বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সোনার খাঁচা

আগামীকাল সংলাপের রেজাল্ট বের হবে। এই বছর উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে সে। সমস্ত পরীক্ষা দিয়ে এসে সে প্রবল সন্তুষ্ট ছিল মনে মনে এই দু'টো মাস। কিন্তু রেজাল্টের আগের রাতে চিন্তায় দু'চোখ স্থির রাখতে পারে না সংলাপ। উত্তেজনাপূর্ণ মনে মা-বাবার মাঝখানে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে চলে সারাটা রাত। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল সুমিত্রার। সংলাপের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি জিজ্ঞেস করেন, "কি রে বাবা, এখনও ঘুমোসনি কেন? রেজাল্টের চিন্তা করছিস?"

মা'কে জড়িয়ে ধরে সংলাপ বলে, "হ্যাঁ, মা! ভীষণ টেনশন হচ্ছে। পরীক্ষা তো সব ঠিকঠাকভাবেই দিয়েছি। তবুও আজ আমার মন বড্ড অস্থির। যদি আমি এবারেও বিবাইয়ের থেকে কম নাম্বার পাই, তবে!"

"না বাবা, এত টেনশন করিস না। দেখিস, তুই-ই-ই বেশি পাবি ওর থেকে। এখন ঘুমিয়ে পড় তো। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। কাল আমি তোর পছন্দের খাবারগুলো সব রান্না করব।"

সুমিত্রা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন এবং মনের চোখে এক খুশির স্বপ্ন কল্পনা করে চলেন। ভাবেন যে, 'কাল যখন সংলাপ পাশের বাড়ির বিবাইয়ের চেয়ে বেশি নম্বর পাবে, তখন ওই মালিনীর মুখটা কেমন হবে সেটা দেখার অপেক্ষাতেই আছি আমি। মাধ্যমিকে নিজের ছেলে সাতটা নম্বর বেশি পেয়েছিল বলে কী অহংকার! কাল সেই দেমাকই চূর্ণ করে দেবে আমার ছেলে।' মা'কে জড়িয়ে ধরে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে সংলাপ। তাদের দু'জনের পাশেই বেঘোরে ঘুমিয়ে আছেন শরৎবাবু।

পরদিন প্রায় ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় ঘুম ভেঙে যায় সংলাপের। মা আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে বললে তার আর ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। ঘুম থেকে উঠে মুখ-টুক ধুয়ে সে চলে গেল ছাদে। ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখা যায় তাদের পাড়ার মাঠটিকে। ভোরের মৃদু আলোক ছটা গিয়ে পড়েছে মাঠটির একেবারে কেন্দ্রে। দিগন্তের দু'পাশ দিয়ে কিছু পাখির ঝাঁক ভেসে চলেছে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। সেইদিকে না তাকিয়ে সংলাপের চোখ কেবল চেয়ে থাকে দূরের ওই মাঠটির ওপরে। পুরোনো কিছু স্মৃতি ঘুরতে থাকে তার মন জুড়ে।

২ বছর আগে...

মাধ্যমিকে সংলাপের থেকে বিবাই মাত্র সাত নম্বর বেশি পেয়েছিল। তবে তার নম্বর ছিল ছয় শতকের ঘরেই। তবু এত নম্বরেও খুশি হয়নি তার বাড়ির সদস্যরা। শতকটা ছয়ের কম হলেও যদি সে নম্বরে বিবাইকে হারাতে পারত, তবে বোধহয় আনন্দের বাতাবরণ সৃষ্টি হতো গোটা বাড়িতে। সুমিত্রা তাকে বলেছিলেন, "দ্যাখ বাবা, এটা জীবনের প্রথম পরীক্ষা ছিল। কিন্তু শেষেরটাতে তোকেই বেশি পেতে হবে ওর থেকে। আর তোর প্রতিটা সাবজেক্টের জন্য মাথাপিছু একজন করে টিচার রাখব আমি এবং যেটায় কাঁচা সেটাতে দু'টো করে। কিন্তু বিবাইয়ের থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকে তোকে বেশি পেতেই হবে বাবা।"

পাশের বাড়ির মালিনী যখন সুমিত্রার সাথে টোন কেটে কথা বলেন, তখন তিনি ঘরে এসে সংলাপকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, "দেখলি বাবা! তুই ওর ছেলের থেকে সাতটা নম্বর কম পেয়েছিস বলে কীরকম দেমাক ওর! কীভাবে ব্যাঙ্গ করে কথা বলে আমার সাথে। আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগে রে! এবারে তো তুই ওকে জিতিয়ে দিলি কিন্তু পরের বার আমায় জেতাবি তো বাবা? আমার কথা রাখবি তো? দেখিয়ে দে তো, সেরা দশজনের একজন হয়ে।"

"ঠিক আছে মা। আমি চেষ্টা করব।"

"না রে বাবা! চেষ্টাটা তো শুধুই মুখের কথা। এবারেও তো করলি। কিন্তু তাতে কি লাভ হল কিছু, বল? তার থেকে বরং আমার কথা শুনে দ্যাখ। বইয়ের সাথে এঁটুলির মতো লেগে থাক দিনরাত। বড়দের কথা শোন, ভালো ফল পাবি।"

ফ্যাকাশে মুখে একটা অমলিন হাসিতে মাথা নাড়ল সংলাপ। শরৎবাবু প্রায় দেড় মাস কথা বলেননি তার সাথে। পরীক্ষার আগে তিনি বলেছিলেন যে, স্টার মার্কস পেলে তাকে নতুন মোবাইল কিনে দেবেন। জেঠুও সাইকেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন। কিন্তু তাদের আশানুরূপ নম্বরের থেকে বেশি পাওয়ার পরেও দু'জনের কেউ নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি, শুধুমাত্র ওই একটি কারণের জন্যই। জেঠু তাকে আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, "দ্যাখ! যেই ছেলেটাকে কখনও ভাবতে পারিনি যে সে এত ভালো নাম্বার পাবে, আজ সে তোকেও টপকে গেল। তুই আমার মুখটাই ছোট করে দিলি রে বাবা! তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম একদিন।"

কাঁদো কাঁদো চোখে সংলাপ বেরিয়ে যায় জেঠুর ঘর থেকে। জেঠুর সামনে সে কাঁদতে পারেনি। তাই সে বাথরুমে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। তবে নিঃশব্দে, পাছে যাতে কেউ তার কান্না শুনতে না পায়।

ওদিকে রেজাল্ট ভালো করায় নতুন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল পেয়েছিল বিবাই। মাসি তাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল আর কাকা দিয়েছিল ল্যাপটপ। বিভাগ আলাদা হলেও একই স্কুলে পড়ত সংলাপ ও বিবাই। টিফিনের সময় রোজ দেখা হতো তাদের। তবুও বিবাইয়ের চোখে সংলাপ যেন স্বার্থপর হয়ে উঠছিল দিন দিন। ইংরেজী, বাংলা দু'জনেরই কমন সাবজেক্ট ছিল। সংলাপ যেহেতু ইংরেজীতে খুব ভালো ছিল, তাই প্রয়োজনে সেই বিষয়ে তার থেকে সমস্ত রকম সাহায্য পেত বিবাই। কিন্তু ইদানীং সে লক্ষ্য করে যে, পড়াশোনা বিষয়ক ব্যাপারগুলো সংলাপ কেমন এড়িয়ে চলেছে তার থেকে। রেজাল্টের পর থেকে বিকেলবেলা মাঠে খেলতেও যায় না সংলাপ। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই সে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার এইরূপ মনোযোগ দেখে শরৎবাবু ও সুমিত্রা খুশি হন। ভাবেন, পরের বার নিশ্চয়ই ছেলে তাদের মুখ রাখবে।

এই ভাবনা নিয়েই কেটে গেল পরপর দু'টো বছর। উচ্চ-মাধ্যমিকের প্রত্যেকটা পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পর বাড়ির সকলে তাকে ঘিরে জিজ্ঞেস করত, "কি রে, এবারে ঠিকঠাক নাম্বার আসবে তো? পাশের বাড়ির ছেলেটার থেকে বেশি নাম্বার পাবি তো?"

প্রতিবারই মুখে সেই অমলিন হাসিটা নিয়ে সে ঘাড় নাড়ত এবং মনের মধ্যে ঘুরে চলত প্রিয় বন্ধুটিকে নম্বরে হারানোর চিন্তা। এবারেও সে উপহারের একই প্রতিশ্রুতি পেল সকলের থেকে, যেমনটা বছর দুয়েক আগেও পেয়েছিল।

স্থির দু'চোখ চেয়ে রয়েছে আলো পড়া মাঠটির দিকে আর একমনে ভেবে চলেছে এইসব স্মৃতিকথাকে। মাঠটিতে কত দিন খেলেনি সে! পরীক্ষা শেষ হতেই পরবর্তী শ্রেণীর পাঠ শুরু করে দিয়েছে সংলাপ। হাওয়ার ঢেউয়ে হাতছানি দিয়ে মাঠটি ডাকছে তাকে। কিন্তু চোখের ইশারায় মাঠকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে সে। আচমকাই নিচ থেকে মায়ের গলা শুনে বাস্তব মুহূর্তে ফিরে আসে সংলাপ। সুমিত্রা চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, "তাড়াতাড়ি নিচে আয় বাবা। টিভিতে নামগুলো বলবে এবার।"

সময় তখন প্রায় সাড়ে ন'টা। ছাদের উপরে কাটানো দীর্ঘ সময়ের কথা মনে থাকে না সংলাপের। এক দৌড়ে সে চলে আসে বসার ঘরে। সেখানে আগে থেকেই বসে রয়েছেন সংলাপের দাদু, ঠাম্মা, জেঠু, জেঠিমা, বাবা আর মা। সংলাপ গিয়ে বসল তার মায়ের পাশে। মায়ের একটা হাতকে নিজের দু'হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখল সে। সুমিত্রা জিজ্ঞেস করলেন, "কি রে বাবা, এ'রকম কাঁপছিস কেন? আর এত ঘামছিস যে! শরীর ঠিক আছে তো?"

"হ্যাঁ, মা! শরীর ঠিক আছে। কিন্তু..." বলতে বলতে থেমে গেল সংলাপ।

"কিন্তু কী বাবা? কী হয়েছে? বল আমাকে?"

"মা! আমি যদি এবারেও বিবাইয়ের থেকে বেশি নাম্বার পেতে না পারি? টেনশন হচ্ছে খুব।"

সান্ত্বনার স্বরে সুমিত্রা বললেন, "ধুর, বোকা! কে বলেছে তুই বিবাইয়ের থেকে বেশি পাবি না? এটা হতেই পারে না। তোর জন্য এতগুলো টিচার রাখলাম আর তুইও তো খেটে পড়েছিস, পরীক্ষাগুলো ভালো দিয়ে এসেছিস। তবে এখন টেনশন করছিস কেন? দেখবি, তুই-ই-ই বেশি পাবি। আমি তোর জন্য পায়েস বানিয়েছি। খাবি এখন, নিয়ে আসব রান্নাঘর থেকে?"

"না মা, এখন আমি কিছুই খেতে পারব না। আগে রেজাল্টটা বেরোক, তারপর।"

সকলে তখন উত্তেজনার সাথে পরীক্ষার্থীদের নাম শুনতে উদগ্রীব। তাই দু'জনের কথোপকথনে কর্ণপাত করল না কেউ। খবরে এক-একটা নাম যখন ঘোষণা হতে থাকে, তখন প্রতিবারই স্তব্ধ হতে থাকে সংলাপের হৃৎস্পন্দন। বাড়ির সকলে মিলে সেই হৃদয়ে বুনে দিয়েছিল ভয় এবং বিদ্বেষের মায়াজাল। দীর্ঘ দু'বছরে সংলাপের রূঢ় ব্যবহারের ফলে দুই বন্ধুর সম্পর্কের অনেক অবনতি ঘটেছে। শৈশব থেকে এরা দু'জনেই ছিল একে অন্যের প্রিয় বন্ধু।

দশটা থেকে ইন্টারনেট মাধ্যমে ফল প্রকাশিত হবে। সেই আগ্রহে সংলাপের জেঠু প্রতীক্ষা করছেন মোবাইল হাতে। দশটা বাজতেই তিনি মোবাইলের ব্রাউজার ওপেন করে ওয়েবসাইটটি টাইপ করতে থাকেন। একই সাথে প্রবল বেগে কম্পিত হতে থাকে সংলাপের হৃদয়। রেজাল্টে দৃষ্টি পড়তেই গম্ভীর হয়ে যান সংলাপের জেঠু। শরৎবাবু জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, "নাম্বার বেশ ভালোই, চারশো সাতাত্তর। সব বিষয়ে লেটারও রয়েছে। আচ্ছা! পাশের বাড়ির ছেলেটা কত পেয়েছে? একটু খোঁজ নিয়ে এসো তো কেউ।"

মিনিট পাঁচেক পরে সংলাপের জেঠি বিবাইদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে বলেন, "বিবাইয়ের রেজাল্ট নাকি ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে না। মালিনী সোফায় বসে কাঁদছে খুব।"

অন্যপ্রান্ত থেকে জেঠু মৃদু হেসে বলেন, "ফেল করেছে নিশ্চয়ই। ফেলের রেজাল্ট ইন্টারনেটে আপলোড করে না। ভালোই হয়েছে।"

শরৎবাবু বলেন, "কিন্তু দাদা, অনেক সময় তো সার্ভারের গন্ডগোলের কারণেও রেজাল্ট দেখা যায় না।"

"আরে না রে! ও ব্যাটা ফেলই করেছে নির্ঘাত। খুব উড়ছিল দিনকে দিন। আগের বার সংলাপের থেকে একটু বেশি পেয়ে দুটো ডানা গজিয়েছিল ওর।"

এ'সবের মাঝে সংলাপ তখনও চুপচাপ। রান্নাঘর থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে আসেন সুমিত্রা। সারা ঘরময় তখন আনন্দের উৎসবে মুখরিত। জেঠু তাকে বলেন, "তোকে আমি সাইকেল দেবো বলেছিলাম, তাই না সংলাপ? তবে তার সাথে একটা ল্যাপটপও পাবি তুই, এত ভালো রেজাল্ট করার জন্য।"

শরৎবাবু বলেন, "বাবা! আজ তুই আমার সম্মান বাড়িয়ে দিলি রে। আমার তোকে নিয়ে গর্বের অন্ত রইল না আর। বুক ফুলিয়ে এবার পাড়া দিয়ে হেঁটে যেতে পারব আমি। আর সকলের চোখে চোখ রেখে বলব– দ্যাখো, আমার ছেলের মতো নাম্বার কেউ পেয়েছে কখনও এই পাড়ায়? তোকে আমি কালই একটা দামী অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল কিনে দেবো। ওই বিবাইয়ের সেটটার থেকেও দামী!"

সকলের উত্তেজনাপূর্ণ আনন্দে সংলাপ ভীষণ খুশি। সুমিত্রা চামচে করে পায়েস তুলে সংলাপকে খাওয়াতে যাবেন, ঠিক তখনই মালিনীর কণ্ঠস্বরটা থমকে দিল তাঁর হাতটাকে। মালিনীর দু'চোখ থেকে যেন আনন্দ ঝরে পড়ছে! সঙ্গে নিয়ে আসা মিষ্টির হাঁড়িটা তিনি তুলে দিলেন সংলাপের জেঠুর হাতে আর অনর্গল বলতে থাকলেন, "কানেকশন প্রবলেমের জন্য বিবাইয়ের নম্বরটা তখন দেখাচ্ছিল না ওয়েবসাইটে। তারপরে ওর বাবা একটা ক্যাফেতে গিয়ে দেখে এসেছে রেজাল্ট। আপনাদের আশীর্বাদে আমার বিবাইটা এবারেও রেকর্ড মার্কস করেছে, চারশো ঊনআশি। এ পাড়াতে এতদিন যাবৎ সবার চেয়ে বেশি! আর চার নম্বর বেশি পেলেই ওর নাম টিভিতে দেখতে পেতেন। সে যাই হোক! এই আনন্দে মিষ্টি খান আপনারা। এ পাড়ার সকলকে আজ আমি মিষ্টি বিতরণ করব।" হাঁড়ি থেকে একটা রসগোল্লা তুলে সংলাপের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে মালিনী বললেন, "নে বাবু, মিষ্টি খা। তোর বন্ধু কত ভালো নম্বর পেয়েছে! আজ রাতের ডিনারটা আমাদের বাড়িতে করিস, কেমন? মহাভোজ হবে আজ, পার্টি দেবো। সংলাপকে সাথে করে আপনারাও আসবেন কিন্তু সবাই।"

একটা আনন্দসূচক উচ্ছ্বাস এবং সেইসাথে ছেলের প্রতি গভীর অহংকারে বিগলিত হয়ে পড়েছেন মালিনী। এরপরে তিনি বেরিয়ে গেলেন সংলাপদের বাড়ি থেকে। এতক্ষণ যে বাড়িটা ছিল প্রফুল্লতায় পরিপূর্ণ, মালিনীর আগমনে সচকিতে সেখানে নেমে আসে শোকের নিস্তব্ধতা। সুমিত্রার হাত কাঁপতে থাকে। চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে তাঁর অবিরাম অশ্রুধারা। পায়েসের বাটিটা সংলাপের হাতে ধরিয়ে তিনি বলেন, "নে! এবার গিলে উদ্ধার কর আমায়। কত প্রত্যাশা নিয়ে তোর জন্যে রান্না করেছিলাম আজ। কত আকাঙ্ক্ষা, কত স্বপ্নই না দেখেছিলাম এতদিন ধরে। আমি বুঝতে পেরেছি, তোর দ্বারা আর কিছুই হবে না।" কাঁদতে কাঁদতে সুমিত্রা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

পাশ থেকে ঠাম্মা বলে উঠলেন, "যার হবার তার নয়'তেই হয়, আর যার না হবার তার নব্বই'তেও কিছু হবে না। এতদিন ধরে টাকাগুলো জলে বিসর্জন দিলি তোরা। গরিব, দুঃখীদের দান করলেও তাতে পুণ্যলাভ হতো।"

কাঁদো কাঁদো চোখে ঘরে চলে গেল সংলাপ। কিছুক্ষণ পরে স্কুলড্রেস পরে রেজাল্ট আনতে যায় সে। বন্ধুরা সবাই মিলে ঘিরে ধরেছে তাকে। এ বছর বিজ্ঞান বিভাগে সবথেকে বেশি নম্বর সেই-ই-ই পেয়েছে। আর বিবাইয়ের কলা বিভাগ। মুখে প্রসন্নতার ছাপ নেই দেখে একজন শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "কী হয়েছে সংলাপ? তোমার মুখে হাসি নেই কেন? আমাদের বিভাগে সবার চেয়ে হায়েস্ট পেয়েছ তুমি আর তোমার মার্কসটাই এখনও পর্যন্ত রেকর্ড মার্কস এই বিভাগের। তবুও তুমি এতটা উদাস কেন? আজ তো তোমার আনন্দের দিন।"

বুকের কান্নাকে লুকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা অমলিন হাসি ফুটিয়ে রেজাল্টটা নিয়ে বাড়ির পথে অগ্রসর হলো সংলাপ। রেজাল্ট দেখাতে সর্বপ্রথম জেঠুর কাছে গেলে তিনি বলেন, "না বাবা! তোর এই নাম্বারে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। হ্যাঁ রে, তুই আর কয়েকটা নাম্বার বেশি পেতে পারলি না? আজ তোর জন্যই রাস্তা দিয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে যেতে পারব না আমরা কেউ। সবাইকে কত বলে বেরিয়েছিলাম যে, আমাদের সংলাপ এ পাড়ায় রেকর্ড মার্কস পাবে। আর সেই তুই... ছিঃ! দেখলি না, পাশের বাড়ির কাকিমা কেমন ব্যাঙ্গ করে কথাগুলো বলে গেল। শুনতে খুব ভালো লাগছিল বল?"

শরৎবাবুর কাছে রেজাল্ট দেখাতে নিয়ে গেলে তিনি দূর থেকেই বলে দেন, "আমার কাছে ওই রেজাল্ট নিয়ে একদম আসবি না। ওটা দিয়ে নৌকো বানিয়ে জলে ভাসিয়ে আয় গিয়ে। গাধা একটা! নিজের মুখটা আয়নার সামনে দেখেছিস কখনও? আজ শুধু তোর জন্যই আমাদের পরিবারের মান ক্ষুণ্ণ হলো। তোর পেছনে এত বছর ধরে কতগুলো টাকা খরচ করেছি, তার কোনও হিসাব রেখেছিস? পরিবর্তে কী দিলি তুই আমায়? অপমান আর লাঞ্ছনার সুখ? এখন রাস্তায় বেরোলেই বিবাইয়ের বাবা আমায় টোন-টিটকিরি কাটবে। তোর ওপর এতটা আশা রেখে খুব ভুল করেছি আমরা। দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। তোর ওই হেরো মুখটা আমায় আর দেখাবি না।"

এইবার প্রকাশ্যেই সকলের সামনে কেঁদে ফেলল সংলাপ। কাঁদতে কাঁদতে সে ঘরে চলে গেল। সংলাপের দাদু তখন শরৎবাবুকে বললেন, "নিজের ছেলের ওপরে এতটা কঠোর হয়ো না শরৎ। ও কিন্তু খারাপ নম্বর পায়নি। যথেষ্ট সচ্ছল নম্বর পেয়েছে আমার দাদুভাই। আর যেটা নিয়ে ও পড়তে চেয়েছিল তুমি কিন্তু ওকে সেটা নিয়ে পড়তে দাওনি। মনে পড়ছে সেই কথা? তুমি জোর করে ওকে তোমার পছন্দের বিষয় নেওয়া করিয়েছিলে। তবুও যে ও..."

"আঃ বাবা, তুমি থামো তো! এখনকার দিনে সাইন্স ছাড়া কিছুরই কোনও ভ্যালু নেই। যুগটাই যে এরকম, কম্পিটিশনের যুগ। আর কম্পিটিশনের মূল্য তুমি কী বুঝবে, বলো? তুমি তো কোনওদিন লেখাপড়াই করোনি।"

এরপর আর কিছুই বললেন না দাদু। একটা বিষণ্ণ মুখ নিয়ে বসে রইলেন সোফার উপরে। ওইদিন রাত্রিবেলা যখন সবাই খাবার খাচ্ছিল, তখন সংলাপ গেল তার দাদুর ঘরে। অতি সন্তর্পণে ঘুমের ঔষধের শিশিটা প্যান্টের পকেটে ভরে সে নিজের ঘরে চলে গেল। সকালের পর থেকে কেউ তার সাথে কোনো কথা বলেনি, কেউ তাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে অবধি আসেনি। ঘরের ভেতর একা একা গুমরে কেঁদে চলেছিল সে। সেই পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত ঘুরতে থাকে তার মনে। সকলে যখন রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, সংলাপ তখন একা একা গেল ছাদে। চাঁদের জ্যোৎস্না গিয়ে পড়েছে অদূরের সেই মাঠটির উপরে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে রয়েছে সেইদিকে। আচমকাই একটা বেড়াল ছুটে চলে গেল রেলিঙের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। এমনিতে সংলাপ একটু ভীতু স্বভাবের। তবে যতটা ভয় পাওয়ার কথা ছিল, আজ সে ততটা ভয় পেল না। তার মাথায় ঘুরে চলেছে কিছু প্রশ্নচক্র... 'অনেকে এমনও আছে যারা পাশ না করে বেশ আনন্দের সুখ উপভোগ করছে। কিন্তু ভালো নাম্বার পেয়ে পাশ করা সত্ত্বেও চোখের জল ফেলতে হলো আজ আমাকে। কেন? কীসের জন্য? তবে কি প্রতিযোগিতা করাটাই জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল? সেই প্রতিযোগিতায় জিততে না পারাটাই কি ছিল আমার জীবনের ব্যর্থতা? আজ আমার নিজের লোকেরা যে আঘাত আমায় করেছে, তা আমি ভুলতে পারব না কখনও। পুনর্ঘাত চরিতার্থ করতে আমি হয়তো তাদের শত্রু হয়ে উঠতে পারি ভবিষ্যতে। তখন সমাজ আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে যে, ছেলেটি কেমন নির্দয় প্রকৃতির! তবে এর থেকে মুক্তি পাবার একটাই মাত্র উপায় রয়েছে। যখন প্রতিযোগিতাই এদের জীবনের মূলাধার, তখন সেই প্রতিযোগী থাকল কি না থাকল তাতে নিশ্চয়ই কারুর কিছু আসবে-যাবে না। শুধু একটাই আফসোস যে, দূরের ওই মাঠটিকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না।' ঘুমের ঔষধের শিশিটা খুলে একটা একটা করে মুখে ভরতে থাকল সেগুলোকে। দিশাহারা সংলাপের চোখ তখনও তাকিয়ে রয়েছে জ্যোৎস্নামাখা মাঠের দিকে। ক্রমশ টলতে শুরু করল তার দেহটা। একসময় দাঁড়ানোর শক্তিও হারিয়ে যায় তার। অবসন্ন দেহটা আচমকাই পড়ে গেল মেঝের ওপর। চাঁদের কিরণ এসে পড়েছে সংলাপের অমলিন হাসি মুখটিতে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এল তার চোখদুটো আর সময় হয়ে গেল অন্ধকারাচ্ছন্ন।

৩০ বছর পর...

আগামীকাল মগ্নজিতের রেজাল্ট বের হবে। এই বছর উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে সে। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে বাবা-মায়ের সাথে শুয়ে পড়েছে মগ্নজিৎ। অনবরত মাথায় ঘুরে চলেছে রেজাল্টের উদ্বেগ। পাশ থেকে বৈশাখী মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তাকে জিজ্ঞেস করেন, "হ্যাঁ রে বাবু, বিল্টু আর সুমিতের থেকে তোর বেশি নাম্বার আসবে তো?"

মগ্নজিৎ কিছু বলার আগেই অন্যপাশ থেকে তার বাবা বলে উঠলেন, "এসব কী বলছ তুমি? এমনিতেই ছেলেটার আজ টেনশনে ঘুম হবে না সারারাত আর তার মধ্যে তুমি... প্লিজ, এসব কথা বলে ওর চিন্তাকে বাড়িয়ে দিয়ো না।" তারপর শান্তস্বরে মগ্নজিৎকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা, তোকে আমি ছোটবেলায় একটা কথা বলেছিলাম। মনে আছে সেটা?"

"কোন কথাটা বলো তো?"

"একজন কৃষক কখনওই এটা ভাবে না যে, তাকে যেকোনও উপায়ে ফসল ফলাতেই হবে। বরং সে তার শ্রম আর চেষ্টাকে একত্রিত করে নিজের কাজের ওপর তা প্রয়োগ করে। সে অপেক্ষা করে, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা করে না। কেন বলত? কারণ আশাহত হলেও তার মনোবল স্থির থাকে। কিন্তু সে যদি অত্যাধিক আশা করে ফেলে, তবে পরাজয়ের ভয় তার ভবিষ্যৎকে অস্থির করে তোলে। তাই জীবনে আশা করা ভালো, কিন্তু অধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মোটেই শ্রেয় নয়।"

"হ্যাঁ বাবা, মনে পড়েছে। তোমার এই কথাটার মানে ছোটবেলায় আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে বারবার প্রমাণ পেয়েছি এটা।"

তাদের দু'জনের কথোপকথনের মাঝে বৈশাখী আর কিছু বলে না। পরদিন সকালে রেজাল্ট বের হলে বেশ ভালো নম্বর পেয়েই পাশ করে মগ্নজিৎ। তবে এক্ষেত্রে তার মায়ের আশাও পূর্ণ হয়। বিল্টু ও সুমিতের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে সে।

মগ্নজিৎ যখন রেজাল্ট আনতে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে গেল, তখন বৈশাখীকে আলাদা করে ডেকে বিবাই বললেন, "একটা লেবুকে হাতে নিয়ে তুমি যত বেশি কচলাবে, ততই তার স্বাদে তিক্ততা এসে যাবে। সন্তানদের মানুষ করার জন্য অবশ্যই শাসনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা যেন কখনওই মাত্রাতিরিক্ত না হয়ে যায়। তাদের ওপরে আমরা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি। কিন্তু এই শাসন, আশাকে সবসময় নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখাই যথাযথ।"

তারপর তিনি চলে যান নিজের ঘরে। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই তাঁর মনে পড়ে গেল বাল্যবন্ধু সংলাপের কথা। তিরিশ বছর আগে ঘটা এইদিনের বিষম পরিণাম আজও কম্পিত করে তোলে তাঁর হৃদয়কে। নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে আপনমনেই তিনি বলে চলেন, 'কী বিচিত্র এই সমাজ! কতই না নির্মমতা, নৃশংসতা, স্বার্থপরতা আর নিস্পৃহতা লুকিয়ে রয়েছে সমাজের আনাচেকানাচে। চারশো সাতাত্তর কিংবা চারশো ঊনআশি... আমার জীবনে এই দুটো সংখ্যা নিছকই কোনও নাম্বার নয়; একটা হৃদয়হীন সমাজের চক্রব্যূহও বটে। যে নির্বিবেক সমাজের ব্যূহ কেড়ে নিয়েছিল আমার প্রিয় বন্ধুটাকে, মিথ্যে করে দিয়েছিল আমাদের দীর্ঘ বছরের সম্পর্ককে, না জানি আরও কত কিছুকে! খাঁচায় বন্দী একটা পাখি যতদিন বাঁচে, তার চেয়ে অধিক দিন বেঁচে থাকে মুক্ত আকাশে বিচরণকারী পাখিরা। কারণ তারা স্বাধীনভাবে চলতে পারে। প্রত্যেকটা প্রাণীরই বেঁচে থাকার জন্য নিজস্ব স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক, নয়তো সে একদিন চলার ভাষাই হারিয়ে ফেলতে পারে। কে জানে? হয়তো আজও কোথাও সমাজরূপী সোনার খাঁচা আবদ্ধ করে রেখেছে অন্য কোনও সংলাপের জীবনকে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু