট হবে, উচ্চতা সত্তর ফুটের কাছাকাছি, সব মিলিয়ে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটা মতো ঘর হবে। ছোটো থেকেই লেখক খুব সাহসী, বয়স কম হলেও অত্যন্ত বিচক্ষণ। রাজবাড়িতে আসার সময় রাস্তায় একটা লোকের সাথে কথা হচ্ছিল তাঁর, রাজবাড়ির ব্যাপারেই। লোকটি বলল, "মশাই, ওই রাজবাড়ি আমার ঠাকুরদা, তাঁর ঠাকুরদার সময়কার। প্রায় দেড়শো থেকে দুশো বছরেরও পুরোনো। এখন ওটার কোনো উত্তরাধিকারীই আর নেই। কথিত আছে, রাজবাড়িটা নাকি খুব অপয়া আর আনাচে-কানাচে ভূতেদের বাসা। তাই তো কেউ সেখানে যায় না।" লেখক ভূতে বিশ্বাস করেন না। তাই তিনি লোকটির কথায় তেমন কান দিলেন না।

রাজবাড়িতে থাকার জন্য লেখক নিজের পছন্দমতো একটা ঘর বাছলেন। ঘরটি দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে দুটো ঘর ছেড়ে তিন নম্বর ঘর। সেটাকে থাকার উপযুক্ত করে লেখক বাইরে গেলেন চা খেতে। চা-এর দোকান রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে দশ মিনিটের পথ। সেখানে কয়েকজন লোক তাঁর সাথে একরকম যেচেই আলাপ করতে এল। তিনি রাজবাড়িতে উঠেছেন শুনে কয়েকজনের তো চোখ প্রায় কপালে! রাস্তায় দেখা হওয়া লোকটির মতো তাঁরাও সকলে একই কথা বলল।

লেখক জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, এই রাজবাড়িটি কবে বন্ধ হয়েছিল আর এখানকার শেষ রাজা কে ছিল, কেউ একটু বলতে পারবেন?"

পাশ থেকে একজন বয়ষ্ক ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, "তা প্রায় একশো বছর তো হবেই। আমি আমার বাবার কাছে শুনেছিলাম। শেষ রাজার নাম ছিল প্রদ্যুম্ন। কিন্তু আপনার তো অতি অল্প বয়স। আমার কথা শুনুন, ওই রাজবাড়ি থেকে চলে যান। ওখানে রাত্রিবাস করবেন না। কিছু বছর আগে কয়েকজন লোক আপনার মতোই ওখানে থাকতে এসেছিল। কিন্তু একরাত্রি যাবার পর তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।"

বয়ষ্ক মানুষটির সঙ্গে লেখক আর তর্ক করলেন না। মনে মনে ভাবলেন, 'ওই লোকগুলো নিশ্চয়ই ডাকাত ছিল। তাই হয়তো রাতের অন্ধকারেই রাজবাড়ির কিছু জিনিস চুরি করে চম্পট দিয়েছে।' এরপর তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন এবং চা খেয়ে আবার রাজবাড়ির পথে পা বাড়ালেন।

রাজবাড়িতে আসার আগে লেখক একটি টর্চ, কয়েকটি মোমবাতি, দেশলাই বাক্স, তাঁর লেখার খাতা ও একটি কলম -এইসব সরঞ্জাম একটি ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলেন। আর কিছু শুকনো খাবারও তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। এতক্ষণ এই লেখকের পরিচয় বলা হয়নি। এঁর নাম শ্রী উদয়ন ভট্টাচার্য্য, সাতাশ বছরের নিতান্তই এক যুবক তিনি। পরিবারে কেউ ছিল না তাঁর। তাই জীবনের একাকীত্বকে দূর করার উদ্দেশ্যে রোমাঞ্চকেই আশ্রয় করে নিয়েছিলেন তিনি। রোমহর্ষকতা, রোমাঞ্চমুখর জীবনের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। তাই তো সুদূর ত্রিপুরা থেকে তিনি চলে এসেছেন ভাদোদরার এই রাজবাড়িতে, রোমাঞ্চতা উপভোগের গর্বে। এর আগেও তিনি রাজস্থান, দিল্লী, মিজোরাম, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে রোমাঞ্চকতাকে খুঁজে নিয়েছিলেন এবং তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লেখাগুলো পাঠকমহলে তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও শোকাহত হননি তিনি। লেখার আনন্দেই লিখে যাওয়া... বলা ভালো, রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাক্ষী হওয়াই একমাত্র লক্ষ্য তাঁর।

রাজবাড়িতে ঢুকে লেখক সদর দরজা বন্ধ করে দোতলায় নিজের ঘরে গেলেন। তারপর মোমবাতি জ্বালিয়ে, পেন ও লেখার খাতাটি ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন। তিনি যে ঘরটিতে ছিলেন, সেটায় বেশি কিছু সরঞ্জাম ছিল না। একটি আধভাঙা পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেখানে। লেখক অনুমান করলেন, ঘরটিতে হয়তো আরও সরঞ্জাম, আসবাব ছিল, সেগুলো বোধহয় সরকারের লোকেরাই এসে নিয়ে গেছে। যাই হোক, লেখার খাতাটি তিনি টেবিলে রেখে পেনটিকে নিয়ে চেয়ারে বসে লিখতে লাগলেন। গভীর রাত অবধি লেখার অভ্যাস তাঁর। প্রায় দেড়টার সময় লেখা শেষ করে খাতাটি বন্ধ করে তিনি পালঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। হাত থেকে ঘড়িটি খুলে মাথার কাছে রাখলেন এবং মোমবাতিটি পাশের টেবিলেই জ্বলতে থাকল সারারাত ধরে।

পরদিন ভোর হতেই হঠাৎ কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় লেখকের। খিড়কির ফাঁক থেকে মৃদু আলো ঘরের ভিতর ঠিকরে পড়ছে। পাশে রাখা ঘড়িটিতে তিনি দেখলেন ঘন্টার কাঁটা পাঁচের ঘর থেকে সামান্য এগিয়েছে। লেখক সেই অজানা শব্দটির সন্ধান করতে ঘর থেকে বেরিয়ে পিছন দিকটায় গেলেন। রাজবাড়ির পিছন দিকে ছিল একটা মস্ত বাগান। কিন্তু সম্পূর্ণ বাগানটাই জঙ্গলের স্তূপ। বিশেষ তেমন কিছু দেখতে পেলেন না তিনি ওই বাগানটিতে। বাগান থেকে রাজবাড়িতে ঢুকতে গেলেন, হঠাৎই তাঁর নজরে আসে রাজবাড়ির কিছু ফুট উচ্চতায় থাকা একটা সূর্যঘড়ি। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এত বছর পরেও ঘড়িটা সচল এবং তাতে সঠিক সময়ই দেখাচ্ছে। লেখক আরও একটা দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ঘড়িটির ঠিক পাশের ঘরে জানালার কাঁচ দিয়ে কেউ যেন তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। তিনি মুখে কোনো শব্দ না করে তাড়াতাড়ি ওই ঘরটির দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু রাজবাড়িটি এতই বড় ছিল যে, তিনি ঠিক কোন ঘরটি দেখেছিলেন সেটা বুঝতে পারলেন না। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে তিনি সমস্ত ঘরে ঢুকে খুঁজতে লাগলেন, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। অবশেষে লেখকের চোখে পড়ল একটি তালাবন্ধ ঘর। তালাটি অনেক পুরোনো হলেও বেশ মজবুত। অনেক চেষ্টা করেও তিনি সেই ঘরের তালাটিকে খুলতে পারলেন না কিছুতেই। ব্যর্থ হয়ে তিনি নিচে চলে আসেন এবং হাত-মুখ ধুয়ে আবার চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে যান। গত রাতে যাঁদের সাথে তাঁর আলাপ হয়েছিল তাঁদের কাউকেই তিনি দেখতে পেলেন না সেখানে। তবে লেখকের রাজবাড়িতে রাত্রিবাস করার কথা শুনে অনেক লোক তাঁকে ছেঁকে ধরল। নানান লোকের নানান অদ্ভুত সব প্রশ্নবাণ। এদিকে কয়েকজন তো তাঁকে ভূত ভেবে ভয়ে পালিয়েই গেল। লেখক যত তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাঁরা কিছুই বুঝতে চান না। রেগে, বিরক্ত হয়ে তিনি সেখান থেকে রাজবাড়িতেই ফিরে গেলেন।

ফিরে গিয়ে লেখক আবার ওই ঘরটির কাছে গেলেন। আবারও অনেকবার চেষ্টা করলেন তালা খোলার, কিন্তু এবারেও সফল হলেন না। এরপর নিজের ঘরে গিয়ে লেখার খাতাটি নিয়ে তিনি বসলেন, কিন্তু কিছুই লিখতে পারলেন না। একমনে চুপ করে বসে কলমটিকে মুখের কাছে ধরে কেবল একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তাঁর, 'সমস্ত ঘরই যখন খোলা রয়েছে তখন শুধুমাত্র এই একটিই ঘর তালাবদ্ধ কেন?' দুপুরের স্নান-খাওয়া সেরে লেখক বাগানে চলে গেলেন। বাগানটির পুরোটা ঘুরে দেখতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, পায়ের কাছে একটা আংটি পড়ে রয়েছে। সেটা হাতে তুলে তিনি ভালো করে দেখলেন এবং অনুমান করলেন সেটা এই রাজ-পরিবারেরই কারোর হবে। আংটিটা তিনি নিজের পাজামার পকেটে ভরে নিলেন এবং পিছন ঘুরে রাজবাড়ির দিকে যেতে গিয়েই আবার নজরে পড়ল জানালার আড়ালে থাকা সেই মুখটি। কেমন যেন করুণ দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। লেখক এবার জোরে চিৎকার করে উঠলেন, "কে ওখানে?" কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না। তিনি আবারও ডাকতে লাগলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জানালার কাঁচটি সরে গেল। তবে কাউকেই দেখতে পেলেন না তিনি।

কিছুক্ষণ পর লেখক আবছা একটি মহিলা কণ্ঠ শুনতে পেলেন, "আমাকে বাঁচান রাজকুমার। আমি এই কুঠিতে একলা বন্দি হয়ে রয়েছি।"

লেখক কিছু না ভেবেই প্রত্যুত্তর করেন, "কিন্তু আপনি কোন ঘরে আছেন? আমি দেখতে পাচ্ছি না আপনাকে। আমাকে বলুন?"

এরপর আর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, লেখক ঘরে ফিরে গেলেন। ঘরে গিয়ে আবারও একমনে ভাবতে লাগলেন, 'মেয়েটি কে? আর কাকেই বা 'রাজকুমার' বলে ডাকছিল? খুবই রহস্যজনক ব্যাপার!'

সেদিন রাতে লেখক আর কিছুই লিখতে পারলেন না, তাঁর মনে শুধু একটাই চিন্তা। মোমবাতিটি জ্বেলে চুপ করে বসে রইলেন চেয়ারে। রহস্যময় ব্যাপারটা তাঁকে এতটাই উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল যে সেদিন রাতে খাওয়ার কথা মনেই ছিল না তাঁর। তিনি ভাবছিলেন, 'তাহলে কি ওই বন্ধ ঘরেই রয়েছে সব রহস্যের চাবিকাঠি? কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও যে আমি ওটাকে খুলতে পারলাম না। এখন আরেকবার গিয়ে চেষ্টা করব? যদি খুলে যায়...' লেখক তাঁর ঘড়িতে সময় দেখলেন, দু'টো বাজতে দশ। তবুও তিনি শঙ্কিত না হয়েই ব্যাগ থেকে টর্চটি বের করে বন্ধ ঘরটির দিকে চললেন। ঘরটির কাছে যেতেই তিনি দেখলেন অবাক কান্ড, ঘরটির তালা খোলা রয়েছে! আস্তে আস্তে লেখক দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। দরজায় কান পেতে এবার স্পষ্ট শুনতে পেলেন একটি মেয়ের কান্নার শব্দ। শুধু কান্নাই নয়, ফিসফিস করে বলতে থাকা যেন কিছু কথাও ভেসে আসে তাঁর কানে। লেখক ভাবতে লাগলেন, 'এই কথাগুলো এত চেনা লাগছে কেন আমার? মনে হয় আগেও কোথায় যেন শুনেছি।' কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলেন না। তিনি এটা বুঝলেন যে, এ সেই মেয়েটিই যার গলার শব্দ তিনি বিকেলে শুনেছিলেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপর তিনি দরজায় টোকা মারতে গিয়ে আপনেই সেটি খুলে যায়। টর্চের আলোয় লেখক দেখলেন, এই ঘরটি রাজবাড়ির বাকি ঘরগুলোর মতো নয়, বরং একটু অন্যরকম। ভিতরে ঢুকে তিনি খুঁজতে লাগলেন মেয়েটিকে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না তাকে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ যেন তাঁর কাঁধের উপর হাত রেখে বলে উঠল, "আপনি এসেছেন রাজকুমার। এবার তবে আমায় মুক্ত করুন।"

সহসা হাতের স্পর্শে এবং অচেনা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলেন লেখক। পিছন ঘুরে দেখলেন, মুখের উপর একহাত ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটি। কাঁপা কাঁপা হাতে ঘোমটাটি তুলে লেখক দেখতে পেলেন, এক অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে রাজবেশে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, দেখলে যেন দু'চোখ জুড়িয়ে যায়।

লেখক জিজ্ঞেস করলেন, "কে আপনি? এই রাজবাড়িতে কী করছেন?"

নরম স্বরে মেয়েটি বলে, "আপনার জন্যই তো অপেক্ষায় ছিলাম রাজকুমার।"

"রাজকুমার! আমি?" লেখক হেসে উঠলেন, "আরে, আমি কোনো রাজকুমার নই। আমি একজন সামান্য লেখক।"

"সে আপনি এখন লেখক হতে পারেন। কিন্তু এককালে তো আপনি রাজকুমার ছিলেন। আমার রাজকুমার, কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন।" মেয়েটির কণ্ঠস্বর আরও কোমল হয়ে আসে, "কত যুগ ধরে আমি আপনার জন্য এই বন্ধ কুঠিতে অপেক্ষা করে চলেছি। অবশেষে আজ আপনি এলেন। আমায় মুক্ত করবেন না রাজকুমার?"

লেখক আশ্চর্য হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন, 'আরে, এসব কী বলছেন উনি? আর কেনই বা বলছেন এসব? তবে কেন জানি না, ওঁর মুখটাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন... ধুর, কিছুই তো মনে পড়ছে না আমার।"

মেয়েটি এরপর বলে, "আমাকে চিনতে পেরেছেন তো রাজকুমার?"

"কে আপনি? আর কেনই বা আমায় 'রাজকুমার' বলে সম্বোধন করছেন?"

মেয়েটি বলতে শুরু করে। "তখন অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক। মহারাজ অশ্বদ্যুম্নের পুত্র মহারাজ প্রদ্যুম্ন তখন এখানকার রাজা ছিলেন। মহারাজ অশ্বদ্যুম্নের পিতামহ মহারাজ শ্রীদ্যুম্ন এই নগরীর স্থাপনা করেছিলেন। মহারাজ প্রদ্যুম্নের দুই পুত্র - রাজকুমার শত্রদ্যুম্ন আর রাজকুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন। কুমারদের মাতা মহারাণী অম্বাক্ষী তাঁদের শৈশবেই দেহ রাখেন। বড় রাজকুমার শত্রদ্যুম্ন ভালো মানুষ ছিলেন না। প্রথম থেকেই সিংহাসনের প্রতি একরাশ মোহ ও লোভ ছিল তাঁর। শৈশব থেকেই তিনি তাঁর ছোট ভাই কুমার ইন্দ্রদ্যুম্নকে প্রবল হিংসা ও ঘৃণা করতেন। অন্যদিকে, কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন দাদার বিপরীতধর্মী; যেমন স্বভাবে, তেমন আচরণেও। কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন সব সময় প্রজাদের সুখের কথা চিন্তা করতেন। প্রজারাও তাঁকে খুব ভালোবাসত, কিন্তু সেই ব্যাপারটা বড় কুমারের কখনোই পছন্দ হতো না।

একদিন কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন বাগানে ফুল তুলতে গিয়েছিলেন। ফুল তুলতে গিয়ে একটা মেয়ের দিকে চোখ যেতেই আচমকা তাঁর হাতে কাঁটা বিঁধে, হাত থেকে রক্তও ঝরে খানিক। মেয়েটি সেই দৃশ্য দেখে তৎক্ষণাৎ কুমারের কাছে ছুটে গেল এবং তারপর নিজের পরনের কাপড় থেকে একটি টুকরো ছিঁড়ে তাঁর হাতে বেঁধে দিল। কুমার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে। মেয়েটির করুণাভরা মুখ, মায়াভরা দু'চোখে গভীর ক্ষতের ভাষা, যেন কুমারের আঘাতের ব্যথা সেই-ই অনুভব করছে। কুমার মেয়েটিকে কিছু বলতে যাবে, মেয়েটি ছুটে পালিয়ে গেল সেখান থেকে। কুমার ইন্দ্রদ্যুম্নও গেল তার পিছন পিছন, কিন্তু তাকে আর কোথাও দেখতে পেল না। এরপর প্রতিদিনই কুমার বাগানে এসে মেয়েটির অপেক্ষায় থাকত। মেয়েটি আড়াল থেকে দু'চোখ ভরে কুমারকে দেখত, কিন্তু তাঁর কাছে যেত না। এরপর একদিন কুমার বাগানে এসে স্ব-ইচ্ছায় নিজের হাতে কাঁটা বিঁধালেন। মেয়েটি তখন আবারও ছুটে আসে এবং সেই একই কাজ করে। কুমার আর তাকে পালাতে দেন না। মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, "কে তুমি? আর এইভাবে পালিয়ে যাচ্ছ কেন?"

মৃদু স্বরে মেয়েটি উত্তর দেয়, "আমার নাম শঙ্খনিতা। এই রাজবাগানের মালির মেয়ে আমি। আমাকে ছাড়ুন কুমার। রাজবাড়িতে অনেক প্রহরী। আমাকে আর আপনাকে একসাথে দেখে ফেললে বিপদ হবে আমার।"

"কীসের বিপদ?"

মেয়েটি মুচকি হেসে বলে, "আপনি হলেন রাজকুমার আর আমি এক সামান্য মালির মেয়ে। একজন রাজকুমারের মালির মেয়ের হাত ধরাটা কখনোই শোভা পায় না। দয়া করে আমার হাতটা ছাড়ুন।"

কুমার জিজ্ঞেস করে, "তাহলে যখন আমার হাতে কাঁটা বিঁধল তখন তুমি অমন করে ছুটে এলে কেন?"

"আপনার হাত থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল যে! আর সেই মুহূর্তে আমার আপনাকে সেবা করাটা উচিত বলে মনে হয়েছিল। তাই আমি কাপড়ের টুকরো বেঁধে দিয়েছিলাম।"

মেয়েটি যে অর্ধসত্য বলছে, তা ধরা পড়ে যায় কুমারের চোখে। কুমার আবার তাকে বলেন, "তুমি কিছু গোপন করছ। সবটা বলছ না আমায়। কারণ গতদিনের ঘটনাটা কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু আজ আমি তোমায় পরীক্ষা করার জন্য ইচ্ছে করে নিজের হাতে কাঁটা বিঁধিয়ে ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যে, তুমি প্রতি মুহূর্তে আমায় আড়াল থেকে প্রত্যক্ষ করো কিন্তু সামনে আসো না। আর আমার এই অনুমানটি আজ সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেল। এবার সব কথা বলো আমায়। কেন তুমি প্রত্যহ দূর থেকে আমায় লক্ষ্য করো?"

"আপনার এই ধারণা ভুল, কুমার। বাগানের এই ফুলগুলি আমার বড্ড প্রিয়। তাই ওদের দেখতেই আমি রোজ এখানে আসি।"

খানিক উত্তেজিত হয়ে কুমার বলেন, "অসত্য বোলো না শঙ্খনিতা। আমি তোমার চোখ দেখেছি। আর তোমার চোখদুটো সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে। তুমি এবার সেই সত্যটাই বলো আমায়।"

"আপনি কোন সত্য জানতে চান, কুমার?"

"তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?"

শঙ্খনিতার একটি হাতকে নিজের দুইহাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ করলেন কুমার। তৎক্ষণাৎ মেয়েটি হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে বলে ওঠে, "এমা! না না কুমার, এটা সঠিক নয়। এমন ভাবনাও যে আমার জন্য পাপ। আশেপাশের কেউ এই কথা শুনে ফেললে আমার বড় বিপদ হবে কুমার।"

"সত্য কথায় পাপ কীসের? বরং সত্যকে আড়াল করতে গেলেই বিপদ বাড়ে। আর তুমি সেই সত্যই গোপন করছ আমার থেকে। মানুষ চিনতে এতটাও ভুল হয় না আমার।" একটু থেমে কুমার আবার বলেন, "আচ্ছা, বেশ। তোমার কথাকেই মর্যাদা দিলাম। তুমি আমায় ভালোবাসো না, তাই তো?"

মেয়েটির মন তখন উচ্ছ্বাসের সাথে বলে ওঠে, 'বাসি তো কুমার, খুব ভালোবাসি আপনাকে। আর আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। কিন্তু এ কথা বলি কী করে আপনাকে?' মুখ নিচু করে মৃদু স্বরে সে জবাব দিল, "না, ভালোবাসি না।"

"আচ্ছা, তুমি যখন বলছ তখন এটাকেই সত্য হিসেবে ধরলাম। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করব, যদি তুমি আমাকে ছুঁয়ে এ কথা বলো।" এবার কী বলবে মেয়েটি বুঝতে পারল না, তাই নীরব হয়ে রইল। কুমার বলেন, "তুমি যদি এভাবে চুপ করে থাকো তাহলে আমায় ধরে নিতে হবে যে, তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে মিথ্যা বলে চলেছ।"

মেয়েটি এবার উপর-নিচে মাথা নাড়ল। মৃদু স্বরে বলল, "হ্যাঁ কুমার, আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। শৈশব থেকেই আমি আপনাকে প্রত্যক্ষ করতাম। আপনার সকল কাজ আমার খুব ভালো লাগত। এইভাবেই আপনি আমার মনে একটা বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন। কিন্তু আপনাকে ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলার স্পর্ধা আমার হয়নি কখনও।" কথাগুলো বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে শঙ্খনিতার।

কুমার তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলেন, "আমি অনেক আগেই সে কথা জেনে গিয়েছিলাম শঙ্খনিতা। সেদিন যখন তুমি আমার হাতে কাপড় বেঁধে পালিয়ে গিয়েছিলে তখন আমি তোমার পিছন পিছন ছুটে যাই। তোমাকে খুঁজে না পেলেও তোমার প্রেমপত্র আমার দৃষ্টিগোচরে আসে। একটা বটবৃক্ষের গায়ে লেখা তোমার সেই প্রেমপত্রখানি আমি দেখতে পাই। আর সেদিনের পর থেকে প্রতি রাতে আমি স্বপ্নে তোমার মুখখানা দেখতে পেতাম। আমিও তোমায় খুব ভালোবেসে ফেলেছি। আর এসব তো কেবল পরীক্ষাই ছিল মাত্র! আসলে আমি তোমার মুখ থেকে সত্যটা শুনতে চেয়েছিলাম। আমায় একটা কথা দেবে শঙ্খনিতা?"

"আজ্ঞে কুমার।"

"তুমি এই বাগানে এসে প্রত্যহ আমার সাথে দেখা করবে?" মেয়েটি 'কিন্তু' বলতে যাওয়ার আগে কুমার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, "না শঙ্খনিতা, কোনো কিন্তু নয়। তোমাকে এটা কথা দিতে হবে। তুমি বুঝতে পারছ না, তোমাকে না দেখলে আমার মন অস্থির হয়ে ওঠে। জানো তো, গোলাপ ফুলের বর্ণ ও সুগন্ধের জন্যই তার এত খ্যাতি। কিন্তু শুকনো গোলাপের কদর কেউ দেয় না! তেমনই তোমাকে ছাড়া আমার মনও বিবর্ণ হয়ে যাবে। তুমি কি সেটা চাও?"

"না কুমার, কখনোই না। আমি আসব, রোজ আসব এখানে। আমি কখনোই আপনার অস্তিত্বকে মুছে যেতে দেব না।"

কুমার তাকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরলেন। একটা অদৃশ্য অনুভূতির কম্পন অনুভব করল দুটো হৃদয়। এরপর থেকে প্রতিদিনই কুমারের সঙ্গে দেখা হতে থাকে শঙ্খনিতার এবং তাদের ভালোবাসা আরও মাধুর্যময় হয়ে ওঠে।

একদিন কুমার শঙ্খনিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। শঙ্খনিতা কোনো অমত প্রকাশ করল না। এই প্রস্তাবের কথা কুমার তাঁর পিতা মহারাজ প্রদ্যুম্নকে জানান। মহারাজ ছিলেন ভীষণ সৎ এবং মহৎ হৃদয়ের একজন মানুষ। ওঁর মতো প্রজাবৎসল রাজা তখনকার দিনে খুব বিরল। জলরাশির প্রবল চাপে পাথর যেভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, কোনোরকম মোহ যেমন তাকে রুখতে পারে না, তেমনই আমাদের মহারাজকে যদি প্রজাদের সুখের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করতেও হতো তিনি সেটাই করতেন। কুমারের প্রস্তাবে মহারাজ সম্মতি দিলেন এবং শঙ্খনিতা ও কুমারকে আশির্বাদও করলেন তিনি। কুমার শত্রদ্যুম্ন সেই সময় পাশের রাজ্য পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে পিতাকে তিনি বিবাহ রদ করার আদেশ দিতে বলেন। বড় কুমার হুমকি দিয়েছিলেন যে, যদি এই বিবাহ প্রতিহত করা না হয় তাহলে তিনি রাজবাড়ির মান-সম্মান সব নষ্ট করে দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিতার ক্ষমতাবলের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। তবুও পিতার চোখে নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে বিবাহে কোনো অমত প্রকাশ করলেন না তিনি, কিন্তু মনে মনে এক ভয়ানক পরিকল্পনার ব্যূহ রচনা করে চললেন। শত্রুরাজ্যের সাথে হাত মিলিয়ে মিত্ররাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করালেন কুমার শত্রদ্যুম্ন। অগত্যা মহারাজ প্রদ্যুম্নকে মিত্ররাজ্যের রক্ষার্থে যুদ্ধে যেতে হল। যাবার আগে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ও শঙ্খনিতাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ফিরে এসে তাদের চার হাত এক করে দেবেন।

তারপর এলো সেই অভিশপ্ত এক রাতটা। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। চারিদিক শুনশান, আবহাওয়া শীতল। কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন শঙ্খনিতাকে নিয়ে রাজবাড়িতে আসেন। দু'জনে পরষ্পরের মনের কথাগুলো আলোচনা করতে থাকেন, দুঃখগুলোও একে অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।

এরই মাঝে শঙ্খনিতা হঠাৎ বলে ওঠে, "কুমার, আমার মনটা না আজ বড়ই উথালপাথাল করছে। এমন মনে হচ্ছে, যেন কোনো অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে।"

কুমার শঙ্খনিতাকে বুকে টেনে নিলেন, "কিচ্ছু হবে না, শঙ্খনিতা। এখন আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সমর্পিত, কারোর ক্ষমতা নেই আমাদের আলাদা করার। আর পিতা তো বলেই গেছেন যে, ফিরে এসে উনি আমাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।"

"সবই ঠিক আছে। তবুও আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে যে, এত তাড়াতাড়ি আমরা এক হতে পারব না। আমাদের হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।"

"তুমি কি কোনো কারণে দাদাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে আছ? তাহলে বলব, চিন্তার কোনো কারণ নেই। তুমি দেখলে না, সেদিন পিতা যখন আমাদের বিবাহের কথা বলছিলেন, দাদা কত খুশি হয়েছিল।"

"না কুমার, আমি তাঁকে নিয়ে ভাবছি না। তবে..."

শঙ্খনিতাকে থামিয়ে কুমার বললেন, "তবে আর কিছু বোলো না। কতদিন পর আমরা একসাথে আছি। তুমি চুপটি করে আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকো। তোমার চুলের পবিত্র সুবাস আমার হৃদয়কে বড়ই প্রশমিত করে তুলেছে।" তাকে নিজের আরও কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন কুমার। শঙ্খনিতাও দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে তার প্রাণের মানুষটিকে।

কিছুক্ষণ পরে এই রাতই তাদের জীবনে ভয়ঙ্কর কালরাত্রি ডেকে আনল, কুমার শত্রদ্যুম্নের এক কুপরিকল্পনায়। কুমার শত্রদ্যুম্ন সেদিন রাজবাড়ির সমস্ত প্রহরীকে ছুটি দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের কিছু প্রহরীকে সাথে নিয়ে কুমার তাদের কক্ষে প্রবেশ করেন। বড় কুমারের অকাল আগমনে বিচলিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা।

কুমার শত্রদ্যুম্ন ভাইকে আদেশ করেন, "প্রাণে যদি বাঁচার আকাঙ্ক্ষা থাকে তাহলে এই মুহূর্তে মেয়েটিকে এখানে রেখে বিদায় হও।"

কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন ক্রুদ্ধস্বরে বলে ওঠেন, "না দাদা, এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছি। তাই তোমার এই আদেশ আমি কখনোই মান্য করব না আর তোমার এই বিশ্রী পরিকল্পনার কথা আমি পিতাকে জানিয়ে দেব।"

বড় কুমার হো হো করে হেসে ওঠেন, "তুমি জানাতে চাইলে জানাতেই পারো। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেই অবস্থায় থাকলে তো তুমি জানাবে!"

এরপর তিনি প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন, আদেশ না মানার অপরাধে ছোট কুমারকে কক্ষের বাইরে নিয়ে গিয়ে চাবুক কষতে। শঙ্খনিতা অনেক মিনতি করলেও তা বিফল হয়। কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রতিহত করতে পারেন না তাদের এবং শিকার হন দাদার কুপরিকল্পনার মায়াজালে। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর কুমার শত্রদ্যুম্ন কক্ষের দ্বার আঁটেন এবং শঙ্খনিতাকে তাঁর সঙ্গে সহবাসের প্রস্তাব দেন।

ক্রোধান্বিত হয়ে শঙ্খনিতা তাঁর গালে জোরে চড় কষিয়ে বলে, "পাষণ্ড, তোর ঠাঁই নরকেও হবে না, আর মৃত্যুর পরে তোর এই কু-আত্মা মুক্তির জন্য ছটফট করবে, কিন্তু মুক্তি পাবে না কিছুতেই। আর আমি বেঁচে থাকতে তোর এই নোংরা পরিকল্পনা কিছুতেই সফল হতে দেব না।"

কথাটা বলে শঙ্খনিতা কক্ষ থেকে যেই বেরোতে যাচ্ছিল, তখনই বড় কুমার তার পথ অবরোধ করেন। এরপর পাশবিক অত্যাচার নেমে আসে শঙ্খনিতার উপরে। ভোগস্পৃহা চরিতার্থ করার পর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি এবং কক্ষের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন। তারপর কুমার ইন্দ্রদ্যুম্নকে নৃশংস অত্যাচার করে হত্যা করেন তিনি, আর তাঁর দেহটিকে রাজবাড়ির বাগানে মাটির নিচে পুঁতে দেন। এইদিকে বন্দি অবস্থায়, অপমানের জ্বালায় তিন দিন পর মৃত্যু হয় শঙ্খনিতার। শেষ পর্যন্ত তার আশঙ্কাটাই সত্যি হল আর কুমার শত্রদ্যুম্নের নোংরা অভিসন্ধিও।

এই হল সেই কাহিনি। আপনি হলেন কুমার ইন্দ্রদ্যুম্ন আর আমিই আপনার সেই ভালোবাসা, শঙ্খনিতা। আপনার মৃত্যুর পর আপনি মুক্তি পেয়ে পুনর্জন্ম লাভ করেছেন, কুমার। কিন্তু মৃত্যুর আগে আমার একটি শেষ ইচ্ছে ছিল, একটিবার আপনাকে দু'চোখ ভরে দেখার। সেই কারণে আজও আমি আটকে রয়েছি এই কক্ষটিতে।"

মেয়েটির বলা এতক্ষণে সমাপ্ত হয়েছে। লেখকের চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তাঁর মনের অজান্তেই। মেয়েটিকে তিনি বলেন, "আর কিছু বলতে হবে না, শঙ্খনিতা। এরপর আমি সবটাই জানি। সেদিন আমার দাদা আমার উপর এমন হিংস্র অত্যাচার করেছিল, যা কোনো পশুর উপরেও কেউ করে না। তারপরে আমাকে নির্মমভাবে হত্যা করে আমার দেহটিকে খণ্ড-বিখণ্ড করে পিছনের জঙ্গলের মাটিতে পুঁতে দিয়ে আসে।" পকেট থেকে আংটিটা বের করে তিনি বলতে লাগলেন, "এটা আমারই আংটি। ওই বাগানের জঙ্গলে পড়েছিল। এসব ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে এই দৃশ্যগুলোই আমার স্বপ্নে ভেসে উঠত আর আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেতাম না। কিন্তু আজ আমার সব মনে পড়ে গেছে। আর তুমি সেদিন বলেছিলে যে, আমাদের মিলনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আজ এত বছর পর আমরা আবার মিলব। আজ আর কোনো পিছুটান নেই, কোনো বাধা নেই আর আমাদের জীবনে। চলে এসো শঙ্খনিতা, তোমার সাথে সাথে আমারও মুক্তি ঘটবে আজ।"

শঙ্খনিতার চোখদুটো জলে ভরে ওঠে। সে শক্ত করে তার কুমারকে আঁকড়ে ধরে। কুমারও তাকে জড়িয়ে ধরেছে। এরপর কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা... চোখের নিমেষেই ধসে পড়ল বাড়িটির সমস্ত অংশ। টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকল রাজবাড়ির ইট, কাঠ, পাথর থেকে শুরু করে সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু স্মৃতিচিহ্নের ধ্বংস ঘটলেও সাক্ষী থেকে যায় দু'জনের ভালোবাসার সেই প্রাচীন মুহূর্তগুলো, যেগুলো হয়তো আজও বেঁচে রয়েছে কারোর ভালোবাসার মধ্যে। দীর্ঘ যুগ পর মুক্তি প্রাপ্তি ঘটেছে তাদের এবং অপূর্ণ ভালোবাসাও অবশেষে পূর্ণতা লাভ করেছে।


[সত্যি ভালোবাসার কদাপি মৃত্যু হয় না। অপূর্ণ ভালোবাসাকে পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে বারে বারেই ফিরে আসতে হয়। কালের নিয়মে সময়ের পরিবর্তন ঘটলেও, বদল ঘটে না ভালোবাসার। তার একটাই লক্ষ্য, আর তা হল মিলন।]

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু